ধারাবাহিক ভ্রমণকথা(পর্ব-২৯)
পৃথিবীর উল্টো পিঠ
বিশ্বেশ্বর রায়
এখন চলছে আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন রোমানি মিটের (Romany Mitt)এর সঙ্গে। এখন ওঁদের দু'জনের সঙ্গে প্রতিদিনই চলছে বিতর্ক(debate)। এই বিতর্কের মধ্যে থাকে না কোনও ঝগড়াঝাঁটি, কথার উপর কথা বলা। একজনের বক্তব্যের মধ্যে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে অন্যজনের বক্তব্য পেশ, উত্তেজনা, উচ্চরোলে গলা তুলে আস্ফালন বা অন্যকে যেনতেনপ্রকারেণ বিরক্ত করা এসব কিছুই ঘটে না। খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ বা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে বিতর্ক চলে। এক এক জনের জন্য যে সময় বরাদ্দ থাকে (যেমন দু'মিনিট বা তিন মিনিট) তার মধ্যে একজন তাঁর বক্তব্য বা প্রশ্ন পেশ করেন। পরে অন্যজনও তাঁর জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁর বক্তব্য, যুক্তি পরিসংখ্যান সহযোগে তুলে ধরেন। আবার প্রথমোক্তজন দু'মিনিটে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। দ্বিতীয়জনও ওই দু'মিনিটেই তা খণ্ডন করেন বা প্রতিযুক্তি সহযোগে তাঁর বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই চলতে থাকে বিতর্ক। আমাদের দেশে যেমন একজন বক্তব্য বলেই চলেন তো বলেই চলেন। অন্যকে বলার সুযোগই দেন না বা তাঁর বক্তব্যের মাঝখানে কথা বলতে থাকেন। ফলে দেখা দেয় উত্তেজনা, গোলমাল, কথা কাটাকাটি। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় আলোচনাটাই পণ্ড হয়ে যায়। একটা হযবরলভাবে অনুষ্ঠানটা শেষ হয়। এক এক জন ভাবেন যে তিনিই শ্রেষ্ঠ বক্তা,জ্ঞানী বা বিজ্ঞ। অন্যজন বা অন্যরা নেহাতই এলেবেলে। তাদের বক্তব্য তাঁর বা দর্শক-শ্রোতাদের শোনার প্রয়োজন নেই। তাঁর জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যই শ্রোতারা শুনবেন।
এখানেই আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে এদেশের নেতা-নেত্রীদের পার্থক্য। আমাদের দেশের নেতা -নেত্রীদের মানসিকতার সঙ্গে এঁদের মানসিকতার আকাশপাতাল পার্থক্য। মনে যাই থাক না কেন রাজনৈতিক লড়াই খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে এখানে সম্পন্ন হয়। বড়ো বড়ো জনসভা করে, উচ্চরোলে যাতা বক্তব্য পেশ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ এখানে নিতান্তই কম। কারণ, এখানে যে পরিসংখ্যান ওঁরা পেশ করেন তা হতে হয় নির্ভুল, তথ্যনিষ্ঠ। যাহোক মনগড়া কিছু বলে আসর গরম করা নয়। তাই শেষ পর্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে তাঁদের বিতর্ক শেষ হয়। শুরুর সময় যেমন করমর্দন ও আলিঙ্গন দিয়ে আলোচনা শুরু হয়, শেষেও দেখা যায় একই দৃশ্য। তারপর তাঁরা উপস্থিত শ্রোতা ও দর্শকদের সঙ্গেও করমর্দন করেন, সৌজন্য বিনিময় করেন। এসবই শিক্ষণীয়। একটা দেশ এমনি এমনি উন্নত হয়নি, পৃথিবীর সেরা দেশ হয়নি। তারজন্য শুধু অর্থ নয়, আরও বহুবিধ ফ্যাক্টর বা অনুসঙ্গ কাজ করে। এদের শিক্ষা-দীক্ষা, ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ, সৌন্দর্যবোধ, পরিবেশচেতনা সবকিছুর মধ্যেই আছে এক শালিনতা এবং সচেতন ভাবনা। সর্বোপরি এখানকার গ্রাম এবং শহরের মধ্যে বৈষম্য খুবই কম। শহরের মানুষ যে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে গ্রামের মানুষও প্রায় তার সবকিছুই পায়। যেমন--এখানে শহরের মানুষের সবারই গাড়ি আছে, ঘরে ঘরে এ সি, হিটার, কার্পেট, গ্যাস, বাথটাব, টিভি, ফ্রিজ,মাইক্রোওয়েভ ইত্যাদি আধুনিক জীবনযাত্রার যাবতীয় সরঞ্জাম যেমন আছে, গ্রামের মানুষদেরও প্রায় প্রত্যেকেরই এসব আছে। একটু ঊনিশ-বিশ। ভালো স্কুল একটু দূরে, শহরের চাকচিক্য একটু কম, এই যা। সর্বোপরি গাঁইয়া, চাষা, ছোটলোক, নিম্নবর্গ, পিছড়েবর্গ, অচ্ছুত, এস টি, এস সি, ও বি সি, বামুন, কায়েত, বৈশ্য, শূদ্র ইত্যাদি সহস্রবিধ বিভাজন নেই। এখানের অফিসে চাকরিতে যোগ দিলে প্রথমেই যে কটি রুল বা আইন বা নিয়ম খুবই কঠোরভাবে মানতে বলা হয় তার অন্যতম হল কোনও মানুষকেই হেয় করা চলবে না, অসম্মান করা তো ভীষণ গর্হিত অপরাধ। চাকরিই চলে যেতে পারে। সব মানুষ সমান এই বোধ এখানকার প্রতিটি মানুষের অন্তরে গেঁথে দেওয়া হয়। কেউ কাউকে তাই হেয় বা অসম্মান করার চিন্তাও করে না ভুল করেও। তাই উচ্চমন্যতা বা হীনম্মন্যতা এখানে নিতান্তই বিরল। তবুও কিছু মানুষের মধ্যে যে ভেদবুদ্ধি নেই তা সর্বাংশে বলা যাবে না। অবশ্য তা শুধু কালো( black) আর ধলোর (white) সীমায় আবদ্ধ। ঠিক তার উল্টো চিত্র দেখা যায় আমাদের দেশে। বামুন, কায়েত, বদ্যি, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, মাহিষ্য, বারুজীবী, তিলি, কামার, কুমোর, চাষা, জেলে, ধোপা, নাপিত, তপশীল ইত্যাদি সহস্রবিধ বিভাজনে মানুষ বিভক্ত। এক জাতি বা গোষ্ঠী অন্য জাতি বা গোষ্ঠীকে হেয় করে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে। তাই কখনও 'এক জাতি এক প্রাণ' হয়ে উঠতে পারেনি ভারতবর্ষ। যেন বৈষম্যের এক হিমালয় পর্বত বয়ে চলেছে ভারতবাসী যুগযুগান্ত ধরে। আরও কত যুগ বয়ে চলবে তা কেউ জানে না। যতদিন না এই বৈষম্য ঘুচবে ততদিন ভারতবর্ষের সার্বিক উন্নতির কোনও আশা নেই। যুগে যুগে কত ভগবান, মহাপুরুষ, যুগাবতার, সংস্কারক তো আমাদের দেশে জন্মেছেন কিন্তু কেউই বৈষম্য ঘোচাতে পারেননি। আর এদেশে একমাত্র যীশু সবকিছু একাকার করে দিয়েছেন।
(চলবে...)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন