হেমন্তের সকাল ১০
শিশিরকুমার বাগ
হেমন্ত দিনের শেষ আলো
জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠার মতোই ধূসর পথ বেয়ে হেমন্ত নেমে এল,
তাড়াতাড়ি সন্ধে-ঘনিয়ে-আসা হেমন্ত এল, পাকা ধানের গন্ধটুকু গায়ে মেখে,
পশ্চিম-মাঠের মুসুর-রঙের সূর্যটাকে সঙ্গী করে হেমন্ত এল, মাঠের গল্প শুরু করবে বলে।
আজও আছে, হেমন্তের খড়-নাড়া-মাঠের ফাটল, আজও আছে, শিশিরের জল।
দূরে - - - আরও দূরে - - -
এখনও যে গ্রামগুলি পড়ে আছে পৃথিবীর দূরতম কোনো এক নদীটির তীরে,
সেখানেই কোনো এক মেঠো-পথ ধরে,
অনন্ত বাঁশির ফুঁ-য়ে হেমন্তের মরা আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়।
একটি শামখোল পাখি তারস্বরে ডেকে নিল অন্যদের,
বিলের ধারে উঁচু গাছে আজ বুঝি বকেদের সভা,
ফুলের মতো শাদা শাদা পাখি ফুটে আছে কোনো এক প্রান্ত-প্রশাখায়,
সূর্য ডুবে গেলে, তার হালকা আবির যেন, মাখিয়ে দিয়েছে কেউ
সাঁঝ-কালো কোনো এক যুবতীর গালে।
মাঠভরা পলি কাদা, হাতের মুঠোর মতো, ধীরে ধীরে শক্ত হতে থাকে
নরম আলের প্রান্তে কাঁকড়ারা জড়ো করে রাশি রাশি মাটি
ঘাসের উপরে কিছু মাকড়সা জাল যেন স্ফটিকের হালকা বিছানা।
ওই তো, উঁচু মাথা ঘরগুলোর ওপারে ধোঁয়ার আস্তরণ ঘনিয়ে এল,
ওই তো, বুড়োদের দল হেঁটে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে, যে যাহার বিপন্ন আশ্রয়ে,
ওই তো, ঝমঝমিয়ে স্টেশনে ঢুকে পড়ল, হকার আর ঝালমুড়ি, সাঁঝের লোকাল,
ওই তো, একটি দুটি জ্বলে গেল, ল্যাম্প পোস্ট, ভেপারের আালো,
ওই তো, ও বাড়ির ছাদ থেকে, আকাশে হারিয়ে গেল একটি হাউই
ওই তো, ফানুসগুলো একে একে মিশে যাচ্ছে তারাদের ভীড়ে।
আমার হেমন্ত যেন গ্রামদেশের শুকনো পাতার কানাকানি,
এইমাত্র একটি বাদুড় ডানা ঝাপটে সন্ধান নিল কিছু ডাঁসা পেয়ারার,
এইমাত্র কলামোচার ফুল ছুঁয়ে উড়ে গেল, দু-চারটে দুষ্টু চামচিকে,
এইমাত্র কয়েকটা উড়ন্ত পোকাকে খাদ্য করে নিল চঞ্চল কালো ফিঙে পাখিটি,
গোধুলি-মদির সন্ধ্যাকালে এইমাত্র যে বধূটি আঁচলটি গলায় জড়াল, শাঁখ বাজাল তুলসী-তলায়,
সে তো আমাদের খুব চেনা, সন্ধ্যার আযান শুনে, যে গৃহস্থ এইমাত্র উঠে গেল নামাজের ডাকে,
তাকেও তো হেমন্ত সন্ধ্যায় খুব চেনা মনে হয়।
আমার হেমন্ত যেন আতীত দিনের এক রাত্রি মোহময়ী,
জোনাকির বাতিগুলো বনহরিণীর মতো আজ সবাই স্বাধীন,
ঝাপসা গাছের ডালে পাগলের মতো তারা নৃত্য করে চলে, যেন কোন রূপকথা, স্বপ্নের মতন,
হেমন্তের সন্ধ্যা যেন ঝরে পড়ছে, গলে নামছে, পাতায় পাতায়, ডানার তলায়, হৃদয়ের বোধে,
বেহালার ছড়ে বাজছে, মারু-বেহাগের সুর, বিপুল, করুণ।
দেওদার বনের ছোট্ট পাখিটি তার পাখায় গুঁজে নিচ্ছে নিজের অস্থির ঠোঁটদুটি,
ঠাণ্ডা হাওয়ায় একটানা ডাক দিতে শুরু করেছে পাহাড়ি পোকারা,
ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেন, কালচে সবুজের সঙ্গে মিশে গিয়ে
ছড়িয়ে পড়তে চায় হিম হিম সুতনুকা পাহাড়ের খাঁজে, ঠিক যেন মায়ের কোলের ওম
পাওয়ার জন্য, ছোট্ট শিশুটি আদুরে হাত দিয়ে আর একবার জড়িয়ে ধরল মায়ের গলাখানি।
ওগো, শহরের কোনো এক বহুতলের মেয়ে,
তুমি একবার এসে দাঁড়াও,
আলো কমে যাওয়া এই মাঠের এপারে।
তুমি খড়ের মাঠের পাশে, পউষের সূর্যাস্ত দেখতে পাবে,
দেখতে পাবে, পাখিদের দল বেঁধে ঘরে ফিরে যাওয়া,
তোমার সমগ্র চেতনা দিয়ে তুমি হেমন্তকে ছুঁতে পারবে অনাবিল আনন্দধারায়।
আমাদের হেমন্ত সন্ধ্যা তোমাকে স্বাগত জানাবে কোটি কোটি প্রদীপ জ্বালিয়ে।
তুমি একবার আকাশের দিকে তাকাও,
তুমি একবার কুয়াশা ঢাকা মাঠের দিকে তাকাও,
তুমি একবার বিপন্ন হৃদয়ের দিকে তাকাও,
তোমার আর শহরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে না,
তুমি বাঁধা পড়ে যাবে এই পল্লীগাঁয়ের মাটির মায়ায়,
হেমন্ত সন্ধ্যার এই নির্জন মাঠে, পরীদের দল এসে তোমায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে,
নিয়ে যাবে এক অনন্ত জ্যোৎস্নার দিকে,
যোখানে দুধ-শাদা বেহিসাবী খাতার পাতায়,
নির্জন কবির দল হৈমন্তিক ভালোবাসা দিয়ে,
লিখে যাচ্ছে কোনো এক চিরন্তন হিম কাব্য-গাথা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন