শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

আজ ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস।।এই ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে অঙ্কুরীশা-র 'নিবন্ধ সংখ্যা'- য় শ্রদ্ধাঞ্জলি।। বিষয়ঃ - "মহামারীর হাতে অসহায় স্বাধীনতা।"Ankurisha ।। E.Magazine ।। Bengali poem in literature ।।

 








৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে অঙ্কুরীশা-র   'নিবন্ধ সংখ্যা'- য় শ্রদ্ধাঞ্জলি।। 

বিষয়ঃ - "মহামারীর হাতে অসহায় স্বাধীনতা।" 





নিবেদনে—  

তৈমুর খান

অরুণ ভট্টাচার্য 

দুর্গাদাস মিদ্যা 

সুবীর ঘোষ

সুধাংশুরঞ্জন সাহা

স্মৃতি শেখর মিত্র 

অমিত কাশ্যপ 

তন্দ্রা ভট্টাচার্য 

আশিস চৌধুরী 

অশোককুমার লাটুয়া 

নিমাই জানা 

দীনেশ সরকার 

জয়শ্রী সরকার 

গোবিন্দ মোদক

বিকাশ রঞ্জন হালদার 

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় 

তপনজ্যোতি মাজি 

অনিন্দিতা শাসমল 








জনগণ অধিকার চায়, স্বাধীনতার অধিকার

তৈমুর খান



 করোনাকালে গৃহবন্দি জীবন স্বাধীনতাহীন এক অসহনীয় জীবনেরই পরিচয় বহন করছে। মানুষ কখনোই বদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত নয়। হঠাৎ করে তার জীবনে যখন এই বদ্ধতার ঘেরাটোপ তৈরি হয় তখনই শুরু হয় আত্মপীড়নের অশনি সংকেত। কেমন সেই আত্মপীড়ন?


১) জীবনযাপনে ঘোর অন্তরায়ের জীবন

২) সম্পর্কহীন, কথাবার্তাহীন নির্বাসিত জীবন

৩) রুজি-রোজগারহীন অনাহারক্লিষ্ট জীবন

৪) সৃজন-চেতনা ধ্বংসকারী বীতস্পৃহ জীবন

৫) সৌজন্য-সহানুভূতি বিপন্নকারী জীবন হতাশা ও বিষণ্নতাগ্রস্ত জীবন

৬) অমানবিক, বিকৃত এবং বিকারগ্রস্ত জীবন


     এই অভিশাপগুলিই মানবজীবনে নেমে এসেছে। কোভিদ ছড়ানোর নামে মানব  জীবনকে বিচ্ছিন্ন করারই এক চক্রান্ত বলেই মনে হয়। এটাই কি এই রোগ ছড়ানো বন্ধ করার উপায়?তা কিন্তু নয়। যে রোগটির আগমন বিদেশ থেকে, সেই রোগটির দায় কেন আমরা বহন করব? কেনই-বা বিদেশ থেকে আগমন বন্ধ হল না? রোগ প্রতিরোধের সদিচ্ছা কি রাষ্ট্রের ছিল না?


   এই প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর আমরা পাইনি। অথচ আমাদের স্বাধীনতা হরণ করে রাষ্ট্র আমাদের বাঁচানোর নামে পরোক্ষে কি হত্যার ষড়যন্ত্র করেনি? বহু সংশয়ের সদুত্তর কারোরই জানা নেই। গৃহবন্দি জীবনের অসূয় ভোগ করে দীর্ঘ যাতনায় আমাদের দগ্ধ হতে হয়েছে। যে পরাধীনতার গ্লানি আমরা ব্রিটিশ আমলে সহ্য করে অসহ্য হয়ে উঠেছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছিলাম; এই লকডাউন সময়টি সেই অসহ্যকেই পুনরায় উসকে দিয়েছে। যে দিন-আনি দিন-খাই মানুষ ঘরে বন্দি থাকলে একদিনও খাবার মজুদ থাকে না তাদের কী যে অবস্থা হতে পারে তা সকলেরই জানা। অর্থাৎ পুরোপুরি উপোস ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। সুতরাং সমাজ আরও বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়। নীতি-নৈতিকতার বিচ্যুতি ঘটে। হাহাকার পড়ে যায় সেইসব প্রান্তিক জীবনে।


   বনের পাখিকে খাঁচায় বন্দি রেখে তাকে নিরাপত্তার গল্প শোনানো কি খুব সন্তোষজনক পদক্ষেপ? তা কখনোই হতে পারে না। মুক্ত জীবন হাসিমুখে মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করতে পারে। তার যুদ্ধের পরিসীমাও পরিব্যাপ্ত হয়। কিন্তু বন্দি জীবনে আত্মিক মৃত্যুর শিকার হতে হয় তাকে এবং তা আরও ভয়ংকর। মানুষকে কর্মহীন করে, স্বাভাবিক জীবনাচারকে বাঁধনে বেঁধে, সম্পর্কের ভেতর দূরত্ব সৃষ্টি করে সর্বোপরি ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ করে কখনোই শান্তি ফেরানো যায় না। জীবনের ছন্দপতন ঘটিয়ে মহাজীবনের স্বপ্ন সফল করা যায় না। রাষ্ট্র স্বাধীনতা হরণকারী, প্রজা শোষণকারী, চক্রান্তকারী একটা শক্তির ধারক হয়ে উঠেছে। বলেই মানুষের মৃত্যু মিছিলকে মানুষেরই কর্মফল হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিচক্ষণতার অভাব এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাব তা সকলের কাছেই পরিষ্কার। গণতান্ত্রিক একটা দেশের পক্ষে রাষ্ট্রের এটা স্বৈরাচার পদক্ষেপ মাত্র। আমরা  সাধারণ প্রজাগণ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতাহারা হয়ে গৃহবন্দি জীবন অতিবাহিত করে চলেছি। হয়তো পরিণতি অপেক্ষা করছে কবি নজরুলের কাণ্ডারীর মতোই:


"ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান, 

ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।" 

জনগণ অধিকার চায়, স্বাধীনতার অধিকার। তাদের প্রতি বঞ্চনা পীড়ন অত্যাচারেরই শামিল।






মহামারীর কাছে অসহায় স্বাধীনতা 

অরুণ ভট্টাচার্য


'আগুন জ্বলছে দাউ দাউ ..। পৃথিবীর প্রতি প্রান্তে ঘুমন্ত দ্বীপের মত শ্মশান জেগেছে গোরস্থান গুলি সব টেথিস সাগর চিতার কর্কশ ধোঁয়া আকাশ ঢেকেছে।' এ কেবল কবিতার ভাষা নয়, কবির কথাও নয়, মহামারীর চরম পরিণতি । মহামারী যুগে যুগে এসেছে । ফিরে ফিরে । বসন্ত থেকে শুরু করে প্লেগ, কলেরা, ফ্লু সহ বর্তমানে কভিভ -১৯ । প্রতিবারেই হাজার-লক্ষ মানুষের কখনো অন্য প্রাণীরও প্রাণহানি ঘটেছে । তা সত্ত্বেও আগের মহামারীগুলি সীমাবদ্ধ ছিল কয়েকটি দেশ বা দু-একটি মহাদেশের মধ্যে । ফলে লড়াইটা অনেক সহজ ছিল । সংকটময় দেশগলিকে ‌ বাকিরা সাহায্য করতে পারত সর্বশক্তি দিয়ে । দীর্ঘ সংগ্রাম - অগাধ ক্ষয়, তবুও এসেছে জয় । আর এবারে কভিদ-১৯ । যার কোন চারিত্রিক ব্যাকরন নেই । সমগ্র বিশ্বের অধিকাংশ দেশ প্রায় এক সাথেই করোনার কবলে । প্রত্যেকেরই অবস্থা যেন 'জাউ খাই - না মাছি উড়াই' ! কে কার হাত ধরে বলবে - 'মোর হাত ধরে ওগো নিয়ে চলো সখা' ।

        ‌        ভয়ঙ্কর অবস্থা । মানুষ গৃহবন্দী । স্তব্ধ বিশ্ব । আবহমানকাল থেকে আমজনতার ঠোঁটের নিচে জল থাকলেও ঢোক গেলার স্বাধীনতা থাকে না । তর্জনীর ছায়ারা পাহারাদার । বিড়ালেই খায় দুধ ও জল । কভিডের মাস্ক এমনটাই ইঙ্গিতবাহী । সংগ্রাম করতে করতে অসহায় । মেকি বাক্-স্বাধীনতাই নয়, হৃদয়ের স্বাধীনতা, জীবনের স্বাধীনতা, মৃত্যুর স্বাধীনতাও বড় বিপর্যয়ের মুখে । দেশমাতৃকার পদতলে মাথা নামিয়ে দেশের স্বাধীন জাতীয় পতাকা উড্ডীন করার যে মহান উল্লাস - সেতো হৃদয়েই বাজে অহরহ । কিন্তু কোথায়  স্বাধীনতা !

আজ মানুষ অসহায় । স্বাধীনতা অসহায় ।হৃদয়ের মহামারী হলে স্বাধীনতা উঠোনে দাঁড়ায়।






মহামারীর হাতে অসহায় স্বাধীনতা

দুর্গাদাস মিদ্যা 



প্রথমেই বলে রাখি আলোচনার বিষয়টি সময়ানুগ। সেই ২০১৯ এর শেষ থেকে অদৃশ্য এক ভাইরাস একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার শিখরে থাকা সমগ্র বিশ্বকে একটি কারাগারে  পরিণত করেছে। স্মৃতিতে এসে যায় কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত সেই বিখ্যাত গানের লাইন::স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে বাঁচিতে চায়! 

এ প্রশ্ন  জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন। আর এই মহামারীর কারণে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অবশ্যই খর্ব হচ্ছে বা হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা আমরা সকলেই পড়েছি।  মন্বন্তরে মরিনি  আমরা মারী নিয়ে ঘর করি

বিধির আশিসে  বাঁচিয়া গিয়াছি অমৃতের টিকা পরি। এখন এই সময়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিধি একেবারে বাম তাই অমৃতের টিকা নয় মৃতের টিকা পরে বুক ভরা ভয় নিয়ে অসহায় ভাবে বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকা না বেঁচে থাকারই সামিল। জীবন ও জীবিকার স্বাধীনতা সম্পূর্ণ বিঘ্নিত। এই সময়ে বিশেষজ্ঞ যারা তারা বাঁচার বা বেঁচে থাকার যে নিদান দিয়েছেন তা হল ব্যক্তি স্বাধীনতায় পুরোপুরি হস্তক্ষেপ। যেমন১) অহেতুক বাড়ি থেকে বের হবেন না। ২) মেলা মেশা বন্ধ। ৩) মুখোশে মুখ ঢেকে বের হওয়া। অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনের যাবতীয় সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বাদ তাহলে আর বেঁচে থাকার রইলো টা কি? স্বাধীনতা শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে:---মুক্তি, অবন্ধন, ছাড়া পাওয়া, হাঁফ ছেড়ে বাঁচা ইত্যাদি ইত্যাদি। 

এখন এই সমস্ত সুখ বা স্বস্তি  জীবনের নিয়ামক নয়। এখন এমন এক নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতে হচ্ছে যা প্রায় কয়েদে থাকার সামিল। তা না হলে মারী মরণ হয়ে বাড়ির দুয়ারে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকা  অসহায় ভাবে বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই। অঙ্কুরিশাকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাবো যে এমন সুন্দর একটি বিষয়কে আলোচনার উপপাদ্য করে তুলেছেন। এখন মুক্তি নেই। বিনোদন নেই, ইচ্ছে মতো চলাচল নেই। যা আছে তা হল অসহায় আত্মসমর্পণ। ভাবতে খারাপ লাগলেও এটা এখন মানতে হচ্ছে এবং হবে। 





মহামারীর হাতে অসহায় স্বাধীনতা

সুবীর ঘোষ



স্বাধীনতা মানে স্ব অধীনতা । নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করার সুযোগ । কিন্তু করোনা আমাদের শৃঙ্খলাপরায়ণ হবার তাগিদে শৃঙ্খল পরিয়েছে । অতি স্বাধীনতা নিতে গিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জীবনপাত ঘটেছে এ রকম মানুষের সংখ্যা কম নয় । তাই  ইচ্ছে না থাকলেও এই চিকিৎসা-পরাধীনতা আমাদের মেনে নিতে হয়েছে।করোনার আতঙ্কে ও বিধিনিষেধের জন্য গত ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে একরকম গৃহবন্দী জীবন কাটছে । সাহিত্যসভা নেই , ক্লাব-লাইব্রেরি নেই , বিয়েবাড়ি নেই ,আত্মীয়সমাগম নেই।  এক রকম "মূর্খ বড় , সামাজিক নয়"-এর জীবন। তবু কিছুটা সবুজ আলো ফেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের আড্ডাগুলো।

কালে কালে এক একটি মহামারী আসে আর কোটি কোটি মানুষের সর্বনাশ করে চলে যায় । কত ধরনের পেশার মানুষ জীবিকাচ্যুত যে হল বলা সম্ভব নয় । দু বছর ধরে পড়ুয়াদের স্কুল নেই । এই দু বছরের স্কুলের পঠনপাঠন ও বন্ধুজনেদের মাঝে বেড়ে ওঠার যে সুযোগ তা তাদের জীবন থেকে একেবারেই হারিয়ে গেল । দেশে পর্যটন নেই , রেল চলাচল বন্ধ । রেলের হকার , প্ল্যাটফর্মের পোর্টার , স্টেশনের স্টল , রেলের হকার, অফিস সংলগ্ন স্টল ,হকার ,রিকশা অটো ,ছাপাখানা , দর্জি অজস্র অজস্র ...ভাবা যায় না যাদের জীবন থেকে জীবিকা ঘুচে গেছে । সিনেমা, থিয়েটার, বিনোদন সর্বত্র ফাঁকা। তার ওপর দিনমজুর ও পরিযায়ী শ্রমিকের দল।এর আগে প্লেগ , স্প্যানিশ ফ্লু এরকম মহামারীরূপে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সে সময়ের মানুষ আর কেউ জীবিত নেই । আমরা এই করোনা ভাইরাস মহামারীর সাক্ষী থাকব , যদি শেষ পর্যন্ত বেঁচে যাই। কবি অ্যাপোলিনের যুদ্ধে গিয়েছিলেন । মাথায় আঘাত পেয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন । কিন্তু কিছুদিন পরেই তাঁর মৃত্যু হয় স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারীর কবলে পড়ে।


 বিশ্বব্যাপী মানুষের আজ কোনো স্বাধীনতা নেই , কখন কোথায় যে করোনা গুপ্তঘাতকের মতো ওৎ পেতে বসে আছে !






লিবার্টি

সুধাংশুরঞ্জন সাহা


কেউ বলে স্বাধীনতা । কেউ বলে স্বতন্ত্রতা। কেউ আবার লিবার্টি কিংবা উইশডম। এই স্বাধীনতা নিয়েই সারা পৃথিবীতে হৈচৈ। স্বাধীনতা মানুষের একটি মৌলিক স্বীকৃত অধিকার। এমনিতে স্বাধীনতা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা থাকে না কারো। কিন্তু যখনই কাউকে কথা বলতে না দেয়া হয় কিংবা বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়, অথবা চলাফেরায় গতিরোধ করা হয়, তখনই সে বুঝতে পারে স্বাধীনতার মানে। 

দেশ যখন পরাধীন ছিল তখন এই দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল স্বাধীনতার প্রকৃত মানে। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে কথা বলার অধিকার এবং চলাফেরার অধিকার হরণ করেছিল। আপামর জনসাধারণের প্রতিবাদে সেদিন সারাদেশ উত্তাল হয়েছিল। কত রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের আটক করা হয়েছিল, সাংবাদিক, সমাজকর্মীদের জেলে পোরা হয়েছিল তার কোনো হিসাব নেই। এর ফলশ্রুতিতে পরবর্তী ভোটে কংগ্রেস তথা ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল।

বাস্তবে সারা পৃথিবীতেই যেখানে যেখানে কথা বলার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে কিংবা চলাফেরার উপর বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে, সখানেই মানুষ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আন্দোলনকারীদের জয় হয়েছে।  সে আমেরিকাই হোক কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা।


এর বাইরেও নানা আইনের সাহায্য নিয়ে কিংবা বেআইনিভাবে বহু মানুষকে জেলে পোরা হয়েছে। দিনের পর দিন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এমনকি খুন করা হয়েছে।যেমন সফদার হাসমিকে পথনাটক মঞ্চস্থ করার সময় প্রকাশ্য রাজপথে খুন করা হয়েছিল। খুন করা হয়েছিল সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে ।

ইদানিংকালে অসুস্থ প্রবীন কবি ভরভরা রাওকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে বিনা বিচারে। চিকিৎসা সুযোগ এবং অন্যান্য স্বাধীনতা খর্ব করে। কিছু দিন আগে বন্দি অবস্থায় মারা যান সমাজকর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামী। এইরকম ভুরি ভুরি নজির রয়েছে আমাদের দেশেই । মহামারী করোনাকালে নানা ভাবে মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। না তারা ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে পারছে, না যাতায়াত করতে পারছে। স্বাধীনতা মানুষের যে একটি মৌলিক অধিকার, সেই অধিকার থেকে তাকে বারে বারে বঞ্চিত করা হয়েছে।







মহামারীর হাতে অসহায় স্বাধীনতা

স্মৃতি শেখর মিত্র 


দেশ ও দেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতা। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশের সর্বত্রই পতাকা উত্তোলন ওনানান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়ে থাকে। স্বাধীনতা দিবসে অতিশয় আনন্দেরসঙ্গে দিনটি পালিত হয়।যদিও কিছু মানুষ সে সবআনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকেন।অন্যান্য আর পাঁচটা দিনের মতো স্বাধীনতা দিবস একটি দিন হিসাবে গণ্য হয় তাদের কাছে। আমাদের দেশের পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবস পালন হতে চলেছে আগামীপ নেরোই আগস্ট। কিন্তু দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে এখনও স্বাধীনতা দিবস কি এবং কেন জানানেই।এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে বিশাল সংখ্যক জনগণের কাছে এখনও শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি।অন্যান্য বছরগুলির মতো দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা দিবসে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না এবছর তাঁদের প্রবল ইচ্ছা থাকলেও প্রশাসনিকবাধা নিষেধ থাকবে তাছাড়া দেশের প্রধানমন্ত্রীওহয়তো অন্যান্য বারের ন্যায় সম্পূর্ণ ভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবেন না কারণ করোনামহামারীর তান্ডবে সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত। এছাড়াঅন্যান্য বিশিষ্ট সাংসদগণ ও নেতা মন্ত্রীরাও নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকেই তাঁদের কার্য্যক্রম পালনকরবেন। স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসে সেনাবাহিনীগুলি দেশের জনগণের সমক্ষে নানান কলাকৌশল প্রদর্শন করে থাকেন যা দেখেআপামর জনসাধারণ আনন্দ উপভোগ করে থাকেন তাও হয়তো এবছর করোনার জন্য সম্ভবপর হবেনা। এইসব দিনে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনেতারা আমন্ত্রিত থাকেন এবং তাঁরাও নিজেদের সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারলে খুশি হন এবছর সেটাও সম্ভব নয় কারণ দেশ ও বিদেশের সব ধরনের যাত্রাপথ বন্ধ।আমাদের দেশের মধ্যে রেলযাত্রা স্থগিত। দূরপাল্লার অনেক ট্রেন চলাচল বন্ধ। ইচ্ছা থাকলেও মানুষ কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন না।এছাড়াও মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য যেসব নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নেওয়া হয় তাও হবে না ভিড় এড়ানোর জন্য। অনেক মানুষের এক জায়গায় জমায়েত হলেই করোনা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায় তাই এই বিষম ব্যাধির প্রকোপে বর্তমান সময়ে একত্রিত হতে ভয় পাচ্ছেন। করোনা বহু মানুষের অন্ন সংস্থান কেড়ে নিয়েছে।কত কল কারখানা, নির্মাণ শিল্প ও পর্যটন শিল্পের কাজ একেবারেই বন্ধ যেখানে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মের বিনিময়ে তাঁদের অন্ন সংস্থান করতেন। তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরঅবস্থা সঙ্গীন। এছাড়া এবছর বহু রাজ্যসরকার বন্যার কারণে ভয়ানক বিপন্ন।রাজ্যের মানুষের খাদ্যসঙ্কট ও জলের তোড়ে ভেসে যাওয়া গৃহস্থের ঘরবাড়ির নির্মাণ অথবা সাময়িক ভাবে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা গবাদিপশু, ও পশুপাখির মৃত্যুর কারণে অনেক জল ও বায়ূ দূষণ মানুষের সংক্রমনের ভয় তো আছেই। তাই মানুষের জীবনে সুখ নেই, আনন্দ নেই সবাই ভীষণ কষ্টে দিন গুজরান করছেন। তাই এবছরের স্বাধীনতা দিবসে কোন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হওয়া উচিত নয় বলেই আমার বিশ্বাস।অনাড়ম্বর ভাবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হলেই সকলের মঙ্গল।






স্বর্ণচাঁপা

অমিত কাশ‍্যপ




স্বর্ণ। স্বর্ণচাঁপা। বাবা বলতেন স্বর্ণ। আমার মা। বয়স মাঝে মাঝে গোলমাল করলেও স্মৃতি ভীষণ প্রখর। স্বাধীনতার সময় বয়স ছিল দশ। খানিক দেখা, খানিক শোনা, ঘন ঘন উড়োজাহাজের ধ্বনি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পরে পরে দুর্ভিক্ষ, তারপর স্বাধীনতা।


গড়িয়ে গড়িয়ে শিশুকাল, যৌবন, দাম্পত্য জীবন। বিয়ের পর কতকিছু পালটে গেল। আমি গৌতম, পর পর দুই বোন- তৃষ্ণা আর কৃষ্ণা। দেখতে দেখতে বোনেদের পড়াশোনা, কলেজ জীবন, পরের ঘরে যাত্রা। বাবা আশ্রয়  নিয়েছেন দেওয়ালে। মা আর আমি।মা মাঝে মাঝে পুরোন গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন। তাঁর দেখা কত বন‍্যা, খরা, ঝড়-বাদল, টর্নেডোর ভেঙে পড়া। টাল-মাটাল মানুষের জীবন, রিলিফ সেন্টারে বসবাস। এখন বোনেরা আসে মাঝে মাঝে মা'কে দেখতে।বাবা চলে যাবার পর, মা একদম একা। কিছু বলার নেই, শাসন করার নেই। স্বাধীন। জীবনটা তো নানান বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়েই যায়। নতুন করে আবার বিপর্যয় কি। বয়সের শেষ প্রান্তে এসে শুনছেন মহামারী শব্দ। মহামারী শুনেছেন একশো বছর অন্তর অন্তর নানান রূপ নিয়ে আসে পৃথিবীতে। সমগ্র পৃথিবী ওলট পালট করে দেয়। কোটি কোটি মানুষ মারা যায় বিনা চিকিৎসায়। চিকিৎসা স্বাস্থ্যও সেখানে নিরুপায়। এক কঠিন সময়। অশীতিপর মা ভাবেন স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পর এ কোন উপসর্গ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সমগ্র পৃথিবী আজ ভয়ংকর মহামারীর কবলে। মৃত্যু মিছিল। কুড়ি কুড়ি সালে যে বিপর্যয় আছড়ে পড়েছিল বিশ্ব সংসারে তা আজও অব‍্যাহত। আমরা সম্পূর্ণ অসহায়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা কেবলই অসহায়, তবুও হাঁটছি আলোর সন্ধানে নিরন্তর।







মহামারীর হাতে অসহায় স্বাধীনতা 

  তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য 


  মানুষ  স্বাধীন ভাবে কোনো  নিয়মই তৈরী করতে  পারেনা। যেভাবে  প্রকৃতি  ও পরিস্থিতি  আমাদের  কে চলতে শেখায় আমরাও শিখি  তার নামই নিয়ম।

তারপর  সেই  নিয়মের শাখা প্রশাখার জন্ম মানুষের হাতে। করোনা পরিস্থিতি  আমাদের  অনেক  কিছু চোখে আঙুল দিয়ে শেখাল এবং করতে বাধ‍্য করল। মাস্ক এবং স‍্যানিটাইজার শাসিত আমাদের  বর্তমান জীবন। শিশুর শৈশব  চার দেওয়ালে বাঁধা। খেলার মাঠে একরাশ শূন‍্য মেঘ। প্রেমও মোবাইলের বন্ধনে আবদ্ধ। পথিকহীন নিঃশব্দ  পথ।

 সুন্দর পৃথিবীর  এত রূপ  ঐশ্বর্য   কিন্তু  কোথাও কোনো ভ্রমণ নেই কারণ আমাদের নিয়ন্ত্রিত জীবন যাত্রা । কতদিন দেখা হয়না প্রিয় জনের মুখ, আমরাও বঞ্চিত  প্রিয়  স্পর্শ থেকে।  বয়স্ক মানুষদের  আরো সমস‍্যা এমনিতেই  তাঁরা  একাকিত্বের  শিকার। বাইরে বেরোলে পাঁচজন  সমমনস্ক মানুষের  সঙ্গে মিশতে পারেন একটু খোলা হাওয়া  লাগাতে পারেন। গর্ভবতী  মায়েরা উপযুক্ত  চিকিৎসা  নিতে পারছেননা।  অনির্দিষ্ট কাল লকডাউনের ফলে  উৎপাদিত পণ‍্য পৌঁছে  দেওয়া কিংবা  স্বাধীন  ভাবে নিজেদের  ব‍্যবসা বাণিজ্য  চালাতে পারছেননা মাঝারি ক্ষুদ্র ব‍্যবসায়ীরা।  আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছে  বৃহত্তর  বাণিজ‍্যের ক্ষেত্রেও। দ্রব‍্য মূল‍্য চড়া দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মানুষ  স্বাধীনভাবে  খেয়ে পরে বাঁচার  অধিকার  টুকুও যেন হারিয়েছে।বহু দিনের লটারির  দোকান ছিল ফটিকের মোটামুটি  দিন গুজরান হচ্ছিল এখন  দোকান  চলছেনা বাধ‍্য হয়ে মাস্ক স‍্যানিটাইজারের দোকান দিয়েছে। 


বিশ্বে মহামারী তো আগেও হয়েছে।  সম্ভবত  ব্ল‍্যাক ডেথ বা প্লেগ বিশ্বের সবচেয়ে  ধ্বংসাত্মক মহামারী। ১৮১৮ সালে সালে সাংঘাতিক  রূপে  দেখা দিয়েছিল স্প‍্যানিশ ফ্লু । তখনও  লক ডাউন হয়েছিল । প্রকৃতি  আর পরিস্থিতি  কখন যে মানুষ  কে বেঁধে ফেলবে  তার হিসাব কেউ দিতে পারে না।






এই পরাধীনতা থেকে মানুষ কবে মুক্তি পাবে কে জানে

আশিস চৌধুরী


 রঙ্গলালের ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়’ কিংবা শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি /রবি ঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান/ কাজি নজরুল ঝাঁকরা চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরুষ...’ এইসব কবিতার মধ্যেই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে ।


  গত ২০২০ এর মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত লকডাউনেই আছি আমরা।খুব গভীরেভাবে বললে ওই সময় থেকে পরাধীন হয়ে অসহায় অবস্থায় যেন মনে হচ্ছে সেলুলার জেলে বন্দী আছি কিংবা দ্বীপান্তরে আছি। যে মানুষ সমাজবদ্ধজীব তাকে এই করোনা মহামারীর জুজু দেখিয়ে সমাজ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।যেন খাঁচায় বন্দী পাখি শুধু ডানা ঝাপটায় । মাস্ক পরো,হাতে বারে বারে স্যানিটাইজার লাগাও আর যে কথাটা হওয়া উচিত ছিল ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্স তা না হয়ে হয়েছে সোস্যাল ডিস্ট্যান্স মেনে চলো। এটিই মোদ্দা কথা সামাজিক দূরত্ব। এখানেই আমদের সমাজ বিচ্ছিন্ন করা হল। সংঘবদ্ধ মানুষকে রাষ্ট্র ভয় পায় অর্থাৎ কোনও আন্দোলন করতে পারবে না মানুষ ।করোনা জুজুর ভয় দেখিয়ে গৃহবন্দী  করো। আগামী ১৫ ই আগস্টের পর কি আমরা এই পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাব? জানি না। লকডাউন তো ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত।মুখ ঢেকে রেখেছি মুখোশে আর নিজগৃহে বন্দী আছি।রাষ্ট্র এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তার যা কাজ সাধারণ মানুষের এবং দেশের সর্বনাশ  করে যাচ্ছে।ব্রিটিশ আমলে যেমন এ দেশেরই কিছু মানুষ সর্বতোভাবে তাদের সাহায্য করেছিল বলেই আমরা দীর্ঘদিন পরাধীন ছিলাম।


        WHO এখনও পর্যন্ত যে সব নির্দেশিকা জারি করেছে সব ভুল  প্রমাণিত হয়েছে।এই সংস্থার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই । এর কর্ণধার কোনও বিজ্ঞানী নন,স্রেফ চিনের হয়ে উমেদারি করে নির্দেশ পালন করছে।ডাক্তারবাবুরা এবং বিজ্ঞানীরা দোহারির ভূমিকা পালন করছে।এরাও বিকিয়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের সর্বনাশ করছে।মানুষ তার প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলছে।প্রকৃতি থেকেও তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।প্রাণ ভরে অক্সিজ্জেন নিতে পারছে না তাই এই শ্বাসকষ্ট,এবং কৃত্রিম অক্সিজেনের জন্য হাহাকার। যেন হিটলারের গ্যাস চেম্বারে বন্দীজীবন।রাখে হরি মারে কে,মারে করোনা রাখে কে-এই আমাদের নিয়তিএখন।যতই করোনা করোনা বলছে সবাই ততই অবেচেতনে ‘মুক্তি চাই’, ‘মুক্তি চাই’ শুনছি।এর থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের সঙ্ঘবদ্ধভবে এই কু-চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।







অতিমারীতে পরাধীন স্বাধীনতা

অশোককুমার লাটুয়া




জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, সংবিধান, গণতন্ত্র স্বাধীনতার অন্যতম অনিবার্য অঙ্গ। দেশের মর্যাদা, ঐতিহ্য ও সার্বভৌমের পরিচয় হলো জাতীয় পতাকা। দেশের গৌরব এবং জাতির আদর্শকে মেলে ধরে জাতীয় পতাকা। ত্যাগ, সত্য-শান্তি, পবিত্রতা এবং সজীব শৌর্যের স্মারক জাতীয় পতাকা।জাতীয় সঙ্গীত একটি জাতির আত্মসম্মান, আশা-আকাঙ্খা, একতা, সম্প্রীতিকে জীবনমন্ত্রে উদ্বোধিত করে। দেশের মানুষের স্বপ্ন, ভাষা ও ভালোবাসা হলো জাতীয় সঙ্গীত।শৃঙ্খল নয়, স্বাধীনতা চায় সবাই -- একটি সূর্য, একটি পৃথিবী, একটি পাখি, একটি দেশ এবং মানুষ।


অগণন মৃত্যু, অজস্র রক্তপাতের রক্তিম পাণ্ডুলিপি স্বাধীনতা। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে আমাদের দেশ  মুক্ত হয়েছে ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্ট। এই দিনটিই ভারতভূমির স্বাধীনতা দিবস। মানুষের মন ও মনন, প্রতিভা ও প্রগতি কোনো কিছুর বিকাশ ঘটেনা স্বাধীনতা ছাড়া। স্বাধীনতাপ্রার্থীর কাছে স্বাধীনতা স্বর্ণযুগ এবং স্বর্গসুখ। প্রতিবছর শত শহীদের রক্তেলেখা স্বাধীনতা দিবসটি আমরা পালন করি দেশাত্মবোধক গানে, কবিতায় , নাটকে। আমরা শ্রদ্ধা জানাই স্বদেশ ও স্বদেশের সাহসী সেনাদের।কিন্তু তবু ৭৫ বছর বয়সী প্লাটিনাম স্বাধীনতা অতিমারীর পরিস্থিতিতে আজ কিছুটা হলেও যেন অসহায়। আমাদের আবেগ, অনুভবের যেন আজ একটু মনখারাপ মনে হয়। প্রতিরোধের শিরদাঁড়া, প্রতিবাদের কন্ঠস্বর যেন আজ একটু ভাঙা ভাঙা মনে হয়। আত্মকেন্দ্রিক এখন অতিমারী সময়। বড় বেশী স্বার্থপর বেঁচে থাকা। অসহায় মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে স্বাধীনতার হাত, সাহায্যের হাত, আশ্বাসের হাত, একমুঠো গরম ভাত, আতঙ্কহীন রাত। নারীদের সম্মান খুঁজে বেড়াচ্ছে নিরাপত্তা। দেশবাসী হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে।


কাজের স্বাধীনতা হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছে ক্রমশঃ মানুষ। অতিমারীতে কলকারখানায় লকআউট, জীবনে লকডাউন -- নানা বিধিনিষেধ। মানুষ বিকিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে। মাথা চাড়া দিচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। লুকোচুরি খেলছে সন্ত্রাস। অতিমারীর সুযোগে কিছু ভূয়ো মানুষের বায়োস্কোপ সাধারণ স্বাভাবিক মানুষের সহজ দিনরাতের স্বাধীনতাকে জ্বালাতন করছে। আমফান, ইয়াস, অতিবৃষ্টির বন্যা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের আগুন দাম -- কষ্টকর অসহায় মানুষের জীবনধারণ।


           অতিমারীতে মানসিক অবসাদ কেড়ে নিচ্ছে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত আস্বাদ। অতিমারীর শেকলে গৃহবন্দী ছাত্র-ছাত্রীরা যেন এই মুহূর্তে স্বাধীন দেশে পরাধীন এখন -- যেতে পারছেনা স্কুলে, যেতে পারছেনা খেলার মাঠে। হাটবাজার, দোকানপাট, রাস্তাঘাট সুনসান, বন্ধ পরিবহন। মাস্ক, স্যানিটাইজার , ডিসট্যান্স মেইন্টেন, কোয়ারেন্টাইন -- ওষ্ঠাগত জীবন, ভুলিয়ে দিচ্ছে  স্বাধীনতার মানে। মুখোশ খুলে মুখোমুখি মুখ দেখাদেখি বন্ধ। সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতির আলোচনা ও আড্ডা মৃতপ্রায়।  অরণ্য সমুদ্র পাহাড়ে বেড়াতে যেতে পারছেনা কেউ। আধমরা পৃথিবীর বাসিন্দা যেন আমরা সবাই। আধখাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে অতিমারীর বিধিনিষেধে যেন পরাধীন আমরা সবাই।তবু আশা -- " পৃথিবী আবার শান্ত হবে। " সুস্থিরতা, সুস্থতায় , সাম্যে ও সমন্বয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে আবার জীবন এবং স্বাধীনতা।





বর্ণহীন পতাকা ও মহামারীর চতুর্ভুজ

নিমাই জানা



ক্রুশ কাঁটার উপরে স্বাধীনতার যে পতাকাটি রাখি , তাকে ঘিরে আমাদের আগস্ট মাসের ক্যালেন্ডার পাতা আন্দোলিত হয় পরস্পরের ভেতর। কি এমন আছে এই আগস্টের ১৫ তারিখে  , আমরা সকল দলবেঁধে স্কুলের চৌকাঠ , ঘরের দরজা , পাড়ার বারান্দা , উনুনের মাথা , সব জায়গায় ঘুরে নেওয়ার পর দেখলাম আমার ঠোঁটে কেমন কালো কালো ছোপদাগ লেগেছে।


স্কুলে প্রদীপের মাথায় তেল নেই , রিনা জানার অলিন্দে ফুটো ,সুদীপ মান্না ৮০% প্রতিবন্ধী,  হাঁটতে পারছে না , আমি তবুও তার পায়ে জোর করে সরকারের দেওয়া জুতো পরাই । কেমন মিড ডে মিলের থালাগুলো মৃত হয়ে যাওয়ার পরও আমি দেখেছি শিশুরা উদগ্রীব হয়ে বসে আছে ওই বর্ণহীন স্কুলের দাওয়ায় । মিড ডে মিলের ডাল ভাত তরকারি। পরিযায়ী হাঁটছে অনন্তের দিকে , একটি দোকানদার খালি হাতে বসে আছে রোয়াকে। নিম্নচাপ জলে ভেজা পতাকাটি একা জলীয়বাষ্পের বাতাসে উড়ে যায় অবিরত । নীল সাদা জামা পরা শৈশব গাঁদা ফুল দিয়ে তর্পণ করে দেশপ্রেমিক।


আমি এগুলোকে বলতে চেয়েছিলাম অসুখের ক্ষতের সংজ্ঞায়। কিন্তু না , এইযে আমার পিঠের ওপর দিয়ে একটি কালো ছাপ উড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত ওই দীর্ঘ মহাকাশের দিকে , আমি তাকেই কতভাবেই চেয়েছি। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে একটি মহামারীর দিনে। উচ্ছল শিশু আটকা পড়ে আছে ওই ত্রিবিধ মুখের ভেতর। আমি কখনো অনুজীবের কথা বলছিনা। আমি একটি মানুষের কথা বলছি যে আমার ভেতর ক্রমশ ঢুকে গিয়ে একটি সনাতন রজ্জুকে বের করে আনে। আমি তখন সবে হাত তুলে বলতে পারার ক্ষমতা পেয়েছি। আমি বড় স্বাধীন।


আমি গিগাবাইট মুক্ত ফুল । তবে আমি কেন আগুনের গলনাঙ্ক মাপতে পারিনা ।  আসলে মহাভারতের পলিডাইমেনশান মন্বন্তর আমার গলায় গিলোটিন বসিয়েছে । ছন্দ নেই , ছন্দ ভেঙে পাথর । সংগীত ভেঙে শুদ্ধতা।  সৃষ্টি ভেঙ্গে কাবুলিওয়ালা হয়ে গেছে অনেক রাত । আমি কেবল অন্ধকার আর গ্রহ নক্ষত্রের চলে যাওয়া পরিক্রমণ পথ দেখি। কিভাবে একটি অসুস্থতার দিন মৃত মানুষের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যায় , অথচ তার পায়ের ছাপ পড়ে না শুধু অন্তর্দহন থাকে। অন্তরে তার বসবাস। আমরা কিছু সরল গণিত সমান্তরাল রেখার উপর বসিয়ে দ্বিপদ উপপাদ্য শিখছি । কাগজের তৈরি পতাকাটি ভিজে ক্রমশ বর্ণহীন হয়ে যাচ্ছে , গভীর জ্বরে আক্রান্ত পাটকাঠির মাথায় বাঁধা ওই পতাকা ।কোন সমাধান সূত্র নেই।





স্বাধীনতা দিবসে 

দীনেশ সরকার 


শত শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। আমরা স্বাধীন ভারতের নাগরিক ভাবতেই গর্ব বোধ হয়। ১৫ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবস এলেই বুকের রক্তে দোলা লাগে । বীর শহিদদের আত্মবলিদানের কথা বার বার মনে আসে। শ্রদ্ধার সাথে তাদেরকে স্মরণ করি । কচিকাঁচা, ছেলে-মেয়ে, যুবক-বৃদ্ধ সবাই সমবেত  হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি, দেশমাতৃকার বন্দনা করি। বীর শহিদদের আত্মত্যাগের কাহিনী শুনিয়ে তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করি, কচিকাঁচাদের দেশপ্রেমে দীক্ষিত করি। স্বাধীনতা দিবস আমাদের খুশির দিন, বিশ্বাসের দিন, ভেদাভেদ ভুলে মিলিত হওয়ার দিন।


সেদিন আমার দুই নাতি বাবাই আর পাপাই বললো, ' দাদাই, আমরা হিসেব করে দেখলাম এবার হবে আমাদের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস।'আমি বললাম,'ঠিক বলেছো দাদুভাই।'বাবাই বললো, 'এবার তাহলে খুব ধুমধাম করে উৎযাপন হবে । খুব মজা হবে, তাই না দাদাই ।'আমি বললাম, 'কি করে হবে দাদুভাই। অতিমারি করোনাই তো আমাদের সমস্ত খুশি কেড়ে নিয়েছে। সব্বাইকে ঘর-বন্দি করে রেখেছে। তোমাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে । তোমরা খেলার মাঠেও যেতে পারছো না। শুধু আমাদের না, করোনা সারা বিশ্বের খুশি কেড়ে নিয়েছে। করোনার কাছে মানুষ আজ বড় অসহায়। আমাদের স্বাধীনতাও বড় অসহায় অতিমারি করোনার হাতে।'পাপাই বললো, 'তারমানে দাদাই, এবার স্বাধীনতা দিবস উৎযাপন হচ্ছে না।'আমি বললাম, 'কেন হবে না। গতবারের মতো হবে।'বাবাই বললো, 'তারমানে দাদাই, মাস্ক পরে যেতে হবে, দূরে দূরে থাকতে হবে । কেউ কারও সাথে গল্প করতে পারবো না।'পাপাই বললো, 'গতবারের মতো এবারও জিলিপি-লাড্ডু খেতে পাবো না । ধুর, ভাল্লাগে না । আমি এবার যাবোই না দাদাই।'

আমি পাপাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, 'ওরকম বলে না দাদুভাই, । বহু মানুষের ত্যাগ ও আত্মবলিদানের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা লাভ করেছি । আমরা যাদি সবাই মাস্ক পরে বাইরে যাই, দূরত্ববিধি মেনে চলি আর বারে-বারে সাবান দিয়ে হাত ধুই,তবে ২০২১শেই আমরা করোনাকে বিদায় জানাতে পারবো । ২০২২শের ১৫ই আগষ্ট ধুমধাম করে স্বাধীনতার ৭৫বর্ষ পূর্তি উৎসব পালন করতে পারবো ।





ভাইরাসের ফাঁদে স্বাধীনতা কাঁদে

জয়শ্রী সরকার

             

সত্যিই , " পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন ! " ৭৫-তম স্বাধীনতা দিবসের মুখোমুখি আমরা। কিন্তু কোথায় সেই ফুল্লকুসুমিত মুখ? বর্ষবিদায়-বরণ উৎসব শেষ ! আগমনী দ্বারে ! ভোরের আজান শুরু। পাখিদের কলরব । বুকের গভীরে রবীন্দ্রনাথ। মন বলে , " তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে ... ! " প্রত্যেকেই যেন একা। বড় বেশি একা। মহামারীর গ্রাস । মৃত্যু-ভাইরাস। হারিয়ে ফেলেছি বিশ্বাস। হায় স্বাধীনতা!


অবিশ্বাস , বিভেদ আর বিচ্ছেদের বিষে জর্জরিত সময়। দেশের অর্থনীতি আজ পঙ্গু। এরই মাঝে মহামারীর সুতীব্র আগ্রাসন। যেন অদৃশ্য-হাত হৃদয়টাকে মুঠোয় পুরতে চাইছে। ভালো-মন্দ আলো-অন্ধকারের মানেও আজ অস্পষ্ট । ড্রয়িংরুমেই বিশ্বায়ন। তবু , অদৃশ্য এক ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে আমরা পরাজিত। মৃত্যু-উপত্যকায় বসে আছি। পাশেই গভীর খাদ। জন্মভূমি , তোর চোখে জল ! শূন্য-বুকে একপাহাড় জমাটবাঁধা অভিমান! হায় স্বাধীনতা! শুধু বাঁচার তাগিদে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছে ক্ষুধার্ত-ক্লান্ত-অবসন্ন স্বজনহারা অসহায় পরিযায়ী মানুষের ঢল। কারও ট্রলিব্যাগে ঘুমন্ত-শিশু , আবার ইস্পাতকঠিন রেললাইনেই চিরঘুমে একঝাঁক পরিযায়ী। রুজির টানে ঘর ছাড়লো। ঘরে ফেরা হ'লো না। কোথাও বা মৃত-মাকে জাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে দুগ্ধপোষ্য অবোধ-দেবশিশু। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেবার জন্য কোনো মানবিক-হাত উঠে আসেনি। আবার , গঙ্গায় অসংখ্য লাশ ভেসে চলেছে। ' শেষের সেদিন ' কত না ভয়ঙ্কর ভাবলেই শিউরে উঠতে হয় ! প্রিয়জনকে শেষ দেখাটুকুও হয়ে উঠছে না। বন্ধু , দু'টো চোখ আর যেন নিতে পারছে না। কত অসহায় স্বাধীনতা! 


 বিপন্ন মানুষের কান্না সর্বত্র। এরই মাঝে পরপর প্রাকৃতিক বিপর্যয়। একরত্তি ছোট্টশিশু একগলা জলে নেমে হাত বাড়াচ্ছে একটু ত্রাণের জন্য। সামগ্রিক শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রায় স্তব্ধ। শিশুরাও আজ অন্তর্জালে বন্দি। হারিয়ে ফেলেছে ওদের সবুজ-মাঠ। শিশুর স্বপ্নিল চোখ এতটা চাপ নিতে পারবে তো? দারিদ্র্য-বেকারত্ব নিয়ে নিষ্ঠুর এই মারণব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধটা আরো কঠিন করে তুলছে। সুদূর ডেনমার্কের বন্ধ-ঘরে আমাদের একমাত্র সন্তান ক্যামেলিয়া হয়তো অন্তর্ভেদী হাহাকারে গেয়ে উঠছে ," ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে ... ! " এ কোন্ কুরুক্ষেত্রে আমরা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছি ! চারিদিকে শুধুই বাতাস-বিদীর্ণ করা মৃত্যুর গান আর হাহাকার ! বসুন্ধরার চোখে জল। যেন অশ্রুনদী ! এমন কোনো আঁচল নেই যা মুছিয়ে দিতে পারে এ-অশ্রু। ' আলোর পথযাত্রী ' হায় স্বাধীনতা ! কত অসহায় তুমি ! 





মহামারীর হাতে অসহায় স্বাধীনতা

গোবিন্দ মোদক


          সাম্প্রতিককালের জনজীবনের সর্বত্র অতিমারী শব্দটি যে ভয়াবহ ত্রাসের সঞ্চার ঘটিয়েছে তা বুঝি তুলনারহিত। বস্তুতপক্ষে সমকালের মধ্যে এমন কোনও শব্দ তথা শব্দবন্ধ নেই যা এই ভয়াবহ অতিমারী শব্দটির সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। বিগত সাত দশকের মধ্যে করোনা অতিমারীর মতো এমন কোন ত্রাসের সঞ্চার ঘটেনি। 


           দৈনিক সংবাদপত্র থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং আন্তর্জালিক বিভিন্ন মাধ্যম আমাদেরকে প্রতিমুহূর্তে সতর্ক করে চলেছে এই অতিমারী সম্পর্কে। অতিমারীর এই যে ভয়াবহতা তার ঠিক পাশাপাশিই রয়েছে আরেকটি ভীতিপ্রদ দিক যা বর্তমান কালের আর্থ-সামাজিক পটভূমিকায় এক সুদুরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে। অতিমারীর প্রভাবে স্কুল-কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বহু কল-কারখানা, বহু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সিনেমাহল, থিয়েটারের মতো বহু বিনোদনের মাধ্যম এবং আরও অনেক কিছু যা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। 


           সামনেই আসতে চলেছে স্বাধীনতা দিবস। ভারতের চুয়াত্তর-তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এই মহামারীর থাবা কিন্তু উদ্যত হয়েই আছে। আমরা জানি স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয় স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং বিভিন্ন অফিস-আদালতে। এছাড়া ক্লাবে, বাড়িতে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও মহাসমারোহে স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়ে থাকে। কিন্তু সেই ট্রাডিশনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে এই অতিমারীর প্রকোপ। মহামারীকে রুখে দেওয়ার জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা খুবই জরুরী। মূলত: এই কারণেই স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের মতো অনুষ্ঠানগুলি অতিমারীর বিধিনিষেধ মেনে সঠিকভাবে পালন করা কখনোই সম্ভব নয়; কেননা স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ, শিক্ষকদের সমাবেশ, ব্যান্ড বাজিয়ে প্রভাত ফেরি, সেইসঙ্গে গান গাওয়া, স্লোগান দেওয়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ইত্যাদির ক্ষেত্রে শারীরিক নৈকট্য এসেই যায়। কিন্তু অতিমারীর মতো মহামারীকে রুখতে হলে প্রতি মুহূর্তে মাস্ক-স্যানিটাইজার ছাড়াও প্রয়োজন দূরত্বের সচেতনতা। 


          কাজেই স্বাধীনতা দিবসের এই অনুষ্ঠান উদযাপনের ক্ষেত্রে সবসময় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা যে কখনোই সম্ভব নয় সেটা বলাই বাহুল্য। আর মুষ্টিমেয় দু-একজনকে সঙ্গে নিয়েই স্বাধীনতা দিবস উদযাপন যে ঠিক জমে না। কাজেই মহামারীর হাতে একপ্রকার অসহায় হয়ে পড়েছে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মতো একটি আনন্দঘন উৎসব। বোধকরি স্মরণাতীত কালের মধ্যে অতিমারীজনিত মহামারীর এমন ঘটনা ঘটেনি যা স্বাধীনতাদিবস উদযাপনকে প্রভাবিত করতে পেরেছে।




চৌকাঠের শিকড় উপড়ে যায় 

বিকাশরঞ্জন হালদার 


স্বাধীনতা। একটি মাত্র শব্দ। যা শুনে অদ্ভুত অনুভূতিতে বুকের ভেতর যেনো হু-হু খোলা বাতাস বয়ে যায়। মৌলিক চেতনার এক অপার চরাচর মনে হয়। হয়তোবা মুছে দেওয়া বন্ধন-বিধিলিপি।কখনও কোনো আবিল দৃষ্টির নিরিখে - দিকভ্রম বলে মনে হতে পারে। তবুও বলবো, বুকের কিনারে উঠে আসা জীবন্ত কিছু পিপাসা। যা মানুষকে টেনে বেরকরে আনে মামুলি-আস্তানা থেকে। উপহার দেয় সবুজ-গন্ধ, গান। দেয় উষ্ন-জমি। তাইতো চৌকাঠের শিকড় উপড়ে যায়। জন্ম নেয় ভ্রমণ-সাধ। আমারা গ্রস্ত হই স্বভাবতই। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মুচড়ে দিয়ে, মনের ডাকে সাড়া দিই। কাজ করি। মুক্তির আবেগ স্বতন্ত্র। আলোয়-আলোয়, সবুজে-শ্যামলে তার কত'না রঙিন বিস্তার। রঙচটা জীবন বড় দুর্বিষহ। একঘেয়েমি'তে কোঁকিয়ে মরা। ঠিক সে'কারণেই  হয়তো, স্বাধীনতা এক বাঁধভাঙা অনুরাগ। বলা যেতে পারে, কোনো ঝাঁপ-জিজ্ঞাসা নয়। ঝাঁপিয়ে পড়া। একটু আপ্লুত হয়ে বলতে পারি, স্বাধীনতার জন্যে টু-শব্দটি না করে মরে যেতে পারে চাঁদ। বিস্মৃত কিছুও বাঁধন হারা হয় কখনও-কখনও স্বাধীনতার অমোঘ টানে।  শিকড়ে মাটি-জল, শব্দ থেকে শব্দের অন্তরে, করতলে উড়তে থাকা অম্ল-মধুর, অথবা দাবানল ফুঁড়ে আনকোরা ছাঁচে সভ্যতার ভিন্ন কল্পতরু। এ-সবই স্বাধীনতা। মানুষের জীবনে স্বাধীনতা অক্সিজেন। আমাদের দেশে মহামারী আজ নতুন করে কহতব্য নয়। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তে'র কালজয়ী- " আমরা ফ" কবিতার  সেই ঝাঁকিয়ে দেওয়া কথামালা- " মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি ... " সত্যিই তো  হেরে যেতে শিখিনি। পরাজয়ের সঙ্গে আপস করতে জানিনা। জানি সংগ্রাম। জীবনের আরও একটি নাম। ১৯৪৭ সালে'র স্বাধীনতা। আত্মবলীদানের ইতিহাস। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। স্বাধীনতা আদায় করে নিতে হয়। করোনা-মহামারী  হয়তো দমিয়ে দিতে চায়। মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু আমারা উঠে দাঁড়াই বারবার ... আরও একটিবার  ...মরণটা'কে মেরেফেলি এক সময়।  এই মহামারী কবলিত  স্বাধীনতা আমাদের বুকে মুখ রেখে আহত পাখির মতো কাঁদে। পোড়া বুকের মায়ায় চির-প্রশ্রয় তার। আমরা আচমকা বন্দী হলেও,  বলাকার মতো চঞ্চল।  ডানা মেলি সহস্র বার। অন্য কিংবা অনন্য পথে উড়ে যাই - ইচ্ছে মতো। মৃত্যু পড়েথাকে  খড়কুটোর অবহেলায়। দূরত্বের পায়ের কাছে। কেননা - স্বাধীনতা কারো বশ্যতা স্বীকার করেনা...





মহামারী পারুষ্যে মৃতভেজা  স্বাধীনতা

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়



মন্দাবস্থা! অর্থনীতির বেসুরো স্তনন।স্মের জনজীবন টলোমলো। কর্মনাশা অবস্থা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে এনেছে স্যন্দিত দুঃখ জীবন ধারণে।ফলে বাজারে কার্যকর চাহিদার অভাব।তাই জোগানও কম হতে থাকে যা উৎপাদনকে বন্ধের দিকে ঠেলে দেয় স্থায়ীভাবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরা। কর্ম সংস্থানের অভাবে সরাসরি ধাক্কা জীবনধারণে।সৌমনস্যবিমুখ ক্রন্দনজড়িমা !আয়হীনতার দুষ্টচক্রে স্বাভাবিক জীবন অসহায়ভাবে বাহ্যিক সাহায্য প্রার্থী। সরকারি সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা জীবনের লাবডুব। জীবনের স্বপ্নজড়িমা এক ধাক্কায় পথে।কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরা মানুষগুলো গৃহবন্দী। অন্তরীন কর্মহীন। দুমুঠো ভাতের গন্ধ চায় অভিলাষী জীবন। শিশুর ক্রন্দন শুধু সময় থমকে দাঁড়িয়ে শোনে।

     চুম্বকে এই হলো মহামারীতে অর্থনীতি ও জনজীবনের কথা।তাই স্বাধীনতার মূল সুর আজ বেসুরো জ্যান্ত ক্ষুধার কাছে।"দো গজ দূরী/মাস্ক হ্যায় জরুরী" কেড়ে নিয়েছে জনজীবনের স্বাভাবিক প্রাণ চঞ্চলতা।আর এখানেই মুখ ভার করে বসে স্বাধীনতা।কৃষিকাজ থমকে।পরিবহন অনেকাংশে বন্ধ। "বন্দে মাতরম্" বড়ো ফিকে তাই আজ দিনগত পাপক্ষয়ে আটকে থাকা জনজীবনে।

       পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী যা মুদ্রাস্ফীতির দ্যোতক। কারখানা কার্যকর চাহিদার অভাবে উৎপাদন বন্ধের বিন্দুতে। শূণ্য কারখানায় শুধু শ্রমিকের ক্রন্দনেরা পরিণদ্ধ।পরিভৃতি শূণ্যতা। জীবন বোধ যেখানে কানাগলিতে আছড়ে পড়ছে, সেখানে "সারে জাঁহাসে  আচ্ছা" মনের কোণে আর ঝড় তোলে না উড়তে থাকা পতাকা চোখের তারায় আয়না ধরলে।

    নকডাউনের অর্থনীতিতে স্বাধীনতা চিন্তামগ্ন দাঁড়িয়ে থাকে আগুনখেকো সময়ে। তার চিন্তার ভাঁজ কপালে।গতাসু জীবনকে স্বাভাবিকতার ছন্দে আনতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। শুধু সরকারি অনুদানে তা কার্যত অসম্ভব। মহামারীতে ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতির হাত ধরে দাঁড়িয়ে দিশাহীন স্বাধীনতা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রাতের আকাশে জ্বলতে থাকা শুকতারার দিকে।




অতিমারী এবং স্বাধীনতা দিবস

তপনজ্যোতি মাজি


মার্চ দু হাজার কুড়ি তে থেকে ভারতবর্ষ সহ সারা বিশ্ব অতিমারীর বিষ স্পর্শে সংকটের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। কুড়ি র স্বাধীনতা দিবস কেটেছে বিবর্ণ ও আবেগ বর্জিত নিয়মরক্ষার পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে। আজ আর একটি স্বাধীনতা দিবস। সেই অতিমারী,সেই নিষেধের এক দুই তিন। এ যেন মুক্তির আনন্দ কে তর্জনীর শাসনে স্তিমিত করে দেওয়ার অনাকাঙ্খিত পরিবেশ। অতিমারীর সক্রিয়তা এবারেও কি জয়ী হবে অনুদার নির্মমতায়?উৎসব ও সংস্কৃতি নির্ভর আমাদের উদযাপন। স্বাধীনতা দিবসের সকাল মানে দেশমাতৃকার বন্দনা। দেশাত্মবোধের গান, প্রভাতফেরী, জাতীয় পতাকার গর্বিত উত্তোলন, দেশনায়কদের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও দিনভর শহীদ তর্পণ।  উৎসবের আমেজ। ছাত্রছাত্রীদের  প্রবল উৎসাহ স্বাধীনতা দিবসের আবহে তরঙ্গ সঞ্চারিত করে এ কথা বলা বাহুল্য মাত্র।অতিমারীর এই স্বার্থপর দৈত্যসূলভ আচরণ মন চাইছে না মানতে। প্রাণ বলছে চলো একসাথে গান গাইতে গাইতে পথে বেরিয়ে পড়ি, কবিতা বলি উদাত্ত স্বরে। একদিনের জন্য দেশাত্মবোধের আবেগের কাছে পরাজিত হোক অতিমারী। অচলায়তনের গন্ডি ভেঙে জীবন ফারুক চলার ছন্দে।এতো বড়দের কথা বলা হয়ে যাচ্ছে। চিন্তনের অভিমুখ পাল্টে একবার দেখা যাক কি বলছে শিশু ও কিশোর কিশোরীরা। কতদিন ইস্কুল প্রাঙ্গন তাদের কাছে দৈত্যের বাগান হয়ে থাকবে? কতদিন ঝোলানো থাকবে কাছে না আসার অদৃশ্য বিজ্ঞপ্তি ? কতদিন চকের গুঁড়ো পড়েনি ফার্স্ট বেঞ্চে বসা ছেলেদের চুলে কিংবা ছাত্রীদের নীল ওড়নায়? এই আবহে পনরো ই আগস্ট। কাঙ্খিত স্বাধীনতা দিবস।হ্যাঁ, এবারেও বন্ধন মুক্তি নেই মুক্ত সমাবেশ ও অনুষ্ঠানের।  সমবেত স্বরের গানের প্রতিধ্বনি শোনা যাবেনা স্কুলের দেওয়ালে দেওয়ালে।জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় শোনা যাবেনা সমবেত জয়ধ্বনি।

এই অতিমারীয় নির্মমতার অবসান হোক। জয় হোক জীবনের।আনন্দের। দেশপ্রেমের।শিশুদেরও মন আছে প্রাজ্ঞরা কেন যে ভুলে যান ! পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরে না বেঁধে যদি পর্যায় ক্রমে ছাত্রছাত্রীদের টিকা করণের জাতীয় প্রকল্প নেওয়া যায়, কেমন হয়? ভাবনা বা চিন্তন একটি গতিশীল মস্তিস্ক প্রক্রিয়া। ছাত্রছাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক শ্রেণীকক্ষ, ইস্কুল প্রাঙ্গণ এবং স্কুলে অনুষ্ঠিত জাতীয় দিবসের আনন্দ ও আবেগ। রাষ্ট্র নায়কেরা নিশ্চই ভাববেন এই সদর্থক আশা বজায় রেখে  অতিমারী কে জয় করার অঙ্গীকার নেওয়া হোক একুশের স্বাধীনতা দিবসে।জয় হোক প্রাণের।  ছড়িয়ে পড়ুক বিজয়ী প্রানের জয়বার্তা  হাওয়ার মতো, আলোর মতো।



দাও ফিরে সেই সকাল

অনিন্দিতা শাসমল


দুবছর আগের পনেরোই আগস্ট। সাদা টপের ওপরে সবুজ চেককাটা টিউনিক পরেছে একগুচ্ছ তরতাজা প্রাণ। দুদিকে চুল ব়াঁধা সবুজ অথবা সাদা ফিতে দিয়ে। পায়ে সাদা মোজা ও কেডস। হাতে ত্রিবর্ণরঞ্জিত ভারতের জাতীয় পতাকা। দলে দলে প‍্যারেড করতে করতে চলেছে তারা টিপ টিপ বৃষ্টির মধ‍্যেই। তিন-চারটে  ট্রলিতে কেউ ভারতমাতা,কেউ ক্ষুদিরাম ,কেউ বা মাতঙ্গিনী সেজে দাঁড়িয়ে। আর দুটো ট্রলির একটায় বাজছে দেশাত্মবোধক গান --উঠো গো ভারতলক্ষ্মী, কারার ঐ লৌহ কপাট, ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম ইত‍্যাদি। অন‍্যটায় আবৃত্তি করতে করতে যাচ্ছে  মেয়েরা --হে মোর চিত্ত পুণ‍্য তীর্থে জাগো রে ধীরে,  চল চল চল,উর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল , দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার ...

প্রথম সারিতে গেরুয়া- সবুজ পাড় সাদা শাড়িতে , মাথায় ঘট নিয়ে ছাত্রীআবাসের ছাত্রীরা। কয়েকজনের হাতে ড্রাম বিউগল, বাজছে তালে তালে । সবার সে কী  আনন্দ ! পাশে হেঁটে চলেছেন দিদিমণিরা। গ্রামের পাকা ও কাঁচা রাস্তার দুধারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই , প্রথম প্রভাতসূর্যের মতোই ভারতের স্বাধীনতাকে সাদর অভ‍্যর্থনা জানাতে। শালবনীর রাস্তার এই চিরচেনা প্রভাতফেরী মানুষ দেখে আসছে বহু বছর ধরে। 

বিগত দুটো বছর প্রায় সব বিদ‍্যালয়েই কোনোরকমে পতাকা উত্তোলন করে মহান দেশপ্রেমিকদের পুষ্পমাল্য অর্পণ করে পালিত হচ্ছে স্বাধীনতা দিবস। একটা ছোট্ট ভাইরাসের কাছে পরাজিত হয়েছে আমাদের বিশেষ দিনের অন্তহীন আবেগ। মহামারীর হাতে বড্ড অসহায় আমাদের স্বাধীনতা দিবস , ঠিক যেমন করে অসহায় আমরা। নাক মুখ খুলে পৃথিবীর মুক্ত বাতাস প্রাণভরে গ্রহণ করার স্বাধীনতা নেই আজ।স্বাধীনতা নেই ইচ্ছে করলেই লোকাল ট্রেনের কামরায় উঠে পড়ার , ছোট্ট একটা ভ্রমণ সেরে নেওয়ার।

কানে ভেসে  আসছে শত শত পরিচিত করুণ কোমল কন্ঠস্বর--

পরের বছর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে তো দিদিমণি ?

স্বাধীনতা দিবসের দিন সকালে পতাকা নিয়ে প্রভাতফেরীতে যেতে পারবো তো ?














কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন