স্মৃতিকথা
ফিরে আসি বিজয় দিবসে
গৌতম বাড়ই
শিশুকাল-ই বলব। বছর চার-পাঁচেক বয়স। বাড়ির কাঁচের জানালা খবরের কাগজে মোড়া। তখন আমাদের সেই শহরে হলুদ বাল্ব জ্বলে রাস্তায়। টিউব লাইট সবে ঘরে-ঘরে একটা দুটো করে আসছে। জ্বলছে। বাবার সরকারি চাকরি সূত্রে সরকারি আবাসনে থাকি। কোয়ার্টারস-র রাস্তায় সন্ধ্যা গড়ালেই অন্ধকার। যুদ্ধ চলছে যে। সেই ব্ল্যাক-আউটের স্মৃতি এখনও সজাগ এ মনে। আমাদের শহরটাই একটা সীমান্তবর্তী শহর। চারিদিকে কত-কত দেশের আর রাজ্যের সীমানা।নেপাল,ভূটান,চিন,বিহার,অসম প্রভৃতি। অধুনা বাঙলাদেশ আর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা তো একদম শহর থেকে বলতে গেলে নাকের ডগায়। ফুলবাড়ি সীমান্ত। আমাদের একটা দেয়ালে ঝোলানো এ্যাটলাস ছিল,তাতে এখন যেখানে বাঙলাদেশ লেখে সেখানে পূর্ব-পাকিস্তান লেখা ছিল। সাম্প্রতিক এই ১৬-ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবস বাঙলাদেশে মহা সমারোহে পালিত হল দেখে, অতীতের সেই স্মৃতি মন থেকে যেন উস্কে উঠল।
সেই ছোটবেলায় কিছু-কিছু নাম মনের ভেতর এমন গাঁথা থাকল, যা আজও ভুলিনি। মুজিবর রহমান, ইয়াহিয়া খান, মুক্তিযুদ্ধ, খানসেনা, রাজাকার বাহিনী-- এইসব। বড়দের মুখে শুনতাম আর চুপিচুপি গিলতাম আড়াল থেকে। তখন বড়দের গল্পের সামনে ছোটদের বসতে না দেওয়ার এক অলিখিত নিয়ম ছিল। বড়দের গমগমে গলার প্রতিটি শব্দ শিশুদের মনের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। এখনও বুঝি কি আমরা মনের কথা?
একদিন সন্ধ্যারাতে বড়দের জটলা। ক্রমে-ক্রমে ছোট-ছোট জটলাতে দু-চারজন করে এক-একটা বাড়িতে সেঁধিয়ে গেল। আমাদের বাড়িতে ঐ রকম দু-চারজন কাকু আর বাবাও বেশ গম্ভীর হয়ে গল্প জুড়ে দিলেন মনে আছে। বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নাকি পাকিস্তান সেনারা যুদ্ধ বিমানে বোম্বিং করতে চেয়েছিলেন। পারেন নি,কারন আমাদের বায়ুসেনারা রাডারে ধরে ফেলেছে এবং সেই আক্রমণ বানচাল করে দিয়েছিলেন। হিলি সীমান্তে নাকি ভারতীয় সেনারা প্রচুর মার খেয়েছেন এবং মরেছেন খান-সেনাদের কাছে। বালুরঘাট থেকে খবর এসেছে, ওখানে পাক সেনাদের শেল এসে পড়ছে।কামানের গোলা। শিলিগুড়ি শহর নাকি পাকিস্তানের টার্গেট। ঐ বয়সে যুদ্ধের এইসব বর্ণনা শুনে-শুনে যুদ্ধ সম্বন্ধে একটা ভীতি জন্মে গেল। যা এখনও চলছে। দশকের পর দশক পেরোচ্ছি আমরা, যুদ্ধ নয় শান্তি চাই বলছি অথচ যুদ্ধ বিরত একটা মাসও পৃথিবী জুড়ে দেখলাম না। খবরের কাগজের হেড-লাইন হয়ে থাকে মানুষের আদিম হিংস্রতা শুধু।
শিলিগুড়ি শহরের গুরুত্ব কেন? জানলাম আরও একটু বড় হয়ে উঠে। এর চারিদিকে ছেয়ে রয়েছে একশোর ওপর আর্মি বেস-ক্যাম্প। রয়েছে বায়ুসেনার বড় ঘাঁটি। দু-দুটো বড় ক্যান্টনমেন্ট। একটি তো এখন প্রায় শহর ঘেঁষা। ১৯৬২- সালের চীনা আক্রমণের পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুজী যেমন এনজেপি স্টেশনের ( যা বলতে গেলে শিলিগুড়ি শহরের স্টেশন) জন্ম দিয়েছিলেন, তেমনি এই শহরটির সামরিক গুরুত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। আর একটা জন-বিস্ফোরন ঘটল এই শহরে তৎক্ষণাৎ।
'ওপারে যে বাঙলাদেশ, এপারে সেই বাঙলা-রে'!
সম্ভবত ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরীর এ ছড়ার লাইন স্মৃতি থেকে বললাম। আমাদের ছোটবেলায় আমাদের মুখে-মুখে একটি ছড়া খেলত খুব- 'ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা,বোয়াল মাছের দাঁড়ি।ইয়াইয়া খান ভিক্ষা করে, মুজিবরের বাড়ি।' আরও একটু বড় হয়ে তখনকার অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক খবরের কাগজ যুগান্তরের রোজনামতা কলামে পড়া একটি ছড়া উল্লেখ করবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না, এও সম্ভবত অমিতাভ চৌধুরীর হবে--- ' এ পারে জিয়া ওপারে জিয়া, মধ্যিখানে ইন্ডিয়া। ঢাকার জিয়া কান্দে, ক্যামনে যামু ইন্ডিয়া'। জিয়াউল হক তখন বাঙলাদেশের প্রেসিডেন্ট। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও মুহম্মদ জিয়াউল হক। শুধুমাত্র ছোট্ট একটি ছড়ায় কত ইতিহাস ভূগোল লুকিয়ে থাকে। বড় দুঃখের কথা আমার সেই সময়ের সংগৃহীত ছড়াগুলি একটি খাতায় সেঁটে রাখতাম।আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে হারিয়ে ফেলেছি।
ওদের বিজয় দিবস, আমাদের না। ওরা বলতে ওপারের বাঙালিদের। এই কথা শুনে কেউ-কেউ রে রে করে আসবেন। কিসের বাঙালি? ওরা তো হিন্দু না। এই ধর্ম আর জাতি-তত্ত্ব নিয়েই কেটে গেল সারাটা জীবন। যদি বলি টেস্ট-ক্রিকেটে তো একটা গোটা বাঙালিদের টিম আছে। এবারেও চারিদিকে হালুম-হুলুম শুনবেন। আমাদের বাঙলাটা কেটে যে দু-খণ্ড হয়েছিল সেই দুঃখ কী কখনও শুনেছেন আকাশে বাতাসে সব সময়। আমাদের শেকড় ওপড়ানোর গান। সেই ব্যথা থেকে এখনও আমি আমাদের পূর্ব পুরুষদের ভিটে-মাটি না দেখলেও বাঙলাদেশের বিজয় উৎসব মনে-মনে লালন করি,পালন করি। ওপারে যে বাঙলাদেশ, এপারে সেই বাঙলা-রে। একটা ভাষার জন্য একটা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন হয়েছে। যে ভাষায় আমি আপনি মনের কথা বলি আর এই লিখছিও। সেই দেশের জন্য একটু মাথানত করতেই হয়। পদ্মা- গঙ্গা-মেঘনা-যমুনা-তিস্তা-তোর্সা-মহানন্দা-জলঙ্গী-দামোদর-হলদী-রূপনারায়ণ যদি চেতনায় থাকে একটি দেশ, সে তো আমারই। ঈশ্বর পৃথিবী গড়েছেন, মানুষ দেশ গড়েছেন আপন খেয়াল মতন নিজের স্বার্থ-সিদ্ধিতে। এখনও নিরন্তর চলছে এ ভাঙ্গা-গড়ার খেলা।সারা পৃথিবী ভরে যাচ্ছে শরণার্থীতে। বল কোথায় আমার দেশ?
ফিরে আসি বিজয় দিবসে...
আমি বিজয় দিবসে খুঁজে বেড়াই সেই নাটোরের বনলতা সেনকে আর নাটোরের কাঁচাগোল্লা। স্বপ্ন ভাঙ্গে তখন,যখন চেতনায় ফিরে আসে বিজয় দিবস-- বাঙলাদেশ-ঢাকা-১৬-ই ডিসেম্বরের।
ওদিকেও যদি কিছু দুঃখ থাকে, এদিকেও তাই। মাঝখানে এক কাঁটাতারের বেড়া। পদ্মা আমার মা,গঙ্গা আমার মা।
দূরে কেউ শুনছে রাখালের বাঁশিতে-- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
---------------------------------------------------------------------
এই বিভাগে আপনিও মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে পারেন।
ankurishapatrika@gmail.com
----------------------------------------------------------------


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন