।। প্রতিদিন বিভাগ।।
।। জুন সংখ্যা।।
বিষয় - গল্প ( ৪০০ শব্দের মধ্যে) —৪
*অনুসন্ধান*
অজিত দেবনাথ
অভিরাম দশম শ্রেণির ছাত্র। ছন্নছাড়া দারিদ্র্য তার প্রাত্যহিক সঙ্গী। যেন কোনো কোনো দিন তার বুকের জীর্ণ শিরাগুলো দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। জীবনের প্রতিটি মোড় একেকটি ক্লান্ত ধুলোর মলিন কাব্য, প্রতিটি পদক্ষেপে জমে থাকে অবহেলার যন্ত্রণা। বাবা চটকলের শ্রমিক—দিনভর মেশিনের একঘেয়ে গর্জনে কানে জমে ওঠে বিষাদের নিশ্চিন্ত গোলক, আর সন্ধ্যার স্নিগ্ধ আলোয় তাঁর ক্লান্ত শরীর নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে ঘরের নির্জন কোণে। মা খুব ভোরে ওঠেন, সূর্য ওঠারও অনেক আগে— ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে হাঁটেন বাজারের দিকে, বিক্রি করেন সবজি; রোদ আর ঘামের জলে ধুয়ে যায় প্রতিদিনের শর্তাধীন স্বপ্ন। সন্ধ্যায় ফেরেন হাতে অবিক্রীত পেঁয়াজ-আলু আর হৃদয়ে জমা একরাশ ক্লান্তি।
শীতকালে তাদের ঘরে নতুন কম্বল আসে না—মায়ের পুরোনো শাড়ির আঁচলই হয়ে ওঠে উষ্ণতার প্রাচীর। পুজো আসে, কিন্তু নতুন জামার গন্ধ আসে না; শুধু দোকানের কাঁচে জমে থাকে প্রতীক্ষার দীর্ঘশ্বাস।
তবু এই জীবনের স্তব্ধ অন্ধকারে অভিরামের ভিতর বেঁচে থাকে এক দীপ্ত স্বপ্ন—অঙ্ক শেখার, অঙ্ককে আপন করে তোলার দয়িত প্রয়াস।
তবে অঙ্ক তার কাছে প্রথম থেকেই যেন এক রহস্যময় অরণ্য। সূত্রেরা ঘন ছায়ার মতো তাকে বিভ্রান্ত করে, সংখ্যাগুলো পালিয়ে বেড়ায় তার বোধের নাগালের বাইরে। ক্লাসরুমের বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে ভুল করলে মাস্টারমশাই অনায়াসে বলে বসেন, “ এই জন্মে তোর আর অঙ্ক শেখা হবে না !”
আর সহপাঠীরা?—তাদের মুখে ব্যঙ্গের হাসি, “তোর মাথায় অঙ্ক ঢোকে না কারণ সেখানে জায়গাই নেই, শুধু শূন্য উদ্যান!”
কিন্তু অভিরাম থেমে থাকে না। প্রতিরাতেই, যখন সমস্ত পাড়া ঘুমিয়ে পড়ে, তখন এক কোণায় বসে আবছা আলোয় সে বই খুলে বসে। ঘুমে চোখ ভেঙে আসে , খাতার পাতা কখনও কখনও গতিপথ হারিয়ে ফেলে । ভুল করে, আবার শেখে। যেন রূপান্তরিত মানচিত্রের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক নিঃসঙ্গ পথিক। তার হাত কাঁপে, কিন্তু মনের ভেতরে রাশি রাশি স্বপ্নের বিপুল বিস্তার। সে ভাবে—একদিন নিশ্চয়ই এই ছায়াগুলো আলো হয়ে উঠবে। শঙ্কিত দীপশিখা পূর্ণতা পাবে।
একদিন সন্ধ্যায় মা হাঁপাতে হাঁপাতে বাজার থেকে ফিরে এসে বলেন, “জানিস, তোর বয়সে আমিও স্কুলে যেতে চেয়েছিলাম। পারিনি। তুই যেন থেমে যাস না রে। তোর ভিতরে একটা অনন্য মন আছে, সেটা অনেকের কপালেও জোটে না—সেটাই তোর সবচেয়ে বড় শক্তি।”
মায়ের কণ্ঠে ক্লান্তি আর চোখে জমে ওঠা জলের মধ্যে যে আশীর্বাদ লুকিয়ে ছিল, অভিরাম বুঝে যায়—এই শব্দগুলোই তার অসম্ভবকে সম্ভব করার পাথেয় হয়ে ওঠে।
অকস্মাৎ একদিন স্কুলে ঘোষণা করল যে—আন্তঃবিদ্যালয় গণিত প্রতিযোগিতা হবে। পুরস্কার—এক বছরের টিউশন ফি মুকুব, সঙ্গে উন্নত মানের গণিত বইয়ের সেট। ছাত্ররা তালিকা দেখে উল্লসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন দেখে, সেই তালিকায় অভিরামের নাম, তখন তাদের চোখে অদ্ভুত বিস্ময়।
কেউ বলে, “তুই বুঝি এবার গণিত অলিম্পিয়াডে যাবি?”
আরেকজন বিদ্রুপের স্বরে বলে, “তুই তো কলা বিভাগে! অঙ্ক তোর কিসের?”
কিন্তু সেদিন অভিরামের চোখে এক নতুন আলোর রশ্মি । সে ক্লাস ছুটির পর সোজা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছোয় পাড়ার এক বৃদ্ধ গণিত শিক্ষক বিমলবাবুর দরজায়। কাঁপা গলায় বলে, “স্যার, আমি প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছি। আপনি যদি একটু শেখান...”
বিমলবাবু কিছুক্ষণ ছেলেটার চোখের দিকে চেয়ে থাকেন। সেই চোখে ক্লান্তি আছে, অপমানের ক্ষতচিহ্ন আছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আছে—একরাশ জেদ, এক চিলতে শাণিত দীপ্তি। বিমলবাবু মৃদু হেসে বলেন, “তুই যদি সত্যিই মন দিয়ে চাস, তাহলে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”
তারপর শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়—প্রতিদিন বিকেলে অভিরাম পৌঁছোয় বিমলবাবুর ছায়াঘেরা বারান্দায়। শুরুতে সূত্র মুখস্থ করতেই রাত কাবার হয়ে যায়, কিন্তু ধীরে ধীরে সূত্রেরা তার সঙ্গে কথা বলতে শেখে। π, √ আর উপপাদ্য তার কাছে ভয় নয়, বরং তারা হয়ে ওঠে তার ভাষা—বিশ্বকে বোঝার এক অনুপম ছন্দ।
বিমলবাবু একদিন বলেন, “অঙ্ক মানে হিসেব নয় রে—এটা এক ধরনের ভাষা, যার ভেতর লুকিয়ে থাকে জগতের অনাবিল, রহস্য, সৌন্দর্য।”
প্রতিযোগিতার দিন এল। অভিরাম গায়ে চাপাল তার একমাত্র সাদা শার্ট—যার বোতাম নেই একটায়, পকেটের ধারে সেলাই উঠে গেছে। কিন্তু তার চোখে কোনও দ্বিধা নেই, কেবল দুর্দমনীয় আত্মবিশ্বাস। প্রশ্নপত্র হাতে নিয়েই সে বুঝল—এই প্রশ্নগুলো তার চেনা, এই অঙ্কের পথেই তো সে হেঁটেছে।
এক সপ্তাহ পর ফলাফল প্রকাশিত হল—অভিরাম প্রথম।
স্কুলজুড়ে চমক। সেই শিক্ষক, যিনি একদিন অপমান করেছিলেন, আজ নিজেই বললেন, “তোর এই নিষ্ঠা আর পরিশ্রম আমাদের সবাইকে অবাক করে দিল। তুই আজ সত্যিকারের অনুকরণীয়।”
সেই রাতে মা অভিরামের কপালে চুমু খেয়ে চোখ মুছলেন। বললেন, “আমি জানতাম—তুই পারবি।”
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোকে দেখে মনে হচ্ছে, এ জীবনও একদিন চাঁদের আলোর মতো আলোকিত হয়ে উঠবে।”
সেই রাতে অভিরাম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে একাকী, নির্জনে। তার মনে হয়, সংখ্যাগুলো আজ তার সঙ্গী, সূত্রগুলো তার বন্ধু। জীর্ণ চালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে পড়ে তার বুকের ভেতর। হাওয়ার দোলায় যেন ভেসে আসে এক নীরব স্বর—
“অঙ্কের পথে হাঁটলে, কোনো গন্তব্যই দূরের নয়।”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন