ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস পর্ব-২
আংটী রহস্যের নেপথ্যে
অনন্যা দাশ
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ সময় দিল ওরা মামাকে। কে জানি একজন ক্যানসেল করেছিল বলে। মামা বললেন উনি রিপোর্টার সেজে যাবেন যাতে এটা সেটা জিগ্যেস করতে পারেন আর সঙ্গে রেকর্ডও করতে পারেন। সেই কারণেই অবশ্য সঙ্গে কাউকে নিতে পারলেন না। রিপোর্টারের সঙ্গে তার ভাগ্নে আর ভাগ্নি গেলে তো আর চলবে না!
মামার ভিডিও রেকর্ড করা কথোপকথনের থেকে কিছুটা এখানে তুলে দেওয়া হল –
স্যানফোর্ড বোম্যান – হ্যাঁ, আমি শুধু ছোটদের চিকিৎসাই করি। কত যে হার্ট সার্জারি করতে হয় আমাকে সারা মাসে বলতে পারব না। এ ছাড়া আমার একটা সংস্থা আছে, হেলদি হার্টস ফাউন্ডেশান। সারা পৃথিবীর বাচ্চাদের জন্যে কাজ করি আমরা। সেটার জন্যে আমাকে প্রচুর খাটতে হয়। আপনি চাইলে আমি আপনাকে আমার হাসপাতাল আর সংস্থায় টুর করিয়ে দেখাতে পারি। তাহলে আপনার ছবিটবি যা দরকার সব পেয়ে যাবেন আপনি।
মামা- বাহ, তাহলে তো দারুণ হয়। আচ্ছা এপ্রিলের ১৩ তারিখ সেন্ট থমাস কলেজের অ্যাওয়ার্ড সেরেমনিতে আপনি গিয়েছিলেন, তাই না? আমার এক পরিচিত আপনাকে ওখানে দেখেছিল বলল।
স্যানফোর্ড বোম্যান – হ্যাঁ, ওই রকম কত অনুষ্ঠানের যে নিমন্ত্রণ আসে! আমি কয়েকটাতে যেতে চেষ্টা করি তবে অনেক সময় কাজের জন্যে ওই সবে যাওয়ার সময় বার করতে পারি না। গেলে বরং ভালই হয়। কিছু লোকের সগে দেখা হয়, কথা হয়। হেলদি হার্টের জন্যে মেম্বার বা ডোনার জোগাড় করার চেষ্টা করা যায়। টিভি ইন্টারভিউ ইত্যাদিতেও হেলদি হার্টের কথা বলি। এই যে ইকুয়েডরে ভূমিকম্প হয়েছে, আমাদের প্রতিনিধিরা ওখানে গিয়ে হাজির। শিশুদের কষ্ট সব চেয়ে বেশি জানেন তো!
এর পর ভিডিওটা বন্ধ করে দিয়ে মামা বললেন, “ভদ্রলোক অত্যন্ত অমায়িক এবং সত্যিই অনেক কিছু করছেন বিশ্বের জন্যে। ওনার সঙ্গে যারা কাজ করে তাদের কাছে উনি ভগবান। রুগীদের পরিবারের লোকজনের কাছেও তাই। পেশেন্ট স্যাটিসফ্যাকশান নম্বরগুলো আকাশ ছোঁওয়া! সবাই ডাক্তারবাবু বলতে অজ্ঞান। ওখানে কত চিঠি আর ফটো যে দেখলাম তার ঠিক নেই! আমার বারবার মনে হচ্ছে হ্যারি কিছু একটা ভুল করছে। এমনও তো হতে পারে কেউ ওনার আংটিটা চুরি করে পরেছিল? কারণ উনি ওনার ক্লিনিকের লোকেদের বলেছেন যে আংটিটা হারিয়ে গেছে। আমি আর ওনাকে গোরস্থানের কথাটা জিগ্যেস করতে পারিনি অবশ্য। থাক আজ আর ও সব নিয়ে ভাবব না, ব্রুকলিন বোটানিকাল গার্ডেনের সৌন্দর্য উপভোগ করি।”
অখিলবাবুও এসে গেছেন তাই ওরা সবাই মিলে ব্রুকলিন বোটানিকাল গার্ডেনে গিয়ে হাজির হল। এত সুন্দর ফুলের শোভা যে বলে বোঝানো কঠিন, ভাষা হারিয়ে যায়। থোকা থোকা গোলাপি, সাদা চেরি ফুল, গোলাপি বেগুনি রেড বাড, রঙ বেরঙের টিউলিপ, ফুলের ভারে নুয়ে পড়া উইপিং চেরি। অনেক জায়গায় লোকে বসে বাজনা বাজাচ্ছে, কিছু লোক বসে বসে শুনছে। অনেক রকমের বাজনা, ওরা সেসবের নামও জানে না! এ ছাড়া কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরি করে ক্যাকটাস জাতীয় মরুভূমির গাছ, ট্রপিকাল রেন ফরেস্ট সব কিছুই রয়েছে। অখিলবাবু সব কিছুর সঙ্গে সেলফি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দুয়েকবার ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানটাও গাইতেও চেষ্টা করছিলেন কিন্তু জিকো কেকা ওনাকে থামিয়ে দিল! মা স্যান্ডউইচ ইত্যাদি করে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলো বাগানে বসেই সদব্যবহার করা হল। সারাদিন ভালই ছিল হঠাৎ বাড়ি ফেরার মুখে আকাশ কালো করে প্রবল জোরে বৃষ্টি নামল।
কেকা বলল, “জিকোটাকে এত করে বললাম ওয়েদারটা দেখে নে কিন্তু কিছুতেই দেখল না! একটা ছাতা পর্যন্ত আনা হয়নি!”
মা বললেন, “এখানকার বৃষ্টি তো আর কলকাতার বর্ষার মতন নয়, এখুনি থেমে যাবে।”
বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে ওরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে আরেকজন শাড়ি পরা মহিলা এসে দাঁড়ালেন। মাও শাড়ি পরে রয়েছে দেখে তিনি মার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। ওনার নাতনি হয়েছে বলে উনি এসেছেন মুম্বাই থেকে। ওনার নাম স্বপ্নাবেন। ওনার নাতনির নাকি খুব শরীর খারাপ ছিল কিন্তু এখন ভাল আছে। বৃষ্টি থামতে ওনার মেয়ে জামাইও এসে হাজির হল। বাচ্চা মেয়েটা খুব ফুটফুটে মিষ্টি। যদিও তখন ঘুমোচ্ছিল। স্বপ্নাবেন মাকে বললেন, “এখন দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল ওর। হাত ঠোঁট সব নীল হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্য ভাল একজন ডাক্তারের নাম পেয়েছিলাম আমরা। না হলে কী যে হত!”
মা জিগ্যেস করলেন, “কোন ডাক্তার?”
মহিলা বলতে পারছেন না দেখে ওনার জামাই বলে দিল, “ডক্টর স্যানফোর্ড বোম্যান! একেবারে ভগবান!”
জিক-কেকা-মামা সবার কান খাড়া। কিন্তু খারাপ কিছুই শোনা গেল না। ভদ্রলোক খুব যত্ন নিয়ে বাচ্চাটার চিকিৎসা করেছেন এবং তাকে সারিয়ে তুলেছেন।
স্বপ্নাবেনের জামাই বললেন, “উনি দুঃস্থ বাচ্চাদের জন্যেও একটা সংস্থা চালান। একেবারে দেবতা মানূষ। আমি তো জানতামই না এখানে এই রকম হয়। সত্যিই উনি সাক্ষাৎ ভগবান!”
বাড়ি ফিরে মামা বললেন, “ঠিক কী হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। সবাই তো বলছে উনি ভাল লোক তাহলে সমস্যাটা কোথায় ঠিক বুঝতে পারছি না।”
পরদিন খুব ভোরে সর্দারজি হ্যারি এসে হাজির। মামা ওকে দেখে বললেন, “কী হল? এত সকালে তুমি?”
“ব্যাপারটা খুব গন্ডগোলের হয়ে যাচ্ছে দাদা! কাল রাতে আমার বাড়িতে কেউ ঢুকেছিল। আমি বাড়ি ফিরে দেখি আমার সব জিনিস লন্ডভন্ড। জিনিস পত্র চারিদিকে ছড়ানো। কেউ কিছু খুঁজছিল মনে হয়। মনে হয় আংটিটা খুঁজছিল, কিন্তু সেটা তো আমি আমার পকেটে নিয়ে ঘুরছি। এই যে!” বলে পকেট থেকে আংটিটা বার করে দেখালো।
মামা বললেন, “কিন্তু কেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না। সবাই বলছে উনি ভাল লোক। আসাধারণ ডাক্তার। তৃতীয় বিশ্বের দুস্থ বাচ্চাদের জন্যে সংস্থা চালান। উনি তাহলে সেদিন ওই গোরস্থানে কেন গিয়েছিলেন? আর যদি গিয়েই থাকেন তাহলে সেটাকে লোকানোর মতন কী আছে? নিজের আংটিটা নিতে ওনাকে অসৎ পথ ধরতে হচ্ছে কেন?”
হ্যারি বলল, “সেটাই তো বুঝতে পারছি না। উনি তো সেদিন সোজাসুজি আমার কাছ থেকে আংটিটা চেয়ে নিতে পারতেন, তাহলেই ঝামেলা মিটে যেত। উনি আমার ঘরে চোর ঢুকিয়ে সেটাকে পেতে চাইছেন কেন?”
মামা বললেন, “ঠিক আছে তোমার কী এখন একটু সময় হবে? তাহলে চলো গোরস্থানের জায়গাটা দেখে আসি!”
হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। ওদের তিনজনকে নিয়ে গেল সেখানে।দিনেরবেলা জায়গাটা কী চমৎকার শান্ত লাগছে। ভয়ের কোন কারণ নেই। গোরস্থানের চারপাশটা বড় বড় গাছ আর সুন্দর করে কাটা কাঁটা ঝোপ দিয়ে আলাদা করা। ঢোকার জন্যে গেট রয়েছে একটা এবং সেই গেটে তালাটালা কিছু নেই, যে কেউ অবাধে ভিতরে ঢুকতে পারে। চারিদিকে ধুধু মাঠ। অনেকটা দূরে জঙ্গল মতন গাছের সারি দেখা যাচ্ছে। “এইখান থেকেই তুলেছিলাম ওনাকে,” হ্যারি বলল।
মামা বললেন, “আশপাশটা একটু খুঁজে দেখা যাক, যদি কিছু পাওয়া যায়। ওরা চারজন খুঁজতে লাগল। প্রথমে কিছুই পাওয়া গেল না। তারপর জিকো হঠাৎ, “মামা!” বলে চেঁচিয়ে উঠল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখল, ঝোপের মধ্যে থেকে একটা চশমা পেয়েছে সে। ক্লু পেয়ে জিকো তো প্রচন্ড উত্তেজিত কিন্তু মামা বা হ্যারি কেউই খুব একটা উৎসাহ দেখাল না। ডক্টন বোম্যান চশমা পরেন না। আর চশমা তো যে কোন কারোর হতে পারে। জিকো কিন্তু তার অত কষ্ট করে খুঁজে পাওয়া ক্লুকে সহজে ছাড়তে রাজি নয়। সে চশমাটাকে রুমালে মুড়ে সঙ্গে করে নিয়ে চলল।
ফেরার পথে কেকা বলল, “ভাগ্যিস অখিলকাকুকে নিয়ে আসা হয়নি নাহলে ওই সমস্ত সমাধিগুলোর সঙ্গে নিজের সেলফি তুলে বসে থাকতেন!”
শুনে জিকো হি হি করে হাসল!
ক্রমশ...
রহস্যময় উপন্যাসের চমৎকার উপস্থাপনা। একবার প্রবেশ করে আর বের হতে মন চায় না। খুব ভালো। আমার অভিনন্দন রইল।
উত্তরমুছুন