ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৩)
নেপথ্য সংগীতের আড়ালে
অনন্যা দাশ
৫.
জিকো-কেকা টিউশান থেকে ফিরে এসে দেখল বাইরের ঘরে একজন ভদ্রলোক বসে রয়েছেন।
জিকো ফিস্ফিস্ করে মাকে জিজ্ঞেস করল, “উনি কে মা?”
জানি না। সাগরের জন্যে অপেক্ষা করছেন।”
কেকা বলল, “ও মামা আজ এখানে আসবে বুঝি?”
কি জানি ওঁকে তো বলেছে আসবে। এই ঠিকানাও দিয়েছে”
জিকো জিভ কেটে বলল, “ও তোমাদের বলতে ভুলে গ্রেছি, মামা আমাকে ইমেল করেছিল। মামাদের ওখানে কি একটা
গণ্ডগোল হয়েছে, ফ্ল্যাটে জল আসছে না তাই মামা বলেছে আজ রাতটা এখানে থাকবে!”
জিকো! কি ভয়ানক দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে যাচ্ছ তুমি দিনকে দিন! নেহাত আমি বেশিবেশি করে রান্না করি, তা না হলে
আমাকে আবার রাঁধতে বসতে হত।”
জিকো ছুঁচোর মতন মুখ করে চুপিচুপি সরে পড়ল।
একটু পরেই মামা এসে পড়লেন। এসেই বললেন, “জিকো বাড়িতে ডেটল আছে?”
মা শুনতে পেয়ে বললেন, “থাকবে না আবার! ক্রিকেট খেলে তো রোজ হাঁত পা কেটে আসে তোর গুণধর ভাগ্নে। কিন্ত
তোর আবার কি হল?”
না তেমন কিছু নয়, হাতে একটু ঘষা লেগেছে। অটো থেকে সবে নেমেছি অমনি একটা রিকৃশা প্রায় ঘাড়ের উপর এসে
পড়ল!”
হঠাৎ মামার খেয়াল হল বাইরের ঘরে ওই ভদ্রলোক বসে রয়েছেন।
“ও আপনি এসে গেছেন! মাফ করবেন আমি খেয়াল করিনি।”
“না, না, ঠিক আছে আপনি হাত-সুখ ধুয়ে নিন। আমার তাড়া নেই।”
মামা হাত-মুখ ধুয়ে, অফিসের জামাকাপড় ছেড়ে পাজামা পাঞ্জাবি পরে হাতে ডেটল লাগিয়ে আসতে আসতে জিকো
ভদ্রলোকের সাথে গল্প জুড়ে দিল। যদিও উনি খুব একটা বেশি কথা বলছেন না তবুও জিকো জেনে ফেলেছে ওনার নাম বাণীব্রত সেন। অফিস পার্ক স্ট্রিটে আর বাড়ি গড়িয়াতে। মামা আসার সাথে সাথে মা চা নিয়ে এলেন।
“আমার নাম বাণীব্রত সেন। আমি নীলোৎপলের স্ত্রী সুরঞ্জনার প্রতিবেশী। নীলোৎপল বলছিল যে আপনি নাকি জয়পুর
যাচ্ছেন।”
“হ্যাঁ, আমার জামাইবাবু আমেরিকা থেকে আসছেন শীতের ছুটিতে তাই ওই. দিকটা একটু যাবো ভাবছিলাম। নীলোৎপল
আপনি আসবেন বলেছিল কিন্তু ঠিক কি কারণে সেটা বলেনি”
“ও !”
“আপনার কি দরকার বলুন।”
“আসলে কাজটা একটু বেয়ারা তাই আপনাকে বলতে একটু সংকোচ হচ্ছে। আপনার ছুটিটা কিছুটা মাটি হতে পারে।”
“আগে শুনি কি তারপর না হয় ঠিক করব।”
ভদ্রলোক মাটির দিকে তাকিয়ে শুরু করলেন, আমরা দুই ভাই, আমি বড়। ছোট ভাই প্রিয়ব্রত জয়পুরে পড়াশোনা করে।
আমাদের সচ্ছল অবস্থা তাই ওকে মাসে মাসে ভাল টাকাই পাঠানো হয়। সে হোস্টেলে বা মেসে থাকতে চায়নি, নিজে একটা
ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। ইদানীং ওর একটা সমস্যা হচ্ছে। সেই জন্যেই আপনার কাছে আসা।”
মামা টানটান হয়ে বসেছেন, মুখ থমথমে, “কি সমস্যা?”
ওই রকম যেচে গায়ে পড়ে কেস গছাতে আসা মামার ভীষণ অপছন্দ।
«একটা লোক ওকে ক্রমাগত ফোন করছে। মানে ফোন শুধু করছে বললে ভুল হবে, ফোন করে শাসাচ্ছে। প্রিয় নাকি কি
একটা ভুল করেছে সেটার প্রতিকার না করলে ওকে শান্তি পেতে হবে! প্রিয় তো ভীষণ ভয় পেয়েছে। প্রথমে ল্যাগুলাইনে ফোন আসছিল, ও ভয়ে ল্যান্ড লাইন কাটিয়ে দিতে এখন সেলফোনে আসছে। তাই ভয়ে সর্বক্ষণ সেলফোন বন্ধ করে রাখছিল কিন্ত তাতে আবার আমাদের সমস্যা হচ্ছিল, আমরা ওকে ধরতে পারছিলাম না। হুমকি ফোনগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন নম্বর থেকে আসে। আর ইদানীং কে যেন ওর পিছুও নিচ্ছে।”
“পুলিশের কাছে যাচ্ছে না কেন?”
“গিয়েছিল। ওরা পাত্তাই দেয়নি। কলেজে পড়া একটা জোয়ান ছেলে, তাকে কে ফোন করে শাসালো সেটা নিয়ে ওরা
মাথা ঘামাতে চায় না। ওদের আরো অনেক দরকারি কাজ আছে। কিন্ত প্রিয় তো ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। ও এমনিতেই একটু চাপা ছেলে। বন্ধুবান্ধবও বিশেষ নেই তাই আমরা বেশ চিন্তায় আছি।”
“ও, তা এ ব্যাপারে আমি কি করবো?”
“আমি ফোনে জয়পুরের পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি, ওরা বলছে প্রিয় নাকি সব কিছু বানিয়ে বলছে। ওটা ওর মনের
ভুল। এদিকে বাবার শরীরটা খারাপ তাই আমি জয়পুরে যেতে পারছি না। আপনি একটু গিয়ে যদি দেখেন ব্যাপারটা ঠিক কী
ঘটছে তাহলে আমি একটু শান্তি পাই। সত্যি যদি ওকে কেউ ফলো করে তাহলে আপনি পুলিশকে গিয়ে বলতে পারবেন।”
“যে ফোন করছে সে কি ভুল সেটা বলছে না?”
“না, সেটা একবারও বলছে না। সেটা নাকি ওকে ভেবে বার করে তাঁর প্রতিকার করতে হবে।”
“ও, বেশ অদ্ভুত ব্যাপার তো।”
“হ্যাঁ। বেচারার সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। মাস ছয়েক বেশ ভুগল পেটের অসুখে, তারপর এখন এই সব। জেরবার হয়ে
যাচ্ছে বেচারা। পড়াশোনা লাটে উঠছে। আপনার যা পারিশ্রমিক লাগে আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, শুধু প্রিয়কে একটু সাহায্য করুন, প্লীজ।”
“আগে আপনার ভাইয়ের সাথে দেখা করি তারপর পারিশ্রমিক নিয়ে ভাবা যাবে। আপনি ওর ঠিকানা আর ফোন নম্বরটা
আমাকে দিন, আমি ওখানে গিয়ে ওর সাথে দেখা করে নেবো।”
(৬)
প্লেনে করে যাওয়া হবে ঠিক হল কারণ বাবার হাতে বেশি সময় নেই। প্রথমে দিল্লি যাওয়া হবে। দিল্লিতে বড়পিসি থাকেন।
তার বাড়িতে একদিন থেকে তারপর ভলভো বাসে করে জয়পুরে যাওয়া হবে। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে উঠে অখিলবাবু যার পাশে বসলেন তিনি এয়ার হোস্টেসের কাছ থেকে জল নিতে গিয়ে দিলেন ওঁর গায়ে ফেলে। ঠাণ্ডা জলে জামা কাপড় ভিজে যেতে অখিলবাবু উফ্ফ করে উঠলেন। ভদ্রলোক অবশ্য তখন প্রচুর ক্ষমাটমা চাইলেন।
বললেন, “আমার নাম সুগ্রীব মিত্তল। কলকাতায় আমার একটা বিজনেস আছে। আসলে আমি খুব পরেশান, তাই কোনো
কাজ ঠিক মতন করতে পারছি না।”
অখিলবাবু সৌজন্যমূলক ভাবেই জিজ্ঞেস করলেন তিনি 'পরেশান' কেন। তাতে ভদ্রলোক যা বললেন সেটা শুনে অখিলবাবুর কান খাড়া হয়ে গেল। মামা জিকোর সঙ্গে বসেছিলেন। অখিলবাবু ডেকে বললেন, “সাগরবাবু শুনছেন? আপনি এখানে এসে বসলে মনে হয় ভাল হয়!”
সুগ্রীবজিকে বললেন, “সুগ্রীবজি আপনি আপনার 'পরেশান”হওয়ার কারণটা আমার বন্ধুকে আর একবার বলুন প্লিজ।”
মামা এসে পাশে বসতে ভদ্রলোক বললেন, “আমরা তিন ভাইবোন। আমি বড় তারপর আমার বোন সুমিত্রা আর
সবচেয়ে ছোটভাই অঙ্গদ। বাবার ব্যাবসাটা আমিই সামলাই। অঙ্গদের ব্যাবসায় মন নেই। বলছিল চাকরি করবে। সুমিত্রার বিয়ে হয়ে গেছে। সে জয়পুরে থাকে স্বামী আর দুটো বাচ্চাকে নিয়ে। অঙ্গদের কথা শুনে সুমিত্রার বর সুধীর ওর জন্যে জয়পুরে একটা চাকরি জোগাড় করে দিল। আহামরি কিছু নয় কিন্তু খাটতে পারলে উন্নতির সম্ভাবনা আছে। সুমিত্রা ওকে বলেছিল ওদের সঙ্গে থাকতে কিন্তু অঙ্গদ রাজি হয়নি। নিজের আলাদা ঘর ভাড়া করেছিল। এখন সুধীর বেশ বড়লোক বংশের ছেলে। ওদের বাড়ি থেকে বড়ছেলে হিসেবে ওর পূর্বপুরুষের একটা খুব দামি নীলা পেয়েছে। নাম নাকি নীলজ্যোতি। অত দামি জিনিস ওরা কখনই বাড়িতে রাখে না। ওটা লকারেই থাকে। কিন্তু যেদিন সুমিত্রা ওটাকে বার এনেছিল একটা বিয়েতে পরবে বলে, সেদিন রাতেই ওরা খবর পায় যে ইন্দোরে সুধীরের মা খুব অসুস্থ। তাই সব ফেলে ওখানে ছুটেছে আর নীলাটাকে লকারে রাখার সুযোগ পায়নি। অঙ্গদকে বলেছিল, 'তুই দিন দশেকের জন্যে ওটা কাছে রাখ, কিছু হবে না।' অঙ্গদ খুব ভয়ে ভয়ে সেটাকে নিয়েছিল। নেওয়ার পর থেকেই ওর মনে হয়েছে যে কেউ যেন ওর পিছু নিচ্ছে। সুমিত্রাকে ফোন করে ও সেটা বলেছিল। সুমিত্রা অবশ্য ওর মনের ভুল ভেবে পাত্তা দেয়নি। তারপর কাল রাতে অঙ্গদের উপর হামলা হয়। ঠিক কি হয়েছে জানি না কারণ ও এখনও বেহুঁশ, মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। অঙ্গদ হয়তো বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল। ওর বাড়ি তছনছ করা। সকালবেলা কাজের লোক এসে দরজা খোলা আর ভিতরে সব লণ্ডভণ্ড দেখে পাশের বাড়িতে বলে। তখন তারা ঢুকে দেখে ওর ওই অবস্থা। নীলজ্যোতি আছে কি নেই তাও জানি না। অঙ্গদ বাঁচবে কি বাঁচবে না সেটাও বুঝতে পারছি না। তাই আমি যাচ্ছি। কলকাতা থেকে জয়পুর ডাইরেক্ট ফ্লাইট পেলাম না সেই জন্যে দিল্লি হয়ে যাচ্ছি।”
“পুলিশ কি কাউকে সন্দেহ করছে? আপনাকে কিছু বলেছে?”
“হ্যাঁ, যে অফিসারের সঙ্গে আমার কথা হল তিনি বললেন, এটা মনে হচ্ছে কালনাগের কাজ।”
চলবে...
---------------------------------------------------------
এই ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাসটি প্রতি শুক্রবার অঙ্কুরীশা-র পাতায় প্রকাশিত। আপনারা পড়ুন ও পড়ান। মতামত জানান।
ankurishapatrika@gmail.com
----------------------------------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন