বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২২

আজ থেকে প্রকাশিত হবে অঙ্কুরীশা-র পাতায় ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস(পর্ব-১)।।...এবং ইরাবতির প্রেম।। গৌতম আচার্য।।Ankurisha।। E.Magazine।। Bengali poem in literature।।





ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস (পর্ব-১)


...এবং ইরাবতির প্রেম
 
গৌতম আচার্য



শুরুটি হয়েছিলো ভারী চমৎকার। ভাইজির সাহায্য নিয়ে সত্যেন ফেসবুকে তার এ্যাকাউন্ট খুললো জুন মাসে। নতুন এ্যাকাউন্ট। তার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারও। মূহুর্তে কোলকাতায় বসে ফ্রান্স শহরে বন্ধুত্ব স্হাপন। এক কথায় সত্যেন পুলকিত, শিহরিত।

তার কৈশোর যৌবনের শুরুতে মোবাইল ছিলো না। খাম, পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড আর সুযোগ বিশেষে ল্যান্ড ফোন-ই তখন ভরসা। তাও তো তাদের বাড়ি তে ল্যান্ড ফোন থাকলেও আশেপাশে অন্য কারও বাড়িতে ছিলো না। তাই এলাকার অনেক লোকজন এর আত্মীয় পরিজনেরা সত্যেনদের বাড়িতেই ফোন করতেন আর সত্যেন বা বাড়ির অন্য কেউ তাঁদের খবর দিতেন। যথারীতি তাঁরা তাদের বাড়িতে এসে কথা বলতেন দূরের কোন বন্ধু, আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে।

সত্যেনের ছোটবেলায় আর বিস্ময় বলতে যা ছিলো তা হচ্ছে পোস্ট অফিসে "খবর এসেছে- টক্কা- টরে" মার্কা টেলিগ্রাম। সেবার শ্যামবাজার পোস্ট অফিসে গিয়ে দিল্লীতে কাকার বাড়িতে টেলিগ্রাম করে সাফল্যের সঙ্গে তার দিল্লিতে যাওয়ার খবর পাঠিয়ে সত্যেন এমন ভাব করেছিলো যেন সে অর্জুন হয়ে কঠিন লক্ষ্য ভেদে দ্রৌপদীকে জয় করে দ্রৌপদীর হাত ধরে বাড়ি ফিরেছে।

একা একা টেলিগ্রাম করে এসে বাড়িতে বড়ো দের সন্দেহ, আশঙ্কার মধ্যে পড়েছিলো সত্যেন। বড়দা তাকে আগাপাশতলা প্রশ্নবানে ও নানাবিধ সন্দেহের বাতাবরণে জর্জরিত করেও একটা আশঙ্কায় ডুবে গেছিলেন, কারণ পোস্ট অফিসের কাগজে প্রিন্টটা একটু আবছা হওয়ায় ঠিক মতোন বোঝা যাচ্ছিলো না।

ঘন্টাব্যাপী আশঙ্কার মেঘ কাটলো যখন দিল্লি থেকে সত্যেনদের কাকু ট্রাঙ্ককল করে টেলিগ্রাম পাওয়ার কথা বললেন। এবং সেই সঙ্গে তিনি যে দিল্লি ষ্টেশন থেকে সত্যেনকে রিসিভ করবেন তাও নিশ্চিত করলেন। আর এই ঘটনার মাধ্যমে সত্যেন যে টেকনোলজিতে অসম্ভব পারদর্শী হয়ে পড়েছে এবং এখন থেকে এই বিষয়ে তার ওপরে ভরসা করা যায়, তা মূহুর্তে অতি সহজে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে নিলেন।

টেকনোলোজিতে মাষ্টারপিস্ সত্যেনকে মা যে একা একা বোম্বাই পাঠাতে রাজি ছিলেন না, তাও অনেক খানি  কেটে গেলো টেলিগ্রাম করতে পারার এমন বিরল পারদর্শিতার পরিচয় রেখে। আর অবশেষে, হাজার সাবধানতার পরামর্শ সঙ্গে নিয়ে সব সমস্যা ডিঙিয়ে শেষ পর্যন্ত নিরাপদে দিল্লি পৌছে এবং সেখান থেকে ফের সঠিকভাবে বাড়িতে ফিরে এসে সত্যেন সেই বার তার বয়স যাই হোক না কেন, তার মানসিক সাবালকত্বের প্রমাণ তুলে ধরলো সকলের কাছে।

সেই সত্যেন ফেসবুক এ্যাকাউন্টে একমাস পূর্তি লগ্নে হঠাৎ আবিস্কার করলো ইরাবতিকে। ফেসবুক অন্ করেই "people you may know" তে চোখ আটকে গেলো সত্যেনের। ইতিমধ্যেই পুরুষ- নারী মিলিয়ে প্রায় দেড় শতাধিক বন্ধুলাভ তার হয়ে গেছে।। কোন সেই সূদুর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একেবারে বাড়ির পাশের টালা পার্ক বা শ্যামবাজার সর্বত্র তার বন্ধুদের বসবাস।আর সকাল সন্ধ্যে 'গুড মর্নিং', 'গুড নাইট' আর 'গুড ইভনিং' তার একটি নেশায় পরিনত হয়ে গিয়েছে। কতো বন্ধু তো "শুভ দুপুর" বলতেও কসুর করেন না।। সম বয়স্ক, ছোট, তরুণ- তরুণী, যুবক বা যুবতী- সব।

সত্যেন ভালো ভাবে ইরাবতির প্রোফাইলটিকে লক্ষ্য করে ইরাবতির ছবিতে আঙুল ছোঁয়াতেই লুকিয়ে থাকা ইরাবতির প্রোফাইল খুলে গেলো।। মুগ্ধ সত্যেন প্রায় গিলে ফেলা মুগ্ধতায় ইরাবতির বিভিন্ন ভঙ্গিমায় লাইন দিয়ে সাজানো ছবি গুলোকে অধীর আগ্রহে দেখতে শুরু করলো।।

আশ্ যেন মেটেনা সত্যেন এর।। তার মনের ভেতরে উপলব্ধি শুরু হলো, "এ্যতোদিন পর পেলাম আমি তাকে, যাকে আমি খুঁজে গেছি সারাজীবন"।। বেশ একটি প্রেম প্রেম ভাব জেগে উঠলো সত্যেন এর মনের মধ্যে।। অনেকটা সময় ধরে ইরাবতির ছবি গুলো দেখা শেষ করে অদ্ভুৎ একটি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করলো সত্যেন।। দেখি তো কোথায় থাকে, কি করে, কেমন প্রোফাইল?

চোখটা ফের আটকে গেলো সত্যেনের।। ম্যারাইটাল স্ট্যাটাসে লেখা "Widowed". মূহুর্তে বুকের মধ্যেটায় একটি চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে আরম্ভ করেছে সত্যেন।। চোখের ওপর ভেসে আসতে শুরু করেছে সিঁদুর পড়া ইরাবতির প্রাণোচ্ছ্বল মুখটা।। কেমন যেন একটা সহানুভূতি জেগে উঠছে সত্যেনের মধ্যে।।

একরাশ দুঃখ বুকের ভেতরে জমতে শুরু করেছে।। ইরাবতির সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে সত্যেন মনে মনে বললো, আজই তোমায় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আমি পাঠাবো অবশ্যই , আর তুমি যদি আমায় এ্যাকসেপ্ট করো, যদি অ্যালাউ করো আমাকে, তোমায় আমার সব দিয়ে ভালোবাসবো, তোমায় সুখী করে তোলাই হবে আমার একমাত্র লক্ষ্য।।

সত্যেনের মনের ভেতরটা কেমন দুঃখে ভরে ওঠে---- এই বয়সেই "Widowed"? একদম অন্তর ছুয়ে যাচ্ছে সত্যেনের।। না বলতে পারা একটি ব্যথায় ভরে যাচ্ছে সত্যেনের বুক।। "তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো ইরাবতি---" খুব আস্তে আস্তে, কেউ যেন শুনতে না পায় তেমন ভাবে ছবির ইরাবতির দিকে তাকিয়ে উচ্চারন করে সত্যেন।। সব দ্বিধা কাটিয়ে টিপে দেয় ফেসবুকে (ফ্রেন্ড) রিকোয়েস্ট লেখাটায়।।

বুকের ভেতরটা ঢিপ্ ঢিপ্ করে আওয়াজ করতে শুরু করেছে।। দ্রুত থেকে অতি দ্রুত হয়ে ওঠেছে হৃদস্পন্দন।। আশা- আশঙ্কার দোলায় ভাবছে সে, ইরাবতি আমার রিকোয়েস্ট এ্যাক্সেপ্ট করবে তো? আবার আমাকে সে পার্ভাটেড্ ভেবে নেবে নাতো? যদি রিকোয়েস্ট ডি ক্লাইন করে দেয়? তাহলে তো একদম প্রেস্টিজ শেষ।। তার স্বপ্ন দেখা বেকার হয়ে যাবে।।

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সময় কেটে যাচ্ছে সত্যেন এর।। না এখনও কোন হ্যাঁ- না কিছু আসে নি।। ফের ইরাবতির প্রোফাইলটা খোলে সত্যেন।। ছবি গুলো দেখতে থাকে বারবার।। দেখতে থাকে "Widowed" শব্দ টা।। সহমর্মিতা মেশানো তার হাত বুলিয়ে দেয় শব্দটার ওপর, ছবি গুলোর ওপর।। নিজেই ইরাবতি র পাশে থাকার অঙ্গীকারকে স্বীকৃতি দেয়।। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ইরাবতির ছবির দিকে।।

একটু সময় পর পর ইরাবতির ছবি গুলো অন্ধকার হয়ে আসছে।। মূহুর্তে আঙুল ঠেকিয়ে মোবাইলের আলো আবার ফুটিয়ে তোলে সত্যেন।। আজ সে কিছুতেই মোবাইল অন্ধকার হতে দেবে না।। তার শুধু মনে হয়, এতোদিন ধরে যাকে সে খুঁজে ফিরেছে আজ তার দেখা সে পেয়েছে।।

সময় পার হতে থাকে।। কখন যে দেড়টা বেজে গেছে ঠাহর- ই করেনি সত্যেন।। রান্নার দিদা চিৎকার করে বলে ওঠেন, দেড়টা বেজে গেলো, এখনও স্নানের কোন বালাই নেই, কখন খাওয়া হবে? মোবাইল, মোবাইল আর মোবাইল।। আমি কিন্তু বসে থাকতে পারবো নাকো।। সত্যেন তাড়াতাড়ি মোবাইল রেখে উঠে দাঁড়ায়।। দিদা বলেন, এবার আমি যাচ্ছি, দয়া করে দরজাটা দিয়ে দাও।। তারপর আগে স্নান করো, খাওয়া দাওয়া করো, তারপর না হয় আবার ধ্বজা নিয়ে বসবে।।

সত্যেন মাথা নিচু করে বলে, হ্যাঁ ঠিক আছে, তুমি যাও দিদা, আমি এখনই স্নান খাওয়া সেরে নিচ্ছি।। এ্যতো বেলা হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।।
-- হ্যাঁ বুঝবে কি করে? বৌদি তো আগে ভাগে হঠাৎ চলে গেলেন আর তোমায় তো চব্বিশ ঘন্টা মোবাইল টিপতে হবে।। এরকম করলে শরীর ঠিক থাকবে?
-- বললাম তো সব করে নিচ্ছি।।
-- হ্যাঁ এখন আগে স্নান করে, খেয়ে তারপর তোমার যা ইচ্ছা করবে।।

আসলে সত্যেনের স্ত্রী রীতার সময় থেকেই রাঁধুনির কাজ করেন এই বুড়ি দিদা।। রীতা বেঁচে থাকতে রীতার উপরে খবরদারি করতেন।। আকস্মাৎ রীতা মারা যাওয়ার পর ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন।। এখন রীতা নেই।। তাই খবরদারি এসে পড়েছে সত্যেন এর উপর।। সত্যেন-ও তার জন্য কিছু মনে করে না।। কেউ নয়, আসলে মাস মাইনের ঠিকা রাঁধুনি, তবুও কেমন যেন আত্মীয় হয়ে উঠেছে।। বরং অনেক আত্মীয় থেকেও বেশি।। তার বাড়িতে কচু ডাটার তরকারী হলে বাটি ভরে নিয়ে আসে, কখনও গাঁটি কচুর তরকারী--- সত্যেন খুব ভালো বাসে দুটোই।।

চলবে....











এই ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাসটি প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার   অঙ্কুরীশা-র  পাতায় প্রকাশিত হবে। আপনারা পড়ুন এবং মতামত দিন।


২টি মন্তব্য: