ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস /পর্ব—১
অষ্টভুজ রহস্য
অলোক চট্টোপাধ্যায়
উঃ! কি ভয়ানক অন্ধকার। যেন নিকষ কালো একটা পাথরের মত তার বুকের ওপর চেপে বসেছে। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সারা শরীর কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। তিনি কে, কোথায় এসেছেন। কি করে তার এইরকম অবস্থা হল কিছুই মনে পড়ছেনা। ভাবার চেষ্টা করতে গিয়ে তার মনটাও কেমন যেন অবশ হয়ে এল। আবার সেই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে গেলেন তিনি।
ঝোঁকের মাথায় বাসে উঠে পড়ার পরেই প্রফেসার বিজয় দত্তর একবার মনে হয়েছিল কাজটা বোধহয় ঠিক করলেন না। বিকেল চারটে বাজে প্রায়। ড্রাইভার নীলমনির হিসেব মত কদমফুলি আরও ঘন্টাখানেকের রাস্তা। বাসে হয়তো আর একটু বেশিই লাগবে। মানে পোঁছোতে পৌঁছোতে সোওয়া পাঁচটা বেজে যাবে। নভেম্বরের শেষদিকে দিন অনেক ছোটো হয়ে এসেছে। সন্ধ্যে নামবে তাড়াতাড়ি। রাস্তাঘাটও নিশ্চই এই কুড়ি বাইশ বছরে অনেক বদলে গেছে। খুঁজে পাবেন তো বাড়িটা? আর পেলেই বা কি দেখবেন সেখানে? একটা ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত, মেজভাই সুজয়ের কথা অনুযায়ী ভুতুড়ে বাড়ি। অন্ধকার হয়ে গেলে সেই ধ্বংসস্তুপের ভেতর ঢুকতেই পারবেন না হয়তো।
তবু একটা অদম্য আকর্ষণ বিজয়বাবুকে টেনে নিয়ে চলেছে সেই বাড়িটার দিকে। যে বাড়িটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার প্রায় গোটা কৈশোর জীবনের স্মৃতি। দাদু, দিদিমা, সুবল দা, জীবন দাদু, ফুলবেড়িয়া মাধ্যমিক স্কুলের বন্ধুদের স্মৃতি। বাড়ির সামনেই সেই মস্ত আটটা কোনওয়ালা বৈঠকখানা, দাদু মজা করে যার নাম রেখেছিলেন অষ্টভুজ। সামনের ফুলবাগান, পেছনের ঝোপঝাড় আর তার পেছনে বয়ে যাওয়া প্রায় নদীর মতই চওড়া খাল সব মিলিয়ে স্মৃতির অফুরান ভান্ডার । এখনো চোখ বন্ধ করলেও যেন পরিষ্কার দেখতে পান একপাশে সেকেলে ফার্ণিচার দিয়ে সাজানো বসবার ঘর। অন্যদিকটায় সাদা চাদর পাতা তক্তপোষে দাদুর ব্যবসার ম্যানেজার জীবনদাদুর অফিস। দাদু বলত – সেরেস্তা। সেই অনেক ভালোলাগার স্মৃতি জড়ানো ঘরটাতে অন্তত একবার ঢুকে দেখতে পারলেও এতদুর যাবার একটা অর্থ হয়। কিন্তু বাসটা যে গতিতে চলছে তাতে সে সম্ভাবনা ক্রমশই ক্ষীন হয়ে আসছে।
কিন্তু এরকমটা হবার কথা ছিলনা। প্ল্যান ছিল সুজয়কে অফিসে নামিয়ে ড্রাইভার নীলমনি ঠিক দশটার মধ্যে ফিরে এসে বিজয়বাবুকে নিয়ে রওনা হবে। এখন বাসন্তী হাইওয়ে দিয়ে নতুন রাস্তা হয়েছে। কদমফুলি বড়জোর চারঘন্টার পথ। ভাঙা বাড়িটাই একটু দেখবেন, বাগানে একটু ঘুরবেন। সময় থাকলে ফলবাগানের দিকটাতেও একবার যাবেন। ছবি তুলবেন। খুব বেশি হলে ঘন্টাখনেক। তিনটে সাড়ে তিনটের নাগাদ রওনা হয়ে সাড়ে সাতটার ভেতর ফিরে আসবেন বাড়িতে। কিন্তু কোনোকিছুই হিসেব মত হলনা। প্রথমত জ্যামে আটকে পড়ে নীলমনি গাড়ি নিয়ে এল বারোটা নাগাদ। আর তারপর ঘন্টা তিনেক চলার পর বড়গাছা নামের একটা জায়গায় এসে হঠাৎই খারাপ হয়ে গেল গাড়িটা। কপাল ভাল, সামনেই একটা মেকানিকের দোকান ছিল। প্রথমে দেখে বলল আধঘন্টা লাগবে। সে অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু আধঘন্টার মাথায় আবার খোঁজ নিতে মেকানিক জানাল আরও ঘন্টার মত লাগবে। বিজয়বাবু বুঝতে পারলেন এবারেও তার কদমফুলি যাওয়া হলনা।
প্রতিবারই আমেরিকার থেকে এদেশে আসার পর ঠিক এভাবেই কোনো না কোনো কারনে তার আর দাদুর গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয়নি। শেষবার গেছেন সেই দাদু মারা যাবার পর যখন এসেছিলেন সেইবার। বাবা মারা গেছেন তারও এক বছর আগে। সেও হয়ে গেল বাইশ বছর। ইতিমধ্যে তিনি পাকাপাকিভাবে আমেরিকাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেশে আসাও কমে গেছে অনেক। বাবা আর দাদু বেঁচে থাকতে দুবছর অন্তর একবার করে আসতেন।তারপর গত বাইশ বছরে এসেছেন মোট চারবার। তাও কোনো না কোনো সেমিনার বা কনফারেন্সের কাজ নিয়ে। ভাইরা অবশ্য মাঝেমাঝেই অনুযোগ করেছে। এখন তারাও বুঝে গেছে তিনি আর ফিরবেন না। এখন তারাও আর জোরাজূরি করে না।
তবে যতবারই এসেছেন প্রতিবারই ভেবেছেন একটিবার কদমফুলি যাবেন। তার ছোটোবেলার স্মৃতির সবটাই তো ওখানে। ছোটোভাই অজয় শিলিগুড়িতে থাকে, নর্থবেঙ্গলের ব্যবসার দেখাশুনো করে । কিন্তু মেজভাই সুজয়ের খুব উৎসাহ। এমনিতেই তাকে মাঝেমধ্যে যেতে হয় সেখানে। বিশাল ফলের বাগানটা লীজে দেওয়া আছে। তার কাজকর্ম থাকে। তাছাড়া তারও গোটা ছেলেবেলা কেটেছে ওখানেই। সেই টানটাও পুরোদস্তুর আছে। অবশ্য বাড়িটা ভেঙে পড়ার পর থেকে রাতে আর থাকেনা, সন্ধ্যের মধ্যেই ফিরে আসে। তবে তার নাকি অন্য কারনও আছে। সেকথা ভাবতেই বিজয়বাবুর ভুরু একটু কুঁচকে গেল। সুজয় বলে সেখানে নাকি ভুতের উপদ্রব শুরু হয়েছে।
সে যাই হোক, বিজয়বাবু যতবার সেখানে যাবার প্ল্যান করেছেন ততবারই কিছু না কিছু অঘটন হয়ে তার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। গতবার যেমন। সব ঠিকঠাক, কিন্তু যেদিন যাওয়া তার আগের রাত থেকে তার সাংঘাতিক পেটের গোলমাল। দুদিন বিছানাতেই কাটল ডাক্তারের নির্দেশে। তারপরেই ফেরার টিকেট কাটা ছিল। কাজেই আর সুযোগ হলনা যাবার। তার আগের বার, সেও প্রায় বারো বছর আগে, ছোটোভাই অজয় এসেছে, তিনভাই মিলে যাবার প্ল্যান হল। সবকিছু ঠিকঠাক, যাবার দিন সকালে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে অ্যাকসিডেন্টে জখম হল সুজয়। ডাক্তার হাসপাতাল সেরে যখন মাথায় আর পায়ে ভারি ব্যান্ডেজ বেঁধে ফিরল তখন বিজয়বাবুর মাথা থেকে কদমফুলি যাবার প্ল্যান উড়ে গেছে। সুজয় অবশ্য বারবার বলেছিল অজয়ের সঙ্গে চলে যেতে, কিন্তু তখন ঐ অবস্থায় ভাইকে রেখে বেড়াতে যেতে বিজয়বাবুর মন সায় দেয়নি।
এবারেও সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। যদিও হাতে দু হপ্তা সময় ছিল, তবে কাজও ছিল অনেক। কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেমিনার ছিল। পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করার ছিল। তারই ফাঁকে যখন তার সময় হয় তখন সুজয়ের হয়না। শেষকালে সুজয়ই বলল - দাদা, একসঙ্গে হবেনা। তুমি বরং একলাই চলে যাও। নীলমনী আমাকে অফিসে ছেড়ে তোমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। দেখার তো বিশেষ কিছু নেই। বাইরের ঘর অষ্টভুজের দেওয়ালগুলোই শুধু বড়বড় ফাটল নিয়েও কোনোমতে খাড়া আছে, ছাতের খানিকটা ভেঙে পড়েছে। ভেতর বাড়ি পুরোটাই ধ্বংসস্তুপ। ঢোকাই যায়না। অনেক তো চেষ্টা করলাম, কিছুতেই কিছু করা গেলনা। সেই যে সাধুর অভিশাপ লাগল –
বিজয়বাবু হেসে ফেললেন, - আমার খুব অবাক লাগে তুই কি করে এসব আজগুবি জিনিষে বিশ্বাস করিস। ছেলেবেলায় আমি বরং মাঝেমধ্যে অন্ধকারে বাড়ির পেছন দিকে যেতে ভয় পেতাম, কিন্তু তোর তো কোনোদিনই কোনো ভয়ডর ছিলনা।
সুজয় ম্লান হেসে বলল – তুই ফিজিক্সের প্রফেসর। এসব মানবিনা জানি। তবে আমার যা অভিজ্ঞতা তাতে বিশ্বাস না করে উপায় নেই। আর তাছাড়া দেখলাম তো। যতবার বাড়িটা সারাবার চেষ্টা করলাম ততবারই -। কথাটা শেষ না করেই মূল প্রসঙ্গে ফিরে গেল – তুই নীলমনির সঙ্গে বেলাবেলি ঘুরে আয়। সন্ধ্যে হবার আগেই বেরিয়ে পড়িস।
অগত্যা এই ব্যবস্থাতেই রাজি হলেন বিজয়বাবু। না হলে এবারেও বাড়িটা তার দেখা হবেনা। সুজয়ের কুসংস্কারের ব্যাপারটাতে একটু হাসিই পাচ্ছিল। সেটা কোনোমতে চাপা দিলেন।
সত্যি বড় আশ্চর্য ব্যাপার। দিদিমা মারা যাবার পর দাদু তখন একলাই থাকেন। দেখাশুনো করার জন্যে থাকত পুরোনো কাজের লোক সুবলদা আর তার পরিবার। সেই সময় এক তান্ত্রিক সাধু এসে নাকি আস্তানা গেড়েছিল সদর ফটকের ধারের গাছতলায়। চারদিক নোংরা করত, গাঁজার আসরও বসতে শুরু করল। শেষে একদিন জীবনদাদু ধমক ধামক দিয়ে তাড়ায় তাকে। যাবার সময়ে সে নাকি নানারকম শাপশাপান্ত করে গিয়েছিল। এ বাড়িতে নাকি কোনোদিন কেউ থাকতে পারবেনা। যে থাকবে তারই ভয়ানক ক্ষতি হবে। ঐ ঘটনার পরেপরেই জীবনদাদু মারা যান। অবশ্য তার বয়সও হয়েছিল। এরপর এক ঝড়ের রাতে সুবলদা মাথায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মারা যায়। তবে তারপরেও দাদু যতদিন ছিলেন কোনো উপদ্রব ছিলনা। সে সব শুরু হয় দাদু মারা যাবার পর থেকে। সুবলদার বড় ছেলে বলরাম পরিবার নিয়ে থাকত ভেতর বাড়ির একতলার দুটো ঘরে। তার ছোটোভাই বিমল বাইরে কোথাও কাজ করত, মাঝেমাঝে আসত ও বাড়িতে। একদিন একটু রাত করে পৌঁছেছে, দেখে বাড়ির উঠোনে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে। চোর ভেবে বিমল তেড়ে যেতেই সে বিকট ভাবে হেসে উঠে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বিমল আর্ত চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যি ভাল ওর আসবার কথা জানা থাকায় বলরামের পরিবার জেগেই ছিল। বিমলের আর্তনাদ শুনে বাইরে দেখতে না এলে সেদিন সারারাত বিমলকে বাইরেই পড়ে থাকতে হত।
ক্রমশ...
--------------------------------------------------------------------------------
এই ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাসটি প্রতি বুধবারে অঙ্কুরীশা-র পাতায় প্রকাশিত হবে। চোখ রাখুন।
পড়ুন ও পড়ান
মতামত জানান
ankurishapatrika@gmail.com
--------------------------------------------------------------------------------
Wonderful read!
উত্তরমুছুনলেখাটা টানটান সাবলীল। অতীতের বর্ণনার সাথে সাথে চলতে চলতে প্রথম পর্ব শেষ হল একটা কি হয় কি হয় ব্যাপার নিয়ে ...
উত্তরমুছুনএগোব পরের পর্বের দিকে।