লেবেল

শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০

নৈরাশ্যবাদী কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত/বিমল মণ্ডল



নৈরাশ্যবাদী কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত   
- বিমল মণ্ডল  

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। তাঁর জন্ম ২৬শে জুন ১৮৮৭।   পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুরে।  তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি (১৯১১) লাভ করে প্রথমে নদীয়া জেলাবোর্ড ও পরে কাসিমবাজার রাজ-এস্টেটের ওভারসিয়ার হন। চাকরির পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চাও শুরু করেন এবং অল্পকালের মধ্যেই কবি হিসেবে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। রবীন্দ্র যুগের কবি হয়েও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এড়িয়ে যে কয়জন কবি-সাহিত্যিক নতুন ভাবনা ও স্বতন্ত্র বক্তব্য নিয়ে কাব্যচর্চা করেন, যতীন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন দুঃখবাদী, আর এই দুঃখবাদ তাঁর কাব্যের মূল সুর। বাংলা কাব্যকে অবাস্তব কল্পনার জগৎ থেকে কঠোর বাস্তবে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাকে একজন পথিকৃৎও বলা চলে। 



যতীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন যুক্তিবাদী ও মননশীল লেখক; সমাজ ও সমকাল তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু। ভাষার মধ্যে তর্ক, কটাক্ষ ও প্রচ্ছন্ন পরিহাস তাঁর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। দর্শন ও বিজ্ঞান উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি ছিলেন দুঃখবাদী, আর এই দুঃখবাদ তাঁর কাব্যের মূল সুর। প্রকৃতি ছলনাময়ী, জীবন দুঃখময়, সুখ অনিত্য ও ক্ষণিকের এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি জগৎ-সংসারকে দেখেছেন। কোনোরূপ ভাববাদের বশবর্তী হয়ে নয়, বরং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বাস্তব পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি দুঃখ ও নৈরাশ্যের চিত্র এঁকেছেন। 




যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের   প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হলো -মরীচিকা (১৯২৩), মরুশিখা (১৯২৭), মরুমায়া (১৯৩০), সায়ম্ (১৯৪০), ত্রিযামা (১৯৪৮), নিশান্তিকা (১৯৫৭) এবং কবিতা-সংকলন অনুপূর্বা (১৯৪৬) ইত্যাদি।  

 কবির কবিতা বিশ্লেষণ করলে  পাওয়া যায় যে তিনি সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন। তাই   তিনি ঘুমের ঘোরে, প্রথম ঝোঁকে’ কবিতায় বলেছেন-

সাগরের কূলে পুরী তব দারু মূরতি জগন্নাথ;
রথের চাকায় লোক পিষে যায়, তোমার নাহিক হাত

আবার তিনি বারনারী সমাজে ঘৃণ্য এবং পরিত্যক্ত তাকেও  অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। তাই কবি উদার রমণীকেই প্রত্যক্ষ করে বলেছেন - 

   যৌবনখানি বসনের মত
   খুলে রাখ, তুলে পর!
   কার কল্যাণে করে কঙ্কণ
    সিন্দুর সিঁথা পরে;
   অমর কাহারে বরিয়া লয়েছ বিশ্ব সয়ম্বরে। 



গান্ধীর জীবনদর্শন ও রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর জীবনদৃষ্টিতে মানবতাবাদ ও দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের প্রতি গভীর মমতা লক্ষণীয় তাই সেই সব মানুষদের উদ্দেশ্যে কবি লিখেছেন-   

   রাজার পাইক বেগার ধরেছে,
   ক্ষেতে যাওয়া বন্ধ হল আজ;
   জীর্ণচালে হল না আর দেওয়া
   কোথাও দুটি পঁচা খড়ের গুঁজি,
   সারা সনের অন্ন ছাড়ি
   যেতেই হবে রাজার বাড়ি!
স্বর্ণচূড়ায় বর্ণ সেথায় মলিন হল বুঝি।
(চাষার বেগার, মরীচিকা)



 সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ ও সংগ্রামশীলতাকে তিনি নিখুঁতভাবে অঙ্কন করেছেন। ‘নবান্ন’ কবিতায় কবি কৃষকের মনের নতুন নতুন  আশার বর্ণনা এইভাবে দিয়েছেন-   

আমি ভাবি ফসলটা নাবি, আরও কটা দিন যাক,
ভরা অঘ্রাণে ঘটে না-ত কোন দৈব-দুর্বিপাক।
মাড়াই-সরাই শেষ করে সবে খামারে দিইছি হাত,
কালকে হঠাৎ
বন্ধু দোহাই, তুলনাকো হাই হইনু অপ্রগলভ_
ক্ষমা কর সখা বন্ধ করিনু তুচ্ছ ধানের গল্প।
(নবান্ন, মরুমায়া)

কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত একটা  কবিতায় বলেছেন  সহায়-সম্বলহীন অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য সরকারের কাছ থেকে যেসব রিলিফ সামগ্রী আসে উচ্চবিত্তের লোকজন তাও চেটেপুটে খেয়ে নেয়। সমাজে এইরূপ  শোষণের এক নির্দয় চিত্র ধরা পড়েছে  তাঁর কবিতায় –

   তিন আনা চৌকা
   ভুখা পেটে খেটে খা,
   দলে দলে লেগে যা।
  কে বলে কঠিন মাটি? না পোষায় ভেগে যা।
  ঘরে বসে মড়’কে
   চলছিলি নরকে
   না হয় কোদাল হাতে মরবি এ সড়কে
   খাট তবে খাট রে।
  ডোঙা পেট কোঙা করে গোঙা মাটি কাটরে।
(ফেমিন-রিলিফ)

যতীন্দ্রনাথের মতে মানুষের জীবনের প্রথমার্ধ অবিরত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে অতিবাহিত হয়, দ্বিতীয়ার্থে অপরাধ জরা-ব্যাধি ভারাক্রান্ত অবসন্নতা নেমে আসায় রাত্রির অন্ধকার-সদৃশ অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটে।তিনি ভোগবিলাসীর স্বপক্ষে যুক্তি অনেক সময়  খাড়া করেছেন। তাই উপমা হিসেবে বলতে চেয়েছেন যে সেইরূপ  মাংসের দোকানের পাশ থেকে কেনা কেতকীও একই ব্যঞ্জনা বহন করে। সেইরূপ একটা কবিতায় বলেছেন-

   বৌবাজারের মোড়ে,
   যেখানে ফুলের দোকানের পাশে কসাই
   এ মাংস থোড়ে।

রবীন্দ্রনাথের প্রতি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত-এর সম্পর্ক নিয়ে বলা হয় 'শ্রীরাবণের শ্রীরামভক্তি' রবীন্দ্রনাথ এর মৃত্যুর পর শোক যাত্রায় যখন গোটা শহর পথে নেমে এসেছিল যতীন্দ্রনাথ যান নি। তিনি এই উপলক্ষে একটি কবিতা লিখেছিলেন বাইশে শ্রাবণ ১৩৪৮। কবিতায় বলেছিলেন -

   আমি ফুল দিই নি বন্ধু

   আমার  পথে ফুলের দোকান পড়ে না।'

 পরের বছর তিনি আর একটি কবিতা লিখেছিলেন,বাইশে শ্রাবণ ১৩৪৯ । এই কবিতায় তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বহু মানুষ সেদিন সঙ্গে ছিল আজ তারা ভুলে গেছে।কিন্তু আমি আজ ও তোমাকে মনে রেখেছি।তাঁর বিশ্বাস ছিল এমন যে, ঈশ্বর স্বয়ং দুঃখময়, ঈশ্বরের বার্তা মানুষের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না; জগৎ যেমন তেমনই থাকে; প্রেম বলে কিছু নেই, চেতনাই জড়কে সচল করে।


যতীন্দ্রনাথের ভাষা আবেগমুক্ত ও যুক্তিসিদ্ধ; তিনি সরাসরি বিষয়ের প্রকাশ ঘটান। তবে অন্ত্যপর্বের কাব্যগুলিতে কবির রোম্যান্টিক বিহবলতা ও চাঞ্চল্য প্রকাশ পেয়েছে।  তাঁর জীবনাবসান ঘটে ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৪।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন