ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস
...এবং ইরাবতির প্রেম(পর্ব-২)
গৌতম আচার্য
রীতার মৃত্যুর পরে দিনের বেলা সত্যেন একেবারে ঘড়ি ধরে দেড়টা থেকে পৌনে দুটোর মধ্যে তার খাওয়া শেষ করে।একে রীতার অভাব, তার ওপর চব্বিশ ঘন্টা কাজের লোক কাজলের প্রস্থান সর্বোপরী একমাত্র ছেলে তার ব্যবসায় সাহায্য করবার পরিবর্তে চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গেলো।একটি তিন- চার জনের ভরা ভর্তি সাংসারিক পরিবেশ থেকে একদম একা হয়ে পড়েছে সত্যেন।
সারাজীবন হই হট্টোগোল করে কাটিয়ে এসেছে সে।কিছু না কিছু থাকতোই তার পরিবারে। হয় কোনও আত্মীয়, নয় সস্ত্রীক কোনও বন্ধু, আবার কখনো বা রীতার দিককার কোন আত্মীয়- বন্ধুবান্ধব। কখনও তারাও যেতো অন্যের বাড়িতে নিমন্ত্রন পেয়ে। কিছু না থাকলে সত্যেন নিজেই ঘোষণা করতো, "টু ডে ইজ্ স্পেশাল মাংস ডে", অথবা "টু ডে উই উইল সেলিব্রেট রেড লেটার ডে"। কিসের রেড লেটার ডে প্রশ্ন করলে বলতো, "কেন? আজ স্পেশাল খাওয়া দাওয়া হবে না? সেই জন্যই রেড লেটার ডে"।
রীতা থাকাকালীন আত্মীয় পরিজনদে নিয়মিতভাবে আনাগোনা ছিলো এই বাড়িতে। কিন্তু রীতা চিরকাল সংসার সামলানোর ব্যাপারে একটু অগোছালো। ঘর দোর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যে গৃহলক্ষীর দায়িত্বে বর্তায়, হাসি মুখে নিজে অথবা কাজল কে দিয়ে সেই কাজ সম্পন্ন করে ইয়ার্কির ছলে সেটা মনে করিয়ে দিলেও রীতা ভালোভাবে নিতে পারতো না সত্যেনের কথা গুলি। মনে মনে ক্ষুণ্ন হতো।এক এক সময় অভিমান ভরা গলায় বলতো, "আমি পারি না বলে খোঁটা দিচ্ছো"?
কথা বাড়াতো না সত্যেন।এড়িয়ে যেতো। জীবনের অনেক অপ্রাপ্তির ভিড়ে মিশিয়ে দিতো আর একটি অপ্রাপ্তি। চব্বিশ ঘণ্টা কাজের লোক কাজলের পাশাপাশি ঠিকা কাজের মাসি বাসন ধুয়ে, ঘর ঝাঁট দিয়ে যেতো।আর রান্নার জন্য সেই তখন থেকেই আছে এই বুড়ি দিদিমা। রীতার মৃত্যুর পর যখন ছেলেও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া অসহায় বাবার কথা না ভেবে চলে গেলো চাকরি নিয়ে, মুখে কিছু না বললেও মনে মনে খুব ভেঙে পড়েছিলো সত্যেন।আর খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিলো কাজলকে নিয়ে। মধ্য বয়সী কাজলই শেষ পর্যন্ত বললো, "দাদা, বৌদি তো নেই, বাবাই-ও থাকে না।এবার আমায় ছুটি করে দ্যান্"। একটি কথা বলেনি সত্যেন।। পত্রপাঠ তার মাহিনা, সঙ্গে আরও বেশ কিছু টাকা দিয়ে তাকে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ট্রেণের টিকেট, কিছু নতুন জামাকাপড় ইত্যাদি কিনে দিয়ে ছুটি দিয়েছিলো।
এ্যতোদিন ধরে একসঙ্গে এক বাড়িতে থাকা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই একটি আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।তাই যাওয়ার সময় খুব কেঁদে ছিলো কাজল।সত্যেন-ও মন থেকে তাকে ছাড়তে চায় নি। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে শেষ পর্যন্ত নিজে তাকে ট্রেণে তুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় জানিয়ে এসেছিলো।
রান্নার দিদা এবং ঠিকা কাজের মাসি ঘোরতর সওয়াল করে ছিলো কাজলের না যাওয়ার পক্ষে।বারবার সত্যেনের একা হয়ে যাওয়ার কথা মাথায় রেখে যুক্তি সাজিয়েছিলো।কিন্তু সত্যেন-ও মনপ্রাণ থেকে চায়নি কাজল থেকে যাক। পাড়ায় ব্যানার্জী কাকিমা বা গোপালের মা, কার্তিকের বৌদি এবং পাশের বাড়ির বিদ্যুৎ বাবুর "এখন কাজলকে নিয়ে তুমি কি করবে সত্যেন"? এই অতি আগ্রহ মনের দিক থেকে সত্যেনকে খুব ভয়ার্ত করে তুলেছিলো।
কার্তিকের বৌদি তো আরও এককাঠি উপরে উঠে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলো, "কাজল এখন কোথায় শোবে"? ইঙ্গিত টি নাড়িয়ে দিয়েছিলো সত্যেনকে।অথচ কাজল থাকলে তার একাকিত্ব অনেকটাই কমে যেতো। পরিচিত মুখ, সংসারের একজন হয়ে উঠেছিলো।আর সবথেকে বড়ো কথা, সংসারের খুটিনাটি ও-ই জানতো সব।তবুও সত্যেনকে শেষ পর্যন্ত একা থাকার জীবন কেই বেছে নিতে হল।
সেই থেকে একাকিত্ব ভীষণ ভাবে ঘিরে ফেলেছে সত্যেনকে। মনের মধ্যে মাঝেমাঝেই একরাশ যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে ওঠে। বুকের ভেতরটায় ডুকরে ওঠে না পাওয়া জীবনের একগুচ্ছ অপ্রাপ্তি। সব সময় কথা বলা সত্যেন বোবা হয়ে গিয়েছে। আত্মীয় রা প্রায় কেউ যোগাযোগ রাখেন না তার সঙ্গে।রীতার দিককার কেউ একটি ফোন পর্যন্ত করেন না। যেন রীতার মৃত্যুর পরে সত্যেনকে তাঁরা ত্যাজ্য ঘোষণা করেছেন।
আজ হঠাৎ ইরাবতি তার জীবনে যেন একটি নতুন ঢেউয়ের আন্দোলন ঘটিয়ে দিয়েছে।এক বুক আশা নিয়ে বারবার ফেসবুক নোটিশে ঢুকে সত্যেন দেখছে ইরাবতি কি তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট- এ অনুমোদন দিলো?
বারবার আশাভঙ্গে ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছে সত্যেন। ভাবছে, তাহলে কি ইরাবতি তাকে প্রত্যাখ্যান করলো? আদৌ সে কি দেখেছে সত্যেন এর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট? সারাদিনে ফেসবুক খোলেনি নাকি? এরকম নানা ভাবনায় জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে সত্যেন ফোন অফ করে শুয়ে পড়লো বিছানায়।
ঘুম আসছে না।ইরাবতি র কালো শাড়ি পড়া তৃতীয় ছবিটা দুচোখ জুড়ে, মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।এ্যতো রাত্রি হয়ে গিয়েছে।কাউকে ফোন করাও যাবে না।অথচ সারাদিন মনেমনে একা একা ইরাবতির সঙ্গে বকবক করে মনটা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে ইরাবতি সম্পর্কে।ঘড়ির দিকে তাকায়।এখন একটা পঞ্চান্ন। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সত্যেন।
বাথরুমে যায়।জল খায়।তারপর চোখে জলের ঝাপটা দেয় অভ্যাস মতো।গামছা জলে ভিজিয়ে কান, গলায় বুলিয়ে নেয় কয়েকবার। তেমন ঠান্ডা না পড়লেও ঠান্ডা আছেআজ যেন বেশি ঠান্ডাই লাগছে তার। গামছা মেলে দিয়ে, মাথার পাশে মা কালীর ছবিতে এবং বাবা- মায়ের ছবিতে প্রণাম জানিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে বিছানায়। বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত- একাগ্র করতে মনে মনে গুণতে থাকে, এক- দুই- তিন- চার- পাঁচ...
চলবে...
রীতার মৃত্যুর পরে দিনের বেলা সত্যেন একেবারে ঘড়ি ধরে দেড়টা থেকে পৌনে দুটোর মধ্যে তার খাওয়া শেষ করে।একে রীতার অভাব, তার ওপর চব্বিশ ঘন্টা কাজের লোক কাজলের প্রস্থান সর্বোপরী একমাত্র ছেলে তার ব্যবসায় সাহায্য করবার পরিবর্তে চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গেলো।একটি তিন- চার জনের ভরা ভর্তি সাংসারিক পরিবেশ থেকে একদম একা হয়ে পড়েছে সত্যেন।
সারাজীবন হই হট্টোগোল করে কাটিয়ে এসেছে সে।কিছু না কিছু থাকতোই তার পরিবারে। হয় কোনও আত্মীয়, নয় সস্ত্রীক কোনও বন্ধু, আবার কখনো বা রীতার দিককার কোন আত্মীয়- বন্ধুবান্ধব। কখনও তারাও যেতো অন্যের বাড়িতে নিমন্ত্রন পেয়ে। কিছু না থাকলে সত্যেন নিজেই ঘোষণা করতো, "টু ডে ইজ্ স্পেশাল মাংস ডে", অথবা "টু ডে উই উইল সেলিব্রেট রেড লেটার ডে"। কিসের রেড লেটার ডে প্রশ্ন করলে বলতো, "কেন? আজ স্পেশাল খাওয়া দাওয়া হবে না? সেই জন্যই রেড লেটার ডে"।
রীতা থাকাকালীন আত্মীয় পরিজনদে নিয়মিতভাবে আনাগোনা ছিলো এই বাড়িতে। কিন্তু রীতা চিরকাল সংসার সামলানোর ব্যাপারে একটু অগোছালো। ঘর দোর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যে গৃহলক্ষীর দায়িত্বে বর্তায়, হাসি মুখে নিজে অথবা কাজল কে দিয়ে সেই কাজ সম্পন্ন করে ইয়ার্কির ছলে সেটা মনে করিয়ে দিলেও রীতা ভালোভাবে নিতে পারতো না সত্যেনের কথা গুলি। মনে মনে ক্ষুণ্ন হতো।এক এক সময় অভিমান ভরা গলায় বলতো, "আমি পারি না বলে খোঁটা দিচ্ছো"?
কথা বাড়াতো না সত্যেন।এড়িয়ে যেতো। জীবনের অনেক অপ্রাপ্তির ভিড়ে মিশিয়ে দিতো আর একটি অপ্রাপ্তি। চব্বিশ ঘণ্টা কাজের লোক কাজলের পাশাপাশি ঠিকা কাজের মাসি বাসন ধুয়ে, ঘর ঝাঁট দিয়ে যেতো।আর রান্নার জন্য সেই তখন থেকেই আছে এই বুড়ি দিদিমা। রীতার মৃত্যুর পর যখন ছেলেও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া অসহায় বাবার কথা না ভেবে চলে গেলো চাকরি নিয়ে, মুখে কিছু না বললেও মনে মনে খুব ভেঙে পড়েছিলো সত্যেন।আর খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিলো কাজলকে নিয়ে। মধ্য বয়সী কাজলই শেষ পর্যন্ত বললো, "দাদা, বৌদি তো নেই, বাবাই-ও থাকে না।এবার আমায় ছুটি করে দ্যান্"। একটি কথা বলেনি সত্যেন।। পত্রপাঠ তার মাহিনা, সঙ্গে আরও বেশ কিছু টাকা দিয়ে তাকে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ট্রেণের টিকেট, কিছু নতুন জামাকাপড় ইত্যাদি কিনে দিয়ে ছুটি দিয়েছিলো।
এ্যতোদিন ধরে একসঙ্গে এক বাড়িতে থাকা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই একটি আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।তাই যাওয়ার সময় খুব কেঁদে ছিলো কাজল।সত্যেন-ও মন থেকে তাকে ছাড়তে চায় নি। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে শেষ পর্যন্ত নিজে তাকে ট্রেণে তুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় জানিয়ে এসেছিলো।
রান্নার দিদা এবং ঠিকা কাজের মাসি ঘোরতর সওয়াল করে ছিলো কাজলের না যাওয়ার পক্ষে।বারবার সত্যেনের একা হয়ে যাওয়ার কথা মাথায় রেখে যুক্তি সাজিয়েছিলো।কিন্তু সত্যেন-ও মনপ্রাণ থেকে চায়নি কাজল থেকে যাক। পাড়ায় ব্যানার্জী কাকিমা বা গোপালের মা, কার্তিকের বৌদি এবং পাশের বাড়ির বিদ্যুৎ বাবুর "এখন কাজলকে নিয়ে তুমি কি করবে সত্যেন"? এই অতি আগ্রহ মনের দিক থেকে সত্যেনকে খুব ভয়ার্ত করে তুলেছিলো।
কার্তিকের বৌদি তো আরও এককাঠি উপরে উঠে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলো, "কাজল এখন কোথায় শোবে"? ইঙ্গিত টি নাড়িয়ে দিয়েছিলো সত্যেনকে।অথচ কাজল থাকলে তার একাকিত্ব অনেকটাই কমে যেতো। পরিচিত মুখ, সংসারের একজন হয়ে উঠেছিলো।আর সবথেকে বড়ো কথা, সংসারের খুটিনাটি ও-ই জানতো সব।তবুও সত্যেনকে শেষ পর্যন্ত একা থাকার জীবন কেই বেছে নিতে হল।
সেই থেকে একাকিত্ব ভীষণ ভাবে ঘিরে ফেলেছে সত্যেনকে। মনের মধ্যে মাঝেমাঝেই একরাশ যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে ওঠে। বুকের ভেতরটায় ডুকরে ওঠে না পাওয়া জীবনের একগুচ্ছ অপ্রাপ্তি। সব সময় কথা বলা সত্যেন বোবা হয়ে গিয়েছে। আত্মীয় রা প্রায় কেউ যোগাযোগ রাখেন না তার সঙ্গে।রীতার দিককার কেউ একটি ফোন পর্যন্ত করেন না। যেন রীতার মৃত্যুর পরে সত্যেনকে তাঁরা ত্যাজ্য ঘোষণা করেছেন।
আজ হঠাৎ ইরাবতি তার জীবনে যেন একটি নতুন ঢেউয়ের আন্দোলন ঘটিয়ে দিয়েছে।এক বুক আশা নিয়ে বারবার ফেসবুক নোটিশে ঢুকে সত্যেন দেখছে ইরাবতি কি তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট- এ অনুমোদন দিলো?
বারবার আশাভঙ্গে ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছে সত্যেন। ভাবছে, তাহলে কি ইরাবতি তাকে প্রত্যাখ্যান করলো? আদৌ সে কি দেখেছে সত্যেন এর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট? সারাদিনে ফেসবুক খোলেনি নাকি? এরকম নানা ভাবনায় জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে সত্যেন ফোন অফ করে শুয়ে পড়লো বিছানায়।
ঘুম আসছে না।ইরাবতি র কালো শাড়ি পড়া তৃতীয় ছবিটা দুচোখ জুড়ে, মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।এ্যতো রাত্রি হয়ে গিয়েছে।কাউকে ফোন করাও যাবে না।অথচ সারাদিন মনেমনে একা একা ইরাবতির সঙ্গে বকবক করে মনটা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে ইরাবতি সম্পর্কে।ঘড়ির দিকে তাকায়।এখন একটা পঞ্চান্ন। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সত্যেন।
বাথরুমে যায়।জল খায়।তারপর চোখে জলের ঝাপটা দেয় অভ্যাস মতো।গামছা জলে ভিজিয়ে কান, গলায় বুলিয়ে নেয় কয়েকবার। তেমন ঠান্ডা না পড়লেও ঠান্ডা আছেআজ যেন বেশি ঠান্ডাই লাগছে তার। গামছা মেলে দিয়ে, মাথার পাশে মা কালীর ছবিতে এবং বাবা- মায়ের ছবিতে প্রণাম জানিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে বিছানায়। বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত- একাগ্র করতে মনে মনে গুণতে থাকে, এক- দুই- তিন- চার- পাঁচ...
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন