লেবেল

শনিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

রবিবাসরীয় বিভাগ।। আজকের শ্রদ্ধাঞ্জলি।। শ্রদ্ধেয় কিংবদন্তি গায়িকা লতা মঙ্গেশকরের শ্রদ্ধা ও স্মরণে— আমার জীবনে লতাজীর গানসুবীর ঘোষ।।Ankurisha।। E.Magazine।। Bengali poem in literature।।




শ্রদ্ধেয় কিংবদন্তি গায়িকা লতা মঙ্গেশকরের শ্রদ্ধা ও স্মরণে— 

আমার জীবনে লতাজীর গান

সুবীর ঘোষ

 

   আধুনিক বাংলা গানের সঙ্গে আমার পরিচয় আকাশবাণী কলকাতা বেতারকেন্দ্রের অনুরোধের আসর থেকে। আমার যখন ৬-৭ বছর বয়স তখন দেখতাম আমার বাবা দাদারা মন দিয়ে অনুরোধের আসর শুনতেন ।  আমার বড়দা যিনি আমার থেকে ১২ বছরের বড়ো তিনি গানের কথাগুলো শুনে শুনে খাতায় লিখে রাখতেন । এই অবস্থায় আমারও রেডিওতে গান শোনার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেল। লতা মঙ্গেশকর নামটি আমি প্রথম ঐ  অনুরোধের আসর থেকেই জানতে পারি। যতদূর মনে পড়ে লতাজীর প্রথম যে গানটা আমি শুনি সেটি ছিল ---‘সাত ভাই চম্পা’। সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুর করা এই অসাধারণ জনপ্রিয় গানটির অন্তর্নিহিত রূপকথার গল্পের জন্য আমরা শিশু কিশোররা একে ছোটদের গান হিসেবেই ভেবে আনন্দ পেতাম । এই গানটি তখনকার দিনে খুব ঘন ঘন রেডিওতে শুনতে পাওয়া যেত।

    একবার দাদুর ( মাতামহ ) বাড়ি গেছি। সেখানে একটি গান বাজানোর যন্ত্র ছিল যাকে ‘কলের গান’ বলত। মাঝে মাঝে হ্যান্ডেল  ঘুরিয়ে দম দিতে হত। সেখানেই আমি প্রথম একটি গান শুনি –‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’। আমি যদিও তখন কিশোরবয়স পেরোইনি কিন্তু ‘প্রেম’ শব্দটি যে প্রকাশ্যে বলার মতো শব্দ নয় সেটা বুঝতাম। কিন্তু গানটির কথা সুর এবং লতাজীর পরিবেশনা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। তারপর বহু বহু দশক পেরিয়ে গেছে। এই গানটি থেকে আমার বিস্ময়ের ঘোর এখনো সরে যায়নি। এই দুর্দান্ত গানটি লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে

আমারই এ দুয়ার- প্রান্তে

সে তো হায়মৃদু পায়

এসেছিল পারিনি তো জানতে

 

সে যে এসেছি বাতাস তো বলেনি

হায় সেই রাতে দীপ মোর জ্বলেনি

তারে সে আঁধারে চিনিতে যে পারিনি

আমি পারিনি ফিরায়ে তারে আনতে

 

যে আলো হয়ে এসেছিল কাছে মোর

তারে আজ আলেয়া যে মনে হয়

 আঁধারে একাকী  মন আজ

আঁধারেরই সাথে শুধু কথা কয়

 

আজ কাছে তারে এত আমি ডাকি গো

সে যে রীচিকা হয়ে দেয় ফাঁকি গো

ভাগ্যে যে আছে লেখা হায় রে

তারে চিরদিনই হবে জানি মানতে

 

 যতদূর জানি লতাজী প্রথম বাংলা বেসিক গানের রেকর্ড করেছিলেন ১৯৫৩ সালে। গানটি হল ---‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’ । তখনকার দিনের গানের বাণীর মধ্যে এক অনুপম কাব্যসুষমা নিহিত থাকত । ফলে মেলোডিয়াস গানটি শুনতে যত ভালো লাগত ততটাই গানের বাণীকে কবিতার মতো পড়তেও ভালো লাগত। সুদক্ষ গীতিকার-সুরকার-শিল্পী এই ত্রিবেণী সঙ্গমে পড়ে সেসব গানগুলিও কালজয়ী গানে পরিণত হতে পেরেছিল। আকাশপ্রদীপ গানটির গীতিকার ছিলেন পবিত্র মিত্র এবং  সুরকার ছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।

  লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া আরো অজস্র বাংলা হিন্দী বা অন্যান্য ভাষার গান আছে যা যুগ যুগ ধরে শ্রোতাদের আনন্দ দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। লতাজীর একটি বাংলা গান আছে—‘আমার গোপন ব্যথার মাঝে’ । খুব বেশি শোনা যায় না । কিন্তু গানের অন্তর্লীন বিষাদটুকু শিল্পী এত চমৎকার ফুটিয়েছেন যে গানটি যে একবার শুনেছে সে ভুলতে পারবে না।

  কোনো এক বছর স্বাধীনতা দিবসের সময় শুনতে পাই লতাজীর গাওয়া  ‘আই মেরে ওয়তন কে লোগো’। গানের মধ্যেকার বিষাদ মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। পরে জানতে পারি এই গানটি প্রথম রেকর্ড হয়েছিল ১৯৬২-র চিন ভারত যুদ্ধে নিহত বীর ভারতীয় শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে। গানটি লিখেছিলেন কবি প্রদীপ এবং সুর দিয়েছিলেন সি রামচন্দ্র।

  লতাজীর গাওয়া অসংখ্য হিন্দী গান আছে যার কোথাও কোনো তুলনা নেই । তাঁর নিজের কথাই যেন বলা হয়েছে – মেরি আওয়াজ হি পহেচান হ্যাঁয়।  ‘কিনারা’ ছায়াছবির সেই গানে বলা হচ্ছে নাম হারিয়ে যাবে, এই চেহারাও পালটে যাবে কিন্তু আমার আওয়াজই আমার পরিচয় হিসেবে থেকে যাবে। গানটি লিখেছিলেন গুলজার এবং সুরসৃষ্টি করেছিলেন রাহুলদেব বর্মণ। লতাজী সম্বন্ধে এই গানটি বাস্তবিকভাবে প্রযোজ্য।

  সুদীর্ঘ সাতটি দশক ধরে লতাজী বহু সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই মদনমোহন থেকে শুরু করে এ আর রহমান পর্যন্ত অজস্র নাম। স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো সে সব গীতসৃজনের ইতিহাস । লতাজী জড়িয়ে রইলেন ভারতীয় সংগীত সংস্কৃতির সোনা ফলানোর বছরগুলোর সঙ্গে। বাঙালি সংগীতশিল্পী ও পরিচালকদের সঙ্গে লতাজীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কয়েকজনের কথা সকলেই জানেন --- শচীনদেব বর্মণ , হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোরকুমার, রাহুলদেব বর্মণ প্রমুখ।

  আমি তখন কলেজের ছাত্র । বিকেলবেলা কখনও কখনও রেললাইনের দিকে বেড়াতে যাই। শান্ত নীরব নির্জন স্টেশনটির নাম—প্রান্তিক। জেলা... বীরভূম। তখনও ওদিকটায় অত ঘন বসতি গড়ে ওঠেনি। খুব বেশি দ্রুতগামী ট্রেনও ছিল না। দানাপুর এক্সপ্রেস বা আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস। এসব ট্রেনের নামও বোধহয় এখন বদলে গেছে। উত্তরবঙ্গ যাবার একটাই ট্রেন ছিল—দার্জিলিং মেল। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস তখনও খোলেনি।  প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে নানা কথা হচ্ছে। এমন সময় সে বলে উঠল --- পাকীজা দেখতে যাবে ? চিত্রা সিনেমাহলে এসেছে। পাকীজা নিয়ে তখন আমাদের বিশাল কৌতূহল । বিষাদরানি মীনাকুমারীর ছবি। প্রেম ও বিষাদ একসঙ্গে অনুভব করা যাবে জেনেই হয়তো ছবিটি দেখার জন্য এত আগ্রহ । কথাবার্তা হচ্ছে এমন সময় একটি ট্রেন পেরিয়ে গেল । হুইশেলের শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল বাতাসে । বান্ধবীটি গেয়ে উঠল একটি গান । লতাজীর গাওয়া। পাকীজা ছবির। যা সে আগেই রেকর্ডে শুনেছে। ‘চলতে চলতে’।

চলতে চলতে চলতে চলতে

ইয়ুঁহি কোঈ মিল গয়া থা

সারে রাহা চলতে চলতে

ওঁহি থমক রহ্ গয়ী হ্যায়

মেরি রাত ঢলতে ঢলতে

যো কহি গয়ী না মুঝসে

ও জমানা কহ্ রহা হ্যায়

কে ফাসানা

কে ফাসানা বন গয়ী হ্যায়

মেরি বাত চলতে চলতে

ইয়ুঁহি কোঈ মিল গয়া থা

সারে রাহা চলতে চলতে

  আমরাও জীবনের সারা পথ চলতে চলতে লতা মঙ্গেশকরের গান শুনতেই থাকব। আমাদের শুনতেই হবে । এত বিচিত্র গানের সম্ভার তিনি ছাড়া তো আর কারোর কাছে নেই।




1 টি মন্তব্য: