লেবেল

বুধবার, ১৬ জুন, ২০২১

ধারাবাহিক ভ্রমণকথা-(পর্ব-১৪) ।। পৃথিবীর উল্টো পিঠ— বিশ্বেশ্বর রায়।।Ankurisha ।। E.Magazine ।।Bengali poem in literature ।।

 



ধারাবাহিক ভ্রমণকথা-(পর্ব-১৪)


পৃথিবীর উল্টো পিঠ
বিশ্বেশ্বর রায়


পরদিন ভোর সাড়ে ছটায় আমাদের ভ্রমণসূচী অনুযায়ী যাত্রা শুরু হল৷ আধঘন্টার মধ্যে একটা Macdonald's- এর সামনে আমাদের বাস দাঁড়ালো প্রাতরাশের জন্য৷ কারণ, এরপর আমাদের একটানা অনেকটা পথ ছুটতে হবে৷ এদেশে Mac.-এর ছড়াছড়ি৷ ছোট, বড় এমন একটিও জনপদ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে Mac. নেই৷ Mac. ছাড়াও সেসব জায়গায় দেখা যায় K F C, Subway, Taco Bell ইত্যাদি Fast Food-এর রেস্টোরেন্ট৷ এসব রেস্টোরেন্টে চটজলদি পাওয়া যায় বার্গার, পিজ্জা, বুরিতো, সফ্ট ট্যাকো, লবস্টার রোল, বিভিন্ন রকমের স্যাণ্ডউইচ, ফুট লং ইত্যাদি খাদ্য৷ এবং সঙ্গে অবশ্যই কোল্ড ড্রিংকস্৷ অ্যামেরিকানরা কোল্ড ড্রিংকস্ ছাড়া খাবার খেতে পারে না৷ তার কারণ মনে হয় লুকিয়ে আছে ওইসব খাদ্যের মধ্যে৷ এখানকার সব খাদ্যই শুকনো৷ আমাদের দেশের মতো ডাল, ঝোল ইত্যাদি রকমের কোনো খাদ্যই সচরাচর পাওয়া যায় না৷ ফলে ওইসব খাদ্য গলাধঃকরণ করতে কোল্ড ড্রিংকস্ আবশ্যক৷ এখানে অনেক রেস্টোরেন্টেই দেখেছি একবার এক গ্লাস(কাগজের) কোল্ড ড্রিংকস্ কিনে পরে একাধিক বার অনেককে গ্লাস ভরে নিতে৷ প্রথম প্রথম লজ্জা পেলেও আমরাও ওই পদ্ধতিতে অচিরেই রপ্ত হয়ে গেলাম৷
      এদিন আমাদের প্রথম গন্তব্য অ্যাকাডিয়া ন্যাশনাল পার্ক৷ দু'ঘন্টা একটানা চলার পর আমরা পৌঁছালাম Bar Harbour-এ৷ অপূর্ব সৌন্দর্যে ভরা ছোট্ট শহর৷ লবস্টারের জন্য বিশেষ খ্যাতি আছে৷ গত কালের মত আজও বৃষ্টি আর কুয়াশার জন্য জাহাজে সমুদ্র-ভ্রমণ(Cruise) করা গেল না৷ কিছু ডলার বাঁচলো বটে তবে আক্ষেপ থেকে গেল জনমভরের৷ সমুদ্রতীর থেকে দেখলাম সমুদ্রের অনেকটা দূরে সবুজে মোড়া অনেকগুলো দ্বীপ৷ মাঝে মাঝে কুয়াশা ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে৷ জীবনানন্দের 'বনলতা সেন' কবিতার সেই আশ্চর্য পংক্তি ক'টি মনে পড়ে গেল—"অতি দূর সমুদ্রের 'পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর-------
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে৷"
এখানে অবশ্য অন্ধকার নয়, প্রায় দ্বিপ্রহরে মেঘ আর কুয়াশার কুহেলিকায় দ্বীপপুঞ্জ দেখা হল দূরে তীরে দাঁড়িয়ে৷ এখানে পাহাড় আর সমুদ্রের মেলবন্ধন ঘটেছে৷ ওরকম একটি অনুচ্চ পাহাড়ে বসে সমুদ্র-দর্শনের সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল  একটি ছেলে ও তার বোনের সঙ্গে৷ তারা আমাদের সহযাত্রী নয়৷ প্রথম দর্শনে বুঝতে পারি নি তারা বাঙালি বা ভারতীয়৷ চেহারা একেবারে সাহেবদের মতো৷ তারা সমুদ্রের দিকে ঝুঁকে পড়া একটা চওড়া পাথরের উপর বসে ছিল৷ সেই জায়গাটা থেকে সমুদ্রকে সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায়৷ আমরা বলাবলি করছি যে, ইস ওই জায়গাটা দখল করে ওরা বসে আছে, আমরা আর বসতে পারবো না৷ হঠাৎ ওরা এগিয়ে এসে বললো—"আমরা অনেকক্ষণ এসেছি, এবার চলে যাবো৷ আপনারা বসুন৷" বাঙালি জেনে কথা শুরু করা গেল৷ ছেলেটির নাম অতীশ, অতীশ চক্রবর্তী৷ সঙ্গে ওর বোন৷ ওদের বাবা বাঙালি, কলকাতার মানুষ৷ এদেশে চাকরি সূত্রে এসে মেমসাহেব বিয়ে করেছেন৷ ওর বাবাকে কলকাতায় ফিরে  যেতে হয়েছে চাকরির তাগিদে কয়েক বছর পরে৷ অতীশ আর ওর বোনের পড়াশুনো এদেশেই৷ অতীশ পড়াশুনো শেষ করে চাকরি নিয়ে কলকাতায় বাবার কাছে থাকে৷ আর ওর বোন নিউইয়র্কে ওর মায়ের কাছে থেকে এখনও পড়াশুনো করছে৷ অতীশ কিছু দিনের ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে এসেছে৷ দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে ছোট্ট শহরটার এ দোকান ও দোকান ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সস্তায় কিছু স্মারক কেনা যায় কি না৷ হঠাৎ একটা দোকানে ঢুকে দেখতে পেলাম শোয়ানো কাচের শিশির মধ্যে অপূর্ব সুন্দর কলম্বাসের জাহাজের মিনিয়েচার৷ পছন্দ হয়ে গেল৷ $25.20 দিয়ে সেটা কিনে ফেললাম৷ আমাদের পরবর্তী গন্তব্য এবং দ্রষ্টব্য ক্যাডিলাক পিক৷ আবার বাসে চড়ে অনতিদূরে গন্তব্যে পৌঁছানো গেল৷ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সমুদ্র-দর্শন৷ বার হারবারের চেয়ে এই পাহাড়টি অনেক বেশি উঁচু৷ সেখান থেকে সমুদ্র-দর্শন এক অনন্য সাধারণ অনুভূতি৷ বিকেল গড়িয়ে চলেছে৷ আরও দু'টি দ্রষ্টব্য দেখা তখনও বাকী৷ ফলে ক্যাডিলাক পিকে বেশিক্ষণ বসা হল না৷ পরের দ্রষ্টব্য Sand Beach. এখানেও পাহাড় ও সমুদ্রের সহাবস্থান৷ পরের দ্রষ্টব্য Thunder Hole. এখানেও পাহাড়ের গায়ে এসে সমুদ্রের ঢেউ প্রবল আক্রোশে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে পড়ছে সাদা ফেনায়৷ প্রকৃতপক্ষে  এই তিনটি দ্রষ্টব্যই একই পাহাড় ও সমুদ্রকে বিভিন্ন কোণ থেকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে দেখা৷ এদিনের ভ্রমণ শেষ করে আবার হোটেলে ফিরে রাত্রি যাপন এবং পরের দিন অর্থাৎ অন্তিম দিনের ভ্রমণের প্রতীক্ষা৷ শেষ দিনের শুরুও সেই ভোর সাড়ে ছটায়৷ যদিও আজ বিশেষ কিছু দেখার নেই৷ মাত্র দু'টি দ্রষ্টব্য৷ তবু অত ভোরে রওনা দেবার প্রধান কারণ দীর্ঘ যাত্রাপথ৷ একটি দ্রষ্টব্য থেকে অন্য দ্রষ্টব্যে পৌঁছাতে দেড় দু'ঘন্টা লাগে৷ কখনও বা তার চেয়েও বেশি বাস জার্নি করতে হয়৷ যাইহোক, প্রায় আটটার দিকে আমরা প্রথম দ্রষ্টব্যস্থানে পৌঁছালাম৷ নাম Portland. সেখানকার Light House বিখ্যাত৷ এই ভ্রমণসূচীতে রোজই বিঘ্ন ঘটাচ্ছে বৃষ্টি৷ আজও তার ব্যতিক্রম হল না৷ সঙ্গে নিত্য সঙ্গী কুয়াশা৷ যা বাধ সেধে চলেছে মনমতো ফটো তোলায়৷ কখনও সমুদ্রের দিকে, কখনও বিপরীত দিকে বিস্তর ছোটাছুটি করে একটু আলোর আভাস পাওয়া মাত্রই কয়েকটি ছবি তোলা সম্ভব হল৷ লাইটহাউসটি ঘিরে অনেকগুলি জায়গা খোপ খোপ করে ঘন সবুজ ঘাসে সাজানো৷ মখমলের মতো নরম মসৃণ সেই ঘাসের বিছানায় শোয়া-বসা তো দূর অস্ত, পা ফেলাও নিষিদ্ধ৷ পরে অবশ্য দেখেছি এখানকার প্রায় প্রত্যেকটি দ্রষ্টব্যস্থানে এমন সাজানো তৃণশয্যা আছে যা শুধু নয়নাভিরাম, বসে বিশ্রাম বা আরাম করা নিষিদ্ধ৷ আর এই নিষেধাজ্ঞা এখানকার মানুষ সহজ ভাবেই মেনে চলে৷ ভুলেও কেউ তার উপর বসে না বা পা ফেলে না৷
শেষ দিনে দ্রষ্টব্য কম, ছোটা বা জার্নি বেশি৷ তাই আজ আর একটি মাত্র দ্রষ্টব্যস্থানে গিয়েই এই Tour Programme শেষ হবে৷ অবশ্য সেখানেই শেষ হবে না৷ তারপর দীর্ঘ যাত্রাপথ পেরিয়ে শুরুর স্থান, অর্থাৎ নিউইয়র্কের সেই চায়না টাউনে পৌঁছে শেষ হবে এই ভ্রমণসূচী৷

Portland ছেড়ে শুরু হল আবার যাত্রা৷ এবারের গন্তব্য তথা শেষ গন্তব্য York Wild Kingdom. প্রকৃতপক্ষে এটি একটি Zoo বা চিড়িয়াখানা৷ খুবই ছোট৷ আমাদের আলিপুর চিড়িয়াখানার এক চতুর্থাংশও হবে না৷ চিড়িয়াখানা দর্শন এবং দুপুরের খাওয়ার জন্য ট্যুর কর্তৃপক্ষ ঘন্টা তিনেক সময় বরাদ্দ করে দিয়েছিল৷ ঘন্টা দেড়েকও লাগল না ওই ছোট্ট চিড়িয়াখানাটি দেখতে৷ কয়েকটা হরিণ, ঘোড়া, জেব্রা, ম্যাকাও এবং অন্য কয়েক ধরণের পাখি এবং পুকুরের মধ্যে নানা বর্ণের মাছ—এগুলি দেখা হল৷ কয়েকটি ফটো তোলা হল স্মারক হিসেবে৷ এরপর দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে বাসে উঠে বসা গেল৷ এখান থেকে নিউইয়র্ক প্রায় চার ঘন্টার জার্নি৷ সন্ধে সাতটায় নিউইয়র্কের চায়না টাউনে পৌঁছানো গেল৷ আমাদের তাড়াহুড়োর কিছু নেই৷ কারণ, রাত্রি সাড়ে দশটার গ্রে হাউন্ড বাসে আমাদের অগ্রিম টিকিট কাটা আছে৷ ধীরেসুস্থে ট্যাক্সি ধরে সেই টাইমস্ স্কোয়ার৷ রাতের খাওয়া সেরে গুটি গুটি পায়ে রাত্রি দশটার দিকে গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশনে পৌঁছে অপেক্ষা৷ হার্টফোর্ড যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত্রি একটা৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন