দান
সৈয়দ আব্দুল মালিক
মূল ভাষা-অসমিয়া
ভাষান্তর –বাসুদেব দাস
এক কুড়ি বারো বছর বাড়ি থেকে দূরে রইলাম।জীবনের একটা প্রধান অংশ কয়লার খনিতেই গেল।অন্যের মেঝেতে আলো ফেলার জন্য,অন্য যাত্রীর যাতায়ত সুগম করার জন্য,সম্বন্ধ পাতলাম মাটির নিচের কালো কয়লার সঙ্গে,নিজের জীবন অন্ধকার করে,অচল করে।কয়লাখনি স্থবির পাহাড়টা দিয়ে জীবনটাও স্থবিরতাকে সঙ্গী করে নিয়েছে।দেড় কুড়ি দুই বছর।অর্থাৎ পুরো জীবনটা।
নিজের বাড়ি ফিরে এসে দেখলাম গ্রামের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে।অনেক অপরিচিত যুবক,অপরিচিত যুবক-বৃ্দ্ধে গ্রামটা ভরে উঠেছে।তাদের মধ্যে আমি পুরোপুরি বহিরাগত।
আগের পরিচিত অনেকেই নেই।আমার সমবয়সীদের মধ্যে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে।আগের ছেলেরা আধবয়সী হয়েছে,আগের আধাবয়সীরা বুড়ো হয়ে মরেছে।অনেক পুরোনো বাড়ির জায়গায় নতুন বাড়ি হয়েছে।কালের কীর্তি।
খবর নিয়ে জানলাম রাজীবলোচন এখনও বেঁচে আছে।রাজীব্লোচন ছিলেন আমার চেয়ে তেরো বছরের বড়।আমার বয়স এখন বাহান্ন বছর।রাজীবলোচনের বয়স তাহলে ৬৫ বছর হবে।সেই সময়ের সুগঠিত যুবক,বলিষ্ঠ রাজীব আজ তিন কুড়ি পাঁচ বছরের বুড়ো।মনটা খারাপ হয়ে গেল।
রাজীবরা পাঁচ ভাই।মেয়ে তিনটি।পরিবারের মধ্যে রাজীবই বড়।মানুষগুলো খুব দুঃখী ছিল।রাজীবের যখন আঠারো বছর বয়স তখনই তার পিতার মৃত্যু হয়,কোনোমতে প্রবেশিকা পাশ করে যেখানে যেভাবে পারল বোনেদের বিয়ে দিয়ে দিল।তারপর শুরু হল ভাইদের পড়ানোর গুরু দায়িত্ব।ছোট ভাইয়ের যখন দেড় বছর তখনই পিতার মৃত্যু হয়।সে তার চেয়ে ষোল বছরের বড়।একটা বড় পরিবারের সেই আঠারো বছরের রাজীব হল বাড়ির অভিভাবক।তাকে ঘিরে ছিল তখন নিদারুণ দারিদ্র।
শুনতে পেলাম আজকাল রাজীবের অবস্থা বেশ ভালো।আজকাল রাজীব কিছুই করে না।বাগানে কেরানির কাজটাও আজ থেকে কয়েকবছর আগে ছেড়ে দিয়েছে।এখন রাজীব বাড়িতেই থাকে।প্রতিটি ভাই ভালো কাজ করে।তারাই রাজীবকে টাকা পয়সা কাপড় চোপড় দিয়ে সব সময় সাহায্য করে।রাজীবের কোনো কিছুর জন্যই চিন্তা করতে হয় না।
মাঘের শেষ।ফুরফুরে বাতাস বইছিল।বুড়ো দেহে এমনিতেই ঠান্ডা বেশি লাগে।গরম কাপড়ে নিজেকে ঢেকেঢুকে নিয়ে রাজীবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।আজ বহু বছর রাজীবকে দেখিনি,হ্যাঁ বহু বছর।
তখন সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে।
গনগনে আগুনের পাশে একটা পুরোনো বেতের চেয়ারে রাজীব বসে ছিল।আমি ভেতরে চলে এলাম।
‘তুমি এসেছ বলে শুনেছি।তবে দেখা করতে যেতে পারিনি,শরীরটা ভালো নয়।ওখানে বস।’
রাজীবের চুল দাড়ি সব পেকে সাদা হয়ে গেছে।গালদুটোর চামড়া কুঁচকে গেছে।চোখে চশমা।এই বার্ধক্য যেন স্বাভাবিক নয়,অকাল।
আমরা বসে অনেক কথা বললাম।ছোটবেলার কথা।যৌবনের কথা।তারপর এখন বয়স কালের কথা।রাজীবের সমস্ত কিছুই মনে আছে।
তারপরে একেবারে অপ্রয়োজনীয় যদিও আমি রাজীব সারা জীবনে কেন বিয়ে করল না সে কথা জিজ্ঞেস করলাম।জানি,পঁয়ষট্টি বছরে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কোনো মানে হয় না,তবু জিজ্ঞেস করলাম।
শুকনো ঠোঁট দুটিতে পাতলা হাসি ফুটিয়ে রাজীব আমার দিকে তাকাল।রাজীবের মুখটা যেন বড় ক্লান্ত।ধীরে ধীরে রাজীব বলল,‘বিয়ে করার সময়ই হল না।’
আমি স্বাভাবিক কৌ্তূহল নিয়ে রাজীবের চোখের দিকে তাকালাম।
রাজীব বুঝতে পারল যে আমি তার কথা ভালো বুঝতে পারিনি।আগুনটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে রাজীব বলল,সত্যিই সময় পাইনি।বাবার মৃত্যুর পরে বোনেদের বিয়ে দেবার কথা এবং ভাইদের মানুষ করার কথা প্রথম মাথায় এল।বাবা যে ঋণ করে গিয়েছিলেন সে সবও শোধ করতে হল।বোনেদের বিয়ে দিতে দিতে দশ বছর পার হয়ে গেল।তখন ছোট ভাই পাঠশালা স্কুলে।তারপর ভাইদের খরচ-পত্র জুগিয়ে পড়াশোনা করালাম।অনেক কষ্ট হল।তখন বাগানে কেরানির কাজ করে আট টাকা পাই।ভাতও জুটে না।ওদের কাপড় চোপড়,ফীস সমস্ত দিতে হয়।এর মধ্যে মায়ের মৃত্যু হল।দাহের কাজ,শ্রাদ্ধানুষ্ঠান আদিতে আরও ভালোরকমই ধার হল।তারপরে-- কপাল ভালো,ভাইগুলো পড়াশোনায় ভালো ছিল—ছোট ভাই বিএ পরীক্ষা দিল,তখন ঘুরে তাকিয়ে দেখি,আমি চল্লিশের কোঠায় পা রেখেছি।
দুই কুড়ি বছরে আর মানুষের নিজের জন্য ভাবার আগ্রহ থাকে না।সেইজন্য আমি ভাইদের বিয়ে দেওয়ায় হাত দিলাম।নিজে আর বিয়ে করার সময় হল না…।
রাজীব কথাটা সাধারণভাবেই বলল।যেন এই পুরো কথা বার্তাটাই একেবারে স্বাভাবিক।
‘আচ্ছা,আজকাল ভাইয়েরা টাকা পয়সা পাঠায়।নয় কি?’
‘কেউ কেউ পাঠায়।বড়টার নাম ছিল মুনচুপ।এখন জেলার হাকিম হয়েছে।তার পরেরটা শিলঙে কাজ করে।এটা স্কুলের মাস্টার এবং ছোটটি ডাক্তার।প্রত্যেকেই টাকা পাঠায়।’
‘হোক হোক এই বুড়ো বয়সে যে টাকাগুলো দিচ্ছে,সেটা সুখের কথা।তা নাহলে আজকাল চলাই মুশকিল’-আমি বললাম।যাই হোক রাজীবের ত্যাগ সার্থক হয়েছে।সবগুলো ভাই বড় মানুষ হয়েছে।
রাজীব কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইল।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,‘কিন্তু ওদের ভালোভাবে থাকতে দেখে আমার যেমন ভালো লাগে মাঝে মধ্যে তে্মনই খারাপ ও লাগে।’
‘কেন?’আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘ভাইগুলো,ওরা অকৃ্তজ্ঞ নয়।’ওরা আমাকে যথেষ্ট টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করে।আমার জন্য খরচ করতেই থাকে…’
‘তাহলে?’
‘কিন্তু ওদের মানুষ করে তোলার জন্য আমি কেবল আমার অর্জিত টাকা-পয়সাই দিইনি।’ ‘আর কী দিয়েছিলে?’আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘যে টাকা পয়সা ওদের জন্য খরচ করেছিলাম সেটা ওরা ফিরিয়ে দিতে পারে।অনেক বেশি দিয়েছেও।কিন্তু আমার নিজের যে জিনিসটা দিলাম,সেটা ওরা আর আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।কেউ পারবে না।’
রাজীবের কথাগুলো আমি বুঝতে পারলাম না।আমি তার চোখের দিকে তাকালাম।
‘ও আমি ওদের কি দিয়েছি বুঝতে পারছিস না তাই না?’কি দিলাম জানিস--? দিলাম আমার যৌবন,আমার যৌবনের দিনগুলো।ওরা কি আমাকে আর আমার যৌবনের দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে?’
মরণের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আজ রাজীব হারিয়ে যাওয়া যৌবনের কথা ভাবছে।সত্যি,সবগুলো ভাই মিলেও আর তার একটা দিনও ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
মনটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম।গনগনে আগুনটা নিভে ছাই হয়ে আসছে।
রাজীব কয়েকটা নতুন খড়ি আগুনের মধ্যে গুঁজে দিল।
---------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতিঃ অসমিয়া কথা সাহিত্যের অন্যতম রূপকার সৈয়দ আব্দুল মালিক ১৯১৯ সনে অসমের শিবসাগর জেলার নাহরণিতে জন্মগ্রহণ করেন।যোরহাট সরকারি হাইস্কুল থেকে পাশ করে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ করেন।পরবর্তীকালে যোরহাট জেবি কলেজে অধ্যাপনা করেন।লেখকের গল্প সংকলন গুলির মধ্যে ‘পরশমণি’,শিখরে শিখরে’,শুকনো পাপড়ি’বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।‘অঘরী আত্মার কাহিনী’উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
----------------------------------------------------------------
এই বিভাগে আপনিও মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা পাঠান। মতামত জানান।
ankurishapatrika@gmail. com
---------------------------------------------------------------------

ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন