নিবন্ধ
একুশে ফেব্রুয়ারী উনিশ’শো বাহান্ন ও বাংলাভাষা
অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়
যে কোন
জাতির উণ্ণতি বা অবনতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে তাঁর একান্ত নিজস্ব
মাতৃভাষা । ভাষাই হলো জাতির একমাত্র পরিচয়। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ পরিচিতি লাভ করে আমৃত্যু কাল পর্যন্ত। জাতির গৌরব তাঁর
মাতৃভাষা । ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা বা টিকিয়ে
রাখার দায়িত্ব আপামর জনসাধারণের। যে কোন
স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের যে সমস্ত অধিকার দেওয়া হয় তার মধ্যে ভাষা
ও সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতা অন্যতম। এই
সামান্য অধিকার থেকে কোন জাতিকে বঞ্চিত করার অর্থ তাঁর মেরুদন্ডটি ভেঙ্গে দেওয়া। এই রকম এক প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে শুরু
হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন। জাতির নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল যুগান্তকারী
এক নতুন অধ্যায় – আজ থেকে সত্তর বছর পূর্বে সেই একুশে ফেব্রুয়ারী উনিশ’শো বাহান্ন সালে।
প্রাক্তন
পূর্ব পাকিস্তানে (অধুনা বাংলাদেশ) ভাষার সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরী করার অভিসন্ধি
নিয়ে যারা উর্দুকে (প্রাচীন ভারতবর্ষে অর্থাৎ সুলতান আমলে সিপাহীদের চলতি ভাষা ছিল
উর্দু) মুসলমানের ভাষা এবং বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা বলে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল
বাহাণ্ণর একুশে ফেব্রুয়ারী, সেই চক্রান্তকে
সমূলে বিনষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন ওপার বাংলার মানুষ । বাংলাদেশের মুসলমানরাই আজ প্রকৃত বাঙালি নামে জগৎ বিখ্যাত । এক কথায় তাঁরা বিশ্ব বিজয়ী । বাংলা
ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালির আজ যেটুকু গর্ব তা সবই তাঁদেরই কল্যানে এবং
আত্মত্যাগের মহিমায় তাঁরা চির উজ্জল হয়ে আছেন। সেই ক্ষেত্রে এপারের বাঙালিদের অবদান নেই বললেই চলে । ভাষাকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে আমাদের একবিন্দুও
রক্তক্ষয় হয়েছে কি? যা ওপার বাংলার মানুষ পেরেছে তা আমরা পারিনি। বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার্থে বাংলা নামে তাঁরা
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন। বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষাকে সগৌরবে
প্রতিষ্ঠা করতে যারা গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন তার সবটুকু কৃতিত্বই ওপার
বাংলার মানুষদের । ওদের ভূমিকাই সর্বাগ্রে পরিলক্ষিত হয়।
আর আমরা শুধু নীরবে চেয়ে থেকেছি মাত্র ।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার শুধু একটাই প্রশ্ন – বাংলা ভাষাকে নিজের বলে দাবি করার
অধিকার আমাদের আছে কি ? প্রকৃতপক্ষে এপার
বাংলার অগণিত মানুষ এখনো ইংরেজ পদ লেহনকারী হয়ে নিশ্চিন্ত নীরবে দিন যাপন করতে
ভালোবাসেন। আন্তরিক ভাবে বাংলা ভাষার
প্রতি তাঁদের একফোটাও অনুরাগ বা ককৃতজ্ঞতা বোধ নেই । তাঁদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শেখে ইংরেজি
মিডিয়ামে । বাংলা মিডিয়ামে লেখাপড়া শিখলে তাঁদের
যদি মানহানি হয় বা তাঁদের সন্তানরা যদি অমানুষ তৈরী হয় এই আশঙ্কায় তাঁরা
শঙ্কিত। সেই কারণে এদের মধ্যে অনেকেই আবার ঠাকুর্দার নাম পর্যন্ত জানে না। সুতরাং আক্ষেপের সুরে বলতেই হয় – ‘বাঙালি করেছো
মোদের মানুষ করনি’ । আমরা শুধু পিঁপড়েদের
মতো লাভের গুড় চেটে মরছি । মাতৃভাষা
বাংলার প্রতি সাধারণ মানুষের আজ আর কোন
আস্থা বা দায়-দায়িত্ব নেই।
প্রসঙ্গতঃ একটা কথা না বললেই নয়, আগের দিনে যে শিশুরা দাদু-ঠাকুমা বা
দাদু-দিদিমার শাসনে যৌথ পরিবারের আঙ্গিনায় মাতৃভাষা বাংলার পরিমন্ডলের মধ্যে বেড়ে
উঠেছিলেন তাঁরা সকলেই বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, হৃদয়বত্তায়, মস্তিস্কের উৎকর্ষতায়
এবং ত্যাগে অবিস্মরণীয় ও অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন তা সম্ভব
হয়েছিল আমাদের বিচারে যারা অশিক্ষিত নামে চিহ্নিত সেই সব মানুষদের সাণ্ণিধ্যে
তাঁদের বড় হয়ে ওঠার কারণে । তাঁরাই ছিলেন
প্রকৃত মানুষ গড়ার আসল কারিগর। তাই Captive Lady প্রনেতা স্বয়ং মাইকেল মধুসূদন দত্তকেও অবশেষে বাংলায় মহাকাব্য রচনা করতে
হয়েছিল । বিদেশী আদব কায়দায় লালিত স্বয়ং
ঋষি অরবিন্দ নিজের চেষ্টায় বাংলা ভাষাটিকে আয়ত্ত করেছিলেন, নিজের মাতৃভাষা না
জানার কারণে নিজেকে তিনি অপমানিত বোধ করতেন।
এরই নাম মাতৃভাষা বাংলার প্রতি ঐকান্তিক শ্রদ্ধা পোষণ। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বেলাতেও সেই একই কথা
। তিনি নিজের গরজে বাংলা শিখেছিলেন। এমন কি বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ
বসু বলেছিলেন –‘যাঁরা বলেন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয় তাঁরা হয় বাংলা জানেন না
অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না’ । অথচ এপার বাংলার বাঙালিরা ছলে-বলে-কৌশলে আমাদের
মাতৃভাষা বাংলাকে টুটি টিপে হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি অবিরত।
এখনকার বাঙালি ছেলে-মেয়েদের
শৈশবের পাঠ শুরু হয় ইংরেজি রাইমস্ দিয়ে।
বাংলা ছড়ায় অভিভাবকদের ঘোর অনীহা ।
তাঁদের মন ভরে না।
‘মোদের গরব, মোদের আশা
আ-মরি বাংলা ভাষা
তোমার কোলে,
তোমার বোলে,
কতই শান্তি ভালোবাসা...
অথবা
‘বাংলার মাটি, বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পূণ্য হউক পূণ্য হউক
পূণ্য হউক হে ভগবান.....’
এসব এখন অচল। শৈশবের অবশ্য পাঠ্য কবিতাগুলি নিয়ে ইদানীং কেউ আর
বড় একটা মাথা ঘামায় না। বইয়ের পাতাতেই
তারা সীমাবদ্ধ। নীরবে গড়াগড়ি খায় আর
অশ্রু বিসজর্ন করে ছোটবেলার সেই কবিতাগুলি । কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কথা বলা হয় যে ভাষায়,
তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা ভাষা এবং পৃথিবীর একমাত্র‘ সুমিষ্ট’ ভাষা হিসেবে বাংলা
ভাষাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে । অথচ
কীমাশ্চর্যম্ বাঙালি ছেলে-মেয়েরা কথার ফাঁকে হিন্দী ইংরেজি শব্দ প্রয়োগের দ্বারা
অবাঙালি টানে ময়ূরপুচ্ছধারী কাক সাজতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁদের কৃত্রিম আচরণে এমন একটা ভাব পরিলক্ষিত
হয় যেন বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি তাদের বিচারে তুলনায় অতি নগন্য ও তুচ্ছ। তাঁরা
আধুনিক হওয়ার তাড়নায় বদ্ধপরিকর অথচ তাঁরা জানেন না যে মাতৃভাষা না জানার অর্থ
অশিক্ষিতের লক্ষণ।
সত্যি বলতে প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষার
প্রতি আমরা আন্তরিক কোন দায়বদ্ধতা অনুভব করি না।
আমাদের যেটুকু আস্ফালন তা অন্যের কাছে মিথ্যে বাহবা কুড়িয়ে পাওয়ার
উদ্দেশ্যে, এর বাইরে আর কিছু নয়। যেমন
কোন বহুল জনপ্রিয় বাঙালি শিল্পী বা কবি-সাহিত্যিকের দেহাবসানের সংবাদ কর্ণগোচর হলে
মূহুর্তের শোক প্রকাশ জ্ঞাপন করে আমরা নিজেদের কর্তব্য পালন করি । বাঙালির তকমা ধারণ করে ঘুরে বেড়াই কিন্তু
বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে আমরা চির উদাসীন। আমরা পরম সুবিধেবাদী । একুশে ফেব্রুয়ারীকে কেন্দ্র করে আমরা আলোচনা
সভা, বক্তৃতা বা নিদেনপক্ষে কিছু লেখালেখি করতে পারি, কিন্তু কি লাভ? বাংলা ভাষার জন্যে প্রাণ দেওয়া দূরে থাক তাকে
টিকিয়ে রাখার দায়িত্বটুকু পর্যন্ত আমরা বহন করতে অপারগ । তাহলে আমাদের সত্যিকারের পরিচয়টা কি? এমনটা তো
নয় যে একদা কোন এককালে আমাদের
পূর্বপুরুষগণ বাঙালি ছিলেন বলে তাঁদের সৌজন্যে আজ আমরা বাঙালি নামে পরিচিত
! বাংলায় কথা বলতে পারাটাই কী বাঙালিয়ানার একমাত্র মাপকাঠি? এমন অনেক অ-বাঙালি আছেন যারা তথাকথিত বাঙালির
চেয়েও বাংলা ভাষাকে অন্তর থেকে বেশি ভালোবাসেন আর শ্রদ্ধা করেন । আমার মনে হয়
ইদানীং কালে তাঁরাই আসল বাঙালি। তাঁরাই
বাংলা ভাষার আসল ধারক ও বাহক। বাংলা ভাষা
অক্ষুণ্ণ থাকবে তাঁদেরই মাধ্যমে। আমরা কী বাঙালি ? আমাদের পরিচয় ঘরের শত্রু বিভীষণ হিসেবে । তৎসত্ত্বেও আমরা তাঁদের স্বীকৃতি দেই না । অথচ
যারা বংশানুক্রমিক ভাবে বাঙালি হয়েও বাংলা ভাষাকে অশ্রদ্ধা অবহেলা বা অবজ্ঞা
পূর্বক দূরে সরিয়ে রেখে হিন্দী ভাষাকে (তাঁরা জানেন না যে হিন্দী কোন ভাষাই নয়
কারণ হিন্দীর নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই) প্রাধান্য দেন বেশি তাঁরা আর যাই হোক
বাঙালি নন মোটেই । তবু আমরা তাঁদেরকে
বাঙালি বলে স্বীকৃতি দেই যারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে চির উদাসীন । বাংলা ভাষাকে যোগ্য সম্মান এবং মর্যাদা দেওয়ায় যারা
কুণ্ঠা বোধ করেন তারা বাঙালির কলঙ্ক । তাঁরা নিজবাসেই পরবাসী। তাঁরা বাঙালি বলে
দাবি করেন কোন সাহসে আমার তা জানা নেই । নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা যারা নিজের
মাতৃভাষায় কথা বলতে লজ্জা পায়, বাংলায় কথা বলতে গিয়ে যাঁদের জিভ্ আটকে যায় তাঁদের
কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্বই বা কি? তাঁদের
কাছে বাংলা ভাষার সপক্ষে কিছু বলতে যাওয়া মানে বৃথাই অরণ্যে রোদন ! এখানেই এপার
বাংলা এবং ওপার বাংলার মধ্যে বিশেষ তফাৎ ।
রাবীন্দ্রিক স্টাইলে তাঁরা প্রেম নিবেদনে পটু অথচ রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে
নারাজ । মোটা টাকার বিনিময়ে তাঁরা পদ্মার ইলিশ খেতে ভালোবাসেন অথচ ভাটিয়ালী গানে
অরুচি । বাংলা ভাষার এই দুর্দশার মূলে
যাদের অবদান অনস্বীকার্য তাঁরা হলেন আজকের দিনের অত্যাধুনিক ও শিক্ষিত বাঙালি
অভিভাবকেরা ।
বাংলা ভাষার এই দুর্দিনে একুশে
ফেব্রুয়ারী দিনটিকে স্মরণ করাও ধৃষ্টতা বলে মনে করি । এও এক প্রকার বিলাসিতা। বাংলা ভাষার প্রতি
আমাদের আন্তরিক টান কোথায়? বাহাণ্ণর একুশে ফেব্রুয়ারি অথবা একষট্টির উনিশে মে
যাঁরা ভাষা আন্দোলনে শহিদ হয়েছিলেন তাঁদের সম্পর্কে আমরা কতটুকু ওয়াকিবহাল? তাঁরা
আমাদের স্মৃতির আড়ালেই রয়ে গেলেন চিরতরে ।
ইতিহাসের পাতায় আমরা কেবল অপরাধী হয়ে রইলাম । এমন কি পরবর্তী প্রজন্মের
কাছে যে আশা করবো তাও দূরাশা । আমরা তাঁদের শিশুসুলভ মনের নিভৃত গহীন স্থানে
মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বীজ বপন করতে অসমর্থ । আসলে আমাদের গোড়ায় গলদ
। আমরা অধুনা নিজ সংস্কৃতি ভুলে অনুকরণ
প্রিয় হয়ে উঠেছি । আমরা নিঃসন্দেহে সামাজিক প্রাণী
হয়েও সমাজ বহির্ভূত । সমাজ বা এই জগৎটাকে নিয়ে ভাববার সময় কোথায় আমাদের ? সুতরাং বলতে বাধা নেই, রক্তে রাঙানো সেই দিনের
ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি আমরা বেমালুম ভুলে বসে আছি । তাই বাহাণ্ণর একুশে ফেব্রুয়ারি
অথবা একষট্টির উনিশে মে আমাদের জাতীয় জীবনে ক্যালেন্ডারের পাতায় সাধারণ দুটো দিন
ব্যতীত আর অন্য কিছু নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন