বহিরাগত জীববৈচিত্র : দেশীয় জীববৈচিত্রসমূহ এবং আমাদের সামগ্রীক পরিবেশ বিনষ্টকারী উদ্ভিদ;
পার্থেনিয়ামের ইতিহাস (পর্ব- ৪)
- শঙ্কর তালুকদার
পার্থেনিয়ামের প্রচন্ড বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা ও এক ই পরিবেশের অন্য উদ্ভিদের বৃদ্ধি প্রতিহত করার বিষয়টি অবগত হবার সাথেই পার্থেনিয়াম সচেতনতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টি হল এই উদ্ভিদটির মানুষের স্বাস্থের ক্ষতি করার ক্ষমতা;
এই পর্বে উক্ত বিষয়টিকে বিস্তারিত জানাবার প্রচেষ্টায় খানিক বিশদআলোচনা উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি!
পার্থেনিয়ামে নিহিত রাসায়নিক উপাদান
পার্থেনিয়ামে রয়েছে পার্থেনিন নামক ভয়ানক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান।
এতে রয়েছে Sesquiterpene Lactones নামক টক্সিন বা বিষ।
এই বিষ গঠিত হয় Caffeic acid, Vanillic acid, Ansic acid, P-anisic acid, Chlorogenic acid, Ges Parahydroxy benzoic acid দ্বারা।
বিষটি মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীদের জন্য ভীষণভাবে ক্ষতিকর।
এ ছাড়াও এই বিষাক্ত আগাছা আরো এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা কীটপতঙ্গের জৈবনিক ক্রিয়ায় ও ফসল উৎপাদনকারী উদ্ভিদের বৃদ্ধি প্রতিহত করে এবং উভয়েরই প্রভুত ক্ষতি করে আখেরে মানুষের ই ক্ষতি সাধন করে থাকে।
পার্থেনিয়ামের ফুলের রেণু অতি সূক্ষ্ম হওয়ায় এটি সহজেই বায়ু মণ্ডলে ভেসে থাকতে পারে।
এই বিষাক্ত উদ্ভিদটির এইসব অপকর্মগুলিকে সামনে রেখে নিম্নলিখিত তালিকায় পার্থেনিয়ামের ক্ষতিকারক ভুমিকা গুলি সবিস্তারে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। তা হলো -
১. পার্থেনিয়াম মানুষের হাতে-পায়ে বা গায়ের চামড়ার যে কোন যায়গায় লাগলে - প্রাথমিক অবস্থায় চুলকানী দেখা দেয়, লাল হয়ে যায় এবং পরে ত্বকে প্রদাহ সৃষ্টি করে, এমনকি সেই প্রদাহ ক্রমে ক্যান্সারের মত মারণ রোগ ও পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে।
২. পার্থেনিয়ামে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘন ঘন জ্বর, অসহ্য মাথাব্যথা ও উচ্চরক্তচাপে ভুগতে পারে।
৩. দশ মিটার দূর থেকেও ভেসে এসে এই আগাছাটির ফুলের রেণু মানুষের নাসিকা গহ্বরের শ্লেষ্মা ঝিল্লিতে সেই রেণু অঙ্কুরিত হয়ে যে সমস্ত রাসায়নিক পদার্থ সৃষ্টি করে, তার প্রভাবে ভয়ানক এলার্জি হয় !
এর ফলে শ্বাসনালীর প্রদাহ ও বাতাস প্রবাহের পথ সংকোচনের কারণে শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
৪. পার্থেনিয়াম আগাছা যুক্ত মাঠে গবাদিপশু চরলে পশুর শরীর ফুলে যায়, তীব্র জ্বর, বদহজম সহ নানা রোগের উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে।
৫. এই গাছ খেলে গাভীর দুধ তিতো হয়ে যায়, যা দীর্ঘদিন পান করলে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
৬. এই বিষাক্ত আগাছা এক ধরনের রাসায়নিক
পদার্থ নিঃসরণ করে যা কীটপতঙ্গ ও ফসল উভয়ের ই সামগ্রিক ভাবে ভয়ানক ক্ষতি করে।
৭. দেখা গেছে পার্থেনিয়াম আগাছাটি জমিতে থাকলে সেই জমির ফসলের উৎপাদন প্রায় চল্লিশ শতাংশ কমে যায়।
৮. পার্থেনিয়ামের রেণু বাতাসে মিশে টমেটো, লঙ্কা ও বেগুনের ফুলের গর্ভমুন্ডে পতিত হলে অচীরেই ঐ উদ্ভিদের ফুল ঝরিয়ে দিয়ে উক্ত ফসল গুলির ফলনে ভয়ানক ক্ষতি করে।
৯. এই গাছ থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ
নিঃসরণের ফলে ডাল জাতীয় ফসলের গাছের নাইট্রোজেন তৈরিতে সহায়তাকারী ব্যাকটেরিয়া অ্যাজেটোব্যাকটর ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে ঐ ফসলের ও ভীষণ ক্ষতি সাধিত হয় !
পার্থেনিয়াম দমনের উপায়
১. এই আগাছার পুড়িয়ে ফেলা যেতে পারে।
২. ঐ গাছ কেটে গভীরগর্তে পুতে ফেলা যেতে পারে।
৩. আগাছা নাশক রাসায়নিক প্রয়োগ করে এদের ধ্বংশ করার যেতে পারে।
৪. কীটনাশক ব্যবহার করেও আগাছা দমন করা যেতে পারে।
৫. চারা অবস্থায় গাছগুলোকে উপড়ে ফেলা যেতে পারে।
৬. নির্দিষ্ট অন্চল থেকে পার্থেনিয়াম উৎক্ষাতের পর ঐ গাছের গোড়ার ভূমির অংশে লবন জল স্প্রে করে ঐ স্থানে পুনরায় উক্ত উদ্ভিটির বিকাশ রোধ করার চেষ্টা চালানো যেতে পারে।
৭. সাধারণ মানুষের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতার মাধ্যমে এই বিষাক্ত জৈব বৈচিত্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করলেই এদের হাত থেকে আমরা বাঁচতে পারি।
পার্থেনিয়ামের বাসস্থান: কোথায় পাওয়া যায় এদের?:
কোথায় হয় না, পার্থেনিয়াম! পাড়ার ক্লাবের মতো,যেখানে জায়গা পায় সেখানেই গজিয়ে ওঠে এরা।
বিশেষ করে রাস্তার দুপাশে হামেশাই দেখা যায় এদের। পরে থাকা এবং অপ্রয়োজনীয় বা অব্যবহৃত জমিতে জন্মাতে দেখে ওদের বৃদ্ধিকে মূল্য না দেবার কারণেই ক্রমশঃ এরা ভয়ানক ভাবে ছড়িয়ে পরছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের বংশ বিস্তার করে।
বহুদিন আগে ১৯৬০-৭০এর দশকে এদেরকে কেবল রেল ইয়ার্ডের ফাঁকা জমিতেই জিপসি ফুলের মত ফুটে থাকতে দেখলেও বিশেষ মূল্য দেইনি আমরা !
আর আজ, ঘরের বাইরে বের হলেই আপনি নিজের বাড়ির উঠোনে পর্যন্ত এই গাছটিকে দেখতে পাবেন।
বিশেষ করে রাস্তার পাশে অনাদরেই আজ ও দারুণ বেড়ে চলেছে এই গাছটি। পাকা রাস্তার ধারে , গ্রামের রাস্তার ধারে, কোথায় নেই এই গাছ।
খুব দ্রুত বাড়ে এই গাছ। ছড়িয়েও পড়তে পারে খুব দ্রুত।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন