ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনের অন্তিম দিনগুলিঃ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবদনে - সাহিত্যিক শিশিরকুমার বাগ
জীবনের শেষ দিকে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে বিদ্যাসাগর মহাশয় বেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ক্রমে ক্রমে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, সভ্য মানুষদের, যাদেরকেই তিনি কোনো না কোনো ভাবে সাহায্য করেছেন, তারাই উল্টে তাঁর নিন্দা করেছে। নানা ভাবে তিনি প্রতারিত হয়েছেন। ভ্রান্তিবিলাস গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “মানবজাতি নিরতিশয় কুৎসাপ্রিয়; লোকের কুৎসা করিবার নিমিত্ত কত অমূলক গল্পের কল্পনা করে এবং কল্পিত গল্পের আকর্ষণী শক্তির সম্পাদনের নিমিত্ত উহাতে কত অলঙ্কার যোজিত করিয়া দেয়। যদি কোনও ব্যক্তির প্রশংসা করিবার সহস্র হেতু থাকে,অধিকাংশ লোকে ভুলিয়াও সে দিকে দৃষ্টিপাত করে না; কিন্তু কুৎসা করিবার অণুমাত্র সোপান পাইলে মনের আনন্দে সেই দিকে ধাবমান হয়।”
কেবল পরিচিত বন্ধু-বান্ধব বা বাহিরের ভদ্র সমাজের লোকজনই নয়, আত্মীয়েরাও বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে নানা আচরণ করে তাঁকে বিব্রত করেছেন। ১৮৮১ সালে বিদ্যাসাগর প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমার আত্মীয়েরা আমার পক্ষে বড় নির্দয়, সামান্য অপরাধ ধরিয়া অথবা অপরাধ কল্পনা করিয়া আমাকে নরকে নিক্ষিপ্ত করিয়া থাকেন।”
এই প্রকার মানসিক আঘাত ছাড়াও শারীরিক দিক থেকে তিনি জীবনের শেষ দিকে খুবই ভুগতে থাকেন। আমরা জানি উত্তরপাড়ার একটি বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে গিয়ে ঘোড়ার গাড়ির দুর্ঘটনার পর তিনি শারীরিক আঘাতে বেশ কাবু হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়া বিদ্যাসাগর দীর্ঘদিন থেকে পেটের পীড়ায় ভুগতেন। কঠিন রক্তামাশায় রোগে প্রায়ই আক্রান্ত হয়ে পড়তেন। তার উপর ছিল শিরঃপীড়া। অসুস্থতার কারণে বার বার তিনি বায়ু পরিবর্তনের জন্য নানা স্বাস্থ্যকর স্থানে যেতেন। বর্ধমান, চন্দননগর, কার্মাটার ছাড়াও স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য তিনি কানপুর ও মথুরা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি একাকীত্বের মধ্যে শান্তি খোঁজারও চেষ্টা করেছেন তিনি।
এই রকম একটি সময়ে তাঁর পত্নী বিয়োগ ঘটে। দিনময়ীর মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর নানাভাবে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন। বিদ্যাসাগর অনুভব করেন, পুত্রের কারণে স্ত্রীর প্রতি চরম ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন তিনি। সন্তোষকুমার কুণ্ডু লিখেছেন, “স্ত্রীর প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান তিনি (দিনময়ী) পাননি। দিনময়ীর প্রয়াণের পর এই ভাবনা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দগ্ধ করত। তিনি অনেক দিন থেকে অসুস্থ ছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর অসহায়তা অনেক বেড়ে গেল, অসুখও বৃদ্ধি পেল।”
অসুখ বৃদ্ধি পাওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গঙ্গাতীরে ফরাসডাঙায় দুটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে জ্যেষ্ঠ কন্যা হেমলতাকে সাথে করে সেখানে কিছুদিন বসবাস শুরু করলেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হল না। এ সময়ে বিদ্যাসাগরের ছোট ভাই ঈশানচন্দ্র জ্যোতিষীর কাছে বিদ্যাসাগরের কোষ্ঠী বিচার করালেন। জ্যোতিষীর পরামর্শ অনুযায়ী হেমলতা প্রায় সাত-আটশো টাকা খরচা করে বাড়িতে হোম-যজ্ঞ, শান্তি স্বস্ত্যয়ন করলেন। তাতেও কোন ফললাভ না হওয়ায় জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে আবার সবাই কলকাতায় ফিরে এলেন।
কলকাতায় এসে অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের সঙ্গে আবার পরামর্শ শুরু হল। তাঁরা বললেন, বিদ্যাসাগরের আফিম খাওয়ার পরিমান না কমাতে পারলে ঔষধে কাজ হবে না। তখন কলুটোলা থেকে শেখ আবদুল লতিব হাকিমকে আনা হল। তিনি ১৮ আষাঢ় থেকে আফিম ছাড়াবার চেষ্টা শুরু করলেন। কিন্তু দু-দিন ভালো থকার পর আবার হিক্কা আরম্ভ হল, সেই সঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। ২১ আষাঢ় জ্বর কমলেও হিক্কা প্রবল হয় এবং হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে থাকে। ২৩ আষাঢ় রোগের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটলে এবং রোগীর লেবা রোগের উপসর্গ দেখা দিলে হাকিমের চিকিৎসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই হাকিম ছিলেন উদার চরিত্রের মানুষ। তিনি আন্তরিক যত্ন ও শ্রদ্ধার সঙ্গে চিকিৎসা করলেও জরুরী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার ঔষধ বন্ধ করে ক্লোরোডাইন সেবন করানো হলে বেদনা ও হিক্কার কিছটা উপশম হয়। ২৪ আষাঢ় ডাক্তার হীরালালবাবু ও ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু বিদ্যাসাগরকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে পরের দিন ডাক্তার ম্যাকোনেল সাহেবকে আনানোর কথা বলেন। ম্যাকোনেল সাহেব, বার্চ্চ সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্তে এলেন যে, উদরে ক্যানসার হয়েছে।
অ্যালোপ্যাথিতে এ রোগ সারানো অসাধ্য। এ কথা শুনে পরের দিন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার সালজারকে আনানো হল। তিনি বললেন, ক্যানসার নয়, টিউমার। ৩১ আষাঢ় থেকে সালজার চিকিৎসা শুরু করায় প্রাথমিক ভাবে রোগের (বেদনা, হিক্কা, লেবা) কিছু উপশম ঘটলেও ক্রমে কোষ্ঠবদ্ধতা শুরু হয়। ডাক্তার সালজার প্রত্যহ তিন-চার বার করে দেখতে আসতেন। রোগের হ্রাস-বৃদ্ধি চলতেই থাকল। একসময় হিক্কা বেড়ে যাওয়ায় রজনীগন্ধা ফুল বেটে খাওয়ানো হল। তাতে হিক্কা কমলেও ওই দিনই জ্বর বাড়তে থাকল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মুখের দীপ্তি কমে আসছিল, তিনি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। এ সময় পুত্রবৎ ডাক্তার অমূল্যচরণ বাবু দিনরাত বিদ্যাসাগরের কাছেই বসে থাকতেন।
৪ শ্রাবণ থেকে বিদ্যাসাগর মহাশয় আর উঠতে বসতে পারছিলেন না। ডাক্তার সালজারও নিরাশ হয়ে পড়লেন। হাল ছেড়ে দিয়ে ৭ শ্রাবণ থেকে পূর্বের কিছু কিছু ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছিল। ৯ শ্রাবণ কিছু পুরাতন মল নির্গত হওয়ায় ১০/১১ শ্রাবণ তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করছিলেন। ১০ শ্রাবণ “দ্য ইণ্ডিয়ান ম্যাসেঞ্জার” পত্রিকায় লেখা হল-
“It is a matter of national anxiety that Pandit Iswarchandra Vidyasagar is still hovering between life and death. ”
১১ শ্রাবণ বিকেল থেকে জ্বর বাড়ছিল এবং নাড়ির গতি কমে আসছিল। একসময় লোকজনকে আর চিনতে পারছিলেন না। মায়ের ছবি যে ঘরে টাঙানো সে ঘরেই শয্যাশায়ী ছিলেন বিদ্যাসাগর। এ সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। প্রায় অচেতন অবস্থাতেই বিদ্যাসাগরের মাথাটি ঘুরে গেল জননীর দিকে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। দু-চোখ বেয়ে অবিরাম জলের ধারা নেমে আসছে। ১২ শ্রাবণ মঙ্গলবার প্রায় সারাদিনই অচৈতন্য ছিলেন।
আবশেষে ১৩ শ্রাবণ ১২৯৮ বঙ্গাব্দ, ২৯ জুলাই ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ বুধবার রাত্রি ২টা ১৮ মিনিটে এক মহাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। আমাদের পরম শ্রদ্ধার মানুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় আমাদের ছেড়ে পাড়ি দিলেন অমৃতলোকের পথে।
তাঁর মরদেহ প্রথমে তাঁর সাধের প্রতিষ্ঠান মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে নিয়ে যাওয়া হল। শোনা যায় সেখানে পুত্র নারায়ণচন্দ্র বাষ্পাকুল লোচনে উচ্চ কণ্ঠে বলেছিলেন, “বাবা, এই তোমার সাধের মেট্রোপলিটন।” নিমতলা শ্মশানঘাটে তাঁকে দাহ করা হয়। মুখাগ্নি করেন তাঁর একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্র।
পরিশেষে একটাই কথা, আমরা বাঙালিরা, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে মাঝেমধ্যে স্মরণ করি বটে, কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করি না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন