ধারাবাহিক উপন্যাস (শেষ পর্ব)
ছায়া - ছায়া অন্ধকারের আড়ালে
অনন্যা দাশ
সেদিন রাতটা আমাকে ওরা আমার অ্যাপার্টমেন্টেই কাটাতে বলল। টিম বলে যে একজন পুলিশ অফিসার বাইরে পাহাড়ায় থাকবে তাকে সব কিছু বুঝিয়ে সুজিয়ে দিয়ে রোহন আর মেগান চলে গেল। আমাকে অবশ্য বলে দিয়ে গেল যেন আমি টিম ছাড়া অন্য কারো জন্যে দরজা না খুলি।
তাও রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমি শুতে যাব কিনা ভাবছি এমন সময় দরজায় বেল! আমি ম্যাজিক আই দিয়ে দেখলাম টিম। আমি শিকল দিয়ে দরজা অল্প খুলে দেখি টিমের সঙ্গে গোপাদি আর গৌতমদা!
টিম আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এদের চেনো? ওরা বলছে খুব আর্জেন্ট দরকার তোমার সঙ্গে!”
আমি বললাম, “হ্যাঁ চিনি!”
টিম ওদের ঘরে ঢুকিয়ে নিজেও এসে ঢুকল।
গোপাদি বললেন, “তুমি চলে যাওয়ার পর একটা কথা মনে পড়ল...”
প্লপ করে একটা শব্দ হল আর আমি দেখলাম টিম পা ধরে মাটিতে বসে পড়ল। আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি গৌতমদার হাতে উদ্ধত বন্দুক! টিমকে তাও ওই অবস্থাতেই উঠে আসার চেষ্টা করতে দেখে আরেকবার প্লপ করে গুলি চালালেন নিজের সাইলেন্সার দেওয়া বন্দুক থেকে।
“সরি দীপা অনেকদিন ধরেই বুঝতে পারছি তোমাকে তো আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না! যত লোকে জানবে আমার তত বিপদ! পলাশ ব্যাটা আমাকে শুষে ফেলার চেষ্টায় ছিল তাই ওকে যেতে হল। ইলেকশানের জন্যে দাঁড়াবো আমি, মুখের কথা নাকি! কোনরকম স্ক্যানডেল বা ঝামেলা চলবে না! প্রথম বাঙালি এখানকার ইলেকশানে দাঁড়াচ্ছি জানো? সেটা কী কম গর্বের কথা?”
আমার মাথা ধাঁ করে বিদ্যুতের মতন খেলে গেল, সেদিন ওই অ্যাটিকের ঘরটায় ঐশীর সঙ্গে গৌতমদাই ছিল! পলাশ সেটাই দেখে ফেলে ওনাকে ব্ল্যাকমেল করছিল! তাই ওকে মরতে হল। আর ওই ঐশী বা জুলি নামের মেয়েটা আমি কতটা বুঝেছি জানার জন্যে আমার সঙ্গে এসে ছিল। বা গা ঢাকা দেওয়ার জন্যে, কে জানে কী মতলবে! তারপর আমাকে পাগল প্রতিপন্ন করে... আবার একটা কথা মনে পড়ে গেল...ডাক্তার মিত্রর নামই তো নয়ন! তার মানে ওই জুলি ডাক্তার মিত্রর বাড়িতে বেবি সিটার হয়ে ছিল।
“একদম নড়বে না আর ফোন ধরবে না! এইবার ব্যাপারটাকে তোমার আত্মহত্যার মতন করে সাজাতে পারলেই হয়ে গেল! টিমকে মেরে তুমি পাগল মেয়ে আত্মহত্যা করেছো!” তাকিয়ে দেখলাম আমার মাথার দিকে তাক করা গৌতমদার বন্দুক!
এদিকে টিমের রক্তে ঘর ভেসে যাচ্ছে। বেচারা হয়তো মরেই গেল । তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো বেঁচেও যেত! আমার গা গুলিয়ে উঠছিল, পড়ে যাচ্ছিলাম আমি। একটু নড়েছি অমনি প্লপ করে আবার গুলি! এই গুলিটা আমার পায়ে এসে লাগল! উফফ কী অসহ্য যন্ত্রণা! ফিনকি দিয়ে রক্ত! ধপাস করে পড়ে গেলাম আমি। জ্ঞান হারাবার আগে আমি দেখলাম গোপাদির হাতে আমার একটা ল্যাম্প উঠে এসেছে! কেন বোঝার আগেই আমার চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এল।
পরিশেষে
যখন আমার জ্ঞান হল তখন আমি হাসপাতালে। বেশ কিছুদিন ছিলাম হাসপাতালে। শকের জন্যে চিকিৎসা, গুলি লাগার চিকিৎসা সব হল। অনেকেই আমাকে দেখতে এসেছিল। সুনেত্রাদি, আমার ল্যাবের লোকজন, এমন কী আমার বস রজারও তার বউ আর একটা বড়ো ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির! ওকে দেখে আমি তো অবাক! আমার বাড়িওয়ালী মিসেস পালিওয়ালও এসেছিলেন। তবে আমার রেন্টার্স ইন্সুরেন্স ওই পুড়ে যাওয়া কার্পেট ইত্যাদির জন্যে টাকা দেবে কিনা সেটা জানতে! সব সময় নিজের ধান্দা! তাও আমি ওনার ওপর রাগ করতে পারেনি কারণ ওনার কথাতেই পুলিশ বুঝেছিল আমার বাড়িতে সত্যিই আরেকটা মেয়ে থাকত! আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছিলাম না!
যাই হোক পুরো ব্যাপারটা শুনে যা বুঝতে পেরেছি সেটাই বলছি। জুলি বলে মেয়েটা ডাক্তার মিত্রর বাড়িতে বেবি সিটার হিসেবে কাজে ঢুকেছিল। ভারতীয় মেয়ে কিন্তু ওকে দেখে বোঝার উপার ছিল না, চুল টুল সোনালি করে একেবারে অন্য রকম দেখতে করে ফেলেছিল নিজেকে। ছদ্মবেশে পারদর্শী ছিল মেয়েটা! কিছু একটা ঘটেছিল মনে হয় ওর জীবনে যার জন্যে ও পুরুষদের ঘৃণা করত। একেবারে ভয়ঙ্কর ম্যান হেটার! তাদের নিজের জালে ফাঁসিয়ে, নিজের প্রতি আকর্ষিত করে কোপ মারত। ডাক্তার মিত্র, পলাশ, গৌতমদা, কেউ বাদ যায়নি। পুলিশের ধারণা ও আর পলাশ মিলে মনে হয় গোউতমদাকে নিংড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। সেই জন্যেই সেদিন পলাশ আমাকে নিয়ে বাড়ি দেখাতে অত উৎসাহী হয়ে পড়েছিল। ওই এক ঝলকে আমি কিছুই তেমন দেখিনি বা বুঝিনি কিন্তু তাও জুলির সন্দেহ যায়নি! সে ঐশী সেজে আমার সঙ্গে থাকতে এসেছিল। পলাশও এমন অভিনয় করে গেছে যেন সে ঐশীকে চেনেই না! এবার বুঝছি কেন ঐশী আমার সঙ্গে কোন অনুষ্ঠানে যেতে চাইত না! ঐশী সঙ্গে জুলির কোন মিল ছিল না, বরং নিজেকে যতটা সম্ভব আমার মতন দেখতে করে ফেলেছিল মেয়েটা! আসলে ওর অশান্ত মনে বার বার ওই চিন্তাই এসেছিল যে আমি কিছু দেখে ফেলেছি কিনা। যাই হোক পলাশ গৌতমদাকে ভয়ঙ্কর রকম ব্ল্যাকমেল করা শুরু করে। উনি ইলেকশানে দাঁড়িয়েছেন তাই ওনার ভয়ও বেশি। কয়েকবার অর্থ দেওয়ার পর উনি মনে হয় ঠিক করেন যে শত্রুর শেষ রাখতে নেই তাই পলাশকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেন। সেখানেও জুলি/ঐশী ওনাকে সাহায্য করে। পলাশ মনে হয় ওর সঙ্গেও দুমুখো খেলা খেলছিল যেমনটা আমার সঙ্গে খেলার চেষ্টা করেছিল। এক দিকে ভারতে একজনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক আর এদিকে ...যাই হোক ওই বিয়ের খবর শুনেই মনে হয় ঐশীরও রাগ হয়। সে আমার ফোন ব্যবহার করে (মনে হয় আমার মতন গলা করে) পলাশকে ডেকে নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। পলাশের লোভই ওকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যায়। আমি ওদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ঐশী আমার ওপর নজর রাখছিল আমার বাড়িতে থেকে তারপর পুলিশের আনাগোনা শুরু হতে পালায়। নিজের কিছু জামাকাপড় না অন্য জিনিস ভুল করে ফেলে রেখে গেছে বলে আগুন লাগিয়ে সেগুলোকে নষ্ট করার চেষ্টাও করেছিল সে। এদিকে আমি জেনে গেছি বা কিছু একটা সন্দেহ করছি দেখে গৌতমদা আমাকেও শেষ করার প্ল্যান করেন। গোপাদি বেচারি প্রথমে কিছু বোঝেননি। কিন্তু পরে ব্যপারটাকে আন্দাজ করে উনিই আমার বাড়িতে একটা ল্যাম্প তুলে গৌতমদার মাথায় মেরে তাকে অজ্ঞান করে আমার প্রাণ বাঁচান। পুলিশকেও উনিই ডেকেছিলেন। গৌতমদার অবস্থা খারাপ। পুলিশের ওপর গুলি চালানো (টিম বেঁচে যাবে। দুটো সার্জারি হয়েছে ওর, কিন্তু সারা জীবন খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে ওকে। পুলিশের চাকরি আর করতে পারবে বলে মনে হয় না!), পলাশের খুন, আমাকে মারার চেষ্টা সব কিছু মিলিয়ে কবে যে ছাড়া পাবেন, মানে আদৌ ছাড়া পাবেন কিনা তার ঠিক নেই। সারা জীবন জেলে পচার সম্ভাবনাই বেশি। উনি মার্কিন নাগরিক তাই ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। ডাক্তার মিত্রর অবস্থাও ভালো নয়, ওনার ব্যবসা লাটে উঠতে পারে, প্রচুর নেগেটিভ পাবলিসিটি হয়েছে ওনার নামে। পলাশ আর ঐশীর চক্করে পড়ে আমার জীবনটা নষ্ট করতে বসেছিলেন। গোপাদি মনে হয় ভারতে ফিরে যাবেন কিছু দিন পর। ওনার উকিল ওনাকে কোন রকম দোষের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে। তবে জুলি/ঐশীকে ধরতে পারেনি পুলিশ। সে মনে হয় এখানকার পাট চুকিয়ে দিয়ে অন্য কোন একটা ছোট শহরে গিয়ে জাল ফেলার তোড়জোড় করছে! যদিও ও খুন করেনি কাউকে বলে পুলিশ ওকে নিয়ে তত চিন্তিত নয়। যে সব ছেলেগুলোকে শাস্তি দিয়েছে তারা প্রকৃতই বদমাইশ। আর আমার সঙ্গে এত দিন থেকেও আমাকে মারেনি তাই ওর পালিয়ে যাওয়া নিয়ে ওদের মাথা ব্যথা নেই বিশেষ, আমারও না।
ও একটা কথা বলা হয়নি। রোহনও রোজ আসে আমাকে দেখতে। বলে অফিশিয়াল ক্যাপাসিটিতে আসছে, কিন্তু আমার সন্দেহ হয়। অফিশিয়াল ক্যাপাসিটিতে কী কেউ চকোলেট, টেডি বেয়ার ইত্যাদি নিয়ে আসে?
সমাপ্ত
আগামী শুক্রবার থেকে ঔপন্যাসিক অনন্যা দাশের আর একটা নতুন ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস "আংটি রহস্যের নেপথ্যে" প্রকাশিত হবে। আপনারা পড়ুন।মতামত জানান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন