শ্রদ্ধা ও স্মরণে
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
যুগসন্ধির কথাকাহিনীতে তারাশঙ্কর
— অশোককুমার লাটুয়া
'বাতি নিভিয়ে দে-
জলসাঘরের দরজা বন্ধ কর'।
— একটা যুগের অবসান হচ্ছে, আর একটা যুগ আসছে। গ্রাম জনপদ রাতারাতি যন্ত্রদানবের কৃপায় আধা শহরে পরিণত হচ্ছে। সেই ভাঙাচোরা পটভূমিকায় তারাশঙ্কর এঁকেছেন নতুন জীবনের ছবি। দুই যুগের গ্রন্থিবন্ধনের অপর নাম যুগসন্ধিক্ষণ। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এমন এক যুগসন্ধিক্ষণের শিল্পী।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
বীরভূমের লাভপুর গ্রাম।১৮৯৮ খৃষ্টাব্দের ২৩ই জুলাই তাঁর জন্মদিন। ১৯৭১-এর ১৪ই সেপ্টেম্বর তাঁর লোকান্তর।
তারাশঙ্করের উপন্যাস উত্তর রাঢ়-এর মহাকাব্য। বীরভূমের লালমাটি, মহামারী ও অনাবৃষ্টি, বেনাঘাস ও কাশের জঙ্গলে ঘেরা রহস্যময় পরিবেশ, হড়পা বান, অন্ধসংস্কার, অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের পটভূমিতে তাঁর কলমে উঠে এসেছে সাধারণ সাঁওতাল, আউল-বাউল, কবিয়াল, বেদিয়া, বাজিকর, তান্ত্রিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রা ও চরিত্রবৈশিষ্ট্য।
কথাসাহিত্যে তারাশঙ্করের আবির্ভাব ' পূর্ণিমা ' পত্রিকার দুটি গল্পে — ' স্রোতের কুটো ' এবং ' উল্কা'। এরপর 'কল্লোল' পত্রিকায় প্রকাশ পেলো তাঁর
' রসকলি' গল্পটি। আর এখান থেকেই সাহিত্যে শুরু হলো তাঁর অপ্রতিহত জয়যাত্রা।
আলোচনার জন্য কথাশিল্পী তারাশঙ্করের উপন্যাসগুলিকে তিনটি পর্বে ভাগ ক'রে নিতে পারি —
প্রথম পর্ব : চৈতালি ঘূর্ণি, নীলকন্ঠ, রাইকমল প্রভৃতি উপন্যাস।
দ্বিতীয় পর্ব : ধাত্রীদেবতা, কালিন্দী, গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম, কবি, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, নাগিনী কন্যার কাহিনী ইত্যাদি।
তৃতীয় পর্ব : আরোগ্য নিকেতন, সপ্তপদী, রাধা, মঞ্জরী অপেরা, গন্নাবেগম, অভিনেত্রী প্রভৃতি।
এছাড়া তাঁর অন্যান্য উপন্যাসগুলি হলো — পাষাণপুরী, প্রেম ও প্রয়োজন, আগুন, মন্বন্তর, সন্দীপন পাঠশালা, ঝড় ও ঝরাপাতা, পদচিহ্ন, উত্তরায়ণ, তামস তপস্যা, বিচিত্র, পঞ্চপুত্তলী, বিচারক, বিপাশা,মহাশ্বেতা, যোগভ্রষ্ট, নাগরিক, নিশিপদ্ম, যতিভঙ্গ, কালবৈশাখী, একটি চড়ুই পাখী ও কালো মেয়ে, জঙ্গলগড়, সংকেত, ভুবনপুরের হাট, বসন্তরাগ, অরণ্যবহ্নি, হীরাপান্না, মহানগরী, গুরুদক্ষিণা, শুকসারী কথা, কীর্তিহাটের কড়চা, মণি বউদি, শক্কর বাঈ, স্বর্গমর্ত্য, ছায়াপথ, কালরাত্রি, ফরিয়াদ। কথাশিল্পীর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে সুতপার তপস্যা, একটি কালো মেয়ে, নবদিগন্ত প্রভৃতি। প্রায় দু'শো ছোটগল্প লিখেছেন তিনি। গল্পকার তারাশঙ্করের লেখায় মানবের উৎস সন্ধান করতে হলে তাঁর লেখা ' আমার সাহিত্য জীবন ' গ্রন্থটির আশ্রয় নিতে হয়। এই স্মৃতিচারণায় ধরা পড়েছে অর্ধশতাব্দীর সাহিত্য সাধনার বিচিত্র কাহিনী। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি — হারানো সুর, তিনশূন্য, বেদেনী, যাদুকরী, দীপার প্রেম, মধু মাষ্টার, পঞ্চকন্যা, কালান্তর, তপোভঙ্গ, ইমারত, অগ্রদানী, সন্ধ্যামণি, তারিণী মাঝি, নারী ও নাগিনী, বাউল, ঘাসের ফুল, ডাইনী, শেষ কথা, কালাপাহাড়, কামধেনু, গবিন সিংয়ের ঘোড়া ইত্যাদি।
অসংখ্য ছোটগল্পে অজস্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়েছেন তিনি।
তারাশঙ্করের উপন্যাসে সমাজচিত্রের ব্যাপকতা, সমাজ রীতির গভীর আলোচনা, চলমান ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা প্রভৃতি মহাকাব্যিক লক্ষ্মণের প্রশংসা ক'রে বলতে পারি — তারাশঙ্কর ঠিক ঔপন্যাসিক নন, তিনি গ্রাম্যজীবনের চারণ কবি। গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম, হাঁসুলিবাঁকের উপকথা এপিকাল বা মহাকাব্যধর্মী উপন্যাস। মহাকাব্যধর্মী উপন্যাসে কোনো ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতা বিষয়বস্তু নয়। বৃহৎ মানবগোষ্ঠী, বৃহৎ সমাজ তার বিষয়। এই চরিত্রলক্ষণ তারাশঙ্করের উপন্যাসে স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল। নীচুতলার মানুষের শিল্পকে তিনি অমরত্ব দিতে চেয়েছেন ' জীবন এত ছোটো কেনে ' — এই সত্যবোধে। এই থেকে তাঁর উপন্যাসে উঠে আসে রুক্ষ লাল মাটির কথাকাহিনী। এই মাটির দাহ আর দীপ্তি তাঁকে অভিভূত করেছে। আঞ্চলিক ঔপন্যাসিক হিসাবে হাঁসুলিবাঁকের উপকথাতে তিনি তুলে ধরেছেন সমস্ত সমাজ মনের এক নিবিড় ঘন চিত্র। ' আরোগ্য নিকেতন '- এ মৃত্যু নিজেই যেন একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে এবং 'কবি' উপন্যাসে নিতাই কবিয়ালের গানে ধরা পড়েছে মানুষের জীবনের সত্য ও ঝুমুর দলের বৈশিষ্ট্য। অকৃত্রিমতা, ভাষার ঐশ্বর্য, কাহিনীর বিশালতা, চরিত্রের গভীর মানসিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এবং চিত্ররূপময় বর্ণনা তারাশঙ্করের উপন্যাসগুলির বৈশিষ্ট্য। মাটির প্রতি মমত্ববোধ ও মানবিক মহিমার সাধনায় তারাশঙ্কর কালজয়ী।
তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন — " নকলকে আসল বলিয়া চালাইয়া দিবার অপচেষ্টা নাই। " তাঁর গল্পগ্রন্থের সমালোচনায় মোহিতলালের স্মরণীয় মন্তব্য : " - - - গল্প লেখকগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিমান কে, এই প্রশ্ন উত্থাপন ও তাহার সমাধান করিতে হইলে তারাশঙ্করের কৃতিত্ব যেরূপ উত্তরোত্তর স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে, তাহাতে শেষ পর্যন্ত তাঁহার দাবিই গ্রাহ্য হইতে পারে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করিবার দুঃসাহস আমি করিতেছি। " তারাশঙ্করের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন, " তারাশঙ্করের সাহিত্যচেতনার মধ্যে না আছে বিদেশি ভাব, না আছে অন্যের অনুকরণে নিজ চিন্তা গঠন করবার দুর্বলতা। দেশ ও মানুষে তাঁর সাহিত্য চেতনা নিহিত। তাঁর মত সৎ ও বিবেকবান ঔপন্যাসিক সর্ব সময়েই বিরল। "
তারাশঙ্করের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'কালান্তর '- এ নিজের বহু অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসকে তিনি তুলে ধরেছেন নায়ক গৌরীকান্তের মাধ্যমে। কঠোরে-কোমলে, স্নিগ্ধতায়, হিংসায়, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুবসমাজের ক্রোধ-অস্থিরতা, এবং বিদ্রোহ 'জ্ঞানপীঠ ' সাহিত্যসম্মান পাওয়া তারাশঙ্করের রচনাকে নাট্যশিল্পের মর্যাদা দিয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন