বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৫)।। আংটী রহস্যের নেপথ্যে — অনন্যা দাশ।। Ankurisha ।। E.Magazine ।।Bengali poem in literature ।।

 




ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৫)


আংটী রহস্যের নেপথ্যে

অনন্যা দাশ


বাড়ি ফিরে ওরা দেখল মিসেস পার্কার আর টেসা বসে রয়েছেন বাইরের ঘরে। মিসেস পার্কার মনের সুখে মার তৈরি ভেজিটেবেল চপ খাচ্ছেন!

ওদের দেখেই বললেন, “এই তো এসে গেছে!”

টেসা বললান, “ডেনির গাড়িটা খুঁজে পেয়েছে পুলিশ!” 

“কোথায়?”

“ওই সেন্টারফিল্ড গোরস্থান থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটা জঙ্গলের মধ্যে পার্ক করা ছিল। কেন ডেনি ওখানে গিয়েছিল আমি জানি না। আমাকে তো কিছু বলেনি!” বলে উনি কাঁদতে শুরু করে দিলেন, “আমার মনে হচ্ছে ডেনিকে আর খুঁজে পাব না আমরা! মা-বাবা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন। কী করব বুঝতে পারছি না!”

“গাড়িতে হাতের ছাপটাপ কিছু পেয়েছে?”

“না, একেবারে পরিষ্কার নাকি গাড়ি। কোন ছাপটাপ নেই, এমনকি ডেনির নিজের হাতের ছাপও তেমন নেই। ওরা বলছে কেউ মুছেছে গাড়িটাকে!”

“হুঁ। দেখুন আপনি অত বিচলিত হয়ে পড়বেন না। আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলে দেখছি। আমরা এখুনি প্লেস্যান্ট মেডোজ থেকে ফিরছি। ওখানে ডেনিকে লোকে যে কত ভালবাসত সেটাই দেখে এলাম।” 

“হ্যাঁ, ওর তো কোন শত্রু ছিল না। কেন এই রকম হল?”

ওরা চলে যাওয়ার পর মামা পুলিশের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন ডেনির গাড়িটাকে নিয়ে। ডক্টর বোম্যানের ব্যাপারে অবশ্য কিছুই বললেন না। 


পরদিন মামা সকাল সকাল কোথায় জানি বেরিয়ে গেলেন। জিকো, কেকা, অখিলবাবু কাউকে সঙ্গে নিলেন না, বললেন, “না, এখানে আমাকে একাই যেতে হবে!” 

বাড়ি ফিরে কয়েকটা ফোন টোন করে চুপ করে বসে রইলেন।  মাঝরাতে জিকো জল খেতে উঠে দেখল মামা একই ভাবে ল্যাপটপ কোলে করে বসে রয়েছেন, অথচ ল্যাপটপের স্ক্রিন কালো! জিকো দেখে বলল, “মামা! কী হয়েছে? অমন করে বসে আছো কেন?”

মামা বললেন, “রহস্যটার সমাধান পেয়ে গেছি মনে হচ্ছে রে জিকো! ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর রহস্য!”

“সেকি! কী হয়েছে?”

“না, এখন বলা যাবে না। কাল শুনতে পাদি। চল এখন শুয়ে পড়ি।”পরদিন সকালে উঠে মামা ডক্টর বোম্যানের ক্লিনিকে ফোন করলেন। ওরা কোন সময় দিতে পারল না। ভীষণ জরুরি, ‘ম্যাটার অফ লাইফ আণ্ড ডেথ’ বলে টলে মামা কোন রকমে বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ দশ মিনিট সময় পেলেন। হ্যারিকেও যেতে বললেন মামা ওখানে। সে শুনে বলল, “ঠিক আছে আমি নাহয় আপনাদের সবাইকে তুলে নিয়ে যাব আমার গাড়িতে।”

সারাদিন এঘর ওঘর করলেন মামা। জিকো মন্তব্য করল, “মামার অবস্থা নিমো আর ব্রুস লির মতন! সারাদিন ধরে শুধু চক্কর মেরেই চলেছেন!”হ্যারির সাড়ে চারটে নাগাদ আসার কথা ছিল, কিন্তু যখন পাঁচটা বেজে গেল অথচ সে আসছে না দেখে মামা ওকে ফোন করলেন। কেউ ফোন ধরল না। মামা কিছু বললেন না শুধু চোওয়াল শক্ত হল। মামা একাই যেতে চাইছিলেন কিন্তু জিকো, কেকা আর অখিলবাবু নাছোড়বান্দা! শেষে অখিলবাবু ফোন করে নিখিলকে ডেকে পাঠালেন। সে এসে ওদের ডক্টর বোম্যানের ক্লিনিকে পৌঁছে দিল। তখন পাঁচটা চল্লিশ। রিসেপশানিস্ট ওদের দেখে বলল, “ওনার পেশেন্ট দেখা এখনও শেষ হয়নি। আপনারা বসুন আমাকে যেতে হবে বেরিয়ে যাচ্ছি। সামনের দরজা লোক করে দিচ্ছি তবে আপনাদের বেরতে অসুবিধা হবে না, পিছনের দিকের দরজাটা ভিতর থেকে খোলা যায়।”

মিনিট পনেরো পরে একটা খুব মিষ্টি পুঁচকে বাচ্চাকে নিয়ে তার মা-বাবা বেরিয়ে যেতে ওরা ডক্টর বোম্যানের ঘরে গিয়ে ঢুকল। 

উনি কী একটা পড়ছিলেন চোখ তুলে ওদের সবাইকে দেখে বললেন, “মিস্টার রিপোর্টার আপনি! আবার সঙ্গে এক গাদা লোকজনকেও এনেছেন দেখছি! তা কী ব্যাপার?” 

মামা দাঁতে দাঁত চিপে বলেলন, “আমি রিপোর্টার নই! দুঃখিত সেদিন আপনাকে এক ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলতে হয়েছিল। এখন অবশ্য সে সব নিয়ে কথা বলার সময় নেই। আগে বলুন হ্যারি কোথায়?” 

“কে হ্যারি?”

“সেই অভিশপ্ত রাতে আপনার ট্যাক্সি ড্রাইভার! কোথায় সে? কী করেছেন আপনি তাকে?” 

“আমাকে মিথ্যে কথা বলে ভুল পরিচয় দিয়ে আমার অফিসে ঢুকে এসে আমার ইন্টারভিউ নিয়ে এখন আবার কী সব উলটো পালটা বলছেন আপনি!”

“ঠিকই বলছি! হ্যারি যদি আরেকটু বোকা হত তাহলে আপনার অনেক সুবিধা হত, বা আপনি যদি বেখেয়ালে আপনার আংটিটা ওর গাড়িতে না ফেলে আসতেন!”

“কী বলছেন আপনি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!”  

“ডক্টর বোম্যান, আপনি সারা পৃথিবীর লোকের সামনে ভগবান সেজে থাকতে পারেন কিন্তু আমাকে বোকা বানাতে পারবেন না! আপনি ডাক্তারি করেন ঠিকই কিন্তু ইদানীং আপনার ওই হেলদি হার্টশ সংস্থা আপনার ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠেছিল। আপনার সংস্থা চলছিল ঠিকই কিন্তু এই সব ক্ষেত্রে যা হয় তাই হয়েছিল, অর্থের অভাব হয়ে পড়েছিল মনে হয় আপনার। ফান্ড রেজার ইত্যাদি করা মানে প্রচুর টাকা খরচা করে তারপর কিছু টাকা তোলা, তাতে হ্যাপা প্রচুর। সেটা আপনার ঠিক যুক্তিযুক্ত মনে হত না কোনদিনই। আপনি সেই কথাই বলেছিলেন আপনার টেবিলে বসে। সেন্ট থমাস কলেজের অ্যাওয়ার্ড সেরেমনিতে, কী মনে পড়ছে? ওটাই তো সেই অভিশপ্ত রাত ছিল। আপনার সঙ্গে একই টেবিলে বসা রুইজ দম্পতি কিন্তু জানিয়েছেন যে আপনি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বটে কিন্তু আধ ঘন্টা পর আপনার একটা ফোন আসে। আপনি সেটা ধরতে বেরিয়ে যান, আর ফেরেননি। তাই সেদিন রাতে আপনার পক্ষে সেন্টারফিল্ড গোরস্থানে যাওয়া অবশ্যই সম্ভব ছিল। আমার বিশ্বাস হ্যারি ভুল করেনি। আপনি মুখ ঢেকে থাকলেও আপনার গলার স্বর শুনেই ও আপনাকে চিনে ফেলেছিল এবং আপনার আংটিটা আপনাকে ফিরিয়ে দিতে এসেছিল। আপনিই বরং চাইছিলেন না কেউ আপনাকে ওই জায়গায় যেতে দেখুক বা মনে রাখুক। আপনি ওখানে গিয়েছিলেন সেই কথাটার জানাজানি হয়ে যায় পাছে তাই আপনি আংটিটা ফেরত নিতে চাননি, এবং ওখানে যাওয়াটা অস্বীকার করেন। এবার বলুন হ্যারি কোথায়?”  

“আমি জানি না!” 

“আমাকে পুলিশ ডাকতে বাধ্য করবেন না ডাক্তার! গত কয়েকদিন ধরেই এই সব চলছে। প্রথমে ওর বাড়িতে খোঁজাখুঁজি হল, তারপর ওর গাড়ির পিছনে লোক লেগেছিল আর এখন ওকে পাওয়া যাচ্ছে না! এ আপনার কাজ না হয়ে যায় না!”ডক্টর বোম্যান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি তো এখনও বুঝতে পারছি না আপনি কী বলে চলেছেন পাগলের প্রলাপের মতন!” বলেই ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ দরজা দিয়ে সাঁ করে বেড়িয়ে চলে গেলেন। পরক্ষণেই দুম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ওদের চারজনকে নিজের অফিসের ঘরে বন্ধ করে দিয়ে পালিয়ে গেলেন ডক্টর বোম্যান!

অখিলবাবু বললেন, “ডাক্তার এটা খুব বোকামি করলেন! যাক নিখিলকে ফোন করুন, ও তো বাইরেই রয়েছে, এসে খুলে দেবে!” 

নিখিলকে ফোন করতে সে বলল, “রিসেপশানিস্ট মেয়েটা ক্লিনিকের দরজা লক করে দিয়ে চলে গেছে। তাই বাইরে থেকে ঢোকার উপায় নেই। ডাক্তার যখন পিছনের দরজা দিয়ে একা বেরিয়ে চলে গেলেন ওই রকম ঝড়ের বেগে তখনই আমার মনে হয়েছিল কিছু একটা গন্ডগোল। এবার তাহলে পুলিশে খবর দিই! ওরা এসে বাইরের দরজা ভাঙুক!” 

পুলিশকে জানাতে ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির। দরজা ভেঙ্গে ওদের চারজনকে বার করা হল। ততক্ষণে জিকো ডক্টর বোম্যানের টেবিলে বাচ্চাদের জন্যে রাখা চকোলেট, টফি ইত্যাদি সব খেয়ে ফেলেছে!  

পুলিশকে মামা হ্যারির কথাও বললেন।  

হ্যারিদের ক্যাব সার্ভিস কোম্পানিতে ফোন করে জানা গেল যে ওর সঙ্গে ওদের শেষ কথা হয়েছে বিকেল চারটে নাগাদ। ওরা সব সময় ফোনে টিকি ধরে রাখে ড্রাইভারদের কিন্তু চারটের পর থেকে হ্যারি আর ফোন ধরছে না, ওর ফোন সুইচ অফ করা। ওরা ক্রমাগত মেসেজ ছেড়েছে। হ্যারি কিউ গার্ডেনে কাউকে নিয়ে যাচ্ছিল। 

পুলিশ চিফ স্যামসন সব শুনে বললেন, “আমরা ডক্টর বোম্যানকে গিয়ে ধরছি। কান টানলে মাথা আসবে! ওনার বাড়িতে যাচ্ছি আমরা। যতদুর মনে হচ্ছে উনি কোন ভাড়াটে গুন্ডাকে হ্যারির পিছনে লাগিয়েছিলেন। ওনার নিজের পক্ষে তো ওই সব কাজ করা সম্ভব নয়!”

নিখিলের গাড়ি করে ওরা চারজনও ছুটল পুলিশের গাড়ির পিছন পিছন। অখিলবাবু বললেন, “আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! ওই রকম দেবতুল্য লোক হঠাৎ কেন এমন হয়ে গেলেন!” 

“লোভ বুঝলেন, স্রেফ লোভ! খ্যাতির লোভ আর সেই খ্যাতি পাওয়ার জন্যে অর্থের লোভ!”

ব্রুকলিনের একটা সম্ভ্রান্ত এলাকায় ডক্টর বোম্যানের বাড়ি। নিউ ইয়র্ক শহরের ভিড়ে ভরা রাস্তা ডিঙ্গিয়ে ওরা যখন সেখানে পৌঁছল তখন ওখানে বেশ কয়েকটা পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। ওদের দেখে পুলিশ চিফ মাথা নাড়লেন, বললেন, “বড্ড দেরি হয়ে গেছে!” 

নিখিল ধরা গলায় বলল, “হ্যারি?”

“না, না, হ্যারি ঠিকই আছে। জ্ঞান ফেরেনি এখনও, মনে হয় কিছু ইঞ্জেকশান দেওয়া হয়েছিল ওকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ডক্টর বোম্যানকে বাঁচানো গেল না। উনি আত্মহত্যা করেছেন!” 




চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন