লেবেল

শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মদ্বিশত বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে অঙ্কুরীশা-র গদ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি -

 




ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের  জন্মদ্বিশত বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে অঙ্কুরীশা-র গদ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি -








কলমে-—

১.তুলসীদাস মাইতি
২.সুধাংশুরঞ্জন সাহা
৩.দীপক কুমার বেরা          




.
বিদ্যাসাগরের মহত্ত্ব

তু ল সী দা স   মা ই তি


"ধন্য তোমরা, তোমাদের তপস্যা ব্যর্থ হয়নি, তোমরা একদিন সত্যের সংগ্রামে নির্ভয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলে বলেই আমাদের অগোচরে পাষাণের প্রাচীরে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। তোমরা একদিন স্বদেশবাসীদের তিরস্কৃত হয়েছিলে, মনে হয়েছিল বুঝি তোমাদের জীবন নিস্ফল হয়েছে, কিন্তু জানি সেই ব্যর্থতার অন্তরালে তোমাদের কীর্তি অক্ষয়রূপ ধারণ করছিল।" বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদিন এমন কথা বলেছিলেন । কথাটির তারপর্য অনেকটাই গভীরে নিহিত। ওইদিনই রবীন্দ্রনাথ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন যার মূল্য অপরিসীম। দেশবাসীর বিদ্যাসাগর স্মরণের উদ্দেশ্যকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে সেদিন তিনি বলেছিলেন- 

"বিদ্যাসাগর তাঁর চরিত্রের যে মহত্বগুণে দেশাচারের দুর্গ নির্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন সেটাকে কেবলমাত্র তাঁর দয়া-দাক্ষিণ্যের খ্যাতির দ্বারা তাঁরা ঢেকে রাখতে চান। বিদ্যাসাগরের যেটি সকলের চেয়ে বড়ো পরিচয় সেইটিই তাঁর দেশবাসীর তিরস্করণীর দ্বারা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।"(প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩২৯)। এই প্রসঙ্গটির নিবিড় ব্যাখ্যার জন্যই এই প্রতিবেদনের অবতারণা।

বিদ্যাসাগরের মহত্ত্বটি প্রকৃতপক্ষে কোথায় বা তাঁর আসল পরিচয়টি কি তা নিয়ে আজো আলোচনা জরুরি হয়ে পড়ছে। প্রকৃত প্রস্তাবে আধুনিক ভারত নির্মাণের জন্য যে প্রত্যয় বৃক্ষের বীজ উনিশ শতকের বঙ্গভূমি তে প্রোথিত হয়েছিল রামমোহন হাতে, বিদ্যাসাগরের হাতে তার লালন। এর জন্য যে মহৎ শক্তির প্রয়োজন তা বিদ্যাসাগরের ছিল। একটা সংঘাত ময় জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি এই শক্তি দিয়ে। 

বিদ্যাসাগরের বহুবিধ কাজের প্রধানত তিনটি  দিক।  যেমন-
 
এক ।। ধর্ম বাদ দিয়ে সমাজ সংস্কার আন্দোলন।
বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ প্রথার বিলোপ ইত্যাদি এই শ্রেণির কাজের মধ্যে পড়ে।
যে সময়কালে বিদ্যাসাগর তাঁর কাজ গুলি করছেন তখন সমস্ত সমাজ ধর্মের বেড়াজাল কুসংস্কার ও কুপ্রথায় জর্জরিত। ধর্মকে বাদ দিয়ে সমাজসংস্কার কিভাবে সম্ভব। রামমোহন রায় তাঁর পূর্বসূরী। তিনি ধর্মকে আশ্রয় করেই সমাজসংস্কারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর সে পথে হাঁটেন নি। ধর্ম ও ঈশ্বর-এসবের প্রতি তিনি উৎসাহী ছিলেন না। অবশ্য ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদও ঘোষণা করেননি।তাঁর কাছের মানুষজন অনেকেই রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । অনেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন। বিদ্যাসাগর বিচলিত হননি। প্রতিক্রিয়াও দেখান নি। তিনি বুঝেছিলেন বিধবাবিবাহ প্রচলন,বহুবিবাহ প্রথা রদ, বাল্যবিবাহ প্রথার লোপ-এই সব কাজের জন্য ধর্ম থেকে দূরে থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাধারমণ মিত্র বলেছেন-

"বিদ্যাসাগর ধর্ম বিষয়ে উৎসুক্য দেখাননি। সমাজসংস্কার করতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন যে ধর্ম সমাজকে রক্ষা করছে না। বরং পীড়ন করছে। সেটা ধর্মের দোষ নয়, যারা ধর্মব্যবসায়ী, ব্রাহ্মণ-পান্ডা-পুরোহিত - তারাই এই কাণ্ডটা ঘটাচ্ছেন। এজন্য তিনি সরাসরি ধর্ম প্রসঙ্গটাই বাদ দিয়ে দিলেন। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন যে, বিদ্যাসাগর পুরোপুরি নাস্তিক ছিলেন।" 

স্বাভাবিকভাবেই তিনি শত্রু হলেন একশ্রেণির মানুষের কাছে। এমন কি ক্রমশ একা হয়ে গেলেন। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর কাজ তিনি করে গেছেন। কখনো আদর্শ-চ্যুত হননি। আর এখানেই বিদ্যাসাগরের চরিত্রের মহত্ত্ব। এখানেই তিনি অন্যদের থেকে ভিন্ন, স্বতন্ত্র।

দুই ।। শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন। নতুন নতুন  বিদ্যালয় স্থাপন, নারী শিক্ষার নানান আয়োজন ইত্যাদি।।

যে আদর্শে বিদ্যাসাগর সমাজসংস্কার আন্দোলন করেছিলেন সেই পথেই তিনি শিক্ষাসংস্কারের প্রতিও মনোনিবেশ করেন। এখানেও তাঁর লড়াইটা ছিল গভীর। ছাত্রজীবন ও শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছিলেন বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজন। পাঠক্রম ,শিক্ষাপদ্ধতি- সবকিছুর আমূল পরিবর্তন দরকার। সংস্কৃত কলেজে তিনি কয়েকবছর চাকরি করেন মাঝে তাকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল ওই একটাই কারণে। তিনি পাঠ্যসংস্কার করতে চেয়েছিলেন এবং শিক্ষাপ্রণালীর পরিবর্তন চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। আদর্শহীন রসময় দত্ত মেনে নেননি। আদর্শ পরায়ণ বিদ্যাসাগর ইস্তফা দেন। পরে অবশ্য আবার আসেন এখানে চাকরিতে।
নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের ভূমিকা কমবেশি সবার জানা। বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল। বিদ্যালয়গুলো চালু রাখা এবং সংস্কার করার জন্য তিনি কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন নি। অবশ্য বিডন সাহেব কিছু সাহায্য করতেন। সংস্কারমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে প্রকৃত শিক্ষার প্রয়োজন- এটা তিনি অন্তর দিয়ে বুঝেছিলেন বলেই তাঁর এই লড়াই।

তিন ।। গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ।

গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ বিদ্যাসাগরের এক উল্লেখযোগ্য কাজ। বাংলা সাহিত্যে প্রথম শিল্পিত গদ্যের তিনিই প্রথম স্রষ্টা বলে মনে করা হয়। রামমোহনের কেজো গদ্যকে তিনিই প্রথম সাহিত্য পদবাচ্য করে তোলেন। অবশ্য আধুনিক কালের বহু গবেষক অক্ষয়কুমার দত্তের ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত ভূগোল গ্রন্থের গদ্যকে প্রথম সাহিত্যিক গদ্য বলে মনে করে থাকেন। সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, এক অনন্য গদ্যশিল্পী ছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগরের গ্রন্থ রচনার উদেশ্য তাঁর জীবনের অন্যান্য উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য চাই বাংলাবই এবং স্কুল চালানোর জন্য চাই অর্থ। গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রেও তিনি ওই একই আদর্শকে মেনে চলেছেন।। কোথাও ধর্মীয় আবেগকে প্রশ্রয় দেননি। বিধবাদের যাতনা ও নারীর দুঃখের মতোই দেশের বালক-বালিকাদের শিক্ষা নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন। শিক্ষা সংস্কারের অন্যতম এককও ছিল তাঁর রচিত গ্রন্থ। এ প্রসঙ্গে শিশু উপযোগী পাঠ্যপুস্তক বর্ণপরিচয়,প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ বই দুটির কথা বলতেই হয়। বলাবাহুল্য, বর্ণ পরিচয় ( ১৮৫৮)- এর আগে বিদ্যাসাগর অনেকগুলি পুস্তক রচনা করেছিলেন। 'বেতাল পঞ্চাবিংশতি' 'বাংলার ইতিহাস', 'জীবনচরিত' 'শকুন্তলা' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনার উদ্যেশ্যের সাথে বর্ণপিরিচায়ের উদেশ্য পুরোপুরি এক নয় । শিক্ষাসংস্কারের কাজে বিদ্যাসাগর শিশুর প্রথম শিক্ষার জন্য বিজ্ঞান সম্মত বইয়ের প্রয়োজন উপলব্ধি করেছিলেন। তার আগে যে বই ছিল না তা নয়।  ১৮৪৯-৫০ সালে প্রকাশিত মদনমোহন  তর্কালংকারের লেখা 'শিশুশিক্ষা' '( প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ) বইটি ছিলই।  ছিল ১৮৫৩ তে লেখা স্কুল বুক সোসাইটির বই 'বর্ণমালা', হিন্দু কলেজের বাংলা পাঠশালার সম্পাদক ক্ষেত্রমোহন দত্তের 'শিশুসেবধি'.অক্ষয় কুমার দত্তের 'চারুপাঠ 'ইত্যাদি বই ছিলই। কিন্তু কোনোটাই শিশুদের বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার করে নির্মিত ছিল না 
এই পুস্তকেই বিদ্যাসাগর বর্ণমালার আমূল পরিবর্তন করেন। এখানে তিনি পূর্বের ৪৮ টি বর্ণের বদলে তিনি আনেন ৫২ টি বর্ণ। দীর্ঘ 'ঋ' এবং দীর্ঘ '৯'-কার বাংলাভাষায় ব্যবহৃত হয় না বলে বাদ দিয়েছেন। অনুস্বার ও বিসর্গ কে ব্যঞ্জনবর্ণে নিয়ে আসেন। চন্দ্রবিন্দু কে অক্ষরের মধ্যে রাখা হয়। আগে স্বতন্ত্র মর্যাদা ছিল না। ক্ষ কে যুক্তবর্ণ থেকে তুলে এনে ব্যঞ্জন বর্ণে রাখেন। সংস্কৃত বর্ণমালায় থাকা ড় ঢ়, য় কে বাংলা ভাষার নিজস্ব হরফের স্বীকৃতি দেন বিদ্যাসাগরই।
বর্ণপরিচয় লিখতে হয়েছিল সহজ সরল ভাবে শেখানোর উদ্দেশ্যেই। এখানে খুব গুরুত্বের সাথে একটি কথা বলতেই হয়, যে বর্ণ পরিচয় এর বর্ণ ,শব্দ, বাক্য, এসবের ক্রমে একটা বিজ্ঞানসম্মত ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিদ্যাসাগর এই পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে প্রথমে বর্ণপরিচয় পরে প্রকৃতি পরিচয় এবং শেষে সমাজের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। আর এই সম্পূর্ণ পর্যায়ে কোথাও ঈশ্বর ও ধর্মের প্রসঙ্গ আনেন নি। তৎকালীন সময়ে যা ছিল খুব কঠিন। এখানেও বিদ্যাসাগর তাঁর আদর্শকে অটুট রেখেছেন। এখানেই বিদ্যাসাগরের মহত্ত্ব।

দীর্ঘ দুশো বছর দেশবাসী বিদ্যাসাগরের মহত্ত্বের আলোতে স্নান করে চলেছে। কিন্তু তারা 'আধুনিকতম মানুষ'টির এই মহত্ত্বকে কতটুকু চিনতে পেরেছে?
আজ তাঁর দুশো বছর পূর্তিতে প্রকৃতরূপে তাঁকে যদি আমরা চিনে নিতে পারি, তবেই এই স্মরণ-কাল হবে সার্থক।





২.
অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষত্বের প্রতীক
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

সু ধাং শু র ঞ্জ ন সা হা


বাংলার মাটিতে যুগে যুগে যে সব প্রবাদপ্রতিম মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম সেরা বাঙালি । ঈশ্বরচন্দ্র হুগলি (বর্তমানে পূর্ব-মেদিনীপুর) জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । মাত্র আট বছর বয়সেই বাবার হাত ধরে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।  মেধার স্বীকৃতি হিসেবে ১৮৩৯ সালে তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধি দেয়া হয় সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের জন্য । সংস্কৃত ছাড়া ইংরেজিতেও তাঁর বিশেষ বুৎপত্তি ছিল। 

কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান পন্ডিতের পদে যোগ দেন । তারপর তিনি সংস্কৃত কলেজে প্রথমে  অধ্যাপক এবং পরে অধ্যক্ষ-পদে আসীন হন ।

শিক্ষার সঙ্গে গভীরডাবে  যুক্ত থাকার সময়ে তিনি অনুভব করেন যে, প্রথাগত শিক্ষার বদলে আধুনিক শিক্ষাই যথাযথ এবং জরুরি। তিনিই প্রথম বাংলালিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ এবং অপরবোধ্য করে তোলেন । তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে যে সমস্ত সংস্কার করেছিলেন তার মধ্যে রয়েছে পাঠক্রম সংস্কার, গনিতে ইংরেজির ব্যবহার, পাশ্চাত্য লজিকের প্রবর্তন ইত্যাদি । স্কুল বিভাগের সর্বস্তরের জন্য সম্পূর্ণ নতুন করে বাংলা ভাষার পাঠ্যপুস্তক লিখলেন। যেমন, শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয়, কথামালা, শকুন্তলা, ঋজুপাঠ, বোধোদয়, সীতার বনবাস ইত্যাদি ।

তিনি যে কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার করেছেন তা কিন্তু নয়, প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন একজন মানব দরদী এবং সমাজ সংস্কারক । তিনি বাল্যবিবাহ, কৌলিন্যপ্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন । বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন এইসব কুসংস্কার । চেয়েছিলেন বিধবা বিবাহ চালু করতে । 

রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের হাজার প্রতিরোধ উপেক্ষা করে বড়লাটের সহায়তায় ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাশ করালেন এবং প্রবর্তন করলেন । মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ছিল তার একটি অনন্য ব্রত । তাঁর উদ্যোগে জেলায় জেলায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ।আজ মেয়েদের শিক্ষার যে অগ্রগতি তার পেছনে যে মানুষটির ভূমিকা ছিল সর্বাত্মক তিনি ঈশ্বরচন্দ্র ছাড়া অন্য কেউ নন।  তিনি ছিলেন কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার অনাহুত বন্ধু । 
ঈশ্বরচন্দ্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :
'দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রধান গৌরব তাঁর অজেয় পৌরুষ, তাঁর অক্ষয় মনুষত্ব।' 
তিনি ছিলেন সবরকম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে । কোন নীচতা, ক্ষুদ্রতা কিংবা অকারণ আড়ম্বর তাঁর মনুষত্ব, ব্যক্তিত্বকে খর্ব করতে পারেনি। দুশো বছর পরেও তিনি তাই বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির হৃদয়ে সমানভাবে উজ্জ্বল ও অমর হয়ে আছেন ।

আমরা জানি, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে তছনছ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা নানাভাবে সক্রিয় । কখনও তারা বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষাকে বাতিল করে ধর্মীয় ব্যবস্থা কায়েম করতে ব্যস্ত । কখনও নজরুল, সুকান্ত, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিদ্যাসাগরের রচনা সিলেবাস কিংবা পাঠ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে সক্রিয় । কারণ শিক্ষাকে তছনছ করে জাতির মেরুদন্ড ভেঙে দিতে পারলে তাদের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয় । এই স্বৈরাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । এই ভয়ানক প্রবণতাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে হবে । তাহলেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন হবে । কারণ তিনি ছিলেন যথার্থ যুক্তিবাদী এবং সব ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ।

পৃথিবীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে বাংলার এই মহান সন্তান অমৃতলোকে পাড়ি দিলেন ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই । রেখে গেলেন তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় আর মানবদরদী হৃদয়, যা আজও মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেখায়, অনুপ্রাণিত করে । জন্ম ও মৃত্যু এক অমোঘ সত্য । এর হাত থেকে কারো নিস্তার নেই । কিন্তু দৈহিক মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না । কৃতকর্মই মানুষকে অমর করে রাখে । তার জ্বলন্ত প্রমাণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।  যতোদিন বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতির অস্তিত্ব থাকবে ততোদিন বাঙালির হৃদয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর নাম খচিত থাকবে । এটা হলফ করেই বলা যায় । জন্মদ্বিশতবর্ষে তাঁকে আমার শতকোটি প্রণাম ।


৩.

বিদ্যাসাগর
দী প ক কু মা র বে রা  

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে, 
দীন যে, দীনের বন্ধু!"

মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই সত্যোচ্চারণ কোনও অতিশয়োক্তি, আবেগ বা উচ্ছ্বাসের প্রকাশ নয়। বিদ্যাসাগর প্রকৃত অর্থেই বিদ্যার সাগর এবং ভারত তথা বিশ্বের গর্ব। শাস্ত্রীয় অচলায়তনের মধ্যে যখন নাভিশ্বাস উঠেছিল, সমগ্র সমাজের বুকে যখন স্তুপিকৃত হয়ে উঠেছিল দীর্ঘকালের অর্থহীন সব জঞ্জাল, তখন সেই অশিক্ষা ও কুসংস্কারের জঞ্জাল দূর করবার শপথ নিয়ে দুর্বার পদক্ষেপে যিনি এগিয়ে এসেছিলেন, তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঈশ্বরচন্দ্রের পান্ডিত্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা, কর্মনিষ্ঠা, নির্ভীকতা, হৃদয়বত্তা মানবসমাজে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। হিমালয়ের মত বিশাল ও উন্নত মনের মানুষ ঈশ্বরচন্দ্র শুধু মাত্র বিদ্যার সাগরই ছিলেন না, তিনি করুণারও সিন্ধু ছিলেন। 

১৮২০ সালের ২৬-শে সেপ্টেম্বর অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে সিংহ-শাবক ভূমিষ্ঠ হন, যাঁর প্রকৃত নাম ঈশ্বর চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভগবতী দেবী। অতি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও দরিদ্রতা তেজস্বী ঈশ্বরচন্দ্রের বলিষ্ঠ মানসিকতাকে এতটুকু দমাতে পারেনি। বরং এই দারিদ্রের সঙ্গে আশৈশব সংগ্রাম করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক মহান তেজস্বী পুরুষ।

গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের চতুষ্পাঠীতে ঈশ্বরের প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। অতি শৈশবেই পাঠশালার শিক্ষা সম্পূর্ণ করে তিনি পিতার হাত ধরে পদব্রজে শহর কলকাতায় পাড়ি দিয়েছিলেন। তিনি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু, কলকাতায় অত্যন্ত দীন ভাবে শুরু হয় তাঁর লেখাপড়া। বাড়িতে পড়বার মত আলোর ব্যবস্থা ছিল না। তাই তিনি বড় রাস্তার গ্যাসের বাতির নিচে বসে পড়াশুনা করতেন। ঈশ্বরচন্দ্র অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি দারিদ্রের কাছে কিছুতেই হার মানেন নি, দমে যান নি। আপন মেধা ও প্রতিভাবলে তিনি দারিদ্রের সকল প্রতিবন্ধকতা কে  জয় করে সংস্কৃত কলেজে বিভিন্ন শাস্ত্রে তিনি পারদর্শিতা ও বিশেষভাবে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। তাঁর এই অসাধারণ মেধার জন্য সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকবৃন্দ তাঁকে বিশেষ উপাধি 'বিদ্যাসাগর' অভিধায় ভূষিত করেছিলেন। 

কর্মই মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচিতি। তরুণ ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র ২১ বৎসর বয়সে বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিছুদিনের জন্য তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পন্ডিত এর পদ অলংকৃত করেন। এরপর তিনি যোগদান করেন সংস্কৃত কলেজে এবং আপন কর্মদক্ষতায় তিনি হয়ে উঠেন ঐ কলেজের অধ্যক্ষ। এরপর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশেষ বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে নিযুক্ত হন। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন তিনি অনুভব করেছিলেন প্রথাগত শিক্ষার বদলে আধুনিক শিক্ষাই হল যথাযথ শিক্ষা। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি অনেক সংস্কারসাধন করেছিলেন। সেগুলি হল - পাঠক্রম সংস্কার, গণিতে ইংরেজির ব্যবহার, দর্শনে পাশ্চাত্য লজিকের প্রবর্তন, মাহিনা পরিবর্তন, বিরতি দিবস এর পরিবর্তন প্রভৃতি। তিনি স্কুল বিভাগের সর্বস্তরের জন্য নতুন করে বাংলা ভাষায় পাঠ্যবই লিখলেন। এগুলির মধ্যে - বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, শকুন্তলা, সীতার বনবাস, ঋজুপাঠ প্রভৃতি পুস্তক। বাংলা গদ্য সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে তাঁর হাত ধরেই। পদ্যের মত গদ্যেও যতি চিহ্ন ব্যবহার করে গদ্য সাহিত্যকে তিনি ছন্দবদ্ধ করেছেন। 

বিদ্যাসাগর ছিলেন বাংলা ভাষার প্রাণপুরুষ, বাংলা ভাষার যথার্থ শিল্পী। বাংলা সাহিত্যের চরম দুর্দিনে তিনি অনুভব করেছিলেন বাংলা ভাষার বিস্তারের জন্য প্রয়োজন বাংলা গ্রন্থের। বাংলা গদ্যকে সমৃদ্ধশালী করবার জন্যে তিনি রচনা করেছিলেন একাধিক মৌলিক গ্রন্থ এবং একই সঙ্গে নানা কালজয়ী গ্রন্থের বাংলা অনুবাদও করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল 'বেতালপঞ্চবিংশতি', 'শকুন্তলা', 'সীতার বনবাস' প্রভৃতি।

বজ্রকঠিন বিদ্যাসাগরের হৃদয় ছিল কুসুমের মত কোমল। উনিশ শতকের মানবতাবাদে দীক্ষিত এই মহান পুরুষ শুধুমাত্র গ্রন্থ রচনা করেই ক্ষান্ত হননি, সমাজের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে তাঁর দয়ার দৃষ্টি ছিল অপরিসীম। সেই সময় বাল্য-বিধবাদের মলিন মুখ তাঁকে বেদনায় জর্জরিত, অশ্রুসিক্ত করে তুলেছিল। তাদের দুর্দশা মোচনের জন্য তিনি কঠোর সংগ্রাম করেছিলেন। তাঁর লাগাতার দীর্ঘ অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৬৫ সালের ২৬-শে জুলাই বিধবা-বিবাহ আইন সিদ্ধ হয়। বহুবিবাহ প্রথা রদেও বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। সারাজীবন ধরে তিনি সমাজের নানা কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম করে গিয়েছেন। 

শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি মনে প্রাণে উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষার উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারী-শিক্ষা ব্যতীত জাতির মুক্তি নেই। তাই তিনি নিজের টাকা খরচ করে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বহু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকের দৈন্যের কথা ভেবে তিনি রচনা করেছিলেন বহু পুস্তক। তাঁর রচিত বর্ণপরিচয় আমাদের শৈশবের পরম প্রাপ্তি। 

আমরা বিদ্যাসাগরের সুষমামন্ডিত চরিত্রের পরিচয় পাই। তিনি যেমন ছিলেন বিদ্যার সাগর, তেমনই ছিলেন করুণার সাগর। দরিদ্র মানুষের সেবায় তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর কাছে হাত পেতে কেউ কখনও বিমুখ হয়নি। দরিদ্রদের চিরকাল তিনি অন্ন-বস্ত্র-ঔষধ দিয়ে সেবা করেছেন। তাঁর হৃদয় মন্দিরে কখনও দেবদেবীর বিগ্রহ স্থান পায়নি কিন্তু, চিরকাল তিনি নররূপী নারায়ণের উপাস্য ছিলেন। মাতৃভক্তি ছিল বিদ্যাসাগরের চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ। তিনি মায়ের মনোবাঞ্ছা পূরণ করার উদ্দেশ্যে দরিদ্র গ্রামবাসীদের মধ্যে কম্বল বিতরণ করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন বিদেশে চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছিলেন, তখন বিদ্যাসাগর তাঁকে অর্থ সাহায্য পাঠিয়েছিলেন। কালক্রমে এভাবেই তিনি বিদ্যার সাগর থেকে দয়ার সাগরে পরিণত হয়েছিলেন। 

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় পাই, 

"সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয় 
চক্ষে দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়।" 

এভাবেই পান্ডিত্যে, সারাজীবনের নানান ত্যেজোদ্দীপ্ত কর্মকান্ডে, বিবিধ কর্মকুশলতায় বীরসিংহের সিংহশিশু ঈশ্বরচন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর পরম বিস্ময় মহাপুরুষ পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। হয়ে উঠেছিলেন তৃণ লতাগুল্মের বনস্পতির মাঝে এক অনির্বান সূর্য। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯-শে জুলাই এই ক্ষণজন্মা অজেয় পৌরুষ শিখা নির্বাপিত হয়। কালের অমোঘ নিয়মে তাঁর নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর আদর্শ রয়ে গিয়েছে অক্ষয় অমর হয়ে।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়---
"দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।"









কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন