লেবেল

শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২০

রবিবারের গল্প।। জীবনের রঙ।। সুধাংশুরঞ্জন সাহা।।

 

রবিবারের গল্প




জীবনের রঙ
সুধাংশুরঞ্জন সাহা

সন্ধেবেলা বটগাছটার প্রাচীন ডানার বিস্তারে আবছা অন্ধকার কেঁপে কেঁপে ওঠে । দিঘির কালো জল অন্ধকারে আরও কালো দেখায়।চারপাশের শালি জমি বুজিয়ে বুজিয়ে রোজ একটার পর একটা বাড়ি উঠে উঠে এই বিস্তীর্ণ জলা-অঞ্চল এখন লোকালয়ের চেহারা নিচ্ছে ক্রমশ । সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মতলববাজ লোকেদের এখানে আনাগোনা । কে দালাল, আর কে যে মালিক বুঝে ওঠা খুব মুশকিল। চতুর্দিকে গজিয়ে উঠছে হার্ডওয়্যারের দোকান, বিল্ডার্সদের আধিপত্য।  নিস্তরঙ্গ ঝিলের জলে শরতের সন্ধ্যা নামলে চারিদিক আবছা কুয়াশায় ভরে ওঠে । জায়গাটাকে তখন আর শহর বলে মনে হয় না। মনে হয় কোন এক মফস্বলের প্রাগৈতিহাসিক গ্রাম । কোলাহলহীন, ঘটনাবিহীন অন্ধকারে ডুব দেয় রাত্রি । দূরের বড় রাস্তায় টিম টিম করে জ্বলে ওঠে বাল্ব ।

বছর দশেক আগে কণাদ জমিটা কিনেছিল । মাইনের টাকা জমিয়ে জমিয়ে । জমিটা একটু নিচু হলেও ওর খুব পছন্দ হয়েছিল । কারণ মাত্র দুই - তিন কিলোমিটারের মধ্যে বেহালা চৌরাস্তা । তিন সাড়ে তিন কিলোমিটারের মধ্যে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন । দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যে বেহালা ট্রামডিপো, ম্যান্টন সুপার মার্কেট । একদিন জায়গাটা খুব উন্নত হবে । গুরুত্বপূর্ণ হবে । বসবাসের ক্ষেত্রে খুবই উপযুক্ত হয়ে উঠবে, ভেবেছিল । বাস্তবে তেমনটা হয়নি মোটেই । দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল বাড়ির বয়স । বাড়িটা করে কণার তাই ফেঁসে গেছে । একটা কোন ট্রান্সপোর্ট নেই । সরকারী বা বেসরকারী কোন তরফেরই কোন উদ্যোগ নেই । রাস্তায় বেরোলেই কারি কারি টাকা খরচ । রিক্সায় পা দিলেই কুড়ি টাকা । ভালো ডাক্তার নেই ধারে কাছে। সেই চৌরাস্তার আগে কিছুই নেই । না একটা ভালো ওষুধের দোকান, না একটা এটিএম বুথ । সম্প্রতি মুচি পাড়ায় একটা এটিএম হয়েছে বটে, তবে অধিকাংশ সময়েই টাকা থাকে না । টাকা থাকলে আবার নেটওয়ার্ক থাকে না । নানা সমস্যায় জর্জরিত ।

প্রথম দিকে মণীষা খুব উচ্ছ্বসিত ছিল । আত্মীয়স্বজন এবং ওর বন্ধুবান্ধবরা এলে গর্বের সঙ্গে বাড়ি দেখাতো । কিন্তু এই কয়েক বছরেই তার আগ্রহ তলানিতে ঠেকেছে । একটার পর একটা সমস্যা তাকে বিমর্ষ করে তুলেছে ।

এলাকাটা যদিও কলকাতা মেট্রোপলিটান কর্পোরেশনের অধীনে, তবু এখানে পানীয় জলের কোন ব্যবস্থা নেই । যা আছে তা হলো একটি মাত্র টিউবওয়েল ।পুরো পাড়ার জন্য । এখানকার সব বাড়ি তৈরি হয়েছে কর্পোরেশনের অনুমোদিত প্লানে । কর্পোরেশন ট্যাক্স ও অন্যান্য সমস্ত প্রাপ্তিই কড়ায় গন্ডায় বুঝে পাচ্ছে । অথচ ড্রেন বা জল নিস্কাশনের কোন ব্যবস্থা নেই । ফলে, যে যেভাবে খুশি নোংরা, আবর্জনা ফেলছে । আর একটু বেশি বৃষ্টি হলেই এই নিচু এলাকা একটা পরিত্যক্ত ময়লা ডোবার চেহারা নেয় । বর্ষার জল নেমে গেলেও নিচু খালি জমিতে এই জল থেকে যায় । থাকে সাড়া বছর প্রায় । সেই জল পচে পচে বারো মাস মশার উপদ্রব। আবার এই জল পার্শ্ববর্তী বাড়ির পাতকুয়োয় ঢুকে নীরবে কুয়োর জলের বারোটা বাজাচ্ছে ।

সন্ধ্যা একটু গাঢ় হতেই মণীষা জানালাগুলো বন্ধ করে দেয় । কারণ এখনকার এই শিরশিরে হাওয়া নাকি শরীরের পক্ষে ভালো নয় । প্রতি দিনই এই সময়ে ওর খুব একা একা লাগে । কোন কোন দিন ঘরে তালা লাগিয়ে পাড়ার শিবানী বৌদি বা মিতাদের বাড়িতে আড্ডা মারতে যায় । নয়তো পাশের বাড়ির মাসিমা আসেন । কথা হয় । ভালো লাগে । কিন্তু আজ আর কিছু ভালো লাগছে না ওর । টিভিটা একটু জোরে চালিয়ে দিয়ে সেলাই মেশিনটা নিয়ে বসে । একটা নাইটির কাপড় পড়ে আছে সেই কবে থেকে । কণাদই কিনে দিয়েছিল গত পয়লা জানুয়ারিতে ।

সেলাই করতে বসেও ভালো লাগছে না ওর । ভীষণ একা একা লাগছে। আস্তে আস্তে ধূসর অন্ধকার ঘিরে ফেলছে বাড়িটাকে । কণাদটা কিছুতেই বুঝতে চায় না । অফিস, থিয়েটার আর ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে সে এতো ব্যস্ত ! মণীষাকে নিয়ে ভাববার অবকাশ কোথায় তার ! অথচ কত রঙিন স্বপ্ন এঁকেছিল  মনে মনে মণীষা । প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো ওদের বিয়ের। অথচ একটা সিনেমায় পর্যন্ত নিয়ে যায়নি কণাদ । কোন স্টুডিওতে গিয়ে দুজনে একটা ছবিও তোলেনি কখনও । এই রকম অজস্র ছোট ছোট অভিমান,গোপন রাগ জমে আছে মণীষার স্বপ্নের খামারে । তবু, প্রতিদিন রাতের খাবার বানিয়ে বসে থাকে কলিংবেলের বিশেষ আওয়াজের অপেক্ষায় । সেই আওয়াজ হতেই দৌড়ে দরজা খুলে তাড়াতাড়ি কণাদকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজার সিটকিনি বন্ধ করে নিবিড় জড়িয়ে ধরে, প্রবল তরঙ্গায়িত জল সমুদ্রের তীরে আছড়ে পড়ার মতো । কণারই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় । খেতে খেতে মণীষাকে ধমক দেয় এতো রাত পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকার জন্য । মণীষা ভাষাহীন চোখে তাকিয়ে থাকে কণাদের ক্লান্ত মুখের দিকে । বুঝিয়ে দেয় তুমি কোনদিন এই অপেক্ষার মানে বুঝতে পারবে না, মশায় !

খাওয়া দাওয়ার পর্বশেষে দু'জনে ছাদে যায় হাঁটতে । হিম হিম বাতাসে নির্জন আকাশের নিচে বড় স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে দু'জনের মন । মণীষা কণাদের আঙুল জড়াতে জড়াতে বলে, তূমি এতো দেরী করো কেন ! রোজ রোজ আমার একা থাকতে ভালো লাগে না । কাল একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারবে ? আমাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে ? এই রবিবার চলো না দুর্গাপুর থেকে ঘুরে আসি । কতদিন মা'কে দেখি না !  মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে । কণাদ সম্মতি জানায় মণীষার প্রস্তাবে ।

প্রতিজ্ঞামত কণাদ অফিস থেকে সোজা বাড়ি এসেছে । রিক্সায় ডাক্তারের কাছে যেতে যেতে মণীষা কণাদের হাত চেপে ধরে কৃতজ্ঞতা জানায় । ডা. নাগ ইউরিন টেস্ট করতে বললেন। সম্ভবত মণীষা প্রেগন্যান্ট ।কাল সকালেই ওখার্ডের একটি ছেলে এসে বাড়ি থেকে ইউরিন নিয়ে যাবে । সব ব্যবস্থা করে ওরা বাড়ি ফেরে।

ঠিক সকাল সাতটার সময় ইউরিন নিয়ে গেল ছেলেটা । খুব সময় জ্ঞান বলতে হবে । বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় কণাদ রিপোর্ট নিয়ে ডা. নাগের সাথে কথা বলে নিল। ডা.নাগ বললেন প্রেগনেন্সি কনফার্মড । অ্যাডভাইসও করলেন কিছু ।

কণাদ বাড়ি ফিরলো একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে। আকাশে নতুন তারার আভাসে উচ্ছ্বাসে উপচে পড়লো সারা বাড়ি । মণীষা ঘন হয়ে বসলো কণাদের কাছে । মুহূর্তেই ভুলে গেলো সমস্ত জমানো ক্ষোভ । মনে পড়লো আলোকমালায় ঢাকা বিয়ের রাত । ভেসে এলো সেই ডিসেম্বরের হিমেল বাতাসে রজনীগন্ধার সুগন্ধ ।কানে বেজে উঠলো কণাদের রোমান্টিক গলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন-- "কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি....." / " দৃষ্টিতে কি শান্তি দিলে, চন্দন, চন্দন, আমার কুঠার দূরে ফেলে দেবো চলো যাই গভীর গভীরতম বনে।"  কিংবা পূর্ণেন্দু পত্রীর-- " বাবুমশাইরা, গাঁ-গেরাম থেকে ধূলোমাটি ঘষটে ঘষটে,  আপনাদের কাছে এয়েচি। কী চাকচিকন শহর বানিয়েছেন গো বাবুরা ! রোদ পড়লে জোছনা লাগলে মনে হয় কাল-কেউটের গা থেকে খসে পড়া রূপোর তৈরি একখান লম্বা খোলস । ...."
বাসি বিয়ের দিন বিকেলে দুর্গাপুর থেকে ফেরার পথে একের পর এক  কবিতা, গান আর উচ্চমার্গের রসিকতার ফেনিল ছবি ভেসে উঠলো ওর চোখের প্রসারিত ক্যানভাসে ।

কণাদ মনে মনে প্রমাদ গোনে পরবর্তী ঝামেলার কথা ভেবে । বিশেষ করে সময়াভাবের কথা ভেবে । তবু একটা নতুন শিহরণ তাকে সুখানুভূতি এনে দেয় । এক অজানা আবেগ তার বুকের মধ্যে জোছনায় ভাসিয়ে দেয় সমস্ত অবসাদ ।

মণীষা বিয়ের অ্যালবাম বার করে ছবি দেখতে দেখতে হেসে লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে । তার চোখে মুখে খেলা করছে বালিকাবেলার সরলতা।  এক নাগাড়ে ওর বন্ধু সোনালি আর পূর্ণিমার ছেলেমেয়েদের কথা বলে চলেছে, যেন এতোদিন পর জীবনের একটা মানে খুঁজে পেয়েছে। যেন এই একটা দিনের অপেক্ষাতেই ছিল সে ।

কণাদ তারাশঙ্করের একটা গল্প সংকলন নিয়ে পড়ার ঘরে গিয়ে জানালা খুলে, চেয়ারে বসে পড়ছিল। জানালার সামনের গাছ থেকে ভেসে আসছিল শিউলির ঘ্রাণ ।  তার মনে পড়ে যায় শৈশবের দিনগুলো । বাবুই পাখিদের নিপুণ বাসা বোনানো, পাতার আড়ালে ঘুঘু পাখির ঘাপটি মেড়ে বসে থাকা...। কণাদের ক্লান্ত শরীর কখন যে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে, সে নিজেই জানে না । হঠাৎ সে দেখতে পায় টাল মাটাল পায়ে এক শিশু হাঁটছে । হেঁটে যাচ্ছে । হেঁটে যাচ্ছে ভয়ংকর এক সেতুর দিকে ...।

প্রচণ্ড চিৎকারের আওয়াজে ছবি ফেলে দ্রুত ছুটে আসে মণীষা । কাঁধে, মাথায় হাত রেখে নিপুণ আন্তরিকতায় জিজ্ঞাসা করে কী হলো? ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয় কণাদ । মণীষাকে আবেগে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করে --"জীবনের রঙ কী?"  তুমি জানো মণীষা, জীবনের রঙ কী ? মানে কী জীবনের ? টাল মাটাল পায়ে শিশু কেন হেঁটে যায় ভয়ংকর সেতুর দিকে ?  মণীষা হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কণাদের দিকে। মনে পড়ে ওর পুরনো প্লুরিসি অসুখটার কথা । এক অজানা আশঙ্কায় হাবুডুবু খায় দু'চোখের ভরা গঙায় ...।



---------------------------------------------------------------------------------------------
এই বিভাগের জন্য মৌলিক ও অপ্রকাশিত  লেখা পাঠান। 

মতামত জানান। 
 ankurishapatrika@gmail.com

--------------------------------------------------------------------------------------------                
      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন