লেবেল

বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২০

আজকের গল্প— আগুনের পরশমণি ।। দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়






    আজকের গল্প—

            আগুনের পরশমণি   

            দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়  


     ক্লান্ত বিকেল ঢলে পড়ছে সন্ধের গায়ে।আধো অন্ধকারে মাঠের চতুর্দিকে মানুষটা আপন কক্ষপথ বানিয়ে ঘুরছে। গলদঘর্ম। ইনসুলিনের আধিক্যের কারণে চিকিৎসকের পরামর্শ। বাড়ি ফিরে দেখা করতে গেলে ঐখানেই কথা। চলমান পরামর্শ ওখানেই। এবারে আর আমার ডাকে আধো অন্ধকারে আবছা মূর্তি হয়ে বলে উঠলেন না--" কিরে আমায় খুঁজছিস? " নাহ্, ভুল বললাম। এবারে ডাকের উত্তর অন্তরের অন্তঃস্থলে বেজে উঠল। মনের আলোয় প্রতীয়মান তিনি। তিনি যে আজ আছেন সেখানেই--আমার মাঝে, আমাদের মাঝে। মাষ্টারমশাই, আপনি কিন্তু মরেন নি !!!

       চারিদিকে দারিদ্র শতছিন্ন সংসার টায়। স্বামী- স্ত্রী- দুই পুত্র- এক কন্যা আর বাল্যবিধবা এক দিদি। দিন যাপন যে কতো কষ্টের হয় তা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছি আপনার বলয়ে থেকে। কিন্তু শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কোথায় যেন তাচ্ছিল্য দুর্ভাগ্যকে, দারিদ্রকে, হয়তোবা বিধাতার বিধানকেই। শুধু বলতেন, "আমি ভাগ্যবান। আমার ঘর আছে আপন ও বাহির -দুটোই।সেই বয়সে বুঝতাম না "বাহির ঘর " কি ! পরে জানলাম,বাহির ঘর মানে বাহির ভুবন। সকলের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন।আজ বুঝি, সেজন্যই আপনি আজও বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন সারাটা জীবন আপনার অবিসংবাদী দর্শনে।

      বাবা মারা গেছেন।মা চূড়ান্ত অসহায় অবস্থায়। ছেলে মেয়ে দের নিয়ে কি করবেন, কিভাবে সংসার চালাবেন-- চিন্তা অহর্নিশ। কান্নাই যখন স্বাভাবিক ছন্দ সংসারে, আপনি এলেন। অনেকটা দেবদূতের মতো।অভয় দিলেন। আমাদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়ানোর জন্য রাজি হলেন এবং আপনার বন্ধু ইংরাজির শিক্ষককেও রাজি করালেন।কানের কাছে গুরু মন্ত্র দিলেন- লড়াই, লড়াই এবং লড়াই। লড়াই করে ছিনিয়ে নিতে হবে বিদ্যা, পান্ডিত্য, সম্মান এবং প্রাচুর্য।পারতেই হবে। শেষে আপনার অভিভাবকত্বে পেয়েছিলাম। আপনার লড়াই আজও লড়ছি মাষ্টারমশাই।

        জীবনের যাত্রা পথের শুরুতেই আপনাদের শিক্ষক হিসেবে পেয়ে পথ অনুকূল হয়েছিল,আজ বুঝি। অঙ্কের ছোট বড় গলি রাস্তা কি অনায়াসেই আপনার হাত ধরে ঘুরে বেড়িয়েছি।অন্য বিষয়ের পরীক্ষার আগে যখন সারা শরীরে ভয় কাঁপন, অঙ্ক পরীক্ষায় এসে তা স্বস্তির অনুরণন হতো।বুঝতাম, বিষয়টা বেশ গভীরে ঢুকেছে। ক্লাসের শেষের দিকের ছাত্র ইন্দ্র আপনার কাছে এসে অঙ্কে সত্তর ! মনে আছে , ওর বাবা ছেলের আনন্দে পুকুরের একটা বড়ো কাতলা মাছ দিয়েছিল আপনাকে। সেদিন আমরাও ঐ মাছ ভাজার স্বাদ পেয়েছিলাম।সরল অথচ সুনির্দিষ্ট ছিল আপনার লক্ষ্য। সকলের ভিড়েও তাই আপনার ছাত্রদের এখনো আলাদা করা যায়।কারণ,গুরুই যে ছিল এক আলাদা অস্তিত্ব--এক উন্মুক্ত আকাশ। নীলিমা তাই আজও মেখে আছি বাস্তবে, স্বপনে ! এযে আপনার শিক্ষা !বৃথা যে যাবার নয়  মাষ্টারমশাই !

       আশাবাদ। আপনার এক অদ্ভূত বোধ ছিল। কখনো নিরাশ হবি না।জীবন শুধু হাতে ফেরায় না। কোন অঙ্ক একবার বুঝতে না পারলে, বারবার। কোন বিরক্তি নেই।পড়ানোটা যেন আপনার কাছে পূজা ! সময়ের স্রোতে আজ আমিও একজন শিক্ষক।আজ বুঝি আপনার দর্শন টাই বড়ো জরুরী আজকের দীর্ণ শিক্ষাব্যবস্থায়। তবে আপনার দর্শন আপনার ছাত্ররা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বয়ে নিয়ে চলেছি।আপনি বাস্তবিক আছেন আজও আপনার দর্শনের ভিতরই।

      নিয়মানুবর্তিতার প্রথম পাঠ আপনার কাছে। মাঘের শীতে ও ঠিক সকাল ছটায় আসা চাই। নাহলে , কুড়িটা ওঠবস বা নিলডাউন। শাস্তির থেকে লজ্জা বেশি।তাই ' আধেক ঘুমে নয়ন চুমে' অবস্থাতেও আপনার বাড়ি। আপনার যুক্তি,নিয়ম হবে এক। পরিস্থিতি অনুকূল ই হোক বা প্রতিকূল। সেই পাঠ আজও আমাকে সচল রাখে ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথে। আমরা বলতাম" সাহেবী টাইম " ! সেই সাহেবী টাইম হয়েই আপনি বেঁচে আছেন আমাদের কর্মে।

           শৃঙখলাকে আপনি জীবনের মেরুদন্ড মানতেন। আপনার বেতের দাগ তখন আমরা সারা শরীরে বহন করতাম রাগ, ক্ষোভ নিয়ে। কিন্তু অভিভাবকরা ছিলেন নির্বিকার।কারণ তারা জানতেন , আপনি জাদুকর ! আপনার ছাত্রদের কোথায় পৌঁছে দিতে হবে তা আপনার জানা। আপনার দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ সব প্রশ্নের উর্ধ্বে।তাই রাত দশটায় অধৈর্য অভিভাবকরা কখনো প্রশ্ন করেননি :মাষ্টারমশাই,আর কতক্ষণ? বাইরে মশা মারতে অথবা উদ্দেশ্য হীন পায়চারি করতে করতে হয়ত কখনো ভেবেছেন, আপনাকে ঈশ্বর সত্যি ই মৃত্যুঞ্জয় করে রাখুন ছাত্রদের স্বার্থে। ক্লান্ত চোখ, অবসন্ন শরীর নিয়ে আমরাও কখনো বিরক্ত হয়নি।কারণ, আমরা জানতাম আপনার মতাদর্শ : আজকের কাজ আজকেই; কালকের জন্য ফেলে রাখা নয়। লেখাপড়ার বাইরেও যে কতটা দরকারি এটা তা আজ বুঝি।সবতো আপনারই হাতে তৈরি মাষ্টারমশাই। আমাদের সব কাজে আপনি বেঁচে আছেন।আপনি কিন্তু মরেন নি মাষ্টারমশাই !

     শক্ত খোলসের ভেতরে একটা নরম মন ছিল আপনার। ঘন্টার পর ঘন্টা পড়াতেন। ক্ষিধে পেলে গাছের পেয়ারা, পেঁপে,আতা,কলা --নাহলে নারকেল মুড়ি। আপনাকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় ! আপনি তো ডোডো পাখির মতো বিলুপ্ত প্রায় এক শিক্ষক ছিলেন।যে কোন প্রয়োজনে আপনার সস্নেহ হাত বলে দিত আমরা একা নই। একটা বড়ো ছাতার তলায় আমাদের আশ্রয়।আপনার মানব শরীরটা আজ আর নেই। কিন্তু সেই ছাতাটা আজও অনুভব করি মাষ্টারমশাই। সমস্যা দীর্ণ সময়ে মনের গহনে আজও আপনাকে পাই  !

       বাড়ির পাশে কালিপুজো। কদিন পড়াশোনা ডকে। তবুও আপনার হোম টাস্ক ছিল কুড়ি টা পাটিগণিত। ক্লাস সেভেন। আনন্দে ভেসে যাওয়ার আকুতি তখন বেশি। ভাবলাম,ম্যানেজ হয়ে যাবে। কিন্তু সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। ভাইফোঁটার পরদিন পড়তে গিয়ে যথারীতি শাস্তি। বেতের দাগ সারা শরীরে। সন্ধ্যায় জ্বর।খবর পেয়ে বাড়ি এলেন। অনেক ক্ষণ সন্তান স্নেহে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ছিলেন। মাষ্টারমশাই, সেদিন কিন্তু আপনার চোখের জল লুকোতে পারেন নি।ঐ অল্প বয়সে বুঝেছিলাম :সকলেই শিক্ষক নয়,কেউ কেউ শিক্ষক। সেদিন পাওয়া আপনার হৃদয়ের স্পর্শ আজও আমার ছাত্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিই।ওরা ভাবে আমি। কিন্তু আমি জানি ,এ আপনি, আপনি !!

        অসম্ভব গুণী মানুষ ছিলেন আপনি। যাত্রাপালা সোনাই দীঘি। আপনি ভিলেন ভাবনাকাজির ভূমিকায়। এতো স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়।অবাক দর্শক মন্ডলী। সামনে বসা মহিলারা সত্যি ভিলেন ভেবে স্টেজে জুতো ছুড়েছিল। পরদিন আপনার কি হাসি ! উৎপল দত্তের গল্প বলেছিলেন। উনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: যখন দর্শক আমার অভিনয় দেখে আমার দিকে জুতো ছোঁড়ে বা গালাগাল দেয়, সেটাই আমার সেরা পুরস্কার।আপনার স্ত্রী  সকলের কান্ড দেখে রাগ করলে বলেছিলেন: পরের অভিনয় দেখে ওরা আমাকে প্রণাম করবে, দেখে নিও।কী আত্মবিশ্বাস ! পরের বছর "নটী বিনোদিনী"তে আপনার রামকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় দেখে মহিলারা প্রণাম করেছিল আপনাকে। মনে আছে,সজল চোখে আপনার সেই ডায়লগ-- " অমন  ফুলকো ফুলকো লুচি আর দুটো দেনা রে,ও গিরিশ! "সারা গ্রামে লোকের মুখে মুখে তখন। বুঝেছিলাম, কতখানি গভীরতা থাকলে এতটা আত্মবিশ্বাস আসে। গভীরে যাওয়ার দর্শন কখন যে আপনার হাত ধরে আমাদের জীবনে প্রোথিত হয়ে গেছে ,বুঝতেই পারিনি।আজ বুঝি,বিষয় গভীরতার আস্বাদন আপনার তৈরি পথেই !

        " অদ্ভূত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ।" জীবনানন্দ বুঝেছিলেন। আপনি বুঝতে পারেন নি। নাকি ,চান নি।শেষদিন পর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছিলেন আপনার ছাত্র দর্শনকে আঁকড়ে ধরেই। প্রাক্তন বর্তমান সমস্ত ছাত্রদের আপনি অভিভাবক,এই বোধই আপনাকে বড়ো বেশি ধাক্কা দিল শেষে। পড়তে আসার পথে কয়েকটা মেয়েকে কিছু ছেলে বিরক্ত করে শুনে ছড়ি হাতে চললেন আপনি। গিয়ে দেখলেন, ওরা আপনারই প্রাক্তন ছাত্র। ধাক্কা খেলেন। আরো বড়ো ধাক্কা খেলেন যখন ছড়ি উঁচিয়ে শাসন করতে গেলে আপনার ভাগ্যে জুটল গালাগাল , ধাক্কা। মাটিতে ছিটকে পড়ে কপাল ফাটল। কাছেপিঠে থাকা লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ল ও উদ্ধত ছেলেগুলোর ওপর।আপনার অসম্মান উপস্থিত সকলে মানতে পারেনি।কি হৃদয় আপনার ! রক্তাক্ত মুখে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের নিরস্ত করেছিলেন। পরদিন ঐ ছাত্ররাই আপনার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছিল। কিন্ত আপনি আর নিজের ছন্দে ফিরতে পারছিলেন না। সারা জীবনের শ্রম তাহলে কি পন্ডশ্রম হল? বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় এ জিনিষ যে আজকাল প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে,তা আপনার বোধগম্য হতে দেরি হচ্ছিল। অনেক উদাহরণ টেনে আমরা আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোথায় যেন আয়নায় ভাঙ্গন লেগেছিল। পন্ডশ্রম হয়নি মাষ্টারমশাই ! আপনার মশাল আমরা বইছি অভিযোজিত হয়ে। আপনার দর্শন আমাদের মননে, যাপনে নিশিদিন ।

       আপনার শরীর ভাঙ্গতে লাগল খুব দ্রুত।আর পেরে উঠলেন না। জীবনের নিয়মকে শেষ পর্যন্ত মেনেই নিলেন।চিরসঙগী লড়াই কোথায় যেন আস্তে আস্তে স্তিমিত হতে থাকল। অবশেষে সেই সংবাদ ! আপনি নেই...

       কালো মাথাগুলোর ভিড়ে আপনার শায়িত শরীর অদৃশ্য। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে মানুষ ভেঙ্গে পড়েছে শ্মশানে। ঠেলাঠেলি করে আপনার সামনে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে এক বাঁধভাঙ্গা বন্যা। আবার পিতৃবিয়োগ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম আপনি পঞ্চভূতে ছড়িয়ে পড়ছেন। বুঝলাম, আরো বিস্তৃত হচ্ছে আপনার পরিধি। মনের কোণে কে যেন বলে উঠল, এইসব মানুষের মৃত্যু হয় না। উনি সত্যিই মৃত্যুঞ্জয়... নামে ও কর্মে !!!








           

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন