শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১

রবিবাসরীয় বিভাগ।। আজকের গল্প ।। ছোট ও বড় — অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়।।.Ankurisha ।।E.Magazine ।। Bengali poem in literature ।।

 






রবিবাসরীয় বিভাগ

আজকের গল্প


ছোট ও বড়

অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়


(মহানায়ক উত্তম কুমারের শ্রীচরণে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন)

         একালের দিনে একই ছাদের নীচে বাবা-মা’য়ের পাশে বসে টি.ভি.-র পর্দায় ছায়াছবি দেখে মনোরঞ্জন ও সময় কাটানোর ব্যাপারটা যেন একেবারে আমবাত্ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতই জলবৎ তরলম্ ঘটনা যে ইদানীং কালে সেটা আর বেমানান বা অশোভনীয় বলে মনে হয় না।  তাছাড়া বাচ্চাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। ওরা যাবেই বা কোথায়? না আছে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ, না আছে খেলার উপযোগী কোন নিরাপদ জায়গা। আজকাল ফ্ল্যাটের যুগ। যৌথ পরিবার এযুগে অচল। জন্ম নিয়েছে ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’। আমি, তুমি আর ইহ জীবনে দুই-একটি খেলার পুতুল।  

         অন্যদিকে সন্তান স্নেহে অন্ধ হাল আমলের ধৃতরাষ্ট্র তুল্য মা-বাপেরা তাঁদের পুত্রস্নেহে এতটাই কাতর যে দু’দন্ডের তরে চোখের আড়াল হোক পরাণে তা  সয় না।  কী জানি নয়নের নিধিরা পড়ে গিয়ে যদি ছড়ে যায় কোথাও বলাবাহুল্য এই ব্যাপারে অভিভাবকদের অভয় ও প্রশ্রয় দুই-ই থাকে। 

         টি.ভি.-র পর্দায় সেদিন বাংলা ছায়াছবি – ‘শুন বরনারী’ হচ্ছিল।  দুপুরে  খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকে যাওয়ার পরে সাত বছরের শিশুপুত্রটিকে পরম যত্নে আদর করে বুকের কাছে টেনে নিয়ে – ট্রেনের কামরায় জানালার পাশে বসে থাকা বাংলা সিনেমা জগতের হৃদয় কাঁপানো মহানায়ক উত্তম কুমারকে দেখে উচ্ছসিত এবং গদগদ স্বরে তাঁর সাথে ছেলের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে হঠাৎ বাপজান বলে ওঠেন – ওই দেখ, ওনাকে চিনিস?  ওনার নাম উওম কুমার।  আমাদের মহানায়ক।  এই নামটি ওনার দাদুর দেওয়া।  কী সঠিক নামকরণ করেছিলেন বল তো। এখন উনি শুধু দাদুর নয় সকলের উত্তম। আর মহানায়ক নামটি দিয়েছিলেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং সত্যজিৎ রায় মহাশয়। কী সুন্দর দেখতে বল তো, একেবারে রাজপুত্তুর! নিখুঁত নিস্পাপ চেহারা।  প্রাণভরে শুধু দেখতে ইচ্ছে করে। 

         অবশ্য যাকে উদ্দেশ্য করে মহানায়ক প্রসঙ্গে এত উপমা ও বিশেষণ প্রয়োগ সে কিন্তু পরম নির্বিকার চিত্তে খাতার পাতায় আপন মনে ড্রইং করতে ব্যস্ত। সেই মূহুর্তে ছেলেটির হাবভাব এবং আচরণের মধ্যেই স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল যে, উত্তম বা অধমের প্রতি সে একেবারে উদাসীন ও নির্লিপ্ত।  মহানায়ক বা উত্তম কুমার সম্পর্কে তাঁর হৃদ মাঝারে যে বিন্দুমাত্র কৌতূহল বা অনুসন্ধিৎসুতা বজায় আছে তা সেই মূহুর্তে বোধগম্য বহির্ভূত বিষয় বলে স্বীকার করে নেওয়া ব্যতীত দ্বিতীয় বিকল্প ছিল না। মহানায়ক তাঁর স্বাভাবিক স্বকীয়তার গুণে শীল্প নৈপুন্য সে যত উচ্চমানেরই হোক না কেন ছেলেটির তাঁর প্রতি কোন আগ্রহ বা রুচি ছিল না তা বলাই বাহুল্য।  জগৎ মেতে উঠলেও ছেলেটির মানসিকতায় ছিল পর্যাপ্ত পরিমান অনীহা। 

         এর কয়েকটা দিন পরের ঘটনা।

         সেদিন রাতের বেলায় খাওয়া-দাওয়ার পরে বাড়ির সকলে একসঙ্গে বসে টি.ভি.-র র্পদায় ‘শোলে’ সিনেমাটি উপভোগ করছিল। ছেলেটি হঠাৎ একসময় উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠে– ওই দেখ, ওকে চিনতে পারো? ও অমিতাচ্চন (অমিতাভ বচ্চন)।  কী সুন্দর দেখতে! ও ফাইটিং করতে পারে, চলতি ট্রেনের ছাদের উপর দৌড়োতে পারে।  তোমার উত্তম তো ট্রেনের কামরার ভেতরে বসে থাকে শুধু।  এখন বল কে বড়?

         কথায় বলে পুত্রের কাছে পিতার পরাজয়, সে তো পরাজয় নয়– জয়েরই আরেক নাম। কিন্তু সেই মূহুর্তে পুত্রের অজ্ঞানতা দূরিকরণ হেতু পিতা তাঁর নিজ কর্তব্যপালনে তৎপর হয়ে ওঠে। মহানায়কের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত করার দুর্বার আকাঙ্ক্ষায় বলে ওঠে – জানিস, কে বড় আর কে ছোট তা বোঝা যায় মানুষের মৃত্যুর পরে ।  শ্মশান বন্ধুর সংখ্যা গণনা করে।  মহানায়ক উত্তমের মরদেহ যখন টালিগঞ্জ রেল ব্রিজের নীচে, ঠিক তখনই একটা লোকাল ট্রেন ঊপর দিয়ে যাচ্ছিল ।  ড্রাইভার নীচে উত্তম কুমারের মরদেহ দেখতে পেয়ে ব্রেক কষেণ  গাড়ি যখন থামে তখন ভেন্ডার কামরাটি পড়ে শবযাত্রার উপর।  যারা সেদিন ফুল বিক্রি করতে বেরিয়েছিল তাঁরা সেদিন সব ভুলে গিয়ে পুস্পাঞ্জলি দিয়েছিলেন মহানায়ককে।  সুতরাং এবার বুঝতে পাচ্ছিস তো সে কতবড় মাপের মানুষ ছিলেন?  এইজন্যেই তো প্রত্যেকটি বাঙালির ঘরের দেওয়ালে টাঙানো থাকেন শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজির পাশে বাঙালির আরেক মহাপুরুষ মহানায়ক উত্তম কুমারের ছবি । 

         এবার বোধহয় যুক্তি খন্ডনের পালা পুত্রের – বাবা, বেশি বলো না তুমি।  অমিতাচ্চনের ওয়াক্স মডেল তৈরী হয়ে গিয়েছে লন্ডনে।  আমার জি.কে. বইতে আছে। 

           --তা হবে। কিন্তু আমাদের মহানায়ক উত্তম কুমারেরও কালো পাথরে তৈরী মর্মরমূর্ত্তি দাঁড়িয়ে আছে টালিগঞ্জের চৌরাস্তায় মোড়ে ইন্দ্রপুরী স্টুডিও-র সামনে।  লোকে দেবতাজ্ঞানে তাঁকে পূজো ও শ্রদ্ধা করেন।  শুধু কী তাই? তিনি ভালো গান গাইতে পারতেন।  ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছায়াছবির নির্দেশক ছিলেন। সেই ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সুর সংযোজন করেছিলেন। স্বনামধন্যা প্রখ্যাত গায়িকা আশা ভোসলেজিকে দিয়ে তিনি সেই ছবির গান গাইয়েছিলেন, গানের নোটেশন তৈরী করে দিয়েছিলেন। আশাজি উত্তম কুমারের গান শুনে বলেছিলেন – আপনি প্লে ব্যাক করেন না কেন?  হৃদয়নাথ মুঙ্গেশকারের হারমোনিয়াম বাজানোর ব্যাপারে খুব অহংকার ছিল।  উত্তমকুমারের হারমোনিয়াম বাজানো দেখে তাঁর সেই সুপ্ত অহংকার চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।  হিন্দি ছবির তাবড় তাবড় নায়করা তাঁকে যেরকম শ্রদ্ধা করতেন, সেই সৌভাগ্য অন্য কোনও নায়কের কপালে জোটেনি।  সেই কথা কল্পনাও করা যায় না।  এই ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন ও রাজেশ খাণ্ণা উত্তম কুমারের পা  ছুঁয়ে প্রনাম করতেন। অভিনেতা দিলীপ কুমারের বক্তব্য ছিল, ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিস্ময় উত্তম কুমার।     

         ছেলেটি জেতার নেশায় এবার মরিয়া হয়ে ওঠে – অমিতাচ্চন্ ডি.লিট. উপাধি পেয়েছেন তা জান?

     --ভরত উপাধিতে ভূষিত প্রথম বাঙালি আর কেউ নয় আমাদের মহানায়ক উত্তম কুমার।  ছেলের কথায় পিতা প্রতিবাদ করে ।

        পুত্রের চটজলদি উত্তর – এটা তো ইন্ডিয়ান এ্যাওয়ার্ড!  

        এরপর নিজের অজান্তে একটি দীঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।  ছেলের সাথে যুক্তি-তর্কের প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে বাপের সাহসে কুলোয় না। শানিত তীরের ফলার ন্যায় বুকে এসে বেঁধে কথাটা।  নিজের মনেই ভাবতে থাকে – সমুদ্রে অসময়ের তুফান ঝড়ে নাবিক যেমন সঠিক দিক নির্ণয় করতে অসমর্থ, ছেলের মতি-গতিও অনেকটা প্রায় দিগভ্রান্ত্র নাবিকের মতোই।  সঠিক দিক নির্ণয় করা বোধহয় অসম্ভব।  প্রকৃত ও সুষ্ঠ রুচিজ্ঞানের অভাবেই বোধহয় একটু একটু করে চারিদিক ছেয়ে যাচ্ছে রুক্ষতায় ও শুষ্কতায়।      

         আর তর্ক নয়। ভদ্রলোক এবার নিজের মনেই আওড়াতে থাকেন – তাঁর আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার কারণে  মৃত্যুর এতগুলো বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও লোকে এখনো তাঁর অভিনীত সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন।  নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একমনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবেগে অশ্রু বিসর্জন করেন।  এই অত্যাশ্চর্য ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।  আজও উত্তম কুমার স্মরণে টি.ভি.-র পর্দা জুড়ে নানান অনুষ্ঠান হয়ে চলেছে তার ইয়ত্তা নেই। এসব কথা কার কাছেই বা বলা যায় আর কেই বা শুনবে?  যেমন কথায় আছে - ‘অতীত দিনের কথা কেউ ভোলে কেউ ভোলে না’।  নাবালক পুত্রের দিকে সে অসহায় ভাবে তাকিয়ে ভাবতে থাকে – পরস্পর দুই প্রজন্মের ব্যবধানটা বোধহয় এইভাবেই সৃষ্টি হয় যুগ-যুগান্তর ব্যাপী। এটাই বোধহয় চিরসত্য এক স্বাভাবিক ঘটনা। 








                                            

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন