অজিতেশ নাগ
অজিতেশ নাগ
শ্মশান থেকে ফিরে
এই তো গত পরশু দেখে এলাম,
এই তো মনে হল অনেকটা প্রাণ তখনো সঞ্চয়ে,
পা থেকে মাথা অবধি সশরীরে অধিষ্ঠান,
অনিয়মিত হলেও প্রশ্বাস মিশে যাচ্ছে জাগতিক বায়ুমন্ডলীতে।
অথচ আজ অনিচ্ছায় দেখে ফেলি শূন্য খাট,
মাথার কাছে, বালিশের পাশে ওষুধ, ব্যবহারিক জিনিষপত্র...
ইত্যাদি ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা চিরকালীন অব্যবহারের জন্য।
আর ইলেকট্রিক চুল্লির আশেপাশে কিছু ফুল, ছড়ানো ছিটানো,
একটা ভাঙা কলসি, আবছা হরিনামসংকীর্তন
হালকা ধুপকাঠি আরো হালকা হতে থাকে, পিছু ধাওয়া করতে থাকে;
চুল্লির ভিতরে অতি ধীরে প্রবেশ করতে থাকা সাদা চাদরখানার।
বাইরে তখন,
ডাল-কচুরি, পান-সিগারেট-চা আর আধহাত, দুহাত সাদা কাপড়ের দোকানে;
রমরমে বিক্রি।
আমার দু-চোখের কোনে অস্পষ্ট দু-ফোঁটা জল;
অজানা বাউল
এ ঘরে আজ আর কোন বাউলের গান নেই,
কাল বেশ গভীর রাত অবধি ছেড়ে যাওয়া খোলসের সঙ্গীত রচনা হয়েছে,
আর আমি বেশ নিঝুমে এক ছায়াঘেরা আশ্রমের পরিবেশ দেখছিলাম,
মতিবাউলের গহীন জীবন ছাপ ছেড়ে যাচ্ছিল ক্লান্ত বটতলায়,
খাঁ খাঁ জ্যোৎস্নার চাঁদোয়ার নিচে ঝরে পরা পাতার খসখস।
আমি গান শুনতে শুনতে এক বনজ ঔষধের খোঁজ করছিলাম,
দেখছিলাম এখনো কিছু লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা........অন্ধকারে,
মতিবাউলের সুর চুঁয়ে চুঁয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে কি না পাতায় পাতায়,
একসময় খুঁজেও পেয়েছি বলে মনে হচ্ছিল –
সাদা জমি লাল পেড়ে শাড়ি, আলতা-ছোঁয়া দুটি পায়ের ছাপ।
ও বাউল, দাও আমায় খোঁজ মৃত সোনার হরিণের; নিদেনপক্ষে -
এক বনজ উদ্ভিদ; যা আমায় জাগিয়ে রাখবে সারা রাত,
আমি বীজ পোঁতার শব্দে ভাববো এখনো বুঝি সৃষ্টি শুরু হয়নি,
যার ভরসায় নিভু প্রদীপকে সামনে রেখে শুনে যেতে পারি সব গান।
অথচ, সকালের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম ঠিকই,
উঠে দেখি ঘরের দরজা একেবারে বন্ধ, চুপ।
কীট
তোমার রক্ত মাংস কুরে কুরে খাচ্ছে জীবন তাড়নার কীট,
আমি অলক্ষেতে অপরাহ্ণ বেছে নিয়েছি,
যেমন করে ভগ্নপ্রায় এক আঘাটা জলজ আগাছা বেছে নেয় –
তার ঐতিহ্যশালী ইতিহাসের গ্লানি ঢেকে রাখতে,
যেমন করে এক বৈশাখী আকাশ আশ্রয় দিতে চেয়ে বেছে নেয়,
নিরাভরণ বাতাসের ঝাপটায় এলোমেলো মেঘরাশি।
তুমি আমাকে উন্মাদ করেছ, পরিয়েছ রাজভিখারীর বেশ,
আমি গৃহপালিত মানুষের মত জানতে চাইছি না,
কোথায় আলো? কোথায় জল? কোথায় মেঘ?
অথচ আমি তোমাকে যতটা জানি, তুমি নিজেকেও তত জানোনা,
তাই নিদান দিলাম অক্লেশে -
তোমার রক্ত মাংস কুরে কুরে খায় নির্বিশেষে যেসব জীবন তাড়নার কীট,
একে একে হত্যা করে নেমে এস মোরাম বিছানো পথে।
আমি ক্রীতদাস নই,
আমি আমার ধর্মের গান নিজেই লিখি, অক্ষর আমার কুয়াশায় ঢাকা তেলেঙ্গানা,
নিজস্ব অভ্যেসে জৈবিক তাগাদায় হত্যা করি রোজ জীবন তাড়নার কীট।
আজীবন করে যাবো, তবু আজ অবধি সুখের মুখ দেখলাম না বলে -
তোমায় দোষারোপ করব না,
পিতৃতর্পণ
আরো একটা বছর ঘুরে যায়,
তারও আগে আরো কিছু বছর অতিবাহিত হয়েছে কালের সংকেতে,
অনেক হেঁটে এসে জীবনের পথে গঙ্গার জলে দুহাত ভরে যায়,
আজ পিতৃতর্পণ।
ওঁ নমঃ আ-ব্রহ্মভুবনাল্লোকা, দেবষী©-পিতৃ-মানবাঃ ,
তৃপ্যন্তু পিতরঃ সর্বে মাতৃ-মাতামহাদয়ঃ।
কোথাও কি তুমি আছো পিতা?
কালের জঠরে নিহিত তোমার বংশপরিচয়,
মনে হয় এই তো সেদিন, আমার প্রথম পা রাখা এই মহানগরের পথে,
তোমার দুআঙুলে আঙুলে জড়িয়ে;
তোমার গালে গাল ঠেকিয়ে পরম বিশ্বাসে ঘুমিয়ে পরা।
ওঁ নমঃ যে বান্ধবা অবান্ধবা বা, যে অন্য জন্মনি বান্ধবাঃ ।
তে তৃপ্তিং অখিলাং যান্ত, যে চ অস্মৎ তোয়-কাঙ্খিণঃ ।।
তে তৃপ্তিং অখিলাং যান্ত, যে চ অস্মৎ তোয়-কাঙ্খিণঃ ।।
জানি না জাগতিক উচ্চারনে তুমি তৃপ্তিলাভ করবে অথবা করেছ কিনা।
কেন না,
আঘাটার অদুরে দাঁড়ানো আমার পরমাত্বীয়রা ততক্ষণে বলাবলি করে,
নানান বিষয়ে; শুধুমাত্র তোমার স্মৃতি-উচ্চারণ ব্যতিরেকে,
যার মধ্যে কিছু কিছু সশব্দে আলোচিত হয় –
আমার অনুপস্থিতির সুযোগে
তুমি ভাবতেই পারো,
আমার অনুপস্থিতির সুযোগে -
একটা সন্ন্যাসিনী তোমার খালি ফ্ল্যাটে উঁকি দিয়ে যাবে,
আরেকজন কলিংবেল বাজিয়ে দেখবে আমি ঘরে আছি কিনা,
আবার কেউ নরম গদীতে মোড়া গাড়ির কালো কাঁচের এপার থেকে –
সরাসরি দেখে যাবে আমি ফ্ল্যাট থেকে বেরোলাম কখন,
ঐ ধরো নেদারল্যান্ড অথবা যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের কোন মিলিটারি গুপ্তস্থান থেকে –
একটানা অথবা বিরতি দিয়ে দিয়ে গোপনীয় টেলিফোন।
তুমি চাইতেই পারো,
ওদের কাউকে নিয়ে কোন পাঁচতারা বাসস্থানে আশ্রিত হতে,
ফুটপাতে বিক্রি হওয়া সস্তা আধাঝরা গোলাপ উপহার দিতে,
আবার সন্ন্যাসিনী অথবা কামুক নারী – কোথাও কোথাও কখনও।
আমার অনুপস্থিতির সুযোগে,
তোমার কাশের ফুলে আগুণ ধরাতে চাইলেই বা,
সে অথবা তুমি।
নিটফল শুন্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন