লেবেল

শনিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

রবিবাসরীয় বিভাগ।। আজকের গল্প ।। গল্প হলেও সত্যি (চার) ।। মায়া দে।।Ankurisha।। E.Magazine।। Bengali poem in literature।।

 



রবিবাসরীয় বিভাগ


আজকের গল্প 

গল্প হলেও সত্যি (চার)

     মায়া দে


ঢং ঢং করে টিফিনের ঘন্টা পড়ল । গার্লস স্কুল । ক্লাস টিচার বেরিয়ে যেতেই হো হো করে মেয়েরা বেরিয়ে এলো -- চাক ভাঙ্গা মৌমাছির মতো । বারান্দায় মাঠে রুমে যে যেদিকে খুশি । তখন টিফিন আওয়ারে টিফিন খাওয়া সেভাবে ছিল না।   ছিল আচার , টোপাকুল  , কঁতবেল , আমচুর , কাঁচা -তেঁতুল ,কাঁচা আম এইসব খাওয়া। উঃ ! মনে হলেই জিভে জল যেন এখনও চলকে ওঠে ।  বন্ধুদের কাঁধে হাত দিয়ে সুখ-দুঃখের কথা চালাচালি চলছে  । হঠাৎ  মনে হল রানুদির ক্লাসের কথা । টিফিন শেষ হলেই তো । ছ্যাঁত করে উঠলো বুকটা ।  দুম দুম করে যেন বোম  ফাটছে বুকে । বুক থেকে শব্দ  পৌঁছে কানে ধাক্কা দিচ্ছে । ভয়ঙ্কর কিছু  ঘটতে চলছে , এই আগাম আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়ল ওরা।

 

থমথমে ক্লাসরুম। রানুদি ক্লাসে এলেন। গল্প বলার ক্লাস। একেক জন ডায়াসে গিয়ে গল্প বলবে , বাকিরা বসে শুনবে । মজার ক্লাস নিশ্চয়ই ! না। ব্যাপারটা ছিল পুরো উল্টো। গল্প যেমন তেমন বললে চলবে না। গল্প  বলে জমিয়ে দেওয়া চাই । আমতা আমতা করে -- ইনিয়ে বিনিয়ে --- তেমনটা হলেই বেত্রাঘাত। অবশ্য দু-তিনজন খুব দক্ষ ছিল ।  তার মধ্যে  সেরা ওই স্কুলের দিদিমণির মেয়ে। বেশ ভালো বলতো ।  গল্প শুনতে বেশ  লাগতো । আর বাকিরা ? বাকিদের মধ্যে ছিল নন্দিনী । রানুদির চোখ মুখ দেখলেই তার গলা শুকোয়,  পা কাঁপে ,  মাথা ঘোরে । কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলে  --"বলতে পারবি তো ? সাহস আছে? "  অসম্ভব । চার - পাঁচ মিনিট ধরে রসিয়ে বসিয়ে  গল্প বলা? তাও  আবার রানুদির সামনে? নার্ভ ফেল হলো বলে --।

 

পরপর তিনটি গল্প তিনজন শোনালো ।  এবার বাকিদের  পালা । দাঁড়াতে বললেন তিনি । হাতে  বেত নিয়ে এগিয়ে এলেন ।  শুরু প্রহার‌ । পাশের বন্ধুদের ওপর বেতের তাণ্ডব চলছে ।সব বুঝছে নন্দিনী। পাশের বন্ধুর  পর  বেত তার দিকে এগিয়ে এলো । মাথা ঘুরছে, পা টলছে । তবু  স্থির।  মুখ নীচু।  রানুদি বিদ্যুতের মতো সপাত্ সপাত্ করে  কয়েক ঘা বসিয়ে দিলেন। একেকটা বিদ্যুতের শক্ যেন । ঝড়ে ঝাপটা খাওয়া ছেঁড়া নেতানো ফুলের মত নন্দিনী স্থির। মাথা নত।

ক্লাস শেষ হয়ে আরও এক খানা ক্লাস। থমথমে ক্লাস তখনও ।  ছুটি হল শরীরে মনে দাহ ,প্রদাহ ।  বাড়ি ফিরল নন্দিনী । সামান্য কিছু খেলো। তারপর বিছানায়।  মা দেখলেন নন্দিনীর গায়ে জ্বর । জ্বর ক্রমশ বেড়েই চলছে। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ । অস্ফুট স্বরে রানুদির নাম। মা সবটা  না বুঝলেও কিছুটা আঁচ করলেন। অজানা আশঙ্কায় মেয়েকে সারারাত বুকে আঁকড়ে রাখলেন।

পরের দিন জ্বর অনেক কম। প্রায় নেই বললেই চলে।  কিন্তু স্কুল যাওয়া  আর হলো না।  পাড়ার বন্ধুরা স্কুলে গেলো । প্রথম ক্লাস আজ আবার রানুদির । বাংলা ব্যাকরন । তিনি এলেন সেই রনংদেহী মূর্তি  নিয়ে। হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন --"আজ নন্দিনী কোথায়?" বন্ধুরা জানায় ওর  গতকাল স্কুল ফেরা থেকেই প্রবল জ্বর । শুনে  রানুদি যেন কিছুটা থমকে গেলেন । গতদিন একটু বেশিই শাস্তি দিয়ে ফেলেছেন। ঠিক কাজ  হয়নি। তারপর রানুদি কেমন শান্ত স্বাভাবিকভাবে ক্লাস শেষ করলেন। বকা ঝকা না।

পরেরদিন প্রেয়ার লাইনের সামনে রানুদি দাঁড়িয়ে।  প্রেয়ার শেষ হতেই নন্দিনীকে ডাকলেন। নন্দিনী একটু সুস্থ হয়ে স্কুলে এসেছিলো ফের যেন অসুস্থ বোধ করলো। ডেকেছেন। যেতে তো হবেই। কাছে গেল। শান্ত দুরু দুরু বুক। মাথা নীচু। রানুদির  সামনে দাঁড়িয়ে সে। হঠাৎ রানুদি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন  ---"কিরে? শরীর কেমন আছে? সেদিন খুব লেগেছিল? নে ধর এই  বইটা । এতে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প আছে। পড়িস। "  নন্দিনী কচি কলা পাতার মতো আনন্দে লজ্জায় বইটাকে হাতে  নিয়ে  ঝপ করে রানুদিকে প্রণাম করে নিল। রানুদির সেই রনংদেহী মূর্তি ও যে মায়ের মতো পরম স্নেহে বুকে টেনে নিতে পারে - !

 

শ্রদ্ধার ভারে নন্দিনীর মনের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভগুলো ভেঙে  খানখান। নন্দিনী যেন এক বিন্দু শিশির পরম আহ্লাদে মহাসাগরের অগাধ জলে মিলেমিশে বিলীন।  তাতে নেই ক্ষোভ, নেই দুঃখ ।  আছে শ্রদ্ধা। আছে  প্রশান্তি।

 

সেই থেকেই নন্দিনী  রানুদি অন্তঃপ্রাণা ।

                 

 

 

২টি মন্তব্য: