শুক্রবারের
ছোটদের জানা ও অজানার গল্প
আঁচড়হাটি জঙ্গলের বাঘ
রতনতনু ঘাটী
আমি সারা জীবনে বাঘ দেখব বলে কম জঙ্গলে ঘুরিনি। আজকাল টাইগার রিজার্ভ ছাড়া বাঘের দেখা পাওয়া মুশকিল। একমাত্র সুন্দরবনের বাঘ ভাগ্যে থাকলে দেখা যায়। সুন্দরবনের গোসাবায় আমার ফুলিপিসির বাড়ি। সেখানে কবে থেকে যাব-যাব করেও যাওয়া হয়নি। কখনও পরীক্ষা, কখনও দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা, এসব সামলে আর যাওয়াই হয়নি। এখন বড় হয়েছি। আমি ভূমিরাজস্ব অফিসে চাকরি পেয়েছি। এখন ইচ্ছে করলে ফুলিপিসির বাড়ি যাওয়াই যায়।
আমরা কয়েকজন মিলে জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়ার একটা দল তৈরি করেছি। আমাদের বন্ধু অন্তুই তার নাম রেখেছে ‘টিম-টাইগার’। টিম-টাইগারের সদস্য মোটে চারজন। আমি, অন্তু হালদার, ভবেশ দাস আর শ্রীনিবাস নিয়োগী। অন্তু জেলাপরিষদ অফিসে কাজ পেয়েছে। ভবেশ শহরতলির একটা স্কুলে সহশিক্ষকের চাকরি করছে বছর তিনেক হল। স্কুলটার নাম আকুতিনগর উচ্চ বিদ্যালয়। শ্রীনিবাস ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে পোস্টিং বাঁকুড়ার জয়পুরে। বলা যায় শ্রীনিবাসই আমাদের মধ্যে বাঘ দেখার নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। শ্রীনিবাসের রেফারেন্সে আমরা অনেক ফরেস্ট বাংলোয় বেড়াতেও গিয়েছি।
শ্রীনিবাস ছুটিছাটায় বাড়ি এলে কত যে বাঘের গল্প বলে। না, বাঘ সে নিজেও কখনও চোখে দ্যাখেনি ঠিকই। তবে জঙ্গলে তার পোস্টিং, তাই সে বাঘের যেসব গল্প শুনে এসে আমাদের কাছে বলে, তার সিক্সটি পারসেন্ট গুলগল্প বলে ফেলে দিলেও, যে ফর্টি পারসেন্ট পড়ে থাকে, সেটুকুকেও হেলাফেলা করা যায় না। অন্তত আমরা তিনজনই হেলাফেলা করিনি কোনও দিন।
আমি এর মধ্যেই গত কলকাতা বইমেলা থেকে শখ করে বেশ কয়েকখানা বাঘের উপর লেখা বই কিনেছি। তার মধ্যে বাঘ নিয়ে লেখা গল্পের বইও যেমন আছে, জিম করবেটের লেখা ‘ম্যান-ইটার্স অফ কুমায়ুন’ এবং ‘দ্য ম্যান-ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ বই দুটিও আছে। বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে বাল্মীক থাপারের লেখা ‘লিভিং উইথ টাইগার্স’ বইটা হঠাৎ একটা পুরনো বইয়ের দোকানে পেয়েই কিনে নিয়েছি। এই তো সেদিন বাংঘের গল্পের সংকলনের একটা বইতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বুকের উপরে বাঘ’ গল্পটিও আমি পড়ে ফেললাম।
এবার শ্রীনিবাস ছুটিতে বাড়িতে ফিরেই ফোনে আমাদের খবর পাঠাল, ‘তোরা আজ সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে চলে আয়। একটা দারুণ ফরেস্টের খোঁজ পেয়েছি।’
ওর ফোন পেয়ে আমরা তিনজনই উত্তেজিত। সন্ধেবেলা অফিস ফেরত আমরা তিনজন হাজির ওর বাড়িতে। আমরা জঙ্গলের খবর শোনার জন্যে উসখুস করছি। দেখি, শ্রীনিবাস জঙ্গলের কথা তুলছেই না। এ কথা সে কথার পর কফি দিয়ে গেলেন কাকিমা। কফিতে চুমুক দিয়ে পা দুটো সোফার উপর তুলে জমিয়ে বসে প্রথম আমাদের দিকে তাকিয়ে শ্রীনিবাস বলল, ‘নে, কফি খা!’
আমি বললাম, ‘তুই নতুন জঙ্গলের কথাটা তো বল? শুনব বলেই তো ছুটে এসেছি।’
আমার দিকে তাকিয়ে শ্রীনিবাস বলল, ‘দ্যাখ দেবতোষ, এবার যে জঙ্গলের খোঁজ পেয়েছি, সেখানে বাঘের দেখা পাওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়। এক্কেবারে পাক্কা!’
‘জায়গাটা কোথায় বলবি তো?’ কফিতে লম্বা চুমুক দিয়ে অন্তু জিজ্ঞেস করল।
ভবেশ চোখ নাচিয়ে বলল, ‘জায়গাটা বল তো আগে! সেবার করবেট ন্যাশনাল পার্কে বাঘ দেখাবি বলে কত ধুমধাম করে আমাদের নিয়ে গেলি। জঙ্গলের ভিতরের গেস্ট হাউস বুক করে রাখলি আগে থেকে। আমরা জানি যে করবেট পার্কে অনেক বাঘ আছে। কিন্তু সবই তো ফক্কা হয়ে গেল। বাঘের লেজ পর্যন্ত দেখাতে পারলি না।’
আমি বললাম, ‘গতস্য শোচনা নাস্তি! যা গেছে তা গেছে। এখন যা ঘটতে চলেছে সে নিয়ে কথা বল! শ্রীনিবাস, বল তো আগে, জায়গাটা কোথায়?’
শ্রীনিবাস খানিক চুপ করে থাকার পর বলল, ‘জায়গাটা হল কালিম্পংয়ে।’
আমার বাঘ নিয়ে যেটুকু পুঁথিগত বিদ্যা, আমি বললাম, ‘কালিম্পংয়ে বাঘ? কী বলছিস তুই? অত হাই অল্টিচিউটে বাঘ মানে রূপকথার গল্প হয়ে গেল না রে শ্রীনিবাস?’
শ্রীনিবাস মাথা দুলিয়ে বলল, ‘সেটাই খবর! বছর দু’-তিন আগে খবর পাওয়া গেছে, এক শীতের সন্ধেবেলা নর্থ প্যাঙ্গোলাখা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে লুকিয়ে পেতে রাখা ক্যামেরায় ধরা পড়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ফোটো। অনুসন্ধানী দলের একজন বলেছেন, ‘আমরা বাঘের যাতায়াতের একটা সরু রাস্তাও জঙ্গলের মধ্যে দেখতে পেয়েছি। ধুলোর উপর বাঘের থাবার চিহ্ন দেখে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, বাঘ ওই পথে শিকারের সন্ধান করে গভীর জঙ্গলে ফিরে যায়। তবে বাঘ আছে একটা নয়, দুটো। তাঁদের ক্যামেরায় বাঘের ফোটোও তোলা সম্ভব হয়েছে। একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘ জঙ্গলের পথে হেঁটে যাচ্ছে।’ বলে শ্রীনিবাস ঘরের ভিতর উঠে গিয়ে একটা ফাইল বের করে আনল। আমরা চোখ বড়-বড় করে দেখছি। সত্যি-সত্যি শ্রীনিবাস একটা মস্ত বাঘের ফোটো বের করে দেখিয়ে বলল, ‘এই সেই বাঘের ফোটো। তোরা যদি বিশ্বাস না করিস, তাই এক কপি ফোটো আমার ফরেস্ট রেঞ্জারকে দিয়ে আনিয়েছি।’
আমরা তিনজনই হুমড়ি খেয়ে বাঘের ফোটেটা দেখতে লাগলাম। অন্তু বলল, ‘আরে এ তো মস্ত বাঘ!’
শ্রীনিবাস বাহাদুরি কুড়নোর ভঙ্গিতে বলল, ‘তা হলে আর বলছি কী? অত উপরে এই প্রথম বাঘের খবর পাওয়া গেল।’
ভবেশ বলল, ‘করবেটের জঙ্গলে দু’শো পনেরোটা বাঘ থাকা সত্ত্বেও একটা বাঘের দেখা পেলাম না। আর এখানে একটা কি দুটো বাঘ! তা দেখতে আমাদের ছোটা ঠিক হবে না।’
শ্রীনিবাস বলল, ‘আরে, একটা প্রবাদ আছে না—বাঘের দেখা, সাপের লেখা! ভাগ্যে থাকলে বাঘের দেখা মিলবেই। কালিম্পংয়ের নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে বাঘের থাবা লক্ষ করেছেন ডি এফ ও-রা। তাঁদের অনুমান, ওখানকার ইয়াকের সুস্বাদু মাংসের লোভে বাঘ ওখানে অত হাই অল্টিচিউডেও দেখা গেছে।’
আমি বললাম, ‘শ্রীনিবাস, আমরা যে জায়গাটায় বাঘ দেখতে যাব, সে জঙ্গলটার নাম কী?’
শ্রীনিবাস কেসে নিয়ে বলল, ‘এ কোনও নামী জঙ্গল নয়। এটা সরকারি ব্যাঘ্রপ্রকল্পও নয়। জঙ্গলটার নাম ‘আঁচড়হাটি’। ছোট্ট জঙ্গল। লম্বায়-চওড়ায় কয়েকশো একরের মতো। ঘন জঙ্গলে ঢাকা। জঙ্গলটা শাল-সেগুন গাছে ভরতি। অনেক চিতল হরিণও আছে। তবে চর্যাপদে একটা কথা আছে না—‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। এখানেও তাই হয়েছে। হরিণের বড় শত্রু হল তার নিজেরই সুস্বাদু মাংস। সেই লোভে মানুষ হরিণ শেষ করে ফেলছে এই আঁচড়হাটির জঙ্গলেও। দু’ দিন পরে বাঘেরও খাদ্যসংকট দেখা দেবে। তখন বাঘ আবার অন্য জঙ্গলে পাড়ি জমাবে। এখনই চল, যাই, বাঘ দেখে আসি!’
আমি বললাম, ‘জায়গাটা কোথায়, কীভাবে যাওয়া যাবে, কতদিনের প্রোগ্রাম, থাকব কোথায়, সেসব তুই ঠিক করে বল। আমার তো সরকারি অফিস। ছুটির সমস্যা নেই।’
অন্তু একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সামনে যদি ইলেকশান ডিক্লেয়ার করে দেয়, তবে আমার ছুটি পাওয়ার চান্স নেই। তার আগে চল, দিন পনেরোর মধ্যে একটা প্ল্যান খাড়া করা যাক।’
শ্রীনিবাস ঘাড় নেড়ে বলল, ‘আগে দেখি, থাকার জায়গাটা পাই কিনা। তোরা মনে-মনে তৈরি হয়ে থাক। আমি ফরেস্টে গিয়ে সব খোঁজখবর করে তোদের ফোন করছি।’
ভবেশ সব কিছুতে গাঁইগুঁই করতে পছন্দ করে। মাথা চুলকে বলল, ‘সেই কবে করোনা পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছে বলা যায়! অথছ আমার স্কুলে করোনার সময় ক্লাস নাইন-টেনকে অন লাইনে যে কোচিং করানোর চল শুরু হয়েছিল, সে আজও চলছে। স্কুলের সময় ক্লাস, সন্ধে থেকে অন লাইন কোচিং। কী যে জ্বালায় পড়েছি না। দেখি, হেডস্যারকে কথাটা বলে ছুটি পাই কিনা।’
এরকমই বলা-কওয়ার পর শ্রীনিবাস বাঁকুড়ার জয়নগরের জঙ্গলে তার ডিউটির জায়গায় চলে গেল। গিয়েই শুনল প্রিন্সিপ্যাল চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট আসছেন মহারাষ্ট্র থেকে জয়পুরে। তবে দিন পনেরোর মধ্যে তাঁর আসার এবং চলে যাওয়ার পর্ব মিটে যাবে।
সেদিন শ্রীনিবাসের ফোন এল অন্তুর কাছে। শ্রীনিবাস বলল, ‘শোন, আমাদের আঁচড়হাটির জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়ার কোনও বাধা আপাতভাবে নেই দেখতে পাচ্ছি। তবে আলিপুর আবহাওয়া অফিস থেকে খবর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে তৈরি হচ্ছে একটা নিম্নচাপরেখা। সেটি যদি দিন পনেরোর মধ্যে শক্তি অর্জন করে প্রবল আকার ধারণ করে, তা হলে আমার ছুটি বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবু তোরা তৈরি থাকিস!’
অন্তু সকলকে এই খবরটা কনভে করে দিল। অন্তু বলল, ‘এর মধ্যে আমাদের টিকিট কেটে ফেলতে হবে। আমরা এন জে পি’র টিকিট কেটে নিই অন লাইনে?’
আমি বললাম, ‘তুই তা হলে ট্রেনের টিকিটটা কেটে নে শিয়ালদা থেকে এন জে পি। তারিখটা সতেরো নভেম্বর, মনে রাখিস কিন্তু।’
সেরকমই টিকিট কেটে ফেলল অন্তু। কোন ট্রেন কোন স্টশন থেকে কোথায় যায়, সব অন্তুর নখদর্পণে। এক-এক সময় আমার সন্দেহ হয়, অন্তু বুঝি কখনও রেলওয়েতে চাকরি করত কি? না হলে ট্রেনের এত খবর জানল কেমন করে?
দিন যতই এগিয়ে এল, ততই দেখা গেল, বঙ্গোপাগরের নিম্নচাপ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আপাতত তার আর দেখা পাওয়ার চান্স নেই। এর মধ্যে শ্রীনিবাসের প্রিন্সিপ্যাল চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট, মহারাস্ট্রের ভদ্রলোকের শ্বশুরমশাইয়ের মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেছে। তিনি তড়িঘড়ি শ্বশুরবাড়িতে সপরিবার রওনা হয়ে গেছেন বেঙ্গালুরুতে। যা খবর, তাঁর দিন পনেরোর আগে তো ফেরাই হবে না।
আমরা কোথায় উঠব, সেসব শ্রীনিবাস খোলসা করে কিছুই জানায়নি। শুধু ফোন করে অন্তুকে বলে দিয়েছে, ‘সতেরো তারিখ তোরা ট্রেনে চড়ে পরের দিন এন জে পি-তে নেমে স্টেশনের বাইরে চলে আয় ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। দেখবি একটা ঝাঁকড়া কৃষ্ণচূড়া গাছ ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। তারই ছায়ায় আমি তোদের নিতে দাঁড়িয়ে থাকব।’
ক’ দিনের জন্যে আমরা আঁচড়হাটির জঙ্গলে যাচ্ছি, সেসব কোনও কথাই শ্রীনিবাস জানায়নি। দিন সাতেকের বেশি লাগবে না ধরে নিয়েই চব্বিশ তারিখ ফেরার টিকিট কেটে রেখেছে অন্তু।
রোদ ঝলমলে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামতেই মন ভাল হয়ে গেল সকলের। কাঁচা সোনার মতো রোদ উঠেছে। স্টেশনের বাইরে তিন-চারটে চ্যানেলে অনেক ভাড়ার জিপ দাঁড়িয়ে আছে। প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেছে। ওদের সেসব কিছু করতে হল না। দূর থেকে হাত নেড়ে শ্রীনিবাস ডাকল। গাড়ি রেডি করেই রেখেছিল শ্রীনিবাস। লাগেজ উঠিয়ে নিল ড্রাইভার। অন্তু ড্রাইভারের বাঁ দিকের সিটে বসল। আমি, ভবেশ আর শ্রীনিবাস, আমরা মাঝের সিটে তিনজন। গাড়ি স্টার্ট দিতেই শ্রীনিবাস ড্রাইভারকে বলল, ‘রাজদীপ, কালিম্পং চলো!’
ড্রাইভার ছেলেটির বছর বাইশেক বয়স হবে। হাসিখুশি। নিচু স্বরে কথা বলে। সে আগে নাকি এর আগে বার দুয়েক আঁচড়হাটির জঙ্গলে টুরিস্ট নিয়ে গেছে। শ্রীনিবাস জলপাইগুড়ি রেঞ্জের ফরেস্টের লোকজনের কাছ থেকে ওর খোঁজ পেয়েছে।
গাড়ি স্টার্ট দিয়েই ছুটছিল সাঁইসাঁই করে। রাজদীপ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা আঁচড়হাটির জঙ্গলে বাঘ দেখতে যাচ্ছেন তো? সে কি আর সকলের ভাগ্যে ঘটে? শুনেছি, মাত্র গোটা তিনেক বাঘ আছে জঙ্গলটায়।’
শ্রীনিবাস হেসে বলল, ‘আমি তো শুনেছি, দুটো বাঘের কথা। যেসব ফরেস্ট ওয়াচারের ক্যামেরায় তারা ধরা পড়েছে, তার সংখ্যা দুই। তুমি আবার শুরু থেকে বাঘের সংখ্যা বাড়িয়ে বলতে শুরু করলে যে?’
রাজদীপ বলল, ‘বাঘ দেখতে পেলে দেখবেন। বাঘ তো আর আমার পোষা বাঘ নয়। জঙ্গলে বাঘ দেখতে টিকিটও লাগে না। চলুন!’
শ্রীনিবাস বলল, ‘রাজদীপ, আমি শুনেছি, আঁচড়হাটির জঙ্গলে একটা ‘বাঘপথ’ নামে নাকি একটা রাস্তা আছে। স্থানীয়রা সে রাস্তাটার ওরকম নাম রেখেছে। বাঘ ওই পথে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে হরিণ আর ইয়াকের খোঁজে। সন্ধের মুখে বাঘ ফিরে যায় জঙ্গলের ওই পথ দিয়েই। তুমি কি সে পথটা চেনো?’
রাজদীপ সত্যি কথা বলতে পছন্দ করে বোঝা গেল। সে গুলগাপ্পায় বিশ্বাস করে না। রাজদীপ বলল, ‘একবার গিয়েছিলাম। নেওড়া ভ্যালি থেকে তিরিশ কিলোমিটার জঙ্গলে ঢুকলে তবে আঁচড়হাটির জঙ্গল। সে রাস্তার পাশে গভীর জঙ্গলের দিকে এগোলে একটা ছোট জলাশয় পড়ে। শুনেছি হরিণরা সেখানে জল খেতে আসে। আর জানেন তো স্যার, হরিণ আসে মানে বাঘও আসবে। শিকারের লোভে তো বটেই, বাঘেরও তো তেষ্টা পায়।’
‘আঁচড়হাটি জঙ্গলে ঢুকলে কিলোমিটার খানেক এগোলে একটা ‘লেপচা ভিলা’ আছে। ওর মালিক ফুরকিত লেপচা। টুরিস্ট গেলে সে ওখানে থাকার ব্যাবস্থা করে দেয়। ফুরকিতের ছেলে মিলন লেপচা আঁচড়হাটির জঙ্গলটা ভাল করে চেনে। আমাদের আজ ফুরকিত লেপচার ভিলায় থাকার কথা। তুমি ওখানে নিয়ে চলো!’
শ্রীনিবাসের কথায় ঘাড় নাড়ল রাজদীপ। এবার শুরু হয়ে গেল জঙ্গল। দু’ পাশে বড় বড় শাল-সেগুনের প্রাচীর। দু’-একটা বনপাখি এদিক থেকে উড়ে ওপারের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ রে শ্রীনিবাস, ওখানে ফরেস্ট বাংলোটাংলো নেই?’
শ্রীনিবাস বলল, ‘আরে, এটা পপুলার টুরিস্ট স্পট নয় রে। এখানে এখনও রিসর্ট তৈরি হয়নি, গেস্ট হাউসও নেই, থাকার মতো হোটেলও পাবি না। যা আছে সবেধন ওই একটাই ‘লেপচা ভিলা’। ফুরকিতের বউ জানকী দারুণ বনমুরগি রাঁধতে পারে বলে শুনেছি। ওটা পেলে জমে যাবে!’
অন্তু বলল, ‘বনমুরগি জুটুক কি না জুটুক, বাঘ দেখতে পেলেই হল। আমার অত দামি ক্যামেরাটা এনেছি তো! নিরাশ করিস না যেন! অন্তত একটা বাঘের ফোটো না তুলে ফিরব না, এই বলে দিলাম।’
শ্রীনিবাস বলল, ‘বাঘের ফোটো না হোক, ভল্লুকের ফোটো এক-আধটা তুলতে পারি নিশ্চয়ই।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন, আঁচড়হাটির জঙ্গলে বুঝি ভল্লুকের দেখা পাওয়া যায়?’
শ্রীনিবাস বলল, ‘দ্যাখ দেবতোষ, এরকম তো শুনেছি! চল, গিয়ে সব ঠিকঠাক দেখা যাবে। সব জঙ্গল নিয়েই কত না কাহিনি ছড়িয়ে থাকে। আঁচড়হাটি নিয়েও কত না গল্প শুনেছি।’
নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের গেট ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল ‘লেপচা ভিলা’র দিকে। সূর্য বিকেলের দিকে ঢলে পড়েছে। সবুজ বনরেখার উপর তারই শেষ আলো স্পর্শ রেখে অস্তাচলে চলে যাবে একটু পরে। কিছুক্ষণ পরে আমাদের গাড়ি পোঁছে গেল ফুরকিত লেপচার ভিলায়। একটা বছর বাইশের ছেলে এসে তুবড়ে যাওয়া গেটটা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা জলপাইগুড়ির ফরেস্ট রেঞ্জার সাহেবের কাছ থেকে আসছেন তো?’
শ্রীনিবাস বলল, ‘হ্যাঁ। আমাদের চারদিনের বুকিং আছে তোমাদের ভিলায়। তোমার নাম কী? ফুরকিত লেপচা নেই?’
ছেলেটা বলল, ‘আমার নাম মিলন লেপচা। বাবা আপনাদের জন্যে হাটবাজার করে আনতে গেছে নেওড়া ভ্যালিতে। এক্ষুনি চলে আসবে।’
মিলন কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওদের উপরের কাঠের ঘরে নিয়ে গেল। একটা বড় ঘর। তাতে চারটে বেড। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ঘর। অ্যাটাচড বাথ। মিলন বলল, ‘গরম জল লাগলে বলবেন, আমি নীচ থেকে এনে দেব। খাওয়ার ঘর নীচে।’
একটু পরে মিলন চা নিয়ে এল। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ গো মিলন, বাঘ দেখতে পাব তো?’
শ্রীনিবাস জিজ্ঞেস করল, ‘শুনেছি ‘বাঘপথ’-এর ধারে নাকি তোমাদের একটা মাচা বানানো আছে? বাঘ নাকি মাচার পাশ দিয়ে যাতায়াত করে?’
মিলন বলল, ‘মাচায় বসে বাঘ দেখতে চাইলে মাচার ভাড়া লাগে। রাতপিছু পাঁচশো টাকা।’
ভবেশ জিজ্ঞেস করল, ‘ভাড়া না হয় দেওয়া যাবে। কিন্তু মাচায় বসে বাঘ দেখতে পাওয়া যায় কি?’
মিলন হেসে বলল, ‘এ পর্যন্ত যারাই মাচা ভাড়া করে বাঘ দেখতে এসেছে, কেউ নিরাশ হয়নি।’
ভবেশ ফের জিজ্ঞেস করল, ‘বাঘ রাতে কখন ওই পথে নামে?’
মিলন বলল, ‘ভোররাতের দিকে।’
অন্তু বলল, ‘ভাই, মোট ক’টা বাঘ আছে আঁচড়হাটির জঙ্গলে?’
মিলন কাপ-প্লেটগুলো ট্রে-তে সাজাতে সাজাতে বলল, ‘দুটো বাঘ আছে, এটা পাক্কা। কেউ বলে নাকি একটা বাঘিনি এসে এ জঙ্গলে আস্তানা গেড়েছে। সত্যি-মিথ্যে বলতে পারব না।’
‘তুমি কি নিজে কখনও বাঘ দেখেছ?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মিলন বলল, ‘না, আমি কখনও বাঘ দেখিনি। তবে আমার বাবা ক’বার বাঘ দেখেছে।’
শ্রীনিবাস বলল, ‘আমাদের ড্রাইভার রাজদীপ তিনটে বাঘের কথাই তো বলল গাড়িতে আসতে-আসতে?’
মিলন কাপ-প্লেট নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে-যেতে বলল, ‘কী জানি। বাবাকে জিজ্ঞেস করবেন।’
খানিক পরে ফুরকিত লেপচা এসে উঠে এল উপরে। লম্বা দোহারা চেহারা। মাথায় কাঁচা-পাকা বাবরি চুল। গায়ে নীলচে রঙের ফতুয়া। একটা কালো রঙের বারমুডা পরনে। হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, কোনও কষ্ট হয়নি তো? জলপাইগুড়ির রেঞ্জার সাহেব পাঠিয়েছেন। পান থেকে চুল খসলেই মহা বিপত্তি!’
শ্রীনিবাস বলল, ‘আমি বাঁকুড়ার জয়পুর ফরেস্টে চাকরি করি। তবে তোমার চিন্তা নেই। ভুলত্রুটি হলে আমরা মানিয়ে নিতে জানি। রেঞ্জারসাহেবকে বলতে যাব না। একটা কথা বলো তো ফুরকিত, কবে আমরা বাঘ দেখতে যাব? তুমি সঙ্গে যাবে তো?’
ফুরকিত হাসতে হাসতে বলল, ‘না না স্যার, এমনিতে আপনারা চারজন! আপনাদের সঙ্গে আমি আর ভিড় বাড়াব না। বেশি লোক গেলে বাঘ টের পেয়ে যায়। বরং আমি খবর পেলে আপনাদের বলব। সেদিন যাবেন।’
অন্তু মজা করল, ‘তোমার কাছে কি ওয়্যারলেসে খবর আসবে নাকি?’
ফুরকিত লেপচা বলল, ‘বাঘ নেমে আসার দিন সন্ধে থেকে হরিণগুলো ছোটাছুটি করে। ভল্লুকগুলো দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দেয়। ও আমি ঠিক বুঝতে পারি।’
জঙ্গলের রাত ভারী সুন্দর। নির্জন। দূর থেকে রাতপাখির ডাক ভেসে আসছে। ভাগ্যে থাকলে দু’-একবার বাঘের গর্জনও হয়তো শোনা যাবে জঙ্গল কাঁপিয়ে।
ফুরকিত বলল, ‘আজকের রাতটা আমার ভিলায় কাটান। ভাল করে বনমুরগির ঝোল আর ভাত খান। আমার বউ জানকী কিন্তু মাংসটা ভালই রাঁধে। পায়ে হেঁটে আবার জঙ্গল দেখতে যাবেন না যেন! কাল মাচায় বসে বাঘ দেখার ব্যবস্থা করে দেব। আমার ছেলে মিলন সব ব্যবস্থা করে আসবে। সঙ্গে রাতের খাবার দিয়ে দেব, পরোটা আর মাংস। ফ্লাস্কে গরম চা দিয়ে দেব। মাচায় বসে বাঘ দেখবেন।’
সেরকমই ব্যবস্থা হল। সারাদিন লেপচা ভিলার আশপাশে ঘুরে কাটল। সন্ধে নামার মুখে মিলন আমাদের নিয়ে গাড়িতে করে পৌঁছে দিল মাচার কাছে। একটা নড়বড়ে বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম চারজনেই। মাচার চারপাশে রেলিংয়ের মতো করে বাঁশ দিয়ে ঘেরা। পাটাতনের উপর ছেঁড়া তোষকের মতো একটা গদি পাতা। একটা সাত ব্যাটারির টর্চ শ্রীনিবাসের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মিলন গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
যাওয়ার সময় রাজদীপ বলে গেল, ‘আপনারা সাবধানে থাকবেন। বাঘের মতো চতুর প্রাণী কিন্তু জঙ্গলে বেশি নেই।’
টানটান রোমাঞ্চ নিয়ে রাতের এক-একটা প্রহর কাটতে লাগল। ফুরকিত লেপচা কিন্তু একটা কথা বলে দিয়ে গেল আমাদের, ‘স্যার, জঙ্গলের বুনো গন্ধের সঙ্গে যদি নাকে আসে পচা বোটকা গন্ধ, তা হলে জানবেন তিনি এসে গেছেন!’
সারারাত নাক সিঁটকে চারজন চারদিকে তাকিয়ে বসে থাকলাম। দূরে জঙ্গলের মাথায় একটা তারা খসে পড়ল। একবার খামোকা সাঁ-সাঁ করে ঝোড়ো বাতাস বইল। কিন্তু না, কোনও বোটকা গন্ধ চারজনের কেউই পেলাম না।
ভোর হয়ে এল। বনের পাখি বেরিয়ে পড়ল খাবারের খোঁজে। সূর্য উঠি-উঠি করছে ভোরের আকাশে। আমদের বাঘ দেখার প্রথম দিনটা নিরাশায় ডুবে গেল। এমন সময় অন্তু আঙুল তুলে চাপা গলায় বলল, ‘দেবতোষ, ওই দ্যাখ, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার!’
আমরা কোমর তুলে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলাম। অন্তু বলল, ‘আরে, ওই তো, দূরের ঝোপটার পাশ দিয়ে দ্যাখ, একটা মা-বাঘ তার তিনটে বাচ্চাকে নিয়ে সকালের রোদে খেলা করছে। আরে, ওই তো, ওই ঝোপটার বাঁ দিক দিয়ে সোজা তাকা।’
প্রথমে আমি দেখতে পেলাম। তারপর শ্রীনিবাসও বলে উঠল, ‘হ্যাঁ রে। একটা বাঘ আর তার তিনটে বাচ্চা!’
ভবেশ সকলের শেষে দেখতে পেল এই দৃশ্যটা। হঠাৎ চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে মা-বাঘটা হাওয়া হয়ে গেল কোথায়? ওমা! এই তো ছিল? আমাকে বাঁ হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে অন্তু ক্যামেরাটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার তাল করল। মুখে বলল, ‘ক্যামেরা এনেছি, ফোটো তুলব না তা কি হয়? ফিরে গিয়ে সকলকে দেখাব কী?’
আমি ওর প্যান্ট ধরে টেনে রাখলাম। বললাম, ‘তুই কি পাগল হয়েছিস রে অন্তু? বাঘের ফোটো তুলবি? যা তোলার মাচার উপর থেকে তোল। আমি তোকে নামতে দেব না।’
শ্রীনিবাস বলল, ‘শোন, দৌরাত্ম ভাল নয় অন্তু! শান্ত হয়ে বোস!’
ভবেশ অন্তুকে নিষেধ করতে গিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে কী যে বলল, বোঝা গেল না। অন্তু বলল, ‘শোন, মা-বাঘটা মনে হয় শিকারের খোঁজে কোথাও চলে গেল। এই তো সুযোগ বাচ্চা বাঘ তিনটের ফোটো তোলার! এ সুযোগ কি জীবনে কখনও আসবে রে, পাগলা!’ বলে আমার হাত ছাড়িয়ে তরতর করে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে নেমে গেল অন্তু। কিছুতেই আটকানো গেল না অন্তুকে।
আমরা মাচার উপর পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে থাকলাম। অন্তু গটগট করে হেঁটে এগিয়ে গেল বাঘের বাচ্চা তিনটের একদম কাছে। তারপর নিচু হয়ে হাঁটু মোড়ার মতো ভঙ্গিতে ফোটো তোলার জন্যে ক্যামেরা তাক করল অন্তু।
তারপর জঙ্গল তোলপাড় করে প্রচণ্ড গতিতে কিছু একটা ঝাঁপিয়ে পড়ল অন্তুর উপর। পলক ফেলতে না-ফেলতে তীব্র ঝটাপটির শব্দটা মুহুর্তে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে। তখন বাঘের বাচ্চা তিনটে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, অন্তু নেই!
--------------------------------------------------------------------------
আপনারাও এই বিভাগে আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে পারেন। মতামত জানান।
ankurishapatrika@gmail.com
------------------------------------------------------------------------- অঙ্কুরীশা-র পাতায় ক্লিক করে পড়ে নিন —
https://wwwankurisha.blogspot.com/2020/09/blog-post_11.html



ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন