লেবেল

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

বুধবারের গল্প। স্নান— তপনজ্যোতি মাজি

 


গল্প


স্নান

তপনজ্যোতি মাজি


পাখিদের স্নান দেখেছিল অনির্বান বালকবেলায়। তখন সে ক্লাস নাইনের

ছাত্র। দুটো শ্বেত পায়রার স্নান। ওদের বাড়ির পাশে ছিল খেজুর পুকুর।

বেশ কয়টা খেজুর গাছ ছিল পাড়ে। লম্বা। জলের দিকে একটু বেঁকে 

আকাশমুখী। হয়তো এই জন্যেই পুকুরটার খেজুর পুকুর নামে পরিচিতি।

বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই স্নান দৃশ্য দেখেছিল অনির্বান। পুকুরের জল

মেখে  একটা পায়রা আর একটা পায়রার কাছে গিয়ে ডানা ঝাড়ছিলো। 

অন্যটাও তাই। এই যৌথ স্নানের ভঙ্গি দেখে মজা পেয়েছিল খুব। খেলাচ্ছলে

স্নান। ঠিক যেমন সকাল ইস্কুল ফেরত স্নানের সময় দুটো ছেলে পরস্পরের 

দিকে জলছোঁড়ে স্নানের সময়। 


পরে এই দৃশ্যের কথা রাজীবকে বলেছিল অনির্বান। রাজীব  ওর সঙ্গে এক 

ক্লাসে পড়লেও,একটু পাকা স্বভাবের ছিল।কত কি ঐ বয়সেই জানতো

রাজীব।কত রকম ব্যাখ্যা থাকত ওর সংগ্রহে। জীবন সম্মন্ধে জীবনবিজ্ঞান

বিষয়ের বাইরে গিয়ে কত যে তথ্য দিয়েছিল রাজীব , এখনও মনে পড়লে

হাসে অনির্বান। এরকম বন্ধু ইস্কুল কিংবা কলেজ জীবনে থাকেই। রাজীবের

সঙ্গে কতদিন দেখা হয়নি। হয়তো আর দেখা হবেনা কোনও দিন।তবু, মাঝে

মাঝে মনের জলে ঘাই দেয় এই সব বন্ধুরা। ও ঘটনা প্রসঙ্গ । জীবন বুঝি 

এরকমই।


এই যেমন আজ। রবিবার। ছুটির বাতাস বইছে মনে। জীবনের গতি আজ

মন্থর। হচ্ছে হবে।কোনও কিছুতেই তাড়া নেই।কাজগুলো সব লুকোচুরি 

খেলছে।সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠেছে।আর একটু ল্যাদ খাওয়ার ইচ্ছা

ছিল। উর্মি প্রায় জোর করে তুলেছে।


উর্মি , উর্মিমালা অনির্বানের জীবনে উজ্জ্বল আশ্রয়। উর্মিমালার নিখুঁত 

পরিচর্যায় গৃহের আরাম তার জীবনে সুনিশ্চিত হয়েছে উর্মিমালা সংসারে

 পা রাখার পর থেকেই। অনির্বানের মতো কর্মব্যস্ত মানুষের কাছে বাড়ি হলো নিশ্চিন্ত নির্ভরতা  ও আরামের ঠিকানা। সব মানুষের কাছে তাই। বাড়ির

পরিবেশ রচনা থেকে রসনা তৃপ্তি সবই উর্মিমালার সৌজন্যে। কর্ম ব্যস্ততার

মধ্যেও উর্মিমালার সাহচর্য অনির্বানকে ভরে রাখে।


সোফার সামনে টি-টেবিলে ছোট ট্রেতে দুকাপ লাল চা ও দুরকমের বিস্কিট

রেখে উর্মিমালা জলের বোতল ভরছিল ওয়াটার ফিল্টারে। ইতিমধ্যে 

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে পোশাক চেঞ্জ করে অনির্বান এসে বসেছে

সোফায়। পাজামা আর টি শার্ট। এখনো শীতের দেখা নেই এবছর। ভোরের

দিকে শীত শীত ভাব হলেও এখন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে উর্মিমালার 

কপালে। পাখাটা অন করে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। চা নিতে নিতে

সাংসারিক এবং সংসারকে বৃত্ত করে যে সম্পর্ক এবং মানুষজন সাধারণত

সে রকমই কথা হয়  এই চা পর্বে। আজ অবশ্য প্রসঙ্গ অন্য। দীর্ঘ করোনা

পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি হয়ে থাকা। কি রকম একটা অন্তরীণ অনুভুতি মন

ও শরীরে চেপে বসেছে। মুক্তি খুঁজছে মন ও শরীর এক সঙ্গে। সারা পৃথিবী

যেন কারাগার হয়ে গেছে।প্যারোলে মুক্তি পেয়ে কেউ কেউ একটু বাইরে 

বেরিয়েছে এই মাত্র।  দীর্ঘ লকডাউন , মাস্ক , স্যানিটাইজার সর্বোপরি 

আতঙ্ক মানুষকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। এখন যদিও আনলক

পর্ব শুরু হয়ে গেছে, দোকান বাজার খুলেছে,তবু স্বাভাবিক হতে কতদিন

লাগবে কে জানে!


উর্মিমালার মন চাইছে একটু মুক্তি। কাছাকাছি কোথাও। প্রকৃতি সান্নিধ্যে

কয়েকটা ঘন্টা। জাস্ট ফর এ চেঞ্জ। আজ চায়ের টেবিলে কথাটা বললো 

অনির্বানকে। বেড়ানোর কথা উঠলে, কাছে বা দূরে, অনির্বান সবসময়

উৎসাহী। আজও সেই স্পিরিটের ব্যতিক্রম হলো না। তবে , স্পট, ডেট 

এবং বাহন কি হবে,  এই সব ঠিক করার দায়িত্ব উর্মিমালাকে দিয়ে বাজারে যাওয়ার জন্যে চটপট রেডি হয়ে উর্মিমালার পাশে এসে দাঁড়াল। উর্মিমালা

চেয়ারে হেলান দিয়ে পা দুটো তুলে দিয়েছে সোফার ওপর। ফেসবুক খুলে আপডেটগুলো দেখে নিচ্ছে। 


কাল রাতের নীল হাউসকোটটাই পরে আছে উর্মিমালা। এক মুহূর্ত দেখলো নিঃশব্দে।অনেকদিন এরকম নিঃশব্দে উর্মিমালাকে দেখেনি অনির্বান। কাল

রাত দুটো নাগাদ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অনির্বানের। ঘুম ফিরে আসছিলনা 

কিছুতেই।এপাশ ওপাশ করলো কিছুক্ষন। উঠে জল খতে গেল ডাইনিংএ।

জানালার কাছে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েছিল। আকাশে ঘোর লাগা ম্লান 

জ্যোৎস্না। চাঁদের অলোর মধ্যে কেমন একটা আবেশ থাকে। নির্জন রাতে

এই আবেশ মন স্পর্শ করে। হৃদয়ে স্রোত অনুভব হয়। অনেকে প্রশ্ন,জিজ্ঞাসা

সামনে এসে দাঁড়ায়। শোয়ার ঘরে ফিরে এসেছিল অনির্বান। নীল আলোর 

হালকা পরশ বেড রুমে। সুসজ্জিত বেডরুম। প্লাই বোর্ড দিয়ে ফার্ণিশ 

করিয়েছে গতবছর। সে আর উর্মি মিলে রঙ পছন্দ করেছিল ক্যাটালগ

দেখে।


চোখ পড়ল ঘড়ির দিকে।চশমা না থাকলেও ডিজিটাল ওয়াল ক্লক বলছে

রাত্রি দুটা কুড়ি। ঘড়ি থেকে দৃষ্টি গেল খাটে। গভীর ঘুমে উর্মি। নিঃশ্বাস

নেওয়ার মৃদু শব্দ। চুল খোলা। মুখের এক দিকে নীল আলো পড়েছে।

খাটের ওপর বসল অনির্বান কোনও শব্দ না করে। নীল আলো স্নিগ্ধ

মায়া সৃষ্টি করেছে উর্মির ঘুমন্ত চোখে মুখে। কতদিন গভীর ভাবে আদর

করা হয়নি উর্মিকে। নিবিড় আদর পছন্দ করে উর্মি। উর্মিমালার ঘুমন্ত চোখে 

ও কপালে ওষ্ঠের আলতো স্পর্শ দিতে ইচ্ছা হলো। মুখ নেমে এলো 

অনির্বানের। নাকে মিষ্টি সুগন্ধ পেলো সে। উর্মির প্রিয় ডিও র হালকা সুবাস।

খুব সন্তর্পনে উর্মির কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়াল। পালক স্পর্শে উর্মিমালার নিদ্রিত

শরীর পাশ ফিরল। অনির্বান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। ভাবলো, তার ঘুম ভেঙে

গেছে, কিন্তু উর্মি ঘুমোচ্ছে। উর্মিমালা পাশ ফিরে শোয়ার জন্যে খোলা চুল 

ছড়িয়ে আছে বালিশের পাশে।অনির্বান বালিশে মাথা রাখলো। মনে হলো

জুঁই ফুল ফুটেছে কোথাও কাছাকাছি। খেয়াল করতে বুঝলো উর্মির

চুলের সুগন্ধ।একটু সরে সুগন্ধ নিতে থাকল।খুব ইচ্ছা করছে নিবিড় 

করে জড়িয়ে ধরতে। 


সুগন্ধ নিতে নিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল অনির্বানের মনে নেই।আজ 

সকালে যখন উর্মির ডাকে ঘুম ভেঙেছিল , আশ্চর্য লেগেছিল তার।

এখন উর্মিমালার পাশে দাঁড়িয়ে কাল রাতের ঘটনার কথা মনে হতে 

রক্তে ও স্নায়ুতে মৃদু স্রোত বয়ে গেল। মুহূর্তে নিজেকে বাস্তব বিন্দুতে

এনে উর্মিকে জিজ্ঞাসা করলো কি কি বাজার আনতে হবে, স্পেশাল কিছু

আনতে হবে কিনা। উর্মিমালা ফোন রেখে ফ্রিজের স্টোরেজ চেক করলো, 

ডিপ ফ্রিজে মাছের বক্স এবং কিচেনে ফলের ঝুড়ি, পেঁয়াজ,আদা,রসুনের

ঝুড়ি দেখে নিয়ে কি কি আনতে হবে বলে দিল অনির্বানকে। অনির্বান ব্যাগ

নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামছিল।আজ সে অন্য রবিবারের থেকে একটু লেট।

উর্মিমালা ডাকল , অনির্বান থেমে গিয়ে ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু চোখে

উর্মিমালার দিকে তাকালে, উর্মিমালা বলল, ফেরার সময় মোড়ের মিষ্টি

দোকান থেকে গরম কিছু নিয়ে আসবেতো। সম্মতি সূচক ইংগিত করে

অনির্বান পুনরায় পা বাড়াল বাজারের উদ্দ্যেশে।


অনির্বান বাজার যাওয়ার পর বন্দনা এলো। বন্দনা উর্মিমালার বহুদিনের

বাধ্য এবং বিশ্বস্ত হেল্পিং হ্যান্ড। বন্দনা কে নিয়ে ছাদে গিয়ে ছাদবাগানটা

একটু অন্যরকম করে সাজিয়ে নিল দ্রুত হাতে। কাল জল দিয়ে রেখে ছিল। 

একটু পেস্টিসাইড স্প্রে করতে হবে। পোকা এসেছে চন্দ্রমল্লিকা ও হাইব্রীড জবাগাছে। অনির্বানকে  আজ পেস্টিসাইড আনার কথা বলবে। বন্দনাকে 

বাকি কাজের কথা বুঝিয়ে নিচে এলো। স্নান করতে হবে। রান্নার চাপ নেই।

 দুপুরে পাড়ায় ঘরোয়া জন্মদিনের আমন্ত্রণ আছে। কোভিড১৯ এর সতর্কতা

 মেনে অনুষ্ঠান হচ্ছে এবং না গেলে খারাপ  দেখাবে , তাই যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।  গিজারের সুইচ অন করে ছাদে গিয়েছিল। প্রয়োজনীয় পোশাক নিয়ে স্নানঘরে ঢুকলো উর্মিমালা। একটু সময় নিয়ে স্নান করতে হবে। ট্যাপ থেকে জলপড়ার শব্দ শোনা গেল সঙ্গে মৃদু গলায় রবীন্দ্র গান।


বাজার থেকে ফিরে অনির্বান গান শুনতে পেল। স্নানঘরে গান। উর্মি গাইছে।

 ঝির ঝির জল তরঙ্গ। সম্ভবত শাওয়ার খোলা। কতক্ষন স্নানে গেছে উর্মি? 

 প্রশ্নটা মনে এলো। ভাবলো তার ফিরে আসার সংবাদ দেবে।পরক্ষনেই,

কাল রাতের সুন্দর ঘুমন্ত মুখটা মনে এলো। স্নান পর্ব একান্ত ব্যক্তিগত।

জলের প্রসাধন। গুন গুন সুর স্নানঘরের দরজা পার হয়ে হওয়ায় ভাসছে।

কোন সুদূর অতীতে ছোটবেলায় দেখা পাখির স্নান দৃশ্যের কথা মনে

পড়ল অনির্বানের। মনে হলো শাওয়ারের নিচে দেবী শরীর। এই সময়টুকু

উর্মির একান্ত ব্যক্তিগত।



----------------------------------------------------------------    

এই বিভাগে আপনিও আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা পাঠান। মতামত জানান। 

ankurishapatrika@gmai.. com

            

________________________________________


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন