বৃহস্পতিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব--২)।। ট্রেকিংয়ের পথে রহস্য — অনন্যা দাশ।। Ankurisha ।। E.Magazine ।। Bengali poem in literature ।।




ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব--২)

ট্রেকিংয়ের পথে রহস্য


অনন্যা দাশ

যথা সময়ে অঙ্কন ভজা আর কেভিনকে নিয়ে অকশানে গিয়ে হাজির হল। সেখানে নিজের মামা মিস্টার লরেন্স (ল্যারি) সেভিলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল কেভিন। উনি এককালে পুলিশে কাজ করতেন। আসলে অকশানটাও পুলিশের বাজেয়াপ্ত করা গাড়িরই।  

“এই আমার বন্ধু অঙ্কন আর ভজা। ভজা একটা গাড়ি কিনতে চায়।”

“গাড়ি কিনবে? বাহ, বাহ! আমার এখানে গাড়ি, মোটরসাইকেল, ফার্নিচার আছে, এমনকি নৌকা পর্যন্ত আছে। সব কিছু অকশান করি আমরা। অনেক সময় সাইলেন্ট অকশানও হয়। চিৎকার না করে সবাই যে দাম দিতে চায় সেটা একটা কাগজে লিখে দেয় তারপর যে সব চেয়ে বেশি দাম লেখে সেই জেতে।”

অঙ্কন বলল, “ও ওই রকম সাইলেন্ট অকশান আমাদের কলেজেও মাঝে মাঝে হয়।” 

খ্যাক খ্যাক করে হাসলেন কেভিনের মামা, বললেন, “তা নিশ্চয়ই হয় কিন্তু সেই সব জিনিসের মালিকেরা চোর, ডাকাত বা স্মাগলার হয় কী? আমাদের এখানে কিন্তু তাই। সব বাজেয়াপ্ত করা জিনিস। যাই হোক আজ এখানে বেশ কয়েকটা ভালো ভালো গাড়ি আছে। চলো আমার সঙ্গে তোমাদের দেখাচ্ছি।”  

একটা বিশাল পার্কিং লটের মতন জায়গা জুড়ে বেশ কিছু গাড়ি, কয়েকটা মোটরসাইকেল আর দুয়েকটা নৌকা রয়েছে।  


কেভিনের মামা বকবক করতে ভালোবাসেন মনে হয়। তিনি বললেন, “আমাদের এখানে যা কিছু দেখছ সেই সব জিনিসের মালিক হয় কোন গ্যাংয়ের সদস্য বা কিছু বাজে কাজ করে বেশ কিছুদিনের জন্যে জেলে পচছে বা বেয়াইনি ভাবে অর্থ উপায় করে দামি গাড়ি কিনে ফেলেছিল কিন্তু তারপর ধরা পড়ে গেছে তাই গাড়ি বাজেয়েপ্ত করা হয়েছে এই রকম আর কী। যাই হোক এখানে যা গাড়ি আছে আমি প্রতিটার ঠিকুজি কুলুজি সব জানি। প্রত্যেকটা গাড়ি এক একটা অপরাধের ইতিহাস বুকে করে নিয়ে মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। তোমরা ঘুরে ঘুরে দেখো, কোন গাড়ি পছন্দ হলে আমাকে জিজ্ঞেস কোরো,আশা করছি সেটার সম্বন্ধে যা জানার সব কিছু বলতে পারব।”  

অঙ্কন একটা টুকটুকে লাল ঝকঝকে করভেট গাড়ি দেখিয়ে বলল, “এটার কী গল্প?”

“এটা, এটা...লাল করভেট।।দাঁড়াও দাঁড়াও মনে পরেছে। এটা টনি মারসেলার গাড়ি। টনি লোকটা এক নম্বরের শয়তান। মাদক দ্রব্য বিক্রি করে এই রকম একটা নয় অনেকগুলো দামি দামি গাড়ি কিনে বসেছিল। খুব বেশি চালায়ওনি, মাত্র কুড়ি হাজার মাইল। কিনবে নাকি এটা? দারুণ গাড়ি কিন্তু!”  

অঙ্কনের গাড়িটাকে বেশ পছন্দ হয়েছিল কিন্তু ভজা কিছুতেই লাল গাড়ি কিনতে রাজি হল না। ভজা একটা মোটর সাইকেল দেখছে দেখে কেভিনের মামা বললেন, “এটা কিন্তু সাংঘাতিক একটা জিনিস। এর যে মালিক সে মোটর সাইকেল গ্যাংয়ের লিডার ছিল। ভয়ঙ্কর রাগ তার। কারো ওপর খেপে গেলে তাকে এই মোটর সাইকেলে পিছনে বেঁধে টেনে নিয়ে যেত, ভাবতে পারছ কী বীভৎস!”

“ওই সবুজ গাড়িটার মালিক জেলে। কিছুদিন পরেই ফাঁসি হবে...” 

ভাজা হাত তুলে ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “সত্যিই আপনি অনেক জানেন প্রতিটা গাড়ি সম্পর্কে কিন্তু কার গাড়ি ছিল সেটা জানা আমার কাছে তেমন জরুরি নয় যতটা গাড়িটা পছন্দ হওয়াটা। আমরা না হয় একটু ঘুরে দেখি। প্রতিটা গাড়ির দাম, মাইলেজ ইত্যাদি তো দেওয়াই রয়েছে দেখছি। যদি কিছু পছন্দ হয় তাহলে আমরাই আপনাকে খুঁজে নেব। আপনি এই আশপাশেই থাকবেন তো?” 

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি এখানেই থাকব। নয়তো কেভিনের কাছে আমার নম্বর আছে, একটা কল করে দিও তাহলেই আমি চলে আসব,” বলে মিস্টার সেভিল চলে গেলেন।

ভজা ঘুরে ঘুরে গাড়িগুলোকে দেখতে লাগল। ওর পিছন পিছন অঙ্কন আর কেভিন।  

একটা নীল রঙের লেক্সাস ওর খুব পছন্দ হয়েছিল কিন্তু তারপর দেখা গেল দামটা ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। এমনিতে গাড়িগুলো তাদের বাজার দরের চেয়ে অনেক কমেই বিক্রি করা হচ্ছে কিন্তু তাও ভজার বাজেটের মধ্যে যেন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।

একটা ল্যান্ডরোভার খুব সস্তায় পাওয়া যাচ্ছিল কিন্তু সেটার আবার গায়ে প্রচুর ক্ষত চিহ্ন। পুলিশের তাড়া খেয়ে নাকি কে জানে! তাই সেটাও নাকচ হল।

হঠৎ দেখতে পাওয়া গেল গাড়িটাকে। একটা রুপালি রঙের শেভি ক্যাভালিয়ার। জানালায় টেপ দিয়ে লাগানো কাগজটাতে দেখা গেল গাড়িটা ২০০৩ সালে তৈরি। কিছুটা পুরোনো কিন্তু বেশি মাইলেজ নেই। ছোট খাটো ছিমছাম গাড়ি। দামটাও খুব একটা বেশি না, অর্থাৎ ভজার বাজেটের মধ্যে হয়ে যাবে। 

“নিবি নাকি এটাকে?” ভজা গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে দেখে অঙ্কন জিগ্যেস করল। 

“হ্যাঁ দেখি, মন্দ লাগছে না...”  

কেভিন বলল, “দেখি আমি তাহলে মামাকে খুঁজে নিয়ে আসি। তোমরা ততক্ষণ গাড়িটাকে ভালো করে দেখো।” বলে সে চলে গেল। 

তবে গাড়িটাকে যে শুধু অঙ্কন ভজাই দেখছিল তা নয়। একজন বেঁটে, গাঁট্টা গোঁট্টা সম্পূর্ণ ন্যাড়া মাথা লোকও গাড়িটাকে পছন্দ করছে এবং কিনতে ইচ্ছুক মনে হচ্ছিল। লোকটার হাতে প্রায় প্রতিটা আঙ্গুলে একটা করে আংটি। তার সঙ্গে একটা শুঁটকো মতন চ্যালাও রয়েছে। সে বারবার বলে চলেছে, “গাড়িটা দারুণ স্যার! আপনার পছন্দের জবাব নেই!” ইত্যাদি।

ন্যাড়া মাথা লোকটা গাড়ির প্রতিটা চাকাতে লাথি মেরে মেরে কী সব পরখ করছিল সেই জানে। ভজা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করছিল এমন সময় কেভিন তার মামাকে নিয়ে চলে এল।

ভজা ওনাকে জিগ্যেস করল, “আচ্ছা, এটা কেমন হবে?”

মিস্টার সেভিল বললেন, “একটু পুরনো তবে একদম চাবুক গাড়ি। বেশি চলেওনি। নিয়ে নাও নিয়ে নাও। এই রকম গাড়ি এখন আর তৈরি হয় না। বডিটা মেটালের দেখছ না। প্রথম গাড়ি হিসেবে খুব ভালো।  আজকাল তো কী সব ঠুনকো জিনিস দিয়ে বডি বানায় এক ধাক্কাতেই শেষ। এই গাড়ি অনেক বেশি শক্ত পোক্ত। এই গাড়ি কিনলে মোটেও ঠকবে না। আর কন্ডিশানও ভালোই আছে।”   

ভজা বলল, “সব চেয়ে বড়ো ব্যাপার, অন্তত আমার জন্যে যে আমার বাজেটের মধ্যে রয়েছে দামটা।”

“নাও, নাও ভিতরে বসে পরখ করে দেখে নাও!” বলে ভদ্রলোক দরজা খুলে ভজাকে ভিতরে ঢুকতে বললেন। ভজা ভিতরে ঢুকে স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে সামনের গ্লাভস কম্পার্টমেন্ট খুলে টুলে দেখল। সব কিছুই ঠিকঠাক মনে হল। 

“কার গাড়ি ছিল এটা?”    

কেভিনের মামা হা হা করে হাসলেন,”আরে যার ছিল সে অন্যদের তুলনায় নেহাতই ছিঁচকে চোর বলতে পারো! কী একটা চুরির কেসে শ্রীঘরে ঢুকে ওখানেই টসকে যায়। ও নিয়ে ভেবো না। গাড়িটা তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা বলো, রঙ টঙ  সব?” বললেন বটে মুখে কিন্তু উনি সেলস্ম্যান মানুষ ভালোই বুঝতে পারছিলেন যে ভজার গাড়িটা পছন্দ হয়ে গেছে। 

এদিকে ন্যাড়া মাথা বেঁটে লোকটারও মনে হয় গাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছে। সে এঁটুলির মতন সেঁটে রয়েছে আর নড়ছেও না ওখান থেকে। ভজার ভয় হচ্ছিল অকশান বলে কথা এখন ওই লোকটা যদি খুব বেশি দাম হেঁকে বসে তাহলে তো আর কিছু করার থাকবে না। এদিকে অঙ্কন তো প্রচন্ড উত্তেজিত ভজা গাড়ি কিনছে বলে। সে ফোন বার করে বলল, “গাড়িটার সামনে দাঁড়া ভজা কয়েকটা ছবি তুলে নিই, দিদিকে পাঠাতে হবে আর তুইও তো ইন্ডিয়াতে পাঠাবি নাকি? ফেসবুকে আপলোড করে দেব – ভজা শেষ পর্যন্ত গাড়ি কিনে ফেলল!”   

ভজা হাঁ হা করে উঠল, “এই না, না, ফেসবুকে এখন দিস না প্লিজ! অকশান বলে কথা কত দাম উঠবে তার ঠিক নেই। এখন ছবি দিলে গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের ব্যাপার হয়ে যাব! না, না ফেসবুকে দিস না!”

কেভিন সঙ্গে রয়েছে বলে ভজা কথাগুলো ইংরেজিতে বলল। এদিকে ভজার ছবি তুলতে গিয়ে ওই ন্যাড়া মাথা গাড়ির সঙ্গে চিপকে থাকা লোকটাও ছবিতে এসে গেল। সে বুঝতে পারল তারও ছবি উঠে গেছে তাই সে হাঁ হাঁ করে ছুটে এসে সোজা অঙ্কনের কাছে গিয়ে বলল, “এই আমার ছবি তুলছ কেন ছোকরা। এখুনি সব ডিলিট করো! আমার ছবি ফেসবুকে দিলে তোমাকে আর আস্ত রাখব না!” বলে সে অঙ্কনের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেওয়ার উপক্রম করতে লাগল।  

অঙ্কন কিছুতেই ফোন দেবে না। সে উলটে বলল, “সরি আঙ্কেল! আমি আপনার ছবি মোটেই তুলতে চাইনি! গাড়িটার ছবি তুলতে গিয়ে আপনার ছবি উঠে গেলে আমার কী দোষ বলুন? এরা তো গাড়ির ছবি তুলতে বারণ করেনি!”

আঙ্কেল শুনে লোকটা আরো খেপে লাল। দাঁত কিড়িমিড় করে তেড়ে এলো প্রায়! অঙ্কনের ফোনটা একেবারে নতুন। ওর দিদি সদ্য ওকে জন্মদিনে কিনে দিয়েছে, তাই ওটা আপাতত ওর কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয় প্রায়! ন্যাড়া মাথা আঙ্কেল ওর ফোনের নাগাল না পেয়ে গদাম করে অঙ্কনকে মারলেন এক ঘুষি! ব্যস তার পরেই পুরো দস্তুর হাঙ্গামা বেঁধে গেল ওখানে। 

কেভিন বিকট চিৎকার করে বলল, “আরে আরে এটা কী করছেন! গায়ে হাত তোলার আপনার কোন অধিকার নেই! আমাদের উকিল আপনাকে দেখে নেবেন!”  

আশপাশে যে সব লোকজন গাড়ি দেখছিল তারা গাড়ি দেখা ছেড়ে মজা দেখতে চলে এল। কেউ কেউ অঙ্কনকে পেট চেপে বসে থাকতে দেখে উহু আহা লেগেছে নাকি ইত্যাদি জিগ্যেস করতে লাগল। বেঁটে ন্যাড়া মাথা আঙ্কেলের বেশ কোনঠাসা অবস্থা। সবাই বলতে লাগল, “না, না, যাই হোক আপনি কারো গায়ে হাত তুলতে পারেন না! আমরা পুলিশ ডাকব!”

আঙ্কেল দেখলেন এ তো মহাবিপদ। কেউ গাড়ি দেখছে না। ঝগড়া মারামারি দেখতে সবার বেশি উৎসাহ। বেগতিক দেখে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের চেলাকে নিয়ে সুড়সুড় করে গেট দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলেন।

ভজা অঙ্কনকে জিজ্ঞেস করল, “কিরে তুই ঠিক আছিস তো?”  

অঙ্কন হেসে বলল, “হ্যাঁ! হিপো আঙ্কেল আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি! চল চল আমাকে আবার কেউ ঘুঁসি মারার আগে এবার গাড়িটা কিনে ফেল!”

ভজা তখনও কিন্তু কিন্তু করছে, “বলছিস? কিনব? ঠকা হবে না তো?”

অঙ্কন বলল, “আমি তোর ওই গাড়ির জন্যে মার খেলাম তাও তুই কিনবি না!” 

“না মানে ভাবছিলাম...” 

“আরে কিনে নাও, কিনে নাও,‌ এই রকম ডিল সারা আমেরিকা ঘুরলেও পাবে না!” ঝুট ঝামেলা মিটে যেতেই কেভিনের মামা আবার উদয় হয়েছেন, “চলো তোমাকে সব কাগজ টাগজ দেখাই। এটার প্রাথমিক দামটা দেখে মন ভালো হয়ে যাচ্ছে তাই না? তোমাদের মতন বাচ্চা ছেলেমেয়েদের উপকার করতে আমার যে কী ভালো লাগে কী বলব!”

অঙ্কন ফিস ফিস করে বলল, “যা ওনার সঙ্গে যা, তোকে ললিপপ দেবেন মনে হচ্ছে! বাচ্চা ছেলে বলে কথা!”   


চলবে...










প্রতিদিন বিভাগে আগমনী বন্দনা বিভাগের জন্য আপনিও দুটি মৌলিক ও অপ্রকাশিত কবিতা পাঠিয়েদিন।এই লেখা অঙ্কুরীশা-য় সম্মানের সাথে প্রকাশিত হবে।

ankurishapatrika@gmail.com


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন