ধারাবাহিক ভ্রমণ কথা(পর্ব-৩০)
পৃথিবীর উল্টো পিঠ
বিশ্বেশ্বর রায়
আমরা মুখেই বলি---সব মানুষ সমান, সবাই একই পরমাত্মার থেকে সৃষ্ট, সবার মধ্যেই ভগবানের অধিষ্ঠান, সবাই 'অমৃতস্য পুত্রাঃ'; কিন্তু আদতে তা নয়। তাই আজও দেখি এক জাতের সঙ্গে অন্য জাতের বৈবাহিক মিলনে শত বাধা। যারা নিজেদের উঁচু জাত বলে ভাবে তাদের সঙ্গে তথাকথিত কোনও নীচু জাতের ছেলেমেয়ের প্রেমঘটিত বিবাহও মেনে নিতে পারে না উচ্চমন্যরা। ত্যাজ্যপুত্র বা ত্যাজকন্যা তো আছেই, তার উপর আছে বিবাহ বিচ্ছেদ। তাতেও রাগ না মিটলে আছে খুনোখুনি। তাই সবাই সমান, সবাই অমৃতের পুত্র, সবার মধ্যে ভগবানের অধিষ্ঠান--এসবই কথার কথা হয়েই রয়ে গেল। মান্যতা দেয় না কেউ। তাই পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে দেখা যায় বিভাজন-- ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, বৈশ্য,পৌণ্ড্র, নম:শূদ্র, তিলি, কর্মকার, নাপিত, বারুজীবী, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, উপজাতি ইত্যাদি সহস্রবিধ বিভাজন। এবং বহুক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে বলা থাকে 'জাতিভেদ নাই, তবে এস সি, এস টি বাদে।' কী নির্মম পরিহাস, কী অবমাননাকর, কী জঘন্য আত্মশ্লাঘা! তাই এই দেশ পিছনে ছাড়া এগোবে কিভাবে! কবির ভাষায়--'যারে তুমি নীচে ফেলো সে তোমাকে পশ্চাতে টানিছে।' এই বিপরীতমুখী আকর্ষণে কেউ কি এগিয়ে যেতে পারে! অনেকেই বলেন যে, তাঁরা এসব মানেন না, তবে সমাজে তো বাস করতে হবে! সমাজের অন্যরা কী ভাববে? নিজেরা পতিত বা নিম্নগামী হয়ে গেল না তো! এসব ভেবেই ক্ষান্ত হয় সংস্কারে।
আজ গিয়েছিলাম শার্লটের একমাত্র দুর্গাপুজো দেখতে। 'প্রবাসী অব শার্লট' এই পুজোর উদ্যোক্তা এবং আয়োজক। বাবাই আগেই ফোনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুজোর স্থান-কাল ইত্যাদি জেনে নিয়েছিল। এখানে শনিবার ও রবিবার এই দু'দিনেই পাঁচ দিনের পুজো সারা হয়। সমগ্র ইউ এস এ-তেই এই ব্যবস্থা। সন্ধে ছটায় সন্ধিপুজোর পর শুরু হয় বিচিত্রানুষ্ঠান, পরে নৈশাহার। ভারতের নাম করা শিল্পী, বিশেষত কলকাতার শিল্পীদের প্রাধান্য থাকে। পুজোমণ্ডপে পৌঁছে আলাপ হল কৌশিক, স্বপন, কেয়া প্রমুখ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। শার্লটের আগে দু'টো পুজো হত। এবছর থেকে একটাই। অন্য উদ্যোক্তারা হাল ছেড়ে দিয়ে 'প্রবাসী অব শার্লট'-এর নৌকায় চড়েছেন। পুরোহিতের নাম অজয় চক্রবর্তী। সন্ধিপুজোর পর শুরু হল বিচিত্রানুষ্ঠান। সবই ঘরোয়া। একদম বাচ্চা থেকে শুরু করে সত্তরোর্ধ অনেকেই নাচ, গান ইত্যাদি পরিবেশন করলেন। কয়েকটি অনুষ্ঠান--বিশেষত দু'টি নাচের এবং তিন-চারজনের গানের অনুষ্ঠান খুবই উচ্চস্তরের হল। ভাবতেও পারিনি শুধুমাত্র প্রবাসী বাঙালিরা এখানে এমন মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান উপস্থাপিত করতে পারেন। কলকাতা থেকে আসার সময় আমার লেখা দু'টি বইয়ের কয়েকটি কপি এবং 'প্রগতি সাহিত্য পত্র' পত্রিকার কয়েকটি কপি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো সংগঠকদের হাতে তুলে দিলাম। ওখানেই স্টেজে বই ও পত্রিকাগুলো হাতে হাতে বিলি করা হল। ওঁদের বাৎসরিক স্যুভেনির দেখলাম। লেখা বিনিময়ের কথা বললাম। ওঁরা আপাতভাবে তো আগ্রহ দেখালেন। জানি না পরবর্তীতে কী হবে!
আজ রবিবার, বাবাই-এর ছুটি আছে। আগেই ঠিক ছিল আমরা 'The Great Smokee Mountain' দেখতে যাব। পরিকল্পনা অনুযায়ী বেশ সকালে বেরিয়ে পড়া গেল। দীর্ঘ পথ। যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় ছ'শো কিলোমিটার পথ। আমরা রাত্রিবাস করবো না, আজই ফিরে আসবো। প্রথমে পৌঁছালাম চেরোকীতে। ওখানে বেশ কিছু রেড ইন্ডিয়ান আছেন। তাঁদের কিছু শিল্পকলার নিদর্শন এবং মূর্তি দেখা হল। কয়েকটা ছবি তোলা হল।
তবে এই দীর্ঘ ভ্রমণের অন্য যে আকর্ষণ তা হল গাছে গাছে পাতায় পাতায় বিচিত্র রঙের খেলা উপভোগ করা। আগেই বলেছি অক্টোবর-নভেম্বর মিলিয়ে পনেরো-কুড়ি দিন চলে এই রঙের চমক। যাকে এখানে বলে Fall Foliage. বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে 'ঝরা পাতার রংবাহারি' বা 'পাতায় পাতায় রঙের খেলা'। সারা দিনের ভ্রমণ, দ্রষ্টব্য, খাওয়াদাওয়া, পথচলা সেরে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটা বাজলো। ঘরে ফিরে জানতে পারলাম বাংলা সাহিত্যজগতের এক নক্ষত্র পতন ঘটেছে। 'কাকাবাবু' স্রষ্টা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অকস্মাৎ চলে গেছেন। বাংলা সাহিত্যজগতের এই মহীরূহ পতনে যে বাংলা সাহিত্য যে বহুলাংশে দরিদ্র হবে তা বলাই বাহুল্য।
বিশ্বেশ্বর রায়
আমরা মুখেই বলি---সব মানুষ সমান, সবাই একই পরমাত্মার থেকে সৃষ্ট, সবার মধ্যেই ভগবানের অধিষ্ঠান, সবাই 'অমৃতস্য পুত্রাঃ'; কিন্তু আদতে তা নয়। তাই আজও দেখি এক জাতের সঙ্গে অন্য জাতের বৈবাহিক মিলনে শত বাধা। যারা নিজেদের উঁচু জাত বলে ভাবে তাদের সঙ্গে তথাকথিত কোনও নীচু জাতের ছেলেমেয়ের প্রেমঘটিত বিবাহও মেনে নিতে পারে না উচ্চমন্যরা। ত্যাজ্যপুত্র বা ত্যাজকন্যা তো আছেই, তার উপর আছে বিবাহ বিচ্ছেদ। তাতেও রাগ না মিটলে আছে খুনোখুনি। তাই সবাই সমান, সবাই অমৃতের পুত্র, সবার মধ্যে ভগবানের অধিষ্ঠান--এসবই কথার কথা হয়েই রয়ে গেল। মান্যতা দেয় না কেউ। তাই পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে দেখা যায় বিভাজন-- ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, বৈশ্য,পৌণ্ড্র, নম:শূদ্র, তিলি, কর্মকার, নাপিত, বারুজীবী, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, উপজাতি ইত্যাদি সহস্রবিধ বিভাজন। এবং বহুক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে বলা থাকে 'জাতিভেদ নাই, তবে এস সি, এস টি বাদে।' কী নির্মম পরিহাস, কী অবমাননাকর, কী জঘন্য আত্মশ্লাঘা! তাই এই দেশ পিছনে ছাড়া এগোবে কিভাবে! কবির ভাষায়--'যারে তুমি নীচে ফেলো সে তোমাকে পশ্চাতে টানিছে।' এই বিপরীতমুখী আকর্ষণে কেউ কি এগিয়ে যেতে পারে! অনেকেই বলেন যে, তাঁরা এসব মানেন না, তবে সমাজে তো বাস করতে হবে! সমাজের অন্যরা কী ভাববে? নিজেরা পতিত বা নিম্নগামী হয়ে গেল না তো! এসব ভেবেই ক্ষান্ত হয় সংস্কারে।
আজ গিয়েছিলাম শার্লটের একমাত্র দুর্গাপুজো দেখতে। 'প্রবাসী অব শার্লট' এই পুজোর উদ্যোক্তা এবং আয়োজক। বাবাই আগেই ফোনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুজোর স্থান-কাল ইত্যাদি জেনে নিয়েছিল। এখানে শনিবার ও রবিবার এই দু'দিনেই পাঁচ দিনের পুজো সারা হয়। সমগ্র ইউ এস এ-তেই এই ব্যবস্থা। সন্ধে ছটায় সন্ধিপুজোর পর শুরু হয় বিচিত্রানুষ্ঠান, পরে নৈশাহার। ভারতের নাম করা শিল্পী, বিশেষত কলকাতার শিল্পীদের প্রাধান্য থাকে। পুজোমণ্ডপে পৌঁছে আলাপ হল কৌশিক, স্বপন, কেয়া প্রমুখ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। শার্লটের আগে দু'টো পুজো হত। এবছর থেকে একটাই। অন্য উদ্যোক্তারা হাল ছেড়ে দিয়ে 'প্রবাসী অব শার্লট'-এর নৌকায় চড়েছেন। পুরোহিতের নাম অজয় চক্রবর্তী। সন্ধিপুজোর পর শুরু হল বিচিত্রানুষ্ঠান। সবই ঘরোয়া। একদম বাচ্চা থেকে শুরু করে সত্তরোর্ধ অনেকেই নাচ, গান ইত্যাদি পরিবেশন করলেন। কয়েকটি অনুষ্ঠান--বিশেষত দু'টি নাচের এবং তিন-চারজনের গানের অনুষ্ঠান খুবই উচ্চস্তরের হল। ভাবতেও পারিনি শুধুমাত্র প্রবাসী বাঙালিরা এখানে এমন মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান উপস্থাপিত করতে পারেন। কলকাতা থেকে আসার সময় আমার লেখা দু'টি বইয়ের কয়েকটি কপি এবং 'প্রগতি সাহিত্য পত্র' পত্রিকার কয়েকটি কপি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো সংগঠকদের হাতে তুলে দিলাম। ওখানেই স্টেজে বই ও পত্রিকাগুলো হাতে হাতে বিলি করা হল। ওঁদের বাৎসরিক স্যুভেনির দেখলাম। লেখা বিনিময়ের কথা বললাম। ওঁরা আপাতভাবে তো আগ্রহ দেখালেন। জানি না পরবর্তীতে কী হবে!
আজ রবিবার, বাবাই-এর ছুটি আছে। আগেই ঠিক ছিল আমরা 'The Great Smokee Mountain' দেখতে যাব। পরিকল্পনা অনুযায়ী বেশ সকালে বেরিয়ে পড়া গেল। দীর্ঘ পথ। যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় ছ'শো কিলোমিটার পথ। আমরা রাত্রিবাস করবো না, আজই ফিরে আসবো। প্রথমে পৌঁছালাম চেরোকীতে। ওখানে বেশ কিছু রেড ইন্ডিয়ান আছেন। তাঁদের কিছু শিল্পকলার নিদর্শন এবং মূর্তি দেখা হল। কয়েকটা ছবি তোলা হল।
তবে এই দীর্ঘ ভ্রমণের অন্য যে আকর্ষণ তা হল গাছে গাছে পাতায় পাতায় বিচিত্র রঙের খেলা উপভোগ করা। আগেই বলেছি অক্টোবর-নভেম্বর মিলিয়ে পনেরো-কুড়ি দিন চলে এই রঙের চমক। যাকে এখানে বলে Fall Foliage. বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে 'ঝরা পাতার রংবাহারি' বা 'পাতায় পাতায় রঙের খেলা'। সারা দিনের ভ্রমণ, দ্রষ্টব্য, খাওয়াদাওয়া, পথচলা সেরে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটা বাজলো। ঘরে ফিরে জানতে পারলাম বাংলা সাহিত্যজগতের এক নক্ষত্র পতন ঘটেছে। 'কাকাবাবু' স্রষ্টা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অকস্মাৎ চলে গেছেন। বাংলা সাহিত্যজগতের এই মহীরূহ পতনে যে বাংলা সাহিত্য যে বহুলাংশে দরিদ্র হবে তা বলাই বাহুল্য।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন