শনিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১

রবিবাসরীয় বিভাগ-২৬। আজকের গল্প।। ব্রহ্মদত্যি - স্মৃতি শেখর মিত্র।।Ankurisha।। E.Magazine।। Bengali poem in literature।।





রবিবাসরীয়  বিভাগ-২৬

আজকের গল্প 

ব্রহ্মদত্যি

স্মৃতি শেখর মিত্র

 

আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে নানারূপ স্বপ্নের ঘোরে। ঘুম থেকে ওঠার খানিক পরেই শুরু হয়ে যেত নানা ধরনের খেলা। সে সময় আজকের মত বাচ্চা ছেলেদের অভাব ছিল না; একেক বাড়িতেই পাঁচ সাতজন ভাই বোন থাকতো।দু বছর থেকে শুরু করে বার বছরের মধ্যে।এক একটা পাড়ায় কম করেও ত্রিশ চল্লিশ জন ছেলে মেয়ে অনায়াসেই জুটে যেত। আমাদের বাড়ির সামনেই একটা বিশাল বড় বেলগাছ ছিল।তার ডাল পালা মিলে একটা চার পাঁচ কাঠা জমির জায়গাতে বিস্তৃত ছিল। বিশাল আকারের বেল ধরতো সেই গাছে। খুবই সুস্বাদু এবং উপকারী। আমরা বিশ বাইশজন ছেলে মেয়ে মিলে গাছটিতে চড়ে ঝারুল ঝাঁপ খেলতাম।সেই গাছেই বাস করতেন এক ব্রহ্মদত্যি। তাঁর চেহারার বর্ণনা পাওয়া যায় তিনি অতিশয় লম্বা, একমুখ লম্বা দাড়ি, তিনি খড়ম পরে থাকতেন। যদিও কেউ তাঁকে কখনও চাক্ষুষ করেননি। সবটাই অনুমান নির্ভর। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ কোন কিছু কল্পনা করলে সেটা মানুষের মনে গভীর ভাবে গেঁথে যায়। তাই আমরাও তাঁর কথা চিন্তা করলে ঐ রূপটিই সামনে উদ্ভাসিত হতো। তাঁকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য প্রতিমাসে অমাবস্যা তিথিতে রীতিমত বামুন ঠাকুরকে দিয়ে পূজা করা হতো। প্রতিরাতে রাত বারোটার পর তাঁর আবির্ভাব ঘটত ঐ গাছের শাখায়। তিনি মাঝরাতে গাছে চড়ে দোল খেতেন গাছের ঝুরিধরে। এবং ভোর হওয়ার আগেই খড়মের শব্দ করে চলে যেতেন অন্য কোনখানে কিংবা মিলিয়ে যেতেন অনন্ত আকাশে। এই জনশ্রুতি শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। সন্ধ্যার পর কেউ আমরা ঐ গাছের পাশ দিয়ে যেতে ভয় পেতাম।অমাবস্যার রাতে চিড়া,গুড়  ও কাঁচা দুধ সহযোগে তাঁর পূজা করা হতো। সঙ্গে থাকতো এক ছিলিম গাঁজা। গাঁজা ছাড়া ব্রহ্মদত্যির পূজা হয় না। তাঁর পূজাতে গাঁজা অবশ্যই লাগবে। ব্রহ্মদত্যি বাবাকে চাক্ষুষ আমরা কোনদিন অবশ্য গাঁজা সেবন করতে দেখিনি। আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার ছোট দাদু তাঁর সাগরেদ ধীরেন সর্দারকে নিয়ে বৈঠক খানায় নাম সংকীর্তন করতেন। তিনি ছিলেন গাঁজার ভক্ত। তিনিই ব্রহ্মদত্যি বাবাকে স্মরন করে ঐ গাঁজা সমস্তটা একাই সেবন করতেন। আমাদের পাড়ার সব ছেলে ছোকরা এবং পুরুষ মানুষরা এসে পূজা স্থলে ভিড় করতেন। অনেক মন্ত্রোচ্চারণের পর পূজা সাঙ্গ হত। এখানে উল্লেখ্য যে পূজা স্থলে কোন মহিলার আগমন নিষিদ্ধ ছিল। তাঁর পূজায় মহিলাদের উপস্থিতি একান্তই বর্জ্য ছিল।ভয়ে এবং ভক্তিতে সবাই ঐ বেলগাছের ক্ষতি করার চিন্তাতেও আনতো না। আমার এক ঠাকুমার ঈশ্বরের উপর গভীর আস্থা ছিল। তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় ঠাকুর দেবতার পূজা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। গরীব দুঃখী সব মানুষের জন্য তাঁর ভালবাসা ছিল অগাধ কিন্তু তিনি ভূত, প্রেতাত্মাবা ব্রহ্মদত্যি ইত্যাদিতে মোটেও বিশ্বাস করতেন না। তাই ব্রহ্মদত্যির মাঝরাতে দোল খাওয়ার  কথা শুনে কোনদিনই বিশ্বাস করতে পারেননি; তবে বহু মানুষের বিশ্বাসকে একেবারে উড়িয়ে দিতে চাননি তাই মনস্থির করলেন এক শনিবার অমাবস্যা তিথিতে মাঝরাতে অবশ্যই ঐবেলতলায় যাবেন এবং কাউকে কিছুই এব্যাপারে ‌জানাবেন না। তাঁর মনের মধ্যে এই ইচ্ছাটা বাঁচিয়ে রাখলেন। তিনি পঞ্জিকা দেখে ঠিক করলেন কোন দিন শনিবার ধরে অমাবস্যার রাত  পড়বে। এই দিনটি সে বছর বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি এক শনিবারে পড়েছে।সেইমতো তিনি মনে মনে প্রস্তুত হয়ে রইলেন। এমনিতে তাঁর নিজের নাতনী তাঁর সঙ্গে এক বিছানায় শুত। নাতনী তাঁর ঠাকুমার চোখের মণি।নাতনী ও ঠাকুমায় খুব ভাব।নাতনীও অনেক রাত পর্যন্ত ঠাকুমার কাছে নানা ধরনের গল্প শুনতো এবং রাত দশটার আগে ঘুমাতো না যদিও গ্ৰামের মানুষ জন খুব তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়তো।তাছাড়া গরমকালে তখনকার দিনে প্রায় দিনই এ গ্ৰামে  সে গ্ৰামে ডাকাতদের উৎপাত ছিল আমাদের গ্ৰামের পাশেই বিশাল জঙ্গল।বেশিরভাগ গাছ শাল, পিয়াল, মহুয়া, পলাশ, হরিতকি ইত্যাদি। বেশ ঘন জঙ্গল। বেশিরভাগ শাল, পিয়াল, মহুয়া, পলাশ ইত্যাদি গাছের জঙ্গল।তাই জঙ্গল থেকে আমাদের গ্ৰামের মানুষজন প্রায়দিনই টর্চের আলো দেখতে পেতেন। আমাদের গ্ৰাম খুবই ছোট একটি গ্ৰাম। কয়েক ঘর বামুন এবং বাকি সব কায়স্থদের বাস। তাই গরমের দিনে পালি করে পাহারা দেওয়া হতো।এক একটি পাহারা পার্টিতে পাঁচজন সক্ষম যুবকরা থাকতেন।তাঁরা তাঁদের সঙ্গে লাঠি,সোঁটা, বল্লম, তীর ধনুক ইত্যাদি নিয়ে প্রস্তুত থাকতেন। এবং সঙ্গে অবশ্যই সকলের কাছে টর্চ লাইট থাকতো। ঠাকুমা সেইরাতে দশটা পর্যন্ত গল্প করতে করতে একসময় যখন বুঝতে পারলেন তাঁর নাতনী ঘুমিয়ে পড়েছে তখন তিনি বিছানা ছেড়ে ব্রহ্মদত্যির সাথে মোলাকাত করার জন্য তৈরি হতে থাকেন। তাঁকে জানতেই হবে ব্রহ্মদত্যি কত রাতে দোল খাওয়া শুরু করেন এবং কতক্ষণ দোল খান। তাঁর এই নৈশ অভিযানের কথা তাঁর পাশে শুয়ে থাকা নাতনীকেও জানাননি। সেদিন সন্ধ্যাতেও ব্রহ্মদত্যির জন্য পূজাপাঠের আয়োজন করা হয় এবং ঠাকুমা সেসব জানতেন এবং আমরাও বললাম পূজা উদযাপনের কথা।যেহেতু ঠাকুমা তাঁর নাতনীকে নিয়ে একাই থাকতেন তাই তাঁর টুকটাক কাজে যেমন দোকান থেকে কিছু আনতে বললে এনে দিতাম মাসকাবারি দোকানের জিনিস ইত্যাদি ঠাকুমার বাড়ির মুনীশ শুকু বাউরী নিয়ে আসতো পাশের গ্ৰাম গোপালপুর থেকে। এই ঠাকুমার দুই ছেলে মাইথনে থাকতেন। দুই ছেলেই ডিভিসিতে কাজ করতেন।মাসের শুরুতে কোনবার বড়ছেলে তো একবার বার ছোটছেলে এসে সবকিছু দেখে শুনে যেতেন।আমরা সবাই এক উঠানেই থাকতাম তাই ঠাকুমার কখনও কোন অসুবিধা হয়নি। ঠাকুমার শরীর অসুস্থ থাকলে আমার মা তাঁর সেবা শুশ্রূষা করতেন। আমাদের বাড়ির উঠানে একটা দেশি কুকুর থাকতো।তার নাম রাখা হয়েছিল ভোলা।ভোলাকে ঠাকুমা যত্ন করে নিজের হাতে ভাত, রুটি ইত্যাদি খাবার দিতেন তাই ঠাকুমাকে ভোলা খুব ভালবাসতো। মাঝরাতে যখন ঠাকুমা ব্রহ্মদত্যির দোল খাওয়া দেখার জন্য বের হলেন তখন সদর দরজায় অতিশয় সন্তর্পনে হুড়কা খুলে বেরিয়ে গেলেন আমরা কেউই জানতে পারলাম না কিন্তু ভোলাকে ফাঁকি দিতে তিনি সমর্থ হননি। তাই ভোলাও ওঁর পেছন পেছন বেরিয়ে গেল। আমাদের গ্ৰামের বাড়িতে গরমের দিনে চিতি,ঢ্যামনা,খরিশ ইত্যাদি সাপের খুব উৎপাত। তাই গ্ৰামের প্রতিটি পরিবারেই একটি করে টর্চ লাইট অবশ্যই থাকতো।ঠাকুমাও তাঁর সঙ্গে একটি টর্চ লাইট নিয়ে বের হন।বেলগাছের সন্নিকটে এসে ঠাকুমা ভেবেছিলেন ব্রহ্মদত্যির সামনাসামনি হবেন এবং তাঁর দোল খাওয়া দেখতে পাবেন। তেমনটি কিছু দেখতে পেলেন না। তবে ঘন অন্ধকারের মধ্যে তাঁর সামনে দিয়ে একটা ঘূর্ণিঝড় প্রচন্ডবেগে বয়ে গেল। এই আকস্মিক ঘূর্ণিঝড় যেন জানিয়ে দিয়ে গেল সবকিছু অবিশ্বাস করবি না। আমি আছি এবং এই গাছ ছেড়ে আমি যাব না কোথাও, কোনদিন। ঠাকুমাকে এইটুকু শিক্ষা দিয়ে তিনি কোথাও মিলিয়ে গেলেন।সে রাত্রে তিনি আর দোল খেতে আসেননি। পরদিন সকালে ঠাকুমা আমাদের সকলের সামনে সমস্ত ঘটনাটি খুলে বললেন এবং সবাই তাঁর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

1 টি মন্তব্য: