আষাঢ়ে গপ্প কথা -১৪
দীপক বেরা
আমাদের গেছে যে দিন
লেটার বক্সে একটা খামে বন্ধ চিঠি এসেছে। রাজশ্রী কৌতুহলে তাড়াতাড়ি খাম ছিঁড়ে খুলে দেখে। দেখেই তার মন খুশিতে ভরে ওঠে। তার পেরিয়ে আসা কলেজের রিইউনিয়নের 'আমন্ত্রণ পত্র'। মনে পড়ে যায় ফেলে আসা বহু সময় আর ঘটনার স্মৃতি! যদিও খুব ব্যস্ততাময় জীবন তার, তবুও প্রিয় বান্ধবী সুলেখার অনুরোধ কি করে এড়াবে? সাত-পাঁচ ভেবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে সে।
আজ বছর পাঁচেক বাদে কলেজের মেন গেট পেরিয়ে ঢুকতেই পুরনো গন্ধ-গভীরতায় ডুবে গেল রাজশ্রী। কিছুক্ষণ নীরবতার সাগরে ডুবে যায়। হঠাৎ সুলেখা এসে জড়িয়ে ধরে রাজশ্রী কে। তখনই তার সম্বিৎ ফেরে। দুজনে দুজন-কে জড়িয়ে ধরে। তারপর রাজশ্রী কে নিয়ে সুলেখা এগিয়ে যায় রিইউনিয়ন হলের দিকে। সেখানে গিয়ে আরও অনেক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যায়।
--- কেয়া বলে, তুই কিন্তু আগের মতই আছিস, চেহারায় বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। শুধুমাত্র একটুখানি ফ্যাট লেগে শরীর টা একটু ভারী হয়েছে।
--- ইতিমধ্যেই খাওয়ার প্যাকেট, চা, কফি, কোল্ড-ড্রিঙ্কস্ এসে যায়। খেতে খেতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমে ওঠে রাজশ্রীর। হঠাৎ থমকে যায় রাজশ্রী স্টেজের মাইকের ঘোষণা শুনে। মাইকে ঘোষিত হচ্ছে তখন --- "এখন জীবনমুখী গান শোনাতে আসছে আমাদের কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র রণজয়"..
--- রাজশ্রীর বুকের ভেতর টা ধক করে ওঠে। এলোমেলো ভাবনায় মন টা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ওদিকে স্টেজে রণজয় কর্ডলেস মাইক হাতে এসে দাঁড়িয়েছে। দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়েছে। আসলে ইতিমধ্যেই রণজয় সঙ্গীত জগতে নাম করে ফেলেছে। রণজয় এখন সুপরিচিত সঙ্গীত শিল্পী।
--- রণজয় গান ধরেছে, --- "তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, আরও দূরে তুমি আর আমি, সরে যাই দূরে দূরে..."
--- রাজশ্রীর বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে ওঠে। রণজয় কে দেখবে বলেই কি সে এতদিন পরে এখানে ছুটে এসেছে? গান টা শুনতে শুনতে শরীরটা কেমন করে ওঠে রাজশ্রীর, মনটা বিষাদ-বিষণ্ণতায় ভরে যায়।
--- গানটা শেষ করেই তুমুল হর্ষধ্বণির মধ্যে রণজয় স্টেজ থেকে নেমে আসে। বন্ধুরা সবাই চিৎকার করে রণজয় কে ছেঁকে ধরেছে তখন।
--- "আরে একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছো গুরু, কোনও কথা হবে না বস!"..বন্ধু সুজয় বলে ওঠে। চারিদিকে বন্ধুদের হৈ-হৈ হাসি, ঠাট্টা-মশকরা!
--- রাজশ্রীর কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। সে যেন রণজয়ের থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে, সে ওখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। রণজয় কে নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত ছিল যে, এই ব্যাপারটা কেউই তেমন খেয়াল করে নি।
রণজয়ের কিন্তু ব্যাপারটা চোখ এড়ায় নি। দৌড়ে গিয়ে রাজশ্রীর পিছু নেয়। সবাই ব্যাপার টা রিয়ালাইজ করে চেপে যায়। কারণ, ওদের প্রেমের কথা বন্ধুদের কারুরই অজানা নয়।
---- কলেজ গেটের কাছে গিয়ে পেছন থেকে রাজশ্রীর হাতটা ধরে ফেলে রণজয়।
--- রাজশ্রী পেছন ফিরে রণজয় কে দেখে চমকে ওঠে।
--- কি রে রাজশ্রী, এতদিন পর দুজনে দুজনের এত কাছে এসেও কিছু না বলে চলে যাবি? বন্ধুত্বের বন্ধন কি এত সহজেই আলগা হয়ে যায়?
সেই আশুতোষ কলেজের পুরনো গেট, সেই পুরনো প্রেমের গন্ধ, পুরনো রোমান্স! রাজশ্রী হারিয়ে যেতে থাকে স্মৃতির আচ্ছন্নতায়।
মুহূর্তে সামলে নিয়ে বলে, --- "কেমন আছিস, রণজয়?"
--- "এই তো বেশ আছি বস, তোকে ছাড়া বিন্দাস!"... রণজয় হাসতে হাসতে জবাব দেয়।
--- সেই একইরকম আছে রণজয়, শত দুঃখ-যন্ত্রণা চেপে সবসময় হাসিখুশি থাকে, বুঝতে দেয় না কাউকে। রাজশ্রীর মনে পড়ে যায় কত কথা, সেই নানা রঙের দিনগুলোর কথা। তার স্মৃতির ভাঁজে আজও অমলিন। জীবনপ্রবাহে হেঁটে এসেছে অনেকটা। স্মৃতির আলো-ছায়ায় আজও মনে পড়ে রণজয়ের সেই রোমান্টিক গান, গানের সুর, সেই কলেজ গেট, করিডোর, কলেজ ক্যান্টিন, আর কমন-রুম। কত কথা, কত মুহূর্ত, কত প্রিয় মুখ, কত স্পর্শ-আমেজ, কত উপলব্ধি! মুহূর্তের জন্য অজান্তেই হারিয়ে যায় রাজশ্রী।
--- কিরে রাজশ্রী, স্ট্যাচু হয়ে গেলি যে! কী এত ভাবছিস? এনি থিং প্রব্লেম?
--- রণজয়ের কথায় সম্বিৎ ফেরে রাজশ্রীর। "উঁ, হ্যাঁ,.. আরে না না, একটা কথা ভাবছিলাম। বাদ দে ওসব, তুই এখন কেমন আছিস, কী করছিস? এখন তোর কথা বল।"
--- এই এখানে যেমন দেখলি, ওরকমই স্টেজ-শো করে বেড়াচ্ছি। গানের রেকর্ডিং, মাঝে মাঝে টিভি প্রোগ্রাম। এইসব আর কি। কেটে যাচ্ছে সময় এভাবেই, সুর-তাল-ছন্দে। শুধু জীবনের সুরটাই কেটে গেল, জীবন আজ ছন্দবিহীন! যাইহোক, আমার কথা ছাড়। তোর খবর কী বল? প্রবাসী হয়ে কলকাতা কে ভুলে যাস না যেন। মনে রাখিস, কলকাতায় আমাদের মত ক্ষুদ্র প্রাণিরাও থাকি। রণজয়ের গলায় একটু বিদ্রুপের সুর।
--- কী যে বলিস! ভুলব কেন? তবে, আমার আর কী থাকবে বল? যান্ত্রিকতায় কাটছে সময়। তোর গানের মত সুর-মূর্ছনা নেই আমার জীবনে। ওর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি, নিরন্তর ব্যস্ততা। এদিকে আমার চাকরি নিয়ে আমি ব্যস্ত। জীবনের কলতান নেই, কোনও উপলব্ধি নেই।
--- কিন্তু, তুই তো চেয়েছিলি এই জীবন। আমাদের প্রেম কে উপেক্ষা করে সেদিন চলে গিয়েছিলি অনায়াসেই।
--- হ্যাঁ তা ঠিকই, অস্বীকার করি কী করে? যা সত্যি, তা তো সত্যিই! এখন আফসোস হয়, জানিস রণজয়! এখন মনে হয়, যেখানে রূপ-রস-গন্ধ নেই, আবেগ নেই, অনুভূতি নেই,.. সেটা কি একটা জীবন?
--- আর একটু অপেক্ষা করতে পারতিস! আমি সবকিছু মানিয়ে নিতাম। আমি তখন অনেক চেষ্টা করেছি তোর সাথে যোগাযোগ করার, কিন্তু পারি নি!
--- আসলে, তখন অরিন্দমের (রাজশ্রীর হাজব্যান্ড) মাল্টিন্যাশনাল, কর্পোরেট চাকরির শ্যাম্পেনের ফোয়ারায় ভেসে গিয়েছিলাম। তখন বাবা-মায়ের কড়া নির্দেশ, তাদের ঠিক করা উপযুক্ত পাত্রে বিয়ে করতে হবে। অবশ্য আমারও যে সায় ছিল না, সেটা আজ আর তোর কাছে অস্বীকার করতে পারি না। আসলে, আমিই তোকে এড়িয়ে গেছি। ভেবেছিলাম, এই গান-পাগল ছেলেটার সাথে প্রেম করা যায়, কিন্তু আর যাই হোক সংসার করা যায় না। একটা রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভেসে গিয়েছিলাম অজানা দেশে!
জানিস রণজয়, আজ ডায়েরির ভাঁজে তোর পাঠানো হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠিগুলোর গন্ধ শুঁকি!...
... অনেকক্ষণ দু'জনের নীরবতা! দু'জনেই মুহূর্তের চোরাবালিতে হারিয়ে যায়..!
--- নীরবতা ভঙ্গ করে রণজয় বলে, চল তোর আবার ফিরতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কী আর করা যাবে বল, ভুলে যা ওসব অতীত। বাঁচতে তো হবেই এই জীবনটা কে নিয়ে, সংসারের সবাই কে নিয়ে। তাই বলছি, যা হয় নি ভুলে যা সব, সবকিছু। দাঁড়াতে হবে বর্তমানের দেওয়াল ঘেঁষে, বাস্তবতার স্পর্শে।
--- "কি জানি, পারব কিনা জানি না!".. রাজশ্রী বলে।
দু'জনেই উঠে দাঁড়ায়, পরস্পরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এবার চলে যাওয়ার পালা। পরস্পর হাত নেড়ে বিদায় নেয় ওরা।
--- "ভাল থাকিস রাজশ্রী।".. বলেই রণজয় বিপরীত দিকে হাঁটা দিল। দু'জনের পথ যে আলাদা। তাই দু'জনে আজ বিপরীতমুখী।
--- রাজশ্রী রণজয়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ...!
--- রাজশ্রীর মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই লাইনগুলো, --- "আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?"...
Khub sundor laglo ♥️💐
উত্তরমুছুন