লেবেল

বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০

ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৮)। অষ্টভুজ রহস্য — অলোক চট্টোপাধ্যায়

               




ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৮)

অষ্টভুজ রহস্য

অলোক চট্টোপাধ্যায়


ভেতর বাড়িতে কটা ঘর ছিল? রজতবাবু প্রশ্ন করলেন।

-একতলা দোতলা মিলিয়ে চারটে বড় শোবার ঘর।তা ছাড়া পুজোর ঘর, রান্নাঘর, খাবার ঘর, দালান, তিনটে বাথরুম। তবে সেসবের কিছুই তো আর অবশিষ্ট নেই দেখছি। বিজয়বাবুর গলায় দুঃখের ছোঁওয়া। - আমিই তো দেখছি বাইশ বছর পর।দাদু মারা যাবার পর থেকে এখানে আর আসাই হয়ে ওঠেনি।

-আমি অবশ্য প্রায়ই আসি তবে এইদিকটায় খুব একটা আসা হয়না, সুজয়বাবু বললেন। - এই বাড়ির পাশের দিকে আমাদের কয়েক একরের ফলের বাগান। দাদুর বাকি সব ব্যবসা বেচে দিলেও ওইটা আমরা রেখে দিয়েছি। আগে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে যাবার রাস্তা ছিল। নিচু জমি, পেছনেই বিদ্যাধরীর খাল। জোয়ারের জল ঢুকে এখন পুরো জলা হয়ে গেছে। হোগলার জঙ্গলে ভরা। কোমর সমান পাঁক জমে থাকে।

-ফল বাগানে যাবার কি তাহলে অন্য রাস্তা আছে? পলাশের প্রশ্ন।

-হ্যাঁ, অন্য দিক থেকে যেতে হয়। সুজয়বাবু জানালেন। - আগে অনেকটা ঘুরপথ হত। এখন নতুন ব্রীজ দিয়ে কাছে পড়ে। তবে পাকা রাস্তা এখনো তৈরি হয়নি।

-ঐ দেখুন বিদ্যাধরীর খাল। নীলমনি আঙুল তুলে দেখালো। বড় কয়েকটা জংলি গাছ আর ততোধিক আগাছার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে খালের জল।একটা ডিঙি নৌকোও চলছে। বিজয়বাবু কেমন যেন ঘোরলাগা গলায় বললেন – আমিও ছেলেবেলায় ওখানে ডিঙি নিয়ে কত ঘুরেছি। সুজয়ও। ছেলেবেলায় আমাদের সাঁতার শেখাও ও ওখানেই।

বাড়ির পেছন দিকটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার। অনেকখানি চওড়া জায়গা, তার দুপাশ ঘিরে জলাজমি। প্রধানত হোগলার জঙ্গল। সাত আট ফুটেরও বেশি লম্বা একএকটা গাছ। এত ঘন যে অন্যদিকে কি আছে দেখাও যাচ্ছেনা। তবে অনেকটা দূরে উঁচু গাছের মাথা উঁকি মারছে, বোধহয় ওই দিকেই ফলের বাগান। নিচে কোথাও জল দেখা যাচ্ছে, কোথাও থকথকে কাদা বা পাঁক। কুণাল একদম ধারে গিয়ে দু একটা গাছ হাত দিয়ে সরিয়ে ভেতরে উঁকি মারার চেষ্টা করছিল নীলমনি হৈ হৈ করে উঠল। - ওদিকে একদম যেওনা। একবার পাঁকে পা পড়লে আর দেখতে হবেনা। আর ওখানে দেখারই বা কি আছে?

রজতবাবু একটু এগিয়ে গিয়েছিলেন। নীলমনির কথা শুনে পিছনে ফিরে ওদের মৃদু ধমক লাগালেন। - কাদায় পা স্লিপ করলে এক কেলেংকারি কান্ড হবে। কাছে একদম যাবিনা। বলতে বলতে একটু পিছিয়ে এসে হাতে ধরা গাছের সরু ডালটা অন্যমনস্কভাবে ফেলে দিলেন তিনি। স্যার কি কিছু বলতে চাইলেন? কুণাল আর পলাশ নিজেদের মধ্যে একবার দৃষ্টিবিনিময় করল।

এদিকটায় আর দেখার বিশেষ কিছু নেই। পেছনদিক দিয়েও বাড়িটার ভেতরে ঢোকা বেশ কঠিন। ভাঙা দেওয়ালগুলো বিপজ্জনক ভাবে হেলে রয়েছে। রজতবাবুর সঙ্গে পলাশ আর কুণালও বাইরে থেকেই উঁকিঝুঁকি মেরে ঘরগুলোকে দেখার চেষ্টা করল। তারপর কিছুটা যেন হাল ছেড়েই রজতবাবু বললেন – চলুন,এবার ফেরা যাক। আর কিছু দেখার নেই। একটা কথা, যদিও ঘটনাটার  সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, অন্যদিক দিয়ে ঘুরে আপনাদের ফলের বাগানটা একবার দেখে যাওয়া যাবে কি?

প্রস্তাবটা শুনে অজয় এবং সুজয়বাবু নিজেদের মধ্যে একবার দৃষ্টি বিনিময় করলেন। তারপর সুজয়বাবু একটু অপ্রতিভ স্বরে বললেন – দেখাতে পারলে তো ভালোই হত। দাদাও তো ওদিকটা অনেকদিন যায়নি। কিন্তু একটু মুশকিল হয়ে গেছে। আসলে সবটাই ক্যানিং এর একটা পার্টিকে লীজে দেওয়া আছে। গেটের তালাচাবি সব ওদের কাছেই থাকে।

-কিন্তু মালি বা চৌকিদার কেউ তো থাকবে নিশ্চয়ই। বিজয়বাবু বললেন।

-সে তো আছে। কিন্তু তারা সবাই ঠিক আজই গ্রামে চলে গেছে কিসের যেন মেলা দেখতে। ফিরবে সেই সন্ধ্যেবেলা। দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লেন সুজয়বাবু।

-আসলে আমাদেরই ভুল। এবারে অজয়বাবু বললেন। - কাল যখন আসা ঠিক হল তখনই পার্টিকে ফোন করে দিলে এমনটা হতনা। আজ সকালে ফোন করতে ঠিকেদার ভদ্রলোক জানালেন ওরা নাকি কোন মেলায় যাবে বলে অনেক আগের থেকেই ছুটির জন্যে বলে রেখেছিল। একবেলার ব্যাপার বলে উনি সকলকে একসঙ্গে ছাড়তে আপত্তি করেননি। এখন আর ওদের ডেকে পাঠাবার কোনো উপায় নেই।

-ঠিক আছে। আমি এমনিই দেখতে চেয়েছিলাম। আমার তদন্তের সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই কাজেই দেখাটা তেমন জরুরি কিছু নয়।  জানালেন রজতবাবু। সুজয়বাবু অবশ্য বললেন নতুন ব্রিজ থেকে ওদের বাগানের অনেকটা দেখা যায়। ফেরার পথে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওখান থেকে দেখিয়ে দেবেন। 

না না , ওটা তেমন দরকারি কিছু নয়। রজতবাবু বললেন। -তাছাড়া প্রায় দুটো বাজে। দেরিও হয়ে গেছে। 

এবার ফেরার পালা। পলাশ আর কুণাল একটু পিছিয়ে পড়েছিল। ওদের সামনেই নীলমনি আর রাজিন্দার চলেছে গাড়ি সংক্রান্ত কি সব আলোচোনা করতে করতে। রজতবাবুর সঙ্গে বাকিরা অনেকটা এগিয়ে। হঠাৎ কুণাল হাঁটু মুড়ে বসে স্পোর্টস শু’র ফিতে খুলতে শুরু করল। পলাশ চেঁচিয়ে বলল – আপনারা এগোন স্যার। কুণালের জুতোয় একটা পাথর কুচি ঢুকে গেছে। আমরা এক্ষুনি আসছি।

-তাড়াতাড়ি কর। একটু ধমকের সুরেই বললেন স্যার। নীলমনিও প্রায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রাজিন্দার ওর পিঠে হাত রেখে কি যেন বোঝাচ্ছিল, প্রায় তার ঠেলাতেই তাকেও এগিয়ে যেতে হল। 

ওরা বাড়ির পাশের দেওয়ালের আড়ালে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই পলাশ একদৌড়ে চলে গেল জলার পাশে । রজতস্যারের ফেলে দেওয়া গাছের ডালটা দিয়ে হোগলার গাছগুলো সরিয়ে সরিয়ে ভেতর দিকটায় দেখার চেষ্টা করতে লাগল। নিশ্ছিদ্র জঙ্গল। কিন্তু ওরই মধ্যে কয়েকটা জায়গায় যেন কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা। ওদিকের পরিষ্কার মাটি দেখা যাচ্ছে। বড়জোর কুড়ি ফুট দুরেই। নিচে থকথকে কাদা বা পাঁক। তবে এক জায়গায় কাদার চেহারাটা কেমন যেন অদ্ভুত। যেন কোনো রাজমিস্ত্রি কর্ণিক দিয়ে একদম সমান করে রেখেছে। আবার সমান জমিটার মাঝ বরাবর লম্বালম্বি সোজা একটা দাগ। ভাল করে পর্য্যবেক্ষনের আগেই নীলমনির গলা ভেসে এল। - কি হল দাদাবাবুরা, জুতোর ফিতে বাঁধতে এতক্ষন লাগে? 

দেওয়ালের পাশ দিয়ে নীলমনির আবির্ভাবের আগেই পলাশ তিন লাফে পৌঁছে গেল কুণালের পাশে। ফিতের শেষ নটটা বেঁধে হাত-পা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে পড়ল কুণালও। - এই যে, হয়ে গেছে দাদা। অত তাড়া দেন কেন? জুতোয় কাঁকর নিয়ে হাঁটা যায়?

-আপনাদের স্যারই তো তাড়া দিচ্ছেন। অপ্রস্তুত গলায় নীলমনি বলল। -আর এসব ভুতুড়ে জায়গায় কি এরকম আলাদা হয়ে গেলে চলে। শুনলেন তো বড়বাবুর বিত্তান্তটা। জেদ করে একলা এসে কি বিপদেই না পড়লেন।

গেটের ভেঙে পড়া থামের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা যেন হতভম্ব ভাবে বিজয়বাবু কথা বলছিলেন রজতবাবুর সঙ্গে। কাছাকাছি এসে পলাশেরা শুনতে পেল তিনি বলছেন – বিশ্বাস করুন মিস্টার রায়, এই গেটটাও সেদিন এরকম ভাঙা ছিলনা। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু আমি মোবাইলের টর্চ জ্বেলে দেখেছিলাম। দিব্যি আস্ত দুটো পিলার। ঘরটাও তো একদম ঠিকঠাক ছিল। এ কিভাবে সম্ভব হতে পারে বলুন? আর একদম সুবলদার মত দেখতে লোকটাই বা কে ছিল? এতসব কি মনের ভুল হতে পারে?

রজতবাবু আলতো ভাবে ওনার পিঠে হাত রাখলেন। - একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে। আপনি রিকশায় আসবার সময়ে কোনো কারনে অজ্ঞান হয়ে যান। রিকশাওয়ালাই আপনাকে কোনোমতে তুলে নিয়ে গিয়ে বাড়ির ভেতর শুইয়ে দিয়ে চলে যায়। আশপাশের দোকানের লোকেরা হয়ত ঠিক খেয়াল করেনি, একেবারে সামনাসামনি তো নয়। আর আপনি যেহেতু পুরোনো স্মৃতি নিয়ে আগের থেকেই নস্ট্যালজিক হয়ে ছিল, সেই ঘোরের মধ্যে আপনি বাড়ির আগের চেহারা নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। পুরোনো চেনা লোককে দেখেছেন।

-আচ্ছা, আমরা সেই রিকশাওলাকে খুঁজে বার করতে পারিনা ? পলাশ বলল।

-লাভ কি তাতে? রজতবাবু কেমন যেন নিস্পৃহ গলায় বললেন। - তাকে বড় জোর ধমকানো যেতে পারে ঐ রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে একজন ভদ্রলোককে ভাঙা বাড়ির মধ্যে রেখে যাবার জন্যে। আর তা ছাড়া দেরিও হয়ে গেছে অনেক।

বিজয়বাবু তখনো বিহ্বল মুখে কি যেন ভাবছেন। অজয় ও সুজয়বাবু পাশেই দাঁড়িয়ে। রজতবাবু খুব নরম স্বরে বললেন – আর তাছাড়া, আমরা যাই বলি না কেন, সব ঘটনা কি যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? না প্রকৃতির সব রহস্য আমরা বুঝে উঠতে পেরেছি?

বিজয়বাবু কি যেন একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন। বাস্তবিক, একজন বিজ্ঞান জগতের লোকের পক্ষে এই বক্তব্য মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু পলাশ আর কুনালও ভীষন অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে। এই রকম কথা তাদের স্যার বলছেন? ভাবাই যায় না।

বাইরের রাস্তায়  বেরিয়ে একটু তফাতের দোকান গূলোতে গিয়ে রজতবাবু একটু আধটু কথাবার্তা বললেন। না, সেদিন রাতে ন’টা নাগাদ সুজয়বাবুরা গাড়ি নিয়ে আসার আগে আর কাউকে তারা ঐ বাড়ির দিকে যেতে খেয়াল করেনি। তবে রিকশা করে কেউ উলটো দিক থেকে এলে তারা খেয়াল নাও করতে পারে। রজতবাবুও যেন খুব নিরুৎসাহিত ভাবেই খোঁজ নিচ্ছিলেন। দু এক জনের সঙ্গে কথা বলেই সুজয়বাবুকে বললেন ফেরার জন্য।

দুটো গাড়ি একসাথে রওনা হল। 




চলবে...

--------------------------------------------------------------------------------

প্রতি বৃহস্পতিবার এই ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাসটি অঙ্কুরীশা-র পাতায় ক্লিক করে পড়ুন ও পড়ান। মতামত জানান।

ankurishapatrika@gmail. com

--------------------------------------------------------------------------------



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন