বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২০

ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৪) ।। অষ্টভুজ রহস্য অলোক চট্টোপাধ্যায়

 



ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৪)




অষ্টভুজ রহস্য

অলোক চট্টোপাধ্যায়


-বসুন দাদাবাবু। লোকটা বলল। খসখসে গলা, ঠিক যেন সুবল দা। সেতো কবেই মারা গেছে। আর বেঁচে থাকলেও তার বয়েস হত নব্বইএর কাছাকাছি। এর বয়েসতো মনে হয় ষাটও হয়নি। তাছাড়াও মনে হচ্ছে তার আসার খবর এই লোকটা জানত। কিন্তু তা কি করে হবে?

পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার জন্যই কিছুটা তিনি প্রশ্ন করলেন – তুমি কি জানতে আমি আসব? কলকাতা থেকে ফোন করেছিল কেউ? উত্তরে লোকটা অন্ধকারেই মাথা নাড়ল মনে হয়। খসখসে স্বর শোনা গেল –আমিও তো থাকিনা এখানে।আপনাদের কারো আসার খবর পেলে আসি।তবে কেউ তো বিশেষ আসে না আর। বড়বাবু মারা যাবার পর থেকেই তো বাড়ি খালি। এই আপনিই তো কত বছর বাদে এলেন। 

বি্জয়বাবু অন্যমনস্ক ভাবে গণেশজননী ছবিটার ওপর হাত বোলাচ্ছিলেন। যেন ছুঁতে চাইছিলেন অতীতকে। লোকটার কথায় হঠাৎ বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সুবলদা দাদুকে বড়বাবু বলে ডাকত। দ্বিধান্বিত ভাবে সোফাসেটের পাশ কাটিয়ে পুরোনো ইজিচেয়ারটাতে বসে পড়লেন। জিগ্যেস করলেন – কিন্তু তুমি কে? কি নাম? এ বাড়ির দেখাশুনো কি তুমিই কর নাকি? 

-সে অনেক কথা । সব বলছি। লোকটা বলল। - কফি খাবেন তো? আপনি তো আবার কালো কফি খান। বিস্মিত বিজয়বাবু তাকে জিগ্যেস করতে চাইছিলেন সে কি করে জানল তিনি কালো কফি পছন্দ করেন। কিন্তু তার আগেই লোকটা লন্ঠনটা নিয়েই ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকে গেছে। অবাক হয়ে বিজয়বাবু ভাবতে লাগলেন তবে কি সুজয় ফোন করে একে খবর দিয়েছে? কিন্তু তা কি করে হবে? কিন্তু সেই তো বলেছিল এখানে কেউ থাকেনা। তাছাড়া বাড়িঘরের যেরকম অবস্থা বলেছিল সে রকমও তো নয়। তবে কি সুজয় তার সঙ্গে মজা করতে চেয়েছিল? ভুতুড়ে গল্প বানিয়ে বলে চুপচাপ ঘরদোর সব সারিয়ে ঠিকঠাক করে তাকে নিয়ে এসে অবাক করে দিতে চেয়েছিল? নাঃ, তাহলে তো সে নিজে নিশ্চয়ই সঙ্গে আসত, না হলে মজাটাই তো মাটি।

এদিকে লোকটা লন্ঠনটা নিয়ে চলে যেতেই ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সুজয়ের ভৌতিক গল্পগুলোর কথা ভেবে তার গা-টা কেমন যেন শিরশির করে উঠল। পরক্ষনেই মনটাকে শক্ত করলেন তিনি। ফিজিক্সের অধ্যাপক হয়ে এসব কি আবোলতাবোল ভাবছেন তিনি। কিন্তু এত অন্ধকার কেন? সবে ছ’টা বাজে । আকাশে কি মেঘ করেছে। লোকটাই বা গেল কোথায়? এতক্ষন কি করছে? 

যেন অনন্ত কাল পার করে লোকটা ফিরল। একহাতে লন্ঠনের সঙ্গে অন্য হাতে ট্রে-তে কফির কাপ। লন্ঠনটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে একটা ছোটো টিপয় তার ইজিচেয়ারের পাশে রেখে কফির কাপ রাখল তার ওপর। তারপর একটু পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল লন্ঠনের আলোর বৃত্তের বাইরে।

-বাঃ, বেশ ভাল বানিয়েছো কফিটা। একটা লম্বা চুমুক মেরে বললেন বিজয়বাবু। যদিও কফিটা বেশ কড়া , আর কিছুটা তিতকুটেও হয়ে গেছে, গরমও বিশেষ নয় তাও কিছু একটা বলার জন্যেই বললেন তিনি। লোকটা কোনো কথা বলল না। আরো একটা চুমুক দিয়ে বিজয়বাবু বললেন – ভেতর বাড়িটা একটু দেখব। শুনেছিলাম যে সব নাকি ভেঙেচুরে গেছে, তা এই ঘরটা তো দিব্যি ঠিকঠাক আছে দেখছি। লোকটা কি তার কথা শুনে হেসে উঠল? অন্ধকারে সাদা দাঁতগুলো যেন বেরিয়ে এসেছে। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার শরীরটা যেন কেমন করে উঠল। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল। খুব তাড়াতাড়ি কফিতে আরো দুটো চুমুক দিলেন তিনি। কিন্তু মাথা ঘোরা কমল না, শরীরের অস্বস্তিটাও বেড়ে উঠল আরো ।

বিজয়বাবুর মনে হল সারা ঘরটা যেন তার চোখের সামনে আসবাবপত্র সমেত দুলছে। যেন কেউ তার ইজিচেয়ারটা শূন্যে ভাসিয়ে দিয়েছে। চোখের সামনে অন্ধকারটা যেন কোথাও গাঢ় কোথাও হালকা হয়ে তৈরি করছে ছায়া ছায়া মানুষের অবয়ব। ঘরের কোনে ও কে বসে? সামনে মোটা মোটা জাবেদা খাতা নিয়ে জীবনদাদু নাকি? সামনে লন্ঠনের আলোর বাইরে দাঁড়ান লোকটা ঠিক যেন সুবলদা। কিন্তু সুবলদার মুখটা অমন বীভৎস দেখাচ্ছে কেন? সুবলদা কি হাসছে? দাঁতগূলো বেরিয়ে পড়েছে বিশ্রী ভাবে। ভেতর বাড়ির দরজাটা আপনা আপনি খুলে যাচ্ছে। সাদা ফতুয়া পরে ও কে? দাদু, দাদু – দ্যাখো আমি কাল্টু। সুবলদা ওরকম পাগলের মত হাসছে কেন? দাদু, আমার ভয় করছে দাদু। ভীষন ভয় করছে। দাদু আমাকে  বাঁচাও দাদু –

একটা গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ডুবন্ত মানুষ যেমন হাত-পা ছুঁড়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করে সেই রকম করতে চাইলেন তিনি। কিন্তু পারলেন না, তার সারা শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। আর কিছু ভাবতে পারছেন না তিনি। ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে একটা কালো পর্দা নেমে এল।


কতক্ষণ – কত যুগ পরে যেন জ্ঞান ফিরে এল বিজয়বাবুর। কোথায় আছেন তিনি? দূর থেকে কারা যেন চিৎকার করছে। আস্তে আস্তে চেতনা ফিরে আসছে তার। কোথায় তিনি? অন্ধকার আছে বটে তবে তা অনেকটা ফিকে। চাঁদের আলোয় চারদিক পরিষ্কার হয়ে উঠছে ক্রমে। এত চাঁদের আলো আসছেই বা কোত্থেকে? দেখার জন্যে ধীরে ধীরে ঘাড় ঘোরালেন তিনি। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। কিন্তু একি! তার মাথার ওপর ছাতের অনেকটাই তো নেই। পাশের দুটো জানলাও কপাটহীন। আবছা আলোয় তার চোখের সামনে ক্রমশ ফুটে উঠল একটা ভাঙাচোরা ঘরের কংকাল। দেওয়ালে বড় বড় ফাটল। কিন্তু   দেওয়ালের কোনগুলো পরিষ্কার বেশ বোঝা যাচ্ছে। এ তো সেই অষ্টভুজ ! কিন্তু এ কি করে হল? এই কিছুক্ষন আগে দেখা ঘরটা এভাবে বদলে গেল কি ভাবে?  কোথায় বসে আছেন তিনি? ধড়মড় করে উঠে বসে দেখলেন একটা লম্বা হাতওয়ালা ইজিচেয়ারের কাঠামো। ওপরে লেগে আছে ছেঁড়া ক্যানভাসের টুকরো। সামনের দেয়ালে ট্যারচা হয়ে ঝুলছে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি –। পকেট হাতড়ালেন মোবাইল ফোনটার জন্য। আঃ, টর্চের সুইচটা গেল কোথায়?

কারা যেন দূর থেকে দাদা-দাদা বলে ডাকছে। সুজয়? বিজয়বাবু শরীরের সব শক্তি এক করে চিৎকার করে সাড়া দিলেন – আমি এখানে –

কয়েক মুহূর্ত। তার পরেই ঘর ভরে গেল টর্চ আর চার্জার ল্যাম্পের আলোয়। সুজয়, নীলমনি আরো কারা সব যেন। সুজয় কাঁদছে। -দাদা, আমি এতবার করে তোমাকে বারণ করলাম এভাবে একা একা এসো না। তুমি কিছুতেই শুনলেনা। কি বিপদের মধ্যে পড়েছিলে জানিনা, কিন্তু কিছু একটা হয়ে গেলে আমরা তো -। বলতে বলতে কান্নায় বুজে এল তার গলা।

উজ্বল আলোয় চারদিকে চেয়ে দেখলেন বিজয়বাবু। সেই অষ্টভুজ ঘর। শৈশবের স্মৃতি। চারদিক ভেঙে পড়েছে। ধুলোয় ঢাকা, আবর্জনায় ভরা। একপাশের ছাত ভেঙে পড়েছে । পুরোনো আসবাবপত্রের অবশেষ ছড়ানো চতুর্দিকে। সামনের দেওয়ালে পেরেক খুলে একদিকে কাত হয়ে ঝুলছে ধুলোয় ঢেকে যাওয়া গণেশজননীর বাঁধানো প্রিন্ট। তার মাথাটা ঘুরে উঠল আবার । কোথায় পৌঁছেছিলেন তিনি? কোন অতীতের গর্ভে? কেমন করেই বা ফিরে এলেন আবার? তার সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগল। আবার জ্ঞান হারালেন তিনি।



(ক্রমশ)



--------------------------------------------------------------------------------

এই বিভাগে আপনিও আপনার অপ্রকাশিত লেখাটি আজই পাঠিয়ে দিন।

ankurishapatrika@gmail.com


☝☝☝☝☝☝☝☝☝


লাইক ও কমেণ্ট করুন👇👇👇👇

https://wwwankurisha.blogspot.com/2020/11/blog-post_18.html






--------------------------------------------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন