শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২০

অঙ্কুরীশার শারদীয় সংখ্যা১৪২৭।। অণুগল্প -(পর্ব-১)

 




অণুগল্প-(পর্ব-১)
----------------

সঞ্জীব দে, মঙ্গল প্রসাদ মাইতি, অনন্ত কৃষ্ণ দে, বীথিকা পড়ুয়া মহাপাত্র, অমৃতা খেটো, কালীপদ চক্রবর্তী, অশোক রায়



পাখি
সঞ্জীব দে

     ওই তবাসসুম স্কুল যাবি না রে মেয়ে? 
আয় রে সূবর্ণ। এইতো হয়ে গেছে। আমমু আমার চুলটা বেঁধে দাও তাড়াতাড়ি, আমমু। 
তবাসসুম মাউথ অরগান টা কে বাজায় রে? 
আমার বড় ভাইয়া চঞ্চল। 
কোথায় সে? 
ওই তো পাশের ঘরে। 
দরজা তো বন্ধ! 
বন্ধ ই রাখে সব সময় ও। 
চল দেরি হয়ে যাবে স্কুলে যেতে। 
উদাস হয়ে গেলো রে মনটা! তোর বড় ভাইয়া কি ভালো বাজায়  তবাসসুম! 
প্রেমে পড়লি নাকি? 
এখনো পড়ি নি, তবে পড়ে যাবো পড়ে যাবো মনে হয়। 

     অনেকটা দূরে ওদের স্কুল। সাইকেলেই যাতায়াত। তবাসসুম, সূবর্ণের মধ্যে খুব ভাব। ওরা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। 
     সূবর্ণ সুযোগ পেলেই তবাসসুমের
বাড়িতে চলে আসে। সে কি শুধুমাত্র
বন্ধুর জন্য ই নাকি মাউথ অরগানের
সুরের টানে? যেন শামের বাঁশি, মন খারাপের সুর! 
     অন্য একদিন সূবর্ণ তবাসসুমের
বাড়িতে ঢোকামাতর চঞ্চলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ভাইয়া তবাসসুম কোথায়? 
     ভাইয়া না, বড় ভাইয়া বল তুই আগে শুনি? 
     বড় ভাইয়া, তুই না কিন্তু তুমি বলো। বলো তো তোমার বোহেন কোথায়? 
     তুই ভিতরে গিয়ে, দ্যাখ  কোথায় আছে? আচ্ছা চঞ্চল ভাইয়া মাউথ অরগান টা একটু বাজাবে, শুনি! 
     আমি আকাশবাণীর অনুরোধের
আসর নই বলে, ঘরে ঢুকে খিল তুলে দেয়। কখনো বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে সুরেলা গান শুনতে পাওয়া যায়। রোজার চাঁদ ওঠার গানটা, ও আবার প্রতিদিন ই গায়, যা কিনা অন্যেরা রোজা ছাড়া অন্য সময় গায় না। 
     চঞ্চল একা থাকতে বেশি পছন্দ
করে। বাড়িতে একমাত্র পোষা টিয়া পাখিটাকেই খুব ভালোবাসে। যতনো করে পাখিকে সনান করায়। খেতে দেয় আদর করে। ওর নিজের মা মারা যেতে, সৎ মাকে  আর মেনে নিতে পারে নি কখনো। যদিও বা নতুন মা ছেলে বলতে অজ্ঞান । বাড়ির অন্য সদস্য বলতে চঞ্চল তবাসসুম কে নিজের বোনের মতোনই দেখে। 
      সকালে সূবর্ণ সামনের বারান্দার চাতালের আসতেই দেখে, 
গেটের বাহিরে চঞ্চল দাঁড়িয়ে আছে। 
হাতে একটা টিয়া পাখি। সূবর্ণ কে দেখতে পেতে চঞ্চল বলে, তোকে এই পাখিটা দিয়ে যেতে এলাম। কোথায় যাবে তুমি দাদা? তোমার অষ্টম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা না? 
     আমি বহুদূর চলে যাবো। আমাকে
পাখির দাম বাবদ তিনশো টাকা দে। 
আমি খাঁচা এনে দিচ্ছি। সূবর

আমি খাঁচা এনে দিচ্ছি। সূবর্ণ দৌড়ে ঘরে চলে যায়। ওর বাবার ওকে টিফিন খেতে দেওয়া পয়সা জমানো ঘট টা ভেঙে তিনশো টাকা বের করে নিয়ে এসে বলে, এই নাও দাদা। চঞ্চল পাখিটাকে ধরতে দিয়ে চলে যায়, পয়সা গুলো নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা খাঁচা নিয়ে
এসে বলে, ধর। বাড়িতে একদমই বলবি না। তবাসসুম ও যেন জানতে না পারে যেন। 

                     ( ২ ) 

     এ সবই কুড়ি/বাইশ বছর আগেকার কথা। এখনও সেই দিনটার কথা মনে পড়লে, সূবর্ণ আঁতকে ওঠে। চঞ্চল ওই পাখিটা দিয়ে যাবার পর থেকে খুব যতনেই
দেখভাল করতো সূবর্ণ। ওর মা-বাবা ও খুশি হয়েছিলো। মেয়ের পড়াশোনা, স্কুল যাওয়া-আসা ছাড়া, তখন ওই পাখিটাই সময় কাটানোর
সঙ্গী একমাত্র। হঠাৎ ই এক ছুটির দিনে, পাখিটাকে স্নান করিয়ে দানা পানি দিয়ে বাধানো উঠোনের মেঝে তে রোদে রেখেছিলো। কিছু সময় পরে, খেয়াল হতেই ছুটটে
এসে দেখে, মুন্ডু হীন পাখির ধড় পড়ে আছে খাঁচার ভিতর। ওর শোক তাপে সে কি বিপর্যস্ত অবস্থা! সেইদিন টা ছিলো দোল পূর্ণিমা তিথি। 
ততদিনে তবাসসুম রাও আববা, আমমুর সাথে বাসা বদলে ফেলে। এক্কেবারে বিদেশ বিঁভুই। ছিটমহল গুলো হস্তান্তর হওয়ার সময় সূবর্ণের
পরিবার ভারতের নাগরিক হওয়ার আবেদন করে। সেই আবেদন ভারত
সরকার মেনে নেওয়ায় ওরা চলে আসে কুচবিহারের দিনহাঁটায়। সূবর্ণ লড়াই করে এখন থিতু হওয়া  এক মহিলা। 
ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপর্যয়ের পরে জীবনের
বৈঠা হাতে শান্ত নদীতে তরণী বাওয়া
এক মাঝি। বাবা গত। সূবর্ণ এখন কুচবিহারের ই জেলাশাসক। রবিবারে অনেক কাজের মাঝে ও একটা অবশ্যই প্রয়োজনীয় কাজকাজ ওর থাকেই। পাখির খাঁচা পরিষ্কার করা। ঝাড়পোঁচ করার পর খাঁচা টা কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকে। শুনতে পায়, বাবার ওই তর্জন গর্জন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসার সময়ে অনেক জিনিসের মধ্যে, সূবর্ণ খাঁচা টা তুলতে যেতে, "এটা রেখে যা, নামিয়ে নে।"



ফলাফল

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

 

বিপ্লব গাছে চড়তে পারত, অঙ্কুশ পারত নাবিপ্লবের তাই কাজ ছিল আমগাছে ওঠে পাকা আমগুলো পাড়াআর অঙ্কুশের কাজ নিচে দাঁড়িয়ে সেই পাকা আমগুলো কুড়িয়ে জড়ো করাবিপ্লব কাঠবেড়ালির মতো তর তর করে আমগাছে উঠে পড়ত চোখের পলকে এ ডালে ও ডালে বানরের মতো লাফ মেরে কখনো হাতে করে পেড়ে কিংবা ডাল নড়িয়ে পাকা আমগুলো ফেলে দিত নিচে। অঙ্কুশ তা কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করত। অঙ্কুশের আর একটি কাজ ছিল তা হল এই কুড়োনো আমগুলো দুটো ভাগে ভাগ করা। বিপ্লব যতক্ষণে গাছ থেকে নেমেছে অঙ্কুশের তখন আম ভাগ করা সারা। অঙ্কুশ আম ভাগের সময় অদ্ভুত একটা আচরণ ও কৌশল অবলম্বন করত। যে আমগুলোর এক দিকটা খুব পাকা আর অন্য দিকটা পচে গেছে কিংবা পোকায় খেয়ে ফেলেছে সেগুলো একদিকে করত। ভালো দিকটা উপরদিকে এমনভাবে রাখতো যাতে বুঝতে পারা না যায় অন্যদিকটা খারাপ হয়ে গেছেআর যেগুলো পুরোটাই ভালো তার পাকা দিকটা রাখতো নিচের দিকে আর সবুজ দিকটা রাখত উপরদিকে। দেখলেই যাতে মনে হয় আমগুলো এখনো যথেষ্ট কাঁচা।

   বিপ্লব গাছ থেকে নামলেই অঙ্কুশ বলত – নে দুটো ভাগ করে ফেলেছি। তুই তো গাছে উঠেছিলি। তাই আগে নিবি। তোর যেটা পছন্দ হয় সেটা নিয়ে নে। যেটা পড়ে থাকবে সেটা আমার। সাদাসিধে, সরল মনের বিপ্লব এ সবের কিছুই জানত না। দেখছে পাকা আমগুলো একদিকে রাখা আছে। সেগুলোর দিকেই নজর চলে যেত তার। এইটে আমার বলে তার ভাগের আমগুলো কোঁচড়ে ভরে ফেলতঅঙ্কুশ মনের খুশিতে অন্য ভাগটা নিয়ে নিত। বেশ কিছুদিন এইভাবেই চলছিল। পরে একদিন। এইরকমভাবে আম পাড়ার পর আমগুলো ভাগ হয়ে গেছে। বিপ্লব গাছ থেকে নামতেই অঙ্কুশ যথারীতি বলল – বিপ্লব, তোর ভাগ নিয়ে নে।বিপ্লব বলল – নেবই তো। তবে পাকা আমগুলো নয়, এই কাঁচা ধরনের আমগুলো নেব। বারেবারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান/এবার আমি তোমার বধিব পরাণ ছড়া কাটতে কাটতে অঙ্কুশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কাঁচা সবুজ আমের ভাগটা তুলে নিল। মুহূর্তের মধ্যে অঙ্কুশের খুশিভরা উজ্জ্বল মুখটা শুকিয়ে আমসি। বন্ধু বিপ্লব যে তার চালাকি আর শয়তানি বুদ্ধিটা ধরে ফেলেছে এটা বুঝতে আর বাকি রইল না।


 








ভাইরাস
অনন্ত কৃষ্ণ দে

আবাসন এর চার তলা থেকে নেমে এসে একটু থমকালো অরিএ, আসল জিনিষ টা আনতেই ভুলে গেছে সে, মাস্ক৷ এটা এখন সকলের জীবন এর একটা অপরিহায্য্ অংশ৷ আবার তাকে উঠতে হবে৷ সানাই এর আওয়াজ আসছে, অরিএ পকেটের দিকে তাকালো, আলো দেখা যাচ্চে, সানাই টা প্যানট ভেদ করে একসময় চারিদিক ছড়িয়ে পরলো৷ হ্যালো, হ্যাঁ বলো, ও প্রান্তে রিতার কথা খুব ভালভাবে বোঝা যাচ্চে না। হ্যাঁ কথা বলছি,…… হ্যালো হ্যাঁ বলছি তো, এইবার একটূ পরিস্কার হোল কথা। শোন,বাবার শরীর খুব খারাপ, আজ নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছে, তুমি কি আসতে পারবে? আমি কি করে যাব, তুমি তো জান আমি বাড়ি থেকে কাজ করছি, তা ছাড়া কাজের খুব চাপ। কথা গুলো বেশ রাগের সঙ্গেই বলল অরিত্র। ও দিক এ কোণো সারা নেই ।একটু ভয় পেল অরিত্র, রিতার যা রাগ! হ্যালো, হ্যালো, ফোন কেটে দিয়েছে রিতা।
আজ খুব ক্লান্ত অরিত্র, সারাদিন অফিস এর কাজে ব্যাস্ত ছিল, অনেক কাস্টমর ফোন কল করে করে আর ভাল লাগছে না। এবার একটু বিশ্রাম দরকার। ঘড়ি দেখল অরিত্র, দশ টা বাজে, এবার ওঠা যাক। কিচেন এ এসে দেখল আজ কি খাবার আছে, পাশের ফ্ল্যাট এর মাসি ওর জন্য রান্না করে রেখে গেছে, এ সবই রিতা বেঙ্গালরু যাবার আগে বাবস্থা করে গেছে। ওদের আসল কুক রমেন লক ডাওন এর আগে দেশ এ গিয়ে আটকে গেছে, তাই রিতার এই বাবস্থা। চিকেন কসা, আলুরদম, পটল ভাজা বাঃ ভালই রান্না করেছে মাসি, একটা চিকেন মুখে দিল সে, মা দেখলে এখুনি ওকে বকতো, কলকাতায় গেলেই মা এর রান্নাঘর এ গিয়ে ও খাবার টেস্ট করতো। মাকে একটা ফোন করতে হোবে। আপাতত চান করা দরকার। গিজার টা অন করল আরিত্র।
বেঙ্গালরুতে রিতা কে একবার ফোন করলো, সুইচড অফ। ওদিকের খবর টা নেওয়া দরকার, ঘড়িতে এখন সাড়ে এগার টা বাজে, নিলা দি এখনও জেগে আছে, নিলাদি কে মেলাল আরিত্র। নিলাদির কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল, রিতার বাবা করোনা পসিটভ। সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। খুব ঘুম পেয়েছে যা ভাবার কাল সকালে। নাইট ল্যাম্প টা জ্বালিয়ে দিল শোবার ব্যাবস্থা করলো সে। আঃ কি আরাম!

ব্যালকনি তে চায়ের কাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে নিলা। আজ আকাশ এর অবস্থা খুব খারাপ। সকাল থেকে মুখ ভার। চোখ টা ঝাপসা হয়ে এল। নিলার মনের অবস্থা ভাল নয়। বাবার করোনা পজিটিভ। ওদিকে বাবার পাশে রিতা একা আছে। অরিত্র অফিস এর কাজে চেন্নাই এ ব্যস্ত। সে ও কলকাতায় বসে। ভাল লাগছে না, একদম ভাল লাগছে না। নানারকম কু চিন্তা মনে আসছে। ঘরে গিয়ে রিতা কে ফোন করলো নিলা, সুইচড অফ। এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি বোধহয়। টিভিতে  করোনা আপডেট দেখাচ্ছে। বাবাঃ কলকাতায় হু হু করে বাড়ছে করনা। প্রচুর ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মী আক্রান্ত হয়েছে। কলকাতাতে বস্তি এলাকায় অবস্থা খুব খারাপ। সরকার হাত তুলে নিয়েছে। বাড়িতেই চিকিৎসা করতে বলছে। সে আর কি করবে ? ভয় পেলে চলবে না, মনে সাহস আনতে হবে। টিভি বন্ধ করে ঘরের কাজে মন দিলো নিলা।  
চেন্নাই এ অরিত্রদের আবাসন টা বেশ বড়, মোট ৫৪ টা ফ্ল্যাট, তা ছাড়া জিম, সুইমিং পুল, মর্নিং ওয়াকিং এর যায়গা, সব আছে। ওদের দু কামরার ফ্ল্যাট তবে ডাইনিং ড্রইং রুম দুটো বেশ বড়। এখন লকডাউন চলছে, দুপুর এর দিকে রাস্তাঘাট সব সুনশান থাকে, সকাল এর দিকে কিছু দোকান খোলা থাকে। লকডাওন এখানে খুব কড়াকড়ি। চার চাকা নিয়ে রাস্তায় বেরোনো সম্ভব নয়। রীতা বেশী মার্কেটিং করে না, বেশীর ভাগই ও বিগ বাস্কেট এ অর্ডার করে, রিতা বেঙ্গালরু যাবার আগে একদিণ ভোরবেলা ড্রাইভ করে ওরা বেশ কিছু বাজার করেছিল, তাতেই চলছে। কলিং বেল তা বাজছে। আমাজান এর ডেলিভারি, অরিত্র মাস্ক, সানিটাইজার, ডেটল লিকুইড অর্ডার করেছিল। দরজা টা খুলে জিনিষ গুলো নিল সে।
রিতার বাবা আজ সকালে চলে গেল। বেশ কয়দিন ভেন্টিলেশন এ ছিলেন. ৭৫ বছর কাটিয়েছেন এই্ ধরাধা্মে, আর পারলেন না, করনার হাত ধরে চলে যেতে হল। অরিত্রকে খুব ভালবাসতেন উনি। এক অদৃশ্য ভাইরাস সারা পৃথিবী কে শেষ করে দিল। পুরো ভারত জুড়ে আজ অব্দি নিশ্চিত মারা গেছেন সাড়ে ৭ লাখ মানুষ। করোনার হাত আরও কতো লম্বা কে জাণে। ভালো লাগছে না, একদম ভালো লাগছে না। বারান্দায় এসে দাঁড়ালো অরিত্র। সামনের বাড়িগুলো কিরকম যেন ফ্যাক্যাসে লাগছে। চোখ ঝ্যাপ্সা হয়ে এল তার। এই মুহূর্তে রিতার কথা খুব মনে পরছে।এখন ওকে একটু সান্তনা দেয়ার দরকার।চেয়ার টা টেনে বসলো সে।

অনন্ত কৃষ্ণ দে।জন্মঃ ২৯ ডিসেম্বের ১৯৫৭। কলকাতার বাগবাজারে। মহারাজা কাসিমবাজার স্কুল ও বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনা। বিজ্ঞানএ স্নাতক। অণু পত্রিকা ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা । যুগ্মভাবে পদক্ষেপ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা। নাটক ও স্কাউটিং এর সাথে যুক্ত।


পুচকুনের কান্না।
 বীথিকা পড়ুয়া মহাপাত্র
 
দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা দিতেই লাগলো ,দিতেই লাগলো পুচকুন। কদিন ধরেই ঠাম্মিকে নামান প্রশ্নে সে জেরবার করে শেষে সদুত্তর না পেয়ে ধৈর্য হারা। সিঁড়ি বেয়ে -বেয়ে উঠছে চারতলায়। ভূতের ভয়,দত্যি দানোর ভয়, কোন কিছুই আর বাধার পাহাড় হতে পারেনি। রবি ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতার মতো চার বছরের পুচকুন পাতালপুরীর বন্দিনী মাকে রাক্ষসের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করে আনবেই! কতোদিন দেখেনি সে মাকে! কতদিন খাইয়ে দেয় নি মা নিজে হাতে ! ঠাম্মি বললো "বোকা ছেলে ,বুঝছো না কেন তোমার মা মানুষের জন্য লড়াই করছে! ডাক্তার যে! ঘরে বসে থাকবে কী করে ? কত মুমূর্ষু রোগী চারিদিকে!ওই ভয়ঙ্কর রোগ রাক্ষসটা রক্ত চুষে শ্বাসযন্ত্র বিকল করে দিচ্ছে। মানুষদের না বাঁচালে পৃথিবীটা যে শুন্য শ্মশান হয়ে যাবে!"কতোদিন থেকে ঠাম্মার কাছে এসব কথা শুনে আসছে পুচকুন !শুনতে-শুনতে বোর হয়ে গেছে। চারতলার ছাদের দিক থেকে সে মায়ের গলায় কাশির শব্দ পেয়েছে! ঠাম্মির হাত ছাড়িয়ে ছুট লাগালো দুড়দাড় ঝড়ের মতো! হাঁপাতে হাঁপাতে চারতলার চিলেকোঠার কুঠুরির বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে !ধাক্কা দিতে লাগলো পুচকুন সজোরে আর কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো"আর কখনো দুষ্টুমি করবো না মা!মন দিয়ে পড়বো, একবারটি এসো!"সেই উজাড় করা অবুঝ কান্না ছড়িয়ে যেতে লাগলো বাতাসের কানে কানে! কুঠুরির ভেতর থেকে কাশি মিশ্রিত একটা ফোঁপানো কান্নার সুর চাপা আর্তনাদের মতো ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর স্নেহ-সৌন্দর্য প্রাচীর ছাড়িয়ে কোনো এক প্রার্থনা সঙ্গীতের নিমগ্ন আসরে!




       জয়পত্র
অমৃতা খেটো

রাজা লক্ষণ সেনের রাজসভায় সংগীতের আসর বসেছে।রাজা সঙ্গীতের আসল সমঝদার, গায়কদের নানা উপঢৌকন দিতেন, আর্থিক সাহায্য করতেন যাতে তারা অর্থাভাবে সঙ্গীত থেকে চ্যূত না হন। কবিতার আসর বসত, নিত্যনতুন ছন্দে লেখা কবিতা ও গানে রাজসভা জমজমাট।

তখনকার বিখ্যাত ওড়িয়া কবি বুড়ন  মিশ্র  "পঠমঞ্জরী" রাগ আলাপ করছিলেন।রাজা স্তব্ধ, নির্বাক, মুগ্ধ। কাছেই একটা পিপ্পল বৃক্ষ ছিল, তার সব পাতা তখনই ঝরে গেল।রাজা সংগীতজ্ঞকে
পুলকিত চিত্তে জয়পত্র লিখে দিতে উদ্যত হলেন।

রাজসভার পাশ দিয়ে স্নান সেরে নিজের গৃহে যাচ্ছিলেন এক অতীব রূপবতী রমণী। তিনি বিদুষী,সংগীতজ্ঞ ছিলেন। অতি বিখ্যাত  কবি জয়দেব গোস্বামীর সহধর্মিনী পদ্মাবতী।কবি জয়দেব "গীতগোবিন্দ" লিখে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন।স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সংগীতশাস্ত্রে বিশারদ ছিলেন।

বুড়ন মিশ্রের জয়াভাস শুনে পদ্মা বতী রাজসভায় প্রবেশ করে বললেন,-" কবি জয়দেব আছেন, তাকে পরাজিত করে আপনি জয়পত্র নিয়ে যাবেন"।জয়দেবকে ডাকতে লোক পাঠানো হল।ইতিমধ্যে পদ্মাবতী গান্ধার রাগে আলাপ শুরু করলেন। সেই অপূর্ব রাগসঙ্গীতের আকর্ষণে গঙ্গাবক্ষে  ভেসে থাকা নৌকোগুলো সব এপারে চলে এল।সবাই হর্ষধ্বনি করল," দেবী পদ্মাবতীর জয়"।

এমন সময়ে জয়দেব এলেল।তিনি সুললিত কণ্ঠে "বসন্তরাগ"আলাপ করলেন। আশেপাশের নিষ্পত্র বৃক্ষগুলিতে নবকিশলয় উদ্গত হল।রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে জয়দেবকে আলিঙ্গন করলেন। জয়পত্র পেলেন কবি জয়দেব।




 

     মায়ের ব্যথা                                              কালীপদ চক্রবর্ত্তী

 

সমীরণ-বাবু খুব সাদাসিধে এবং শান্ত প্রকৃতির লোক। মা-কে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসেন। এবার পাড়ার বারোয়ারী দুর্গাপূজাতে সমীরণ-বাবুকে বেদীর সেক্রেটারি করা হয়েছে। দুর্গা-সপ্তমীর দিন পুজো আরম্ভের আগে মা দুর্গাকে মালা পড়াতে গিয়ে দেখলেন খুব অসুবিধে হচ্ছে। দেখলেন পাড়ার এক বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোক দুটি ছেলেকে দুর্গাপ্রতিমার পিছনদিক থেকে মই দিয়ে উঠে মা দুর্গা-র মূর্তির পেছনে দুদিকে দুটো বড় বড় পেরেক ঠুকেছে। সমীরণ-বাবুর নিষেধ কারও কানেই গেল না। সমীরণ-বাবু বুকের ভেতর অসম্ভব এক ব্যথা অনুভব করলেন। দু চোখ বেয়ে জল নেমে এলো। দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরে এসে বুড়ি মা-কে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন – মা, তোমার লাগে নি তো? বলতে বলতে মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। সমীরণ-বাবু-র কষ্টটা অন্তর্যামী ছাড়া আর কেউই বুঝলেন না।  


এক পরিযায়ী আখ্যান

 অশোক রায়


তারা হাঁটছে, মাইলের পর মাইল ক্ষণিকের বিরতি আবার চলা দিন আগেও সে ছিল মহাসুখে  লোনাভলায়বৌ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে কাজ রাজমিস্ত্রীর ঠিকাদার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল ওয়াপস যাও। লক্‌ডাউন হঠেগা তো বুলালুঙ্গা তারপর আর কি! পরিবার নিয়ে একেবারে মেদিনীপুরের পথে।                 

একটু জিরোয় ন্দীপ চোখ বুঁজে আসে ক্লান্তিতে… সামনে মস্ত কালো শয়তান রাতটুকু থাকতে দিয়েছে, নজরানা চায় যুবতী বৌকে। অন্ধকারে পালিয়ে আবার সেই পথে। মালগুলো একাই টানে, বউয়ের কোলে ঘুমন্ত ছেলেমেয়ে। একটা বাস ছাড়বেবলছে কটক যাবে। সঙ্গীরা দৌড়য়...সেও।  লোকঠাসা বাসে চড়ে মহানদী ব্রাহ্মণী বৈতরণী... মন বেড়ায় পাহাড়ের কোলে যেখানে বৃষ্টি জন্ম দেয় একশো ঝর্ণা...।              

কটক থেকে আবার পথচলা হপ্তাখানেক পর সন্দীপ নিজের গ্রামে পৌঁছেছে- কেআমি প্যালা   – দরজাটা খোলো মা – অন্ধকারে জনাকয়েক জিজ্ঞাসু ঘিরে ধরে আমরা সেই মহারাষ্ট্র থেকে আসছি, হেঁটে - নদীর ধারে গাছতলায় থাক চোদ্দ দিন করোনা না হয়ে থাকলে তখন দেখা যাবে          

সেই থেকে ওরা তাঁবুতে খাবারটা বাড়ি থেকে আসেতার জন্য ভাইদের টাকা দিতে হয় – খালাদুটো দূরে রেখে চলে যায় মা – চোখ বানভাসি এক নেতা গোছের মাঝে মাঝে আসে। বাচ্চাদুটোকে চকোলেট দেয় চোখদুটো ইতিউতি কাকে যেন দ্যাখে – নিরুপায় সন্দীপ সব বোঝে কিন্তু একটা কাজ তো চাই। সাঁঝের মুখে ঝাপসা চোখে সে লোনাভলায় ফেলে আসা টুকরো সুখগুলোকে মোছে। 

    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন