প্রকাশিত হলো অঙ্কুরীশা-য়
সদ্যপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক
বুদ্ধদেব গুহ -র স্মরণ সংখ্যা
কলমে —
কবিতা
----------------
আরন্যক বসু
সৌহার্দ্য সিরাজ
অমিত কাশ্যপ
বিদ্যুৎ মিশ্র
দুরন্ত বিজলী
শুভ্রাশ্রী মাইতি
গোবিন্দ মোদক
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
দীপক বেরা
নিমাই জানা
প্রেমাংশু শ্রাবণ
স্মৃতি শেখর মিত্র
স্বাগতা ভট্টাচার্য
নন্দিনী মান্না
জয়শ্রী সরকার
প্রবন্ধ
----------------
আবির গুপ্ত
আশিস মিশ্র
দুর্গাদাস মিদ্যা
বিকাশ রঞ্জন হালদার
তপনজ্যোতি মাজি
বিশ্বজিৎ রায়
বিমল মণ্ডল
কোয়েলের কাছে , আপনাকে
আরণ্যক বসু
( I had an inheritance from my father,
It was the moon and the sun .
And though I roam all over the world,
The spending of it's never done.
-- Ernest Hemingway )
ম্যাকলাস্কিগঞ্জের বন্য- রোমাঞ্চ ছুঁয়ে , সেই কবে , আপনার বর্ণনায় খুঁজেছিলাম এক নরম নরম রেলস্টেশন , প্ল্যাটফর্মে চা-সিঙাড়া, কেক-বিস্কুট-কুকিজ বিক্রি করা বৃদ্ধা , কার্নি মেমসাহেব ,আর আবছা জঙ্গলে আপনার সেই বাংলো।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি...
আপনার ঈর্ষণীয় প্রতিভার আভিজাত্যে একজন ভীষণ চেনা পথের কবি ঢাকা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছেন ; ভাগ্যিস !
তাঁর নাম...
নাগরিক এই আমি তবু মাঝে মাঝেই গত শতকের ছয়ের দশকে ফিরে ফিরে যাই।
আপনার 'খেলা যখন ' - এর পৃষ্ঠা থেকে কে যেন আসবে ভেবে দাঁড়িয়ে থাকি, নস্টালজিক কলকাতার রেডিও স্টেশনে , সান্ধ্য পার্কস্ট্রীট , দক্ষিণী বা দেশপ্রিয় পার্কের কাছে । কখনও জর্জ বিশ্বাসের হারমোনিয়ামে -- কেন সারাদিন ধীরে ধীরে , বালু নিয়ে শুধু খেলো তীরে...
শুনবো বলে ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি...
প্রিয় পানীয়ের চুমুকে চুমুকে , ফরাসি পারফিউমের সুগন্ধে , আর আপনার গেয়ে ওঠা -- সহসা ডালপালা তোর উতলা যে , ও চাঁপা , ও করবী-তে...
যে মুগ্ধতার অন্তহীন সৌরভ , সেখানে আপনার হাতে শিকারের বন্দুক যে মানায় না , সেকথা আপনার কোনো শুভানুধ্যায়ী কখনও বলেন নি?
আপনার সঙ্গে আড্ডার স্বাস্থ্যকর বিন্যাসে ডুবে- ভেসে , আমিই হয়তো বলতাম ; কিন্তু আপনাকে যে লালা'দা বলে ডাকবার সুযোগই হলো না এ জীবনে!
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে আমি ,
'একটু উষ্ণতার জন্যে ' থেকে 'অভিযাত্রিক'-এ ,
বন্দুকের বারুদগন্ধ থেকে কোয়েলের শান্ত জলস্রোতের কাছে ফিরে যেতে চাই...
'মাধুকরী'র প্রতিটি অক্ষর থেকে 'আরণ্যক'-এ ফিরে ফিরে যাই ।
অরণ্য ছোঁয়া ইস্টিশন... মহুয়া-মিলন ,ছিপাদোহর , ম্যাকলাস্কিগঞ্জ...
আপনার স্মৃতিকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে , শেষ পর্যন্ত আচানকমার -অরণ্যগন্ধের নির্জন রেলস্টেশন কার্গিরোডে বসে থাকা, ১৯৩২ সালের সেই বিভূতিভূষণকেই আঁকড়ে ধরি!
আমি যে আজও একজন বনদেবতা আর বনদেবীকে খুঁজে বেড়াচ্ছি!
বুকের ছায়াতে মাধুকরী অরণ্যপ্রান্তর
সৌহার্দ সিরাজ
কলম থেমে গেলেও রোদ্দুর থামে না
রোদ্দুরের মধ্যে কলমের বুকের আগুন
জেগে থাকে বিনিদ্র রাতের প্রহরায়
যেখানে রোদ্দুর সেখানে ছায়া
সেখানে মায়ার সীমানা ঘেরা প্রশান্তির আলো
সে প্রশান্তি থেকে বোধিপ্রাপ্ত নবীন ঋষি উচ্চারণ করেন—
কোনো মেয়েকে আশির্বাদ করি না,আদর করি
তখন একটি যুগের রাস্তা চমকে উঠে
ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে
পৃথিবীটা সবুজ!
প্রকৃতির সজিবতা বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া মানুষ
পাতার ভেতরে পাপড়ি গুজে বসে থাকার
সময়
কোথাও ফুল ফুটছে কি না
সে ফুল হাওয়ায় দুলছে কি না ভাবতে বসেন
নারী আর পুরুষের আবহের স্পন্দন বুকের মধ্যে পুরে রাখেন সেতারের সুরের মাধুর্যে
কার জীবনের মখমলের ভেতরে অন্তর্লীন
পুরুষিক অহম
মেয়েদের মুখের লাবণ্য,গ্রীষ্মস্নানের ধূপের গন্ধ
হুলুক পাহাড়ের গায়ে জেগে ওঠা পাইন আর ওকের পাতার জোনাকী জ্বলে উঠেছিল!
নগরজীবনের আদিখ্যেতা ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে গেলে
ঠিকরে পড়া বাতাসের গায়ে বৃষ্টির ছাঁট খেলা করে
কষ্টের ঝাঁঝ মেখে জটিল অরণ্যপ্রান্তর উত্তরকালের পূর্বদিকে যাত্রা করে!
মাধুকরী! নানা হিসেবে আনুগত্য কিংবা প্রথার শাসনে
যে স্বগতোক্তির প্রবাহ হয়েছে নির্মাণ
কি করে তা ভুলি !
ঋজুদা
অমিত কাশ্যপ
সবুজের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছি কখন
আমার চারিপাশে সবুজের দেওয়াল
হিরণ আলো ঝুমঝুম করে নামছে
কেউ কি ডাকল মুদৃস্বরে, ঋজুদা
এখন সকাল কেবলি নীরব যেন, মনে হয়
আর ফিরব না, সেই যন্ত্রণার শহর, সেই গলিপথ
সেই চেনা মানুষ, কখন যেন অচেনা ভীষণ
কেমন করে হারাব সেখানে, ঋজুদা হয়ে
ঋজুদা তুমিই তো বলেছিলে, হাঁটতে হাঁটতে
হারিয়ে যাব, ডাকলেও সাড়া দেব না
শুধু অন্ধকার, ঝিঁঝির ডাক, জোনাকি হয়ে
'তারার আলোয় দ্যুতিমান শিশির বিন্দু হয়ে,
ঝরাপাতা হয়ে' আশ্চর্য আশ্রয়ে
ঋজুদার গান, কলম, আড্ডার খোরাকি গল্প
ছড়িয়ে ছড়িয়ে থাকবে প্রিয় সান্নিধ্যে অনন্তকাল
বুদ্ধদেব গুহ স্মরণে
বিদ্যুৎ মিশ্র
উদাস মনে ঋজুদা বসে পড়ছে "যাওয়া আসা"
কোথায় গেল স্রষ্টা আমার পাইনা খুঁজে ভাষা।
কোভিড থেকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ হলো একি
চিরদিনের জন্যে বিদায় নিলেন তিনি সে কি।
কেমন করে মানবো আমি তিনিই আমার পিতা
ভাবতে গেলেই বুকের ভিতর উঠছে জ্বলে চিতা ।
"বাসানো কুসুম" ঝরে গেল কেমন করে হায়
"হলুদ বসন্ত" আসবে কি আর নতুন করে ভাই।
" জঙ্গল মহল" ঘুরতে যাবো কথা ছিলো তাই
" খেলাঘর " যে রইলো পরে শুধুই তিনি নাই।
" কোয়েলের কাছে " শুধায় আমি কোথায় তিনি আজ
" আয়নার সামনে" রইলো পড়ে পুরনো সেই সাজ।
" বাতিঘর " উঠলো সেজে এবার ফিরে আসুন
বুদ্ধ বাবু নতুন করে আবার তবে হাসুন।
স্মৃতি গুলো বুকের মাঝে দেয় সে দোলা নিত্য
ঋজুদা আজ চুপটি করে উদাস যে তার চিত্ত।
আলোর মতো তুমি
দুরন্ত বিজলী
রসিক তুমি গানের তুমি জঙ্গলের ধ্বনি তুমি
তাইতো গভীর অনুরাগে
ভালোবাসার গানের রানি হাতটি নিলো আগে
ফাগুন দিনের আগুনঝরা আলোয়
কথাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে
ফুলঝুরি ছড়িয়ে দিয়ে
ভালোবাসার মানুষ তুমি
ঠোঁটে তোমার উষ্ণভূমি
উত্তাপ আর মেঘজলসায়
বৃষ্টি নামে বৃষ্টি নামে দুচোখ বেয়ে বৃষ্টি নামে
হৃদয় ভরা স্নেহের নীড় প্রদীপ স্নিগ্ধ ভালোয়
আলোয় তুমি ছিলে আলোয় তুমি আছো
এপার থেকে ওপারে তুমি রানির পাশে ভাসো
ভালোবাসায় হাসো
আলোর মতই হাসো
আমরা সেই হাসিতে ডুবে গিয়ে কেবল আজ কাঁদি
না না না, না-দিয়ে টপ্পা নিনাদ ফাঁদি
আমরা শুধুই কাঁদি......
অরণ্যমানবশুভ্রাশ্রী মাইতি
বেণীবাঁধা টিফিনবেলায় একমুঠো ঝালমুড়ির সাথে ঝকঝকে
সবুজ মলাটের বইটা হাতে দিয়ে ক্লাস নাইনের সুমিতাদি বলেছিল---
দেখিস, পড়তে পড়তে হারিয়ে যাস না যেন জঙ্গলে, ঋজুদার সাথে...
না, ঋজুদার সাথে দেখা হয় নি আমার কোনদিন
জলে-জঙ্গলে হাঁটা হয়নি পথ এই এতটা বয়সেও...
তবু তোমাকে পড়লেই যেন দেখতে পাই, রোদ-জল-মাটির গন্ধ নিয়ে
একটা মানুষ ‘মানব' হয়ে উঠছে কেমন নরম অরণ্য মেখে...
বুকের গভীরে উদার খোলা আকাশ, বুনো পুটুসের গন্ধমাখা
সোঁদা মাটির পথ, নাম-না-জানা গাছপালা ঘন সবুজ চাঁদোয়া
টাঙিয়ে রেখেছে মাথার ওপর সেই কবে থেকে...
জোছনার মায়া আঁচলে রুখু টাঁড় আর বুনোহাতির রহস্যময় নকশীকথা
বাঘের মতো বাঁচতে চাওয়া পৃথুর শিকড়ের সন্ধানে ঘুরে চলা আজও
অনন্ত মাধুকরী পথের এখানে ওখানে...
এসব দেখতে দেখতে, একটু উষ্ণতার জন্য, কখন যেন
বাবলি, টিটি, কুর্চি হয়ে উঠতাম অবাক প্রেমে, তোমাকেই বুকে চেপে...
অমনি গোটা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ জুড়ে বৃষ্টি শুরু হত ঝমঝম
ঋজুদা, ঋভু, রুরুকে নিয়ে তুমি বেরিয়ে পড়তে নতুন কোন অভিযানে
কি জানি কোন অজানা বেদনে ভেজা গাছের পাতা থেকে
অশ্রুজলের মতো টপটপ ঝরে পড়ত শুধু নিধুবাবুর নিখাদ টপ্পা--
‘ লুকিয়ে ভালোবাসব তারে, জানতে দেব না...'
তিনি-ই বুদ্ধদেব গুহ
গোবিন্দ মোদক
পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট নেশায় লেখক তিনি,
বিখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ সব্বাই তাঁকে চিনি।
উনত্রিশে জুন উনিশ-শো ছত্রিশ জন্ম কলকাতায়,
বিচিত্রতায় ভরপুর তাঁর জীবন নানা অভিজ্ঞতায়।
সাহিত্যিক, অরণ্য প্রেমিক, লেখায় অরণ্য ও বন,
শিকার ও অরণ্য ছাপিয়েও প্রেমিক যে তাঁর মন।
রচনা করেছেন কোয়েলের কাছে, বাবলি, কোজাগর,
জঙ্গলমহল, একটু উষ্ণতার জন্য, কুমুদিনী, বাতিঘর।
আয়নার সামনে, বাসনাকুসুম, পারিধি, আলোকঝারি,
নগ্ন নির্জন, চান ঘরে গান, রিয়া, চবুতরা, মাধুকরী।
অববাহিকা, রাগমালা, জলছবি ও সুখের কাছে,
তাঁর রচনায় প্রেমিক সত্তা কলমকে ছেঁয়ে আছে।
তাঁর সৃষ্ট ঋজুদা, রুরু, পৃথু, টিটি, কুর্চি ও টুঁই,
টাঁড়ে, বনে, অরণ্যে, লবঙ্গীর জঙ্গলে তাঁকে ছুঁই।
পাখসাট, চারকন্যা, পরিযায়ী, ছৌ, চারুমতি,
বনবাস, ঝাঁকিদর্শন, খেলাঘর, মাণ্ডুর রূপমতী।
অরণ্যানীর জীবন ছাপিয়েও তাঁর লেখাতে প্রেম,
প্রেমিক সত্তার "হলুদ বসন্ত" নিকষিত এক হেম।
সদ্য সদ্য উনত্রিশে আগস্ট তিনি গেলেন পরলোকে,
বাংলা সাহিত্য তাঁর অভাবে নিদারুণ এক শোকে।
প্রেমের সবুজ প্রদীপে নিরত্যয়দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
হেমন্ত বেলায় একটু উষ্ণতার জন্য তুমি চলেছো কোজাগর। জেগে থাকে তোমার মাধুকরীর আবেশী অনুভব। একাকী যখন একা। অরণ্যের মর্মরে জাগে তোমার জীবন জিজ্ঞাসা। মাটির সোঁদা গন্ধে জারিত তোমার কলম ঝলা।গুগুনোগুম্বারের দেশ ডাকে তোমায়।হাজার দুয়ারী অভিলাষ ঋদ্ধ করে চলে তোমাকে। তোমাকে ছোটায় সবুজ থেকে সবুজে। তোমাকে ভাসায় ক্লোরোফিল থেকে ক্লোরোফিলে।পোড়ায় বনজোৎস্নার সবুজ অন্ধকারে হলুদ বসন্তের পারুষ্যে।সৌমনস্যতার খোঁজে হৃদয় ভাসে বনবিবির বনে জঙ্গলমহলে। ছেঁড়া ক্যানভাসে সবিনয় নিবেদন তোমার সুখের কাছে।বুভুৎসায় কাঁপতে থাকে তোমার দিন ও রাত। প্রেমের সাতত্যে দুর্নিবার তোমার গোপিত রমন মালকোষ রাগে।
জীবনের হিসাবরক্ষক জানু পেতে বসে থাকো দুর্জ্ঞেয় রহস্যে শেষ ডাকের বিকুলিতে। জোনাকির ফসফরাসে হৃদয় জ্বেলে বসে অপেক্ষায় সূনৃত শাশ্বতের দুয়ারে। যেতে যে হয় ঋজুদা ! যেতে যে হয় পৃথু ! জীবনের সবুজ বাস শেষ ঠাঁই করে নেয় মাটিরই বুকে।
অরণ্যের রাজা
দীপক বেরা
সাহিত্যের আকাশ থেকে খসে গেল একটি নক্ষত্র
হিজলের শাখা থেকে খসে গেল একটি পাতা
কোজাগরীর চাঁদ অস্ত গেল বাওবাব গাছের পিছনে..
চাটার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্টের সাফল্য, পুরাতনী গানের সুর
কিংবা, ক্যানভাসের ছবির রং, ফিকে হয়ে গেছে সব
তাঁর জঙ্গলের চিরকালীন বোহেমিয়ান রূপের কাছে,
তিনি বুদ্ধদেব গুহ---ঋজুদা, আমাদের প্রিয় লালাদা!
পাঠক-কে নিয়ে গেছেন নিটোল ঘরের নিভৃতে
আবার আচমকাই টেনে নিয়ে গিয়েছেন টাঁড়ের মাটিতে
অথবা, ভয়ংকর অন্ধকার শ্বাপদসঙ্কুল জঙ্গলের তাঁবুতে
আদিম অরণ্যের জঙ্গমযাত্রায় বনজ্যোৎস্নায় স্নান করে
বুদ্ধদেবের--- প্রিয় কুর্চি, রুরু, ঋভু, পৃথু-রা..
বারবার ছুটে গেছেন রূপসী জঙ্গলমহলের গহীনতায়
ম্যাকলাস্কিগঞ্জে বৃষ্টি পড়ার শব্দের গভীরতার ভিতর
অরণ্য, সুরা ও সুন্দরীর কাছে,
'বাবলি', 'কোয়েলের কাছে';.. 'একটু উষ্ণতার জন্য'!
'চান ঘরে গান' গেয়ে মাধুকরী হয়ে---
'কোজাগর', 'হলুদ বসন্ত' পেরিয়ে 'লবঙ্গীর জঙ্গলে,
'নগ্ন নির্জন'-এ অরণ্য ও জীবনের বহুমাত্রিক উদযাপনে।
ওরে, ..আজ 'বাজা তোরা রাজা যায়'---
বৃদ্ধ হলেও, অরণ্যে আসলে বাঘ তো রাজা-ই।
অরণ্যের রাজার নশ্বর প্রস্থানে তাই হারানোর শোক নয়,
থাকুক শুধু জীবনরসের উদযাপনে জীবনেরই জয়গান!
ব্রততী পুরুষের দেহে শাখামৃগ হেঁটে যাচ্ছে
নিমাই জানা
পাখির বিরহে টপ্পার গান গায় জঙ্গলের কুর্চি , ভূর্জপত্রের মতো বহ্নিময় প্রশাখাঝিনুকের পাঁচালী গর্ভের ভেতর বাড়তে থাকে হৃদপিণ্ডের নরম শাখামৃগেরাধাবমান ঝরনা সব তিথি নক্ষত্রকে ফেলে যায় এই সহস্র উপাচার অশ্বমেধের তলায়ফুসফুসীয় শিরা ধরে উঠে যাচ্ছে ব্রহ্ম তালুর মহানদ ভুল করে পথ ক্রমশ অশ্বক্ষুরাকৃতি হয়ে যায় পিতাহীন সাপের মতোঅজস্র হলুদ পাখির গান গায় অদ্ভুত সন্ন্যাসী দেহকোষে , আমাদের আজন্ম অন্তর্বাসে পুংকেশর গজিয়ে ওঠে বারবারলাইকোপোডিয়াম গাছে বাতিঘর জ্বেলে আমি কিছু লবঙ্গ ফুল তুলে রাখি বানপ্রস্থ মানুষটির জন্যবিবাগী হওয়ার আগে ফেলে গেছে সব দেহসূত্র অজস্র কণিকার পাথর হিংস্রতা ভুলে ঋজুদার সাথে অরণ্যে চলে গেছেন প্রজনন নেশায় অন্তর্মুখী মানুষটি কেবল মাধুকরী করতে করতে পার্বত্য অববাহিকায় এসে পবিত্র হয়ে যাচ্ছেন সায়াহ্ন বেলায়পুরুষ মানুষ মানতের ফুল বেঁধে রাখে পবিত্র বৃক্ষের তলায়
ব্রীহি ও বালিকা
প্রেমাংশু শ্রাবণ
একটি নক্ষত্র তুমি,বৃন্তচ্যুত খসে পড়লে
মধু ও পৃথিবীর শিকড় অবধি।
তোমাকে ভৈরবী বলা যায় না,
এমন কী যুবতীও
না,তবে কি নিশ্চিত তোমাকে আমরা বালিকা জেনেছি।
আমাদের ফুল খেলা
ভুল নিয়ে কোনো দুঃখ নেই।
নৌকা ডুবে যায়,
তবু ডোবে না নৌকাডুবি নদী।
প্রাগৌতিহাসিক-ভ্রুণে
হিঙ্গুল বর্ণের এক সাপ
যে নিজেকে ভেঙে ভেঙে
ক্রমশই যুবতী হতে চাই
যেখানে শায়িত শব ভেসে যায়
মায়া পৃথিবীর
ব্রীহি ও বালিকা দূরে হেসে ওঠে।
বুদ্ধদেব গুহ
স্মৃতি শেখর মিত্র
দূরে কোন জংলী টিলার উপর
বসে থেকে যে ঝোরার কথা
সংগোপনে লুকিয়ে রাখে , ছবি আঁকে
আপন খেয়ালে, কিংবা নবীন বেশরার
কাঁধে হাত রেখে হরিণের শিকারে ঘুরে বেড়ায়
বনে বনান্তরে
যদি চকিতে দেখা যায় একরাশ বুনো পাখি
তাদের সুমিষ্ট কলধ্বনি শুনে হতবাক হয়
ম্যাকলাস্কিগঞ্জের গভীর অরণ্যে
কুরচি ফুলের সন্ধানে বালকের মতো
ঘোরাফেরা করে সুন্দর সুপুরুষ এক যুবা
যার শিশুর মতো মন , হয়তো সুরাভর্তি
পেয়ালার জলতরঙ্গে যার উজ্জ্বল উপস্থিতি
জানান দেয়। নারীদের কেমন ভাবে
ভালবাসতে হয়, আদর করতে হয় তার শিক্ষা
তার হৃদয়ে মননে।
জীবনকে উপভোগ করার যে শক্তি রাখে
সে আর কেউ নয়... ' বুদ্ধদেব' আমাদের
সকলের প্রিয় লেখক 'বুদ্ধদেব গুহ' আবার কে?
মাধুকরী যার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস
অন্তত আমার বিচারে।
ইন্দ্র পতন
স্বাগতা ভট্টাচার্য
'বাবলি' ছিলো বুদ্ধদেবের
ভিষণ প্রিয় মেয়ে।
কেটে যেতো সারাটা দিন
'অভির' মুখে চেয়ে।
লিখে গেছো গল্প ছড়া
উপন্যাসেও সেরা।
পেলে তুমি অনেক খ্যাতি
আখর দিয়ে ঘেরা।
'আনন্দ ' আর 'শরৎ' পেলে
পেলে 'শিরোমণি '।
নানা রঙের পালক দিয়ে
সাজলো মুকুট জানি।
'দাঁড়াশ সাপ'ও ঠাঁই করে নেয়
তোমার সেরা গল্পে।
তোমার লেখা তৃষ্ণা জাগায়
মন ভরেনা অল্পে।
কচি কাঁচার মন কেড়েছো
'ঋজুদা'কে দিয়ে।
জঙ্গলেও দিচ্ছো পাড়ি
দিব্যি ওদের নিয়ে।
অরণ্য আত্মা-লালাদা
নন্দিনী মান্না
লালাদার অভিজ্ঞতা ভরা
অসাধারণ প্রানবন্ত লেখনি-
বাবা হওয়া ও স্বামী হওয়া
দুটো কাহিনী সংমিশ্রণে
ব্রাত্য বসুর সিনেমা ডিকশনারি
আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত।
অসাধারণ অনুভূতি দক্ষতায়-
ধ্রুপদী সঙ্গীত ও ছবি আঁকার
বইপ্রেমী পাঠকের কাছে অতি
মন প্রিয় কোয়েলের কাছে
আর সবিনয় নিবেদন।
অপরাজেয় স্রষ্টার সৃষ্টি
মাধুকরী উপন্যাস
ভালোবাসার পরমাত্মা
অরণ্য আত্মায় বিলীন।
গভীর চিন্তণের
এক মহান লেখক
ঋজুদা স্রষ্টা অরণ্যপুরুষ।
কে বলে তুমি নেই
জয়শ্রী সরকার
কে বলে তুমি নেই ? সময় অধরা, তবু স্ফটিক-স্বচ্ছ দু'চোখ দেখছে সাহিত্যের আড্ডায়
নম্র নদীর মতো হাস্যমুখে হেঁটে চলেছ তুমি । রসবোধে টইটম্বুর অরণ্য প্রেমিক তুমি।
অক্লেশে করেছো শিকার, তবু রক্ত দেখোনি। প্রকৃতি-নারীকে একাসনে বসিয়েছো।
আজও অম্লান তোমার 'মাধুকরী', 'কোজাগর', 'হলুদ বসন্ত'। ভোলা যায় না তোমার
'স্বামী হওয়ার বাসনা' আর 'বাবা হওয়ার বাসনা'কে। ব্যতিক্রমী তুমি, এক নিঃসঙ্গ নাম ।
মধ্যবিত্ত বাঙালি থেকে বহু যোজন দূরে তোমার কলমের পদচারণা ।
সৃজিত চরিত্ররা ---- রুরু, পৃথু, টিটি, টুই কেমন যেন ছায়াময়, মায়াময়, বর্ণময়।
বাঙালি গৃহবধু আজও নিঃসঙ্গ দুপুর কাটায় তোমার 'বাসনা কুসুম', 'বাতিঘর',
'চান ঘরে গান', 'চার কন্যা', 'চারুমতি' আর 'আয়নার সামনে গান' পড়তে পড়তে।
ভোলোনি ছোটদেরও। 'ঋজুদার সঙ্গে', 'জঙ্গলে' ----- খুঁজে পাই ওদের।
রাজার মতো শিরদাঁড়া উঁচু করে মৃত্যুর গান গাইতে গাইতে চলে গেলে তুমি।
এখানে স্মৃতির অমর উদ্যানে নিঃশব্দ নীরব ধ্যানে
অশ্রুর লিপিতে লেখা হয় তোমার স্মরণিকা, যেখানে
উপলব্ধির অক্ষরমালায় সাজিয়ে তোলা যায় জীবনের প্রবহমানতা।
স্রষ্টার মৃত্যু নেই, মনে হয় যেন না-থামা কোনো নাগরদোলায় বসে
জীবনের জলছবি এঁকে চলেছো তুমি মহাকালের খাতায়...
কে বলে তুমি নেই !
----------------
প্রবন্ধ
---------------------
আবির গুপ্ত
আশিস মিশ্র
দুর্গাদাস মিদ্যা
বিকাশ রঞ্জন হালদার
তপনজ্যোতি মাজি
বিশ্বজিৎ রায়
বিমল মণ্ডল
প্রবন্ধ
ঋজুদা - বুদ্ধদেব গুহর এক অসামান্য সৃষ্টি
আবীর গুপ্ত
ঋজুদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ২০১৩ সালের শেষ দিকে শিলংয়ে। বিষয়টা খুলেই বলা যাক। হঠাৎই ২০১৩ সালের মে মাসে আমাকে টান্সফার করা হলো শিলংয়ে। সরকারি চাকরি করি তাই যেতেই হল। জুলাই মাসের পর বোঝা গেল একাকিত্বের জ্বালা। অফিস থেকে ফেরার পর সময় আর কাটতেই চায় না। লেখালেখি করি ঠিকই কিন্তু লেখা যেন বেরোতেই চায় না। আসলে, পরিবারের সঙ্গে বেশি মাত্রায় এ্যাটাচড্ মানুষদের বোধহয় এটা একটা অসুখ। একজন বাঙালি পরামর্শ দিলেন ইন্টারনেট থেকে বইয়ের পিডিএফ কপি ডাউনলোড করে পড়তে। তখন কোনটা আইনি আর কোনটা বেআইনি বোঝার অবস্থা ছিল না। বুদ্ধদেব বাবুর লেখা আগে অনেক পড়েছি আমার ওঁর লেখা পড়তে বেশ ভালই লাগে। নানান অন্যান্য লেখকের বইয়ের সঙ্গে ঋজুদার অজস্র বই জোগাড় করে ফেলা গেল। শিলংয়ের শীতকালটা ভয়ঙ্কর, প্রায় জিরো ডিগ্রির কাছে টেম্পারেচার পৌঁছে যায়। রুম হিটার তখন একমাত্র ভরসা। অফিস থেকে ফিরে বই বা ল্যাপটপ নিয়ে রুম হিটারের পাশে বসে শুরু হয়ে গেল একটার পর একটা ঋজুদার গল্প পড়া।
ঋজুদার সমস্ত কীর্তিকলাপ তাঁর সব আশ্চর্য অভিযানের কথা আমাদের কাছে তুলে ধরেছে ঋজুদার সঙ্গীদের একজন, যার নাম রুদ্র। বাকি দুজন হল তিতির আর ভটকাই। ঋজুদার কথা পাঠক প্রথম জানতে পারে “ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে” গল্পে যা প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। এই প্রসঙ্গে ঋজুদার একটু পরিচয় দেওয়া যাক। উনি প্রথম জীবনে ছিলেন দুর্দান্ত শিকারি, বাঘ থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের শিকার একসময় করেছেন। পরবর্তীকালে, মানুষটির মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন হয়, বন্যপ্রাণী এবং বন্য জীবন রক্ষায় শিকার ছেড়ে প্রধান ভূমিকা নিতে শুরু করেন। তিন সঙ্গীকে নিয়ে শুরু হয় একের পর এক অভিযান।
ঋজুদার অভিযানগুলো প্রধানত পূর্বভারতের জঙ্গলগুলোতে। তবে ভারতের বাইরেও তিনি জঙ্গলে জঙ্গলে বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়েছেন। প্রতিটি গল্পেই ঋজুদার বন্য প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি প্রতিটি গল্পে পাওয়া যায় সেই জঙ্গলের বিস্তৃত বিবরণ, পরিবেশ এবং মানুষজনের কথা, যা এক কথায় অসাধারণ। পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো জড়িয়ে ফেলে সেই জঙ্গলের পরিবেশের সঙ্গে, মনে হয় পাঠক যেন ঋজুদার সঙ্গে সেই জঙ্গলেই রয়েছেন। এইখানেই সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর সাফল্য যা অন্য কোন সাহিত্যিকদের লেখার মধ্যে তেমন পাওয়া যায় না। ঋজুদার সবচাইতে জনপ্রিয় অভিযানগুলো হল গুগুনোগুমবারের দেশে, রু-আহা, ঋজুদার সঙ্গে বাক্সার জঙ্গলে, ঋজুদার সঙ্গে সুন্দরবনে ইত্যাদি। ঋজুদাকে নিয়ে মোট ২৮ টি বই এখন অবধি প্রকাশিত হয়েছে যার প্রতিটিই অসাধারণ লেগেছে। সত্যি কথা বলতে গেলে ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সীর সঙ্গে ঋজুদারও ফ্যান হয় উঠেছি। বাঙালিদের মধ্যে ঋজুদার ফ্যান খুঁজতে গেলে গুনে শেষ করা যাবে না। ঋজুদার কাহিনীগুলো বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার জন্য, সব বয়সী পাঠকদের জন্য। এই কারণেই ওঁর ভক্তের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি।
সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ আমাদের মধ্যে না থাকলেও তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ঋজুদা কিন্তু সারা জীবন মানুষের মনে থেকে যাবে। শার্লক হোমস, ফেলুদা বা ব্যোমকেশ বক্সী, চরিত্র গুলি যেমন কোনদিন মানুষ ভুলতে পারবে না তেমনই ঋজুদাও হয়তো মানুষের মনের কোণে ওই সব চরিত্রের পাশে এক স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।
আমরা দু'জনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার
আশিস মিশ্র
সত্যি সত্যি তাঁরা দুজনেই সব শূন্য করে চলে গেছেন। তবুও বাঙালির কাছে পূর্ণ হয়ে আছে " মাধুকরী " ও" রবীন্দ্রগান "। ঋতু চলে যাওয়ার পর বুদ্ধদেব শুধু তাঁকেই হৃদয়ে আগলে রেখেছিলেন। মনে মনে অকপটে ভাবতেন --ঋতুকে তিনি সব উজাড় করে দিতে পারেননি। মনে হতো তিনি বোধহয় ঋতুর কাছে বড়ো অপরাধী! তাই কি ঋজুদা? ঋ - কে তিনি আত্মায় ধারণ করে রেখেছিলেন আজীবন। সানি টাওয়ারের যে ফ্ল্যাটে তিনি সকলকে নিয়েও নিঃসঙ্গ থাকতেন, যে শয্যার পাশে চেয়ারে বসতেন, চারপাশে বইয়ের আয়োজন, তার মধ্যে তাঁর দৃষ্টির নিকটে তিনি ঋতু গুহর সেই অসাধারণ হাসিমাখা সাদাকালো পোর্টেট রেখেছিলেন অতি যত্নে সাজিয়ে। দু' জনের সেই অসামান্য ব্যক্তিত্বকে বাঙালি মনে রাখবে শত শত বছর।
যে সময় অনেক প্রথিতযশা লেখকের বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে তাঁদের বেডরুমে প্রবেশ করা যেত না,তখন বুদ্ধদেব ছিলেন একেবারে ভিন্ন ঘরাণার মানুষ। কঠোর শৃঙ্খলা ও সময় মেনে তিনি বেঁচেছেন। হুটহাট করে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া যেত না। তবুও যেত। এবং তাঁর সঙ্গে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হতো। তিনি বলে দিতেন, এই সময় এসো। আসুন। সময় পেরিয়ে গেলে আর দেখা হতো না। তাই আমি বা আমাদের বন্ধুরা ঠিক সময়ে তাঁর কাছে পৌঁছে যেতাম। তিনি যেন অপেক্ষায় থাকতেন। গিয়ে দেখতাম, আমাদের আপ্যায়নের সব আয়োজন তিনি সম্পূর্ণ করে রেখেছেন। এমনই উদার ও বন্ধুবৎসল অভিভাবকের মতো ছিলেন । তাঁর চলে যাওয়ায় গভীর শূন্যতা হলদিয়া জুড়ে।
বলতেন, কী খাবে বলো। অকপটে জিজ্ঞেস করতেন স্কচ খেতে গেলে আগে থেকে বলবে। বয়স বেড়েছে, তাই আমার মেয়েদের ভয়ে ঘরে খেতে পারি না। চলো আমার শান্তিনিকেতনের রবিবারে। সেখানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল একদিন আমার আর বন্ধু কমল বিষয়ীর। সারা দুপুর তাঁর সঙ্গে তুমুল আড্ডায় আমি, কমল, রঞ্জন ও সুমন। দামী হুইস্কি, ছবি নিয়ে কথা, নানা রসিকতার পরে লাঞ্চ --- সে কী অভূতপূর্ব আয়োজন। এতো পরিপাটি! তিনি বলতেন, আমি এখানে না থাকলেও তোমরা কবে আসবে বলবে, এখানে থাকবে। আমরা বলেছিলাম, সে তো হয় না বুদ্ধদা। আপনার ঘরে আপনি না থাকলে কী করে থাকবো। তিনি বলেছিলেন, কেন ---এখানে তো কোনো অসুবিধে নেই। আমার বিছানায় ঘুমোবে। আরও বেড রয়েছে।
এমন করে তরুণ লেখক বন্ধুদের এই সময়ের আর কোন লেখক বলতে পেরেছেন, আমাদের তা জানা নেই। তরুণ লেখকদের প্রতি তাঁর প্রেরণা ছিলো আজীবন। কেউ বই দিলে তা বাড়ি নিয়ে যাওয়া, বা চিঠি দিলে তার উত্তর দেওয়া ---এসবই তিনি করে গেছেন এতো ব্যস্ততার মধ্যেও। এতো বিশাল মাপের চাটার্ড হয়েও তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলে প্রাণের আরাম হতো। রসিকতায় তিনি মন জয় করে নিতেন মুহূর্তে। কিন্তু আজীবন মেরুদণ্ড সোজা করে বেঁচেছেন রাজার মতো।
তিনি বুঝেছিলেন, ফুটবলটা চুনির জন্য। সাহিত্য তাঁর জন্য। তাই যখন লিখতে শুরু করলেন, তাঁকে রমাপদ চৌধুরী কীভাবে আরও লিখিয়ে নিয়েছিলেন, তিনিও কীভাবে বিগ হাউসের উপেক্ষা সত্ত্বেও নিজের কলমের জোরে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন -- সে সব তিনি তার ' সারস্বত ' গ্রন্থে অকপটে লিখে গেছেন। যে কোনো লেখক ও সম্পাদকের কাছে সেই বই অমূল্য সম্পদ।
বাঙালির যৌবনের সুর ও ছন্দ কেমন হওয়া দরকার, অরণ্যকে চিনিয়ে দেওয়া, প্রেম ও যৌনতাকে সম্মান দেওয়া, শিকারের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, পত্রসাহিত্যকে পাঠকের কাছে নিবিড় করে দেওয়া, ছবি এঁকে, গান গেয়ে চমকে দেওয়ার মতো বিপুল ক্ষমতা তাঁর ছিলো। তাই তিনি হোমিংওয়েকেই বেশি পছন্দ করতেন। আর হৃদয়ে আগলে রেখেছিলেন কবিগুরুকে।
বাংরিপোসিকে বাঙালি কি জানতো? কিংবা সেই সব অচেনা অরণ্য, সেখানকার নারী পুরুষ, এসবই তিনি তাঁর গল্প উপন্যাসে এনেছেন নিখুঁত ভাবে। কী অপূর্ব তাঁর কাহিনি বিন্যাস। ' হলুদ বসন্ত ' থেকে ' চানঘরে গান ' এসবই আমাদের যৌবনকালকে শিহরিত করে।
তবুও তাঁকে তেমন কোনো বৃহৎমাপের সরকারি পুরস্কার দেওয়া হয়নি। এতে তাঁর কোনো আফসোস ছিলো না। লক্ষ লক্ষ পাঠক ছিলো তাঁর সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার। তিনি বলতেন, সব ভালো লেখা মানেই তা আত্মজৈবনিক।
এমন সহজ ও অকপট কথাসাহিত্যিক বাঙালি আর কবে পাবে, তা জানা নেই। মনে হয়, একে একে বাঙালির সাহিত্য সমাজে ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। তিনি পা ছুঁয়ে প্রণাম নিতে চাইতেন না। তবুও তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতাম আমরা।
প্রয়াত সাহিত্যিক বুদ্ধদেবের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন
দুর্গাদাস মিদ্যা
বাংলা সাহিত্যে নক্ষত্র পতনের ধারায় নবতম সংযোজন বুদ্ধদেব গুহ। মূলতঃ ঔপন্যাসিক। ছোট গল্পের ও সৃষ্টি করেছেন এমনকি কবিতাতেও স্বাক্ষর রেখেছেন। বুদ্ধদেব বাবু এক সাংস্কৃতিক পরিবার থেকে উঠে আসা পরিশীলিত এক মানুষ। ফলে মানবিক দৃষ্টি সম্পন্ন এক মণীষা সব সময় বিকীর্ণ হতে দেখা গেছে। তিনি নিজে স্বীকার করেছেন তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই তিনিও জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরেছেন। শিকার করেছেন। লিখেছেন জঙ্গল নিয়ে উপন্যাস। যেখানে জঙ্গল নিজেই একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে। কোয়েলের কাছে যারা পড়েছেন জঙ্গলের প্রাকৃতিক গন্ধ তারা উপভোগ করেছেন নিশ্চয়ই। নাগরিক জীবনের ক্লান্তিকর জীবননাট্য তাঁর কলমের ছোঁয়া পায়নি তাও নয়। তাঁর লেখা পড়লে বেড়ানোর রিলিফ পাওয়া যায় বা যেত বলেই তিনি পাঠক পাঠিকা মহলে সবিশেষ সমাদৃত হয়েছেন।
নগরে এবং শহরে বসবাস করেও পাঠক/পাঠিকাকে এমন অরণ্যচারী করে তূলতেন যা ভাবতে আশ্চর্য লাগে। যিনি জঙ্গল ভালোবাসেন তিনি জীবন ভালোবাসেন। আর জীবন ভালোবাসতেন বলেই :-চান ঘরে স্নানের মতো নাগরিক রোমান্টিক উপহার দিতে পেরেছেন।
আসলে বুদ্ধদেব বাবু ছিলেন ওপেন হার্ট অর্থাৎ খোলা মনের মানুষ। দিলখোলা না হলে রাম গরুড়ের ছানার দেশে এমন উচ্চকিত অমলিন হাসি হাসতে পারেন কেউ?
কুচুটে এবং নিম্লরুচি সম্পন্ন কিছু সাহিত্যিকের পাশে বুদ্ধদেব বাবু দৃপ্ত প্রতিবাদ। মেরুদণ্ড সোজা করে চলা মানুষ ছিলেন বুদ্ধদেব বাবু। তাই তাঁর চরিত্রের নাম হয় :-ঋজু ঋতু প্রকৃতি। আমার মনে তিনি গোষ্ঠীবাজির বাইরে ছিলেন।
তিনি সাহিত্যিক হয়ে কখনো সাপের পাঁ দেখেননি। একলা মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক অবিস্মরণীয় সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। তিনি গান গাইতেন আপন মনে মনের আনন্দে। আর সেই আনন্দ রস আমরাও কখনো কখনও পান করেছি হলদিয়া সারা ভারত সাহিত্য উৎসবে যা আমার কাছে চিরকালীন সম্পদ হয়ে থাকবে।
গভীর নির্জন
বিকাশরঞ্জন হালদার
" আমাদের প্রত্যেকের বুকের মধ্যেকত বিভিন্ন মুখী মানুষ থাকে আমারা কি জানি ? কোন্ মানুষটা এসে যে আমাদের উপর দখল নেয়, তা আগে থেকে কেউই বলতে পারিনা।"
বুদ্ধদেব গুহ। নামটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বন-জ্যোৎস্না আর সবুজ-অন্ধকার। ইউরোপের প্রায় প্রত্যেকটি দেশ, ইংল্যান্ড, কানাডা, আমেরিকা, জাপান, থাইল্যান্ড, পূর্ব-আফ্রিকা, এবং পূর্ব-ভারতের বন-জঙ্গল, পশুপাখি, বনের মানুষের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ কালের নিবিড় নির্জন পরিচয়। হয়তো একটু উষ্নতার জন্যই। অনন্য তাঁর জীবন বোধ। জীবনকে জীবন রসিকের দৃষ্টিতে অবলোকন করেন তিনি। বুদ্ধদেব গুহ।
" আমার হঠাৎ মনে হল, চিরদিন, আজীবন তোমাকে আজ যেমন করে ভালোবাসি, তেমন করে ভালোবাসতে পারব তো ? তুমি আমার সামনে বসে আজ যেমন করে সজনে পাতার মতো ভালো লাগায় কাঁপছ, চিরদিনই কি তেমন করে কাঁপবে তুমি,বুলবুলি ? "
আবেগে-শৃঙ্গারে, দ্বন্দ্বিতায়-স্টাইলে, রসবোধে-তির্যকতায়, তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। আচরণে ছিলো তাঁর বৈচিত্র-বিকিরন!
ছোটবেলাটি বরিশাল আর রংপুরে কাটিয়ে ভেতরে ভেতরে কখন যেন বুকের গোপনে বড় করে তুললেন, বন-বনান্ত অরণ্য প্রকৃতি। আর আমরা পেলাম- মাধুকরী, কোজাগর, হলুদ-বসন্ত, কুমুদিনী। এরকম অজস্র মহামূল্যবান সম্পদ। তাঁর কাছ থেকে বাংলা কথা সাহিত্যের জগৎ সমৃদ্ধ হলো তাঁর অভিল্বাহিক, অনবেষ, চবুতরা, চারুমতি, জগমগি-এর মতো অতুলনীয় সব উপন্যাসে। ভারতীয় বাঙালি লেখক তিনি।সারা জীবনের অভিজ্ঞতা, উজাড় করে দিয়ে গেলেন তাঁর সৃষ্টির সম্ভারে। ভরা থাকলো যত- দ্বিধান্বীত-মনখারাপ, বিম্বিত-বিচ্ছেদ-বিভুঁই, অপরিতুষ্ট-অভিভূতি, প্রতিসিদ্ধ রসন-মধুরিমা, ছিনিমিনি-ক্ষণ, পর্যাপ্ত তিমির, আর অশ্রুকাল!
" বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবন থেকে তাঁর সাহিত্যের ভূবন খানিকটা দূরে। টাঁড়ে, বনে, অরণ্যে, বাঘের গায়ের ডোরার সে-সব কাহিনি ছায়াময়। তাঁর নায়কদের নাম ঋজুদা, রুরু, পৃথু। নায়িকাদের নাম টিটি, চুঁই, কুর্চি। তারা ছা-পোষা বাঙালি জীবনের চৌহদ্দিতে নেই। কিন্তু পাড়ার লাইব্রেরি থেকে সেই বই বুকে নিয়েই বাঙালি গৃহবধু তাঁর নিঃসঙ্গ দুপুর কাটাতেন। "
আমরা কে না জানি বুদ্ধদেব গুহ কর্মজীবনে একজন নামী চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। আকাশ বাণী কলকাতা কেন্দ্রের অডিশন বোর্ডের সদস্য। কেন্দ্রিয় সরকারের ফিল্ম-সেন্সর বোর্ডের সদস্য। এমনকি বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র ভবনে পরিচালন সমিতির সদস্যও নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি।
ভাবতে অবাক লাগে, একজন মানুষ কতটা নিরলস হলে, কতটা কঠোর পরিশ্রমী হলে তবে এতকিছুর পরেও তাঁর সৃষ্টি-কাজে একজন নিমগ্ন সাধক হতে পারেন! তাঁর প্রতিভা বহুমুখী আমারা তা জানি। অসম্ভব সুন্দর ছবি আঁকতে পারতেন। নিজের লেখা একাধিক বই-এর অসাধারণ অসাধারণ প্রচ্ছদ তিনি নিজেই এঁকেছেন।
আর তিনি যে সু-গায়ক ছিলেন, বোধকরি তা আজ আর কারো অজানা নয়। আশি বছর বয়সেও গলায় নিটোল সুর ছিলো এই বাঙালি কিংবদন্তীর। তিনি চির নায়কচিত। সাবলীল। রঙিন। বন্ধু নবনীতা দেবসেন-এর হঠাৎ টেলিফোনে গান শোনানোর অনুরোধে গেয়ে ওঠেন, টপ্পা অঙ্গের, আঙ্গুরবালার গাওয়া সেই বিখ্যাত গান- " আমি জগতের কাছে ঘৃণ্য হয়েছি, তুমি যেন ঘৃণা করো না। " এর পর " ভালো বাসিবে বলে ভালো বাসিনে। " এরকম একটার পর একটা। তৃপ্তিতে আর গর্ব-বোধে ঝলমল করেওঠে নবনীতা দেবসেনের বন্ধু-হৃদয়।
বুদ্ধদেব গুহ। প্রকৃতপক্ষে তীক্ষ্ণ ধিষণ আর শীলিত ব্যক্তিত্বে এক দুর্নিবার আকর্ষণ। অবশ্যই তাঁর প্রিয় জন-মনে। তিনি পেতেই থাকেন - সমর্পণী-চোখ, আশ্চর্য-বিষাদ, উদার-প্রসন্নতা, ভালোবাসা এবং অভাবনীয় প্রেম। প্রকৃতি ও নারী তাঁর জীবনে অবিচ্ছেদ্য।
" আমার সঙ্গে তাই বহুদিনের প্রেম ওই মেয়েটির। " " কোনও এক রাতে অপেক্ষা করেছিলাম রেডিও স্টেশনের বাইরে ঐ কণ্ঠস্বরকে সামনে দেখব বলে। " শ্রী-কণ্ঠী, লাবণ্যময়ী ঋতু গুহ এক সময় তাঁর জীবন-সঙ্গিনী।
তিনি হেমিং ওয়ে'র একজন একনিষ্ঠ ভক্ত বলাযেতে পারে। আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে। আমেরিকান ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার। সাংবাদিক। সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পান ১৯৫৪ সালে। এই হেমিংওয়ের বেশ কিছু লেখা থেকে তিনি জলের মতো মুখস্থ বলেন। প্রখর স্মৃতিশক্তি তাঁর। তুলে ধরেন বিশেষ করে সেই সব জায়গা থেকে। যেখানে হেমিং সাহেবের জীবনদর্শনের ছোঁয়া আছে। একটা বেপরোয়া ভাব, সমস্যার মুখোমুখি হওয়া, মৃত্যুকে পরোয়া না করা, আর জীবন উপভোগ করার আকাঙক্ষা। বলা যেতে পারে বুদ্ধদেব গুহ'র জীবনের প্রভূত নেশা, ঝোঁক, উন্মাদনার মধ্যে যার ছায়া এবং ছোঁওয়া দেখতে পাওয়াটা কঠিন নয়।
" হলুদ বসন্ত " এনে দিয়েছে আনন্দ পুরস্কার। তিনি সম্মানিত হয়েছেন। সম্মানিত হয়েছেন শিরোমন এবং শরৎ পুরস্কারেও। আর সবথেকে বড় কথা, সম্মানিত হয়েছেন অগণিত প্রিয় পাঠকের তোলপাড় ভালোবাসায়।
কলকাতা-বইমেলায় দ্যাখা হয়েছে দু'এক বার। তাঁর " লবঙ্গীর জঙ্গলে " , " চানঘরে গান " হাতে কাছে গেছি কলমের স্পর্শ নিতে নতুন বই-এর পাতায়। পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছি নীরবে। প্রাপ্তি আমার! আমার মধুর স্মৃতি!
২৯ জুন ১৯৩৬ থেক ২৯ আগস্ট ২০২১, মাঝে পঁচাশি'টা বছর। কেবলই অন্বেষণ। জীবনের। চলে গেলেন তিনি! থেকে গেলেন তিনি! মৃত্যু তো শুধু মৃত্যু নয়, নিশ্চয়তা এক।
ঋণ- " লালাদা " সংবাদ প্রতিদিন রোববার ১৫ জুলাই ২০১৮
" লবঙ্গীর জঙ্গলে " বুদ্ধদেব গুহ।
হৃদয় অরণ্যে একা…
তপনজ্যোতি মাজি
বৌদ্ধিক পথে নয় , হৃদয় অরণ্যে তাঁর অনিন্দিত বিচরণ। সাহিত্য পাঠকদের এই পর্যবেক্ষণ আক্ষরিক অর্থে মৌলিক।কেউ কেউ বলেন তিনি গদ্যে অরণ্য ও শরীরের কবিতা লিখেছেন। আধুনিক মননে গদ্য ও কবিতার পার্থক্য খরস্রোতা থেকে ক্ষীণস্রোতা হচ্ছে এ কথার উল্লেখ নিঃসন্দেহে বাহুল্য মাত্র। বুদ্ধদেব এই দুরূহ কাজটি করেছেন নিঃশব্দে এবং অবিকল্প মুন্সিয়ানায়। তিনি কথাসাহিত্যে এক অনন্য ধারার প্রবর্তক। অতুলনীয়।
কোনও তুলনার পথে যাওয়া এক অর্থে সীমাবদ্ধতা। প্রতিভার মৌলিকতাকে লঘু
করে দেখা। কেউ কারও সঙ্গে তুলনীয় নয়। বুদ্ধদেব গুহ জীবন ও প্রকৃতিকে ছুঁয়েছেন ভিন্ন আঙ্গিকে , ভিন্ন ঘরানায়। কথাসাহিত্যে তাঁর সৃষ্টি অন্য স্বাদ উপহার দিয়েছে পাঠক তথা সাহিত্য অনুরাগীদের।তাঁর লেখায় লেখকের স্বাধীনতা চূড়ান্ত শীর্ষে পৌঁছতে পেরেছে সাহিত্যের দীর্ঘ
ধারাবাহিকতাকে অবিকৃত রেখে। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র এবং সফল। তাঁর সৃষ্ট উপন্যাসের চরিত্রগুলির জীবনদর্শন , মন এবং জৈব অনুভূতি সংসার জীবনে বন্দী পাঠকের কাছে মুক্ত আকাশ। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে এক স্বাধীন প্রান্তর , যেখানে জীবন ,সম্পর্ক, প্রণয় এবং শরীর বিবিধ বিভঙ্গে বিকশিত হয়েছে বিরল বহুমাত্রিকতায়। অরণ্য কেবল অরণ্য নয়। আরও ভিন্ন কিছু। আরও অতিরিক্ত কিছু ,….এই উপলব্ধিকে তিনি সার্থক মাত্রা দিতে পেরেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে জঙ্গলের প্রতি প্রেম এবং অরণ্য-সঙ্গ উপন্যাসগুলিতে চরিত্র নির্মাণকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছে। নাগরিক মানুষকে অরণ্যের পটভূমিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে ঘুমিয়ে থাকা মন ও শরীরের তৃষ্ণাকে জাগিয়ে দিয়েছেন
নিপুণ সম্পর্ক সমীকরণে। এই সৃষ্টিগুনে তিনি অনন্য এবং বিস্ময়কর রকমের স্বতন্ত্র। ছোটগল্প থেকে উপন্যাস , তিনি বিপ্লব ঘটিয়েছেন। 'একটু উষ্ণতার জন্যে ' একটি পৃথক ও বেস্টসেলিং উপন্যাসের শিরোনাম হলেও বস্তুত পক্ষে
সম্পর্কের জৈব উষ্ণতাকে সঞ্চারিত করেছেন প্রত্যেকটি গল্প এবং উপন্যাসে।'কোয়েলের কাছে ', 'কোজাগর ' এবং ' মাধুকরীর ' চুম্বকীয় আকর্ষণ তথা সাফল্য তাঁকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল । সমসাময়িক সময়কালে
তিনি হয়ে ওঠেন বর্ণ ও প্রেমের হিরন্ময় কথাকার। এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক তাঁর সংগীত ও কবিতার প্রতি প্রগাঢ় প্রেম , পারঙ্গমতা এবং ভালোবাসা। রবীন্দ্রনাথের গান ও টপ্পা গানে তিনি ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত এবং সাবলীল। এই কবিতা ও সাংগীতিক প্রেমের প্রকাশ ' চান ঘরে গান ' পত্র সাহিত্যে।
' চান ঘরে গান ' ভিন্ন উপলব্ধির পত্র সাহিত্য। অধ্যায় বিভক্ত দীর্ঘ কবিতা।হৃদয়ের আবেগকে অর্গল মুক্ত করে শরীর অবর্তনকারী প্রেমকে পৌঁছে দিয়েছেন শরীর উত্তীর্ণ শীর্ষ উচ্চতায়। একজন ঔপন্যাসিকের অন্তরে এক জন কবিও বিচরণ করেন। এই উপলব্ধি বুদ্ধদেবের উপন্যাস বা গল্প বিচার করে বুদবুদের মতো উঠে আসে। একজন সার্থক কবি যেমন জৈব অস্তিত্ব
থেকে কবিতাকে দর্শনের উচ্চতায় পৌঁছে দেন , বুদ্ধদেবও পেরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন মন ও শরীরের মুক্তি দার্শনিক উপলব্ধিতে। শরীর , সম্পর্ক, সংঘাত সব আছে জীবনে কিন্তু উত্তরণের পথ আছে । যেন রবীন্দ্রনাথের গান। শ্রবণের পর আত্মস্থ করলে দার্শনিক উপলব্ধির বোধ সঞ্চারিত হয় শরীরে ও মননে।
ব্যক্তি জীবনের বর্নময়তাকে সাহিত্যের চরিত্র নির্মাণে ব্যাবহার করেছেন কুণ্ঠাহীন সাবলীলতায়। জঙ্গল বা অরণ্য প্রান্তরকে পটভূমি করে মনের
গভীরে নিরন্তর ঘটে যাওয়া ইচ্ছা বা অভিপ্রায় কে মুক্ত করে দিয়েছেন।কেউ কেউ বলেন তাঁর গল্পের বা কাহিনীর পাঠক মূলত কৈশোর উত্তীর্ণ বয়স
পরিধি যাকে আমরা যৌবন বলে থাকি। এখানেই আমাদের গন্ডিবদ্ধতা ,বা একটা দূরত্ব অতিক্রম করে থেমে যাওয়ার প্রবণতা , কখনও সংস্কারবোধে ,কখনও বয়সবোধে। তাঁর বর্ণময়তা এখানেই বিজয়ী প্রানের জয়বার্তা কে অক্ষরে অক্ষরে উদযাপন করেছেন , না থেমে , না পিছিয়ে , নির্ভয়ে।আশিরোনখ সৌখিন , বিদ্বান ও সম্ভ্রান্ত নাগরিক হয়েও তিনি মনের টানে ঘুরে
বেড়িয়েছেন উপজাতি অধ্যুষিত ছত্রিশগড় , উড়িষ্যা ,ঝাড়খন্ড ও বিহারের অরণ্য প্রান্তরে। সঙ্গী হয়েছেন প্রান্তিক উপজাতি ও বনবাসী মানুষদের। ভাগ করে নিয়েছেন তাদের দারিদ্র্য , সংগ্রাময় অনিশ্চিত জীবন , ভাগ করে নিয়েছেন প্রান্তিক জীবনের নগর বিচ্ছিন্নতা এবং রাষ্ট্রিয় উদাসীনতা। এই সমস্ত জনজাতির উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন। আনন্দ ও অনুষ্ঠানে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন ভালোবেসে। তিনি বিশ্বাস করতেন সব মানুষে বৈপরীত্য নিয়ে বেঁচে থাকে। আপাত সুখী কিংবা সুভদ্র মানুষের মধ্যেও দুঃখী কিংবা ক্ষুধার্ত মানুষ দিব্য এবং সমান্তরাল বেঁচে থাকে। আমরা দেখতে পাইনা বা দেখার চেষ্টা করিনা। সার্থক উদাহরণ ' মাধুকরি ' উপন্যাসের পৃথু ঘোষ।
এক সাক্ষাৎকারে অকপট স্বীকার করেছেন তাঁর উপন্যাস কিংবা গল্পে সচেতন অথবা অন্যমনস্কতায় তাঁর ব্যক্তিজীবনের ছায়া ছড়িয়ে আছে।একজন লেখক বা কবির সৃষ্টির মধ্যে আত্মজৈবনিক উপাদান থেকে যায়। গল্প বা উপন্যাসে নিজেকে চরিত্রের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া সম্মন্ধে তাঁর কুণ্ঠাহীন স্বীকারোক্তি তাঁর সম্ভ্রান্ত ও সরল জীবনবোধের প্রকাশ একথা উল্লেখ বাহুল্য মাত্র। তাঁর চরিত্রের অন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো সহাস্য রসিকতাবোধ। নিজের
সম্বন্ধে উদার এবং মুক্ত রসিকতা ক'জন পারেন?
বহু উল্লেখ্যে একটুও ক্লিশে হয়নি সংগীতের প্রতি তাঁর অনুরাগ এবং গায়কীর নিজস্বতা। রবীন্দ্র গান এবং টপ্পা গানে তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর তন্ময় গায়ক।শিকার এবং জীবিকা হিসাবে চ্যাটার্ড এ্যকাউন্টেন্ট , দুই সামলেছেন প্রবল
দক্ষতায়।এই বর্ণময় প্রতিভার চলে যাওয়া , চলে যাওয়া নয় , শূন্যতার সৃষ্টি। মুক্ত চিন্তার লেখক ও কবিদের মহাপ্রস্থানে মেঘ জমে । মেঘ জমেছে
অরণ্য এবং হৃদয় প্রান্তরে ।
দ্বিতীয় বিভূতিভূষণ
বিশ্বজিৎ রায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় - এর " ইছামতী ", আরণ্যক "," বনে পাহাড়ে", " হে অরণ্যকথা", চাঁদের পাহাড় "- এ বুঁদ হয়ে থেকেছি সেই কিশোরবেলা থেকে। তাঁর সোনার কলমে আঁকা পৃথিবীর জল-জঙ্গল- পাহাড় - নদী - মাটির অপূর্ব সৌন্দর্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি আজও। বিভূতিভূষণের পাশাপাশি আরও অনেক স্বনামধন্য সাহিত্যিকের রচনা পাঠ করেছি। কিন্তু, প্রকৃতিকে তাদের গল্প- উপন্যাসে একটা চরিত্র করে তুলে তার কাছে পাঠককে মগ্ন করে রাখা, সেটা বিভূতিভূষণ ছাড়া আর কারও কলমে তেমন পাইনি। এই নিয়ে একটা গভীর গোপন খেদ ছিল আমার মনে দীর্ঘদিন
। বহুদিন পর হঠাৎ " কোজাগর " নামক একটা উপন্যাস পড়তে পড়তে আমি যেন আবার প্রিয় ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণের কলমের সুগন্ধ ফিরে পাই। ঠিক সেইরকম সমাজের একদম দলিত, অবহেলিতদের জীবনকথা, সঙ্গে জল-জঙ্গলের অপূর্ব চিত্রায়ণ। আমাকে মুগ্ধ করে তোলে। এরপর একে একে " বাংরিপোসির দু রাত্রি", " জঙ্গল মহল", "ছৌ", লবঙ্গীর জঙ্গলে", "কোয়েলের কাছে", ইত্যাদি যত পড়েছি ততই যেন আমি বুদ্ধদেবের কলমের প্রেমে পড়ে গেছি। জল- জঙ্গল ও সেখানকার আদিবাসী, মূলবাসীদের জীবন ও তাদের তাদের জীবনকে জড়িয়ে থাকা প্রকৃতির এতো মানবিক-আন্তরিক পটকথা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব গুহ ছাড়া কারও গল্প-উপন্যাস পড়ে আমি তৃপ্ত হইনি। আমার কাছে তাই লেখক বুদ্ধদেব গুহ এক অর্থে দ্বিতীয় বিভূতিভূষণ। হয়তো অনেকে আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন। কিন্তু, আমি নিরুপায়। বুদ্ধদেব গুহ নিজেও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিভূতিভূষণকে তাঁর প্রিয় লেখক বলে উল্লেখ করেছেন বারবার । হয়ত তাই, বিভূতিভূষণের obsession তাকে এমন করে তাড়া করে ফিরত সেই শৈশবকাল থেকে, যার ফলে চ্যাটার্ড একাউন্টেন্ট থেকে সাহিত্যিক বনে যাওয়া বুদ্ধদেবের কলমে অজান্তেই যেন বিভূতিভূষণ সস্নেহে ভর করেছিলেন। তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন একের পর এক জল-জঙ্গলের রূপ-রস-গন্ধ সমৃদ্ধ গদ্য-কাব্য। যা, বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়।
শুধু উপন্যাস নয়, বিভূতিভূষণের বিভিন্ন স্বাদের ছোটগল্পগুলির মতো বুদ্ধদেবের ছোটগল্পগুলিও আমাকে খুব টানে, মুগ্ধ করে। দিনের পর দিন অদ্ভুত মোহজাল বিস্তার করে আমাকে গোগ্রাসে পড়িয়ে নেয়। এই দুই কথাশিল্পীরই জীবদ্দশায় অনেক পুরস্কার পাওয়ার ছিল। পাননি। কিন্তু, পাঠকের কাছ থেকে যে পুরস্কার পেয়েছেন এবং মরণোত্তর কালেও যা পাচ্ছেন, সেটাই তাদের সৃষ্টির সেরা পুরস্কার।
বনজ্যোৎস্নার তান্ত্রিক,বনফুলের পুরোহিত, ঝরা-বনপাতার বাউল। যাঁর সাহিত্যসাধনার সালোকসংশ্লেষে নীরবে এসে মিশেছে টাঁড়, বন, অরণ্যের নিবিড় আলোজলবাতাস।তিনিই বুদ্ধদেব গুহ।সেই প্রাণপুরুষ মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল প্রথম হলদিয়া সারা বাংলা কবিতা উৎসবে।তিনদিন ব্যাপি এই অনুষ্ঠানে উনার মুখ থেকে শুনতাম উনার গল্প, জীবন কাহিনি এবং টপ্পা গান।বেশ মজার মানুষ ছিলেন উনি। আমাকে ছেলের মতো ভালোবাসতেন।তমালিকা পণ্ডা শেঠের মৃত্যু বার্ষিকী পালন অনুষ্ঠান হয়েছিল কলেজ স্কয়ারে। সেখানে উনাকে সম্মাননা জানানো হবে শুনে আমি আশিস দা, দেবাশিস দার সঙ্গে যেতে রাজি হলাম। তারপর পৌঁছেই উনার আসার অপেক্ষায় সময় গুনতে লাগলাম। তারপর উনি এলেন আমাকে দেখে ডাকলেন।প্রণাম করলাম।উনি আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, 'তোদের স্থান তো আমার এই বুকে।' সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল এই আদর সত্যিই পিতা- পুত্রের অন্যন্য সম্পর্কের অনুভব।
তাঁর অনেক গল্প আমি পড়েছি।যাঁর সঙ্গে অবাধ মিল আছে তিনি হলেন প্রকৃতি প্রেমিক ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিভূতিভূষণ যেভাবে অরণ্যকে দেখেছিলেন, বুদ্ধদেব দেখেছিলেন অন্য চোখে। জঙ্গল তাঁর প্রেম। প্রতিটি গাছের পাতা তাঁর চেনা। বাঙালির মধ্যবিত্ত জীবন থেকে তাঁর সাহিত্যের ভুবন কিছুটা দূরেই অবস্থান করতো। টাঁড়ে, বনে, অরণ্যে, বাঘের ডেরায় তার বিবরণ ছড়িয়ে আছে। তাঁর চরিত্ররা ঋজুদা, রুরু, পৃথু। নায়িকারা টিটি, টুই, কুর্চি। তিনি ছবি এঁকেছেন, ছড়া লিখেছেন, গানও গেয়েছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। আজও বেজে ওঠে তাঁর নিজস্ব গায়কিতে "ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে"। এমনই বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর তাঁর জীবন। ইংল্যাণ্ড, ইউরোপের প্রায় সব দেশ, কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ড, পূর্ব আফ্রিকা - তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। পূর্ব ভারতের বন-জঙ্গল, পশুপাখি ও বনের মানুষের সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। সাহিত্য রচনায় মস্তিষ্কের তুলনায় হৃদয়ের ভূমিকা বড় বলে তিনি মনে করতেন।মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়ের জেরেই বাংলাসাহিত্য পেয়েছে জঙ্গলের বিপুল এক মঙ্গলকাব্য। আর তিনি ক্রমে হয়ে উঠেছেন বিভূতিভূষণ-উত্তর নব্য বাংলাসাহিত্যের এক অনন্য 'অরণ্যপুরুষ'।শুধু তো জঙ্গলের নিবিড় উদ্ভিদ, ঝরাপাতা বনপল্লবের বর্ণগন্ধের ধারাপাতই নয়, তাঁর অরণ্য-পাঁচালির পরতে-পরতে মানুষের মেলাও কম আকর্ষণীয় নয়। হবে নাই-বা কেন! তথাকথিত সভ্য সমাজ থেকে দূরে কোনও অখ্যাত অনামা জনপদেই তো তিনি বারবার খুঁজে নিয়েছেন তাঁর 'আত্মীয়'দের-- চোখ বন্ধ করলেই তিনি দেখতে পান নাজিম সাহেব, কাড়োয়া, চাঁদুবাবু, আবু সাত্তার, বুধুয়াদের। এইসব মানুষের সঙ্গে তিনি একদা হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল, খুঁজেছেন, খুঁজে নিয়েছেন তাঁর ইচ্ছে,আবেগ ও ভালোবাসা।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'জঙ্গল মহল' । তারপরে বহু উপন্যাস ও গল্প প্রকাশিত হয়েছে। 'মাধুকরী' দীর্ঘদিন বেস্টসেলার। ছোটদের জন্য প্রথম বই ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বই 'কোজাগর','বাবলি','বাতিঘর', 'চানঘরে গান', 'একটু উষ্ণতার জন্য', 'হলুদ বসন্ত', 'ঝাঁকি দর্শন','জঙ্গল মহল' প্রভৃতি।
আজ আমিই সত্যি সত্যিই অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম। কারণ আর এমন করে কেউই কোনদিনভালোবাসবে না, গল্প কেমন লিখতে হবে আর কেউই বলবে না।খসে গেল আরও একটি নক্ষত্র। হিজলের শাখা থেকে চ্যূত হলো একটি পাতা।২০২১ সালের ২৯ অগাস্ট। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে বলি যে বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান চিরন্তন হয়ে থাকবে।।
প্রতিটি কবিতা ও প্রবন্ধে সুন্দর শ্রদ্ধামিশ্রিত নিবেদন করা হয়েছে। খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন