ধারাবাহিক ভ্রমণকথা(পর্ব-২৮)
পৃথিবীর উল্টো পিঠবিশ্বেশ্বর রায়
'বন্দরের কাল হল শেষ'। দেশে, বাড়ি ফেরার জন্য মন ছটফট করছে বহুদিন আগের থেকেই। 'দেশের কুকুর তুলি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া', কিংবা 'তবু ভরিল না চিত্ত----তাই মা তোমার কোলে এসেছি আবার'। এই যে টান, এই যে আপন দেশ, আপন ঘর, আপন পরিবেশের মধ্যে ফেরার আকুতি --এর যে কী রসায়ন তা মনে হয় মানুষ কখনও অনুধাবন করতে পারবে না। এখানে এত সুখ, এত আনন্দ, এত নি:শঙ্ক নির্ভার জীবনযাপন, তবু বেশিদিন তা দীর্ঘায়িত করতে ভাল লাগে না। তবে আমাদের এবারের এই আনন্দ-ভ্রমণ অন্য তাৎপর্য বহন করছে। কারণ, এখানে আমাদের ছেলে এবং মেয়ে-জামাই সবাই আছে। তবে যাবার বেলা মেয়ে-জামাইয়ের জন্য তেমন মন খারাপ করছে না। কারণ, ওরা দু'জন একসঙ্গে আছে এবং আছে প্রায় দু'বছর ধরে। ওরা ঠিকঠাক সামলে চলতে পারবে। কিন্তু বাবাইকে অনেকটা অসহায় মনে হল। কেমন যেন একটা নির্ভরতা গড়ে উঠেছিল আমাদের উপর। আমাদের সুখ-সুবিধার জন্য ওর সদাব্যস্ততা আর ব্যাগ্রতা দেখলেও ভাল লাগে। এর উপর ওর অফিসের কাজের চাপ, বাথরুম যাওয়া, নাওয়া-খাওয়ার সময় পর্যন্ত পায় না ঠিকঠাক। একুশে নভেম্বরে যেদিন ওর জন্মদিন গেল সেদিনও work from home করতে হয়েছে ওকে। সকাল সাতটা থেকে সন্ধে আটটা পর্যন্ত ও কম্পিউটার ছেড়ে উঠতেই পারে নি। সকালের জলখাবার, দুপুরের খাওয়ার সময় পর্যন্ত পেল না প্রায়। হাতের কাছে সবকিছু গুছিয়ে দিয়েও এই অবস্থা। আমরা না থাকলে ও যে কিভাবে সামলাবে তাই ভাবতে ভাবতে মন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। এর মধ্যেই আজ ফিরতে হবে। আজ আমাদের জন্যই ও P. T.O. নিল। সারাদিন গল্পগুজব করে কেটে গেল। তারপর ঠিক সন্ধে ছটায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সাতটা একান্নয় আমাদের উড়ান। ব্র্যাডলি(হার্টফোর্ড) পৌঁছাবো এগারোটা চব্বিশ মিনিটে। অত রাত্রে পৌঁছে ট্যাক্সি ধরে ওদের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছাতে প্রায় বারোটা বেজে গেল। মুনিয়ারা জেগেই ছিল। আমাদের ট্যাক্সি দরজার মুখে থামতেই মুনিয়া ছুটে বেরিয়ে এল। এরপর প্রায় দেড়টা পর্যন্ত গল্প করে কেটে গেল। এর মধ্যেই মুনিয়ার মুখে শুনলাম বাবাই আমাদের এয়ারপোর্টে ছেড়ে ঘরে ফিরেই মুনিয়ার সঙ্গে কথা বলেছিল। তখন বলেছে-'বাবা-মা এখানে দু'মাস ছিল তখন ঘরে ফিরে দেখতাম বাবা-মা ঘরে আছে। ঘরের সবকিছু পরিপাটি করে গোছানো, খাবারও প্রস্তুত। কিন্তু আজ ঘরে ফিরে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কেমন এক শূন্যতা, ফাঁকা ফাঁকা!' শুনে বুকটা মুচড়ে উঠল। চোখের সামনে ওর অসহায়তাগুলো যেন ভেসে উঠল ছবির মত। এখন কিভাবে যে ও সামলাবে সবকিছু! আরও তিন মাস এভাবেই সামলাতে হবে ওকে। তারপর বিয়ের পর যদি অনামিকাকে নিয়ে আসতে পারে তবে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।
কাল অনেক রাত অবধি জেগে সকালে বেশ দেরিতে ঘুম ভাঙল। তারপর সারাদিন আর ঘরের বাইরে বের হইনি। সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে বাবাই Skype-এ যোগাযোগ করল। অনেক রাত অবধি নানা গল্প এবং কাজের কথা হল। কাজের কথা বলতে বাবাইয়ের বিয়ের প্রসঙ্গ। ওরই মধ্যে এখানকার ব্যাগগুলো একটু একটু করে গোছানো শুরু করলাম। জয়দীপ অফিস থেকে ফিরে হাত লাগাল আমাদের সঙ্গে।
এখানে আজ খুবই হালকা তুষারপাত হল। সামনে গাছের পাতায় চিনির দানার মত বরফকুচি জমে আছে। রাস্তায় বোঝা যাচ্ছে না। তবে লনে, ঘাসের উপর সাদা সাদা বরফের স্তর কেমন এক প্রস্তরিভূত দুধের নদীর মত শুয়ে আছে।
দু'মাস আগে এখান থেকে যাবার সময় যে গাছগুলোকে প্রথমে ঘন সবুজ এবং পরে fall foliage-এর সময় রঙিন দেখে গিয়েছিলাম এখন এসে দেখছি সেই সবুজ সতেজ গাছগুলো সম্পূর্ণ পত্রহীন, বজ্রাহত, শুকনো, নিষ্প্রাণভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বড় খারাপ লাগছিল তাদের দিকে তাকাতে তাকাতে। তবে জানি এই শীত শেষ হলে গাছগুলো আবার পত্র-পুষ্পে ভরে উঠবে বসন্তের আগমনে। প্রকৃতির সেই রূপ আমরা দেখতে পাব না। আমাদের এদেশে বাসকাল আর মাত্র দু'দিন।
মাঝের দু'দিন শুধু গোছগাছ, বাবাইয়ের সাথে Skype-এ গল্প, ফেরা, বিয়ের কেনাকাটার পরিকল্পনা--এসবই চলল। সবাই বেশ exited. মুনিয়াও এখন অনেক সহজ স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। বুঝি না মাঝে মাঝে ওর ঘাড়ে কী ভূত চাপে!
জয়দীপ আগেই গ্রেহাউন্ড বাসের টিকিট কেটে রেখেছিল। চারজনের জন্য। মুনিয়া-জয়দীপ আমাদের সঙ্গে জে, এফ, কে, পর্যন্ত যাবে। আমাদের বিদায় দিয়ে ওরা একটু নিউইয়র্কে ঘোরাঘুরি করে রাতে হার্টফোর্ডে ফিরবে। আমাদের ফ্লাইট ছিল দুপুরের দিকে। হার্টফোর্ড থেকে আমরা বেরিয়েছিলাম রাত তিনটের দিকে। নিউইয়র্ক পৌঁছানো গেল সকাল ছটায়। গ্রেহাউন্ড বাসস্ট্যান্ডে প্রাত:কৃত্যের সুব্যবস্থা আছে। সেসব সেরে, সঙ্গে আনা কিছু খাবারের সদ্ব্যবহার করে আমি আর জয়দীপ বেরোলাম আরও কিছু খাবারদাবার কিনতে। দুপুরের খাওয়াটা এখানেই সেরে আমরা ট্যাক্সি ধরে জে, এফ, কে, পৌঁছাবো এগারোটার মধ্যে--এমনই পরিকল্পনা।
এয়ারপোর্ট পৌঁছে মুনিয়ার চোখ-মুখ একটু ছলছল করছিল। আমাদের চোখও আর্দ্র হয়ে উঠল। ওরা ভাল থাকুক এই কামনা করে ওদের বিদায় দিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকে গেলাম।
ভেতরে ঢুকে জানতে পারলাম ফ্লাইট ছাড়তে অন্তত ঘন্টা তিনেক দেরি হবে। সেজন্য এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ সবাইকে কাউন্টারে আহ্বান করে নগদ কুড়ি ডলার করে দিল লাঞ্চের জন্য। এমন সময় ফোন বেজে উঠল। বাবাই ফোন করেছে। ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার পর কিছু খাবারদাবার কিনে খেয়ে নেওয়া গেল। তারপরেও আরও তিন ঘন্টা কাটাতে হবে। উড়ান ছাড়বে পাঁচটায়।পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে ঘন্টায় ছশো কিলোমিটার বেগে যখন আমাদের ফ্লাইট পূর্বাভিমুখী হয়ে ছুটে চলেছে তখন যেন সেই উচ্চতা থেকে আমার দেশ, আমার কলকাতাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আর তো মাত্র আঠারো-ঊনিশ ঘন্টা পরেই পৌঁছে যাব সেখানে।
(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন