বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২০

ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৩)।। অষ্টভুজ রহস্য —অলোক চট্টোপাধ্যায়

 


ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৩) 

অষ্টভুজ রহস্য

অলোক চট্টোপাধ্যায়   


রিকশা রওনা হল। অন্ধকার নেমে আসছে চারদিকে। বাড়িটাতে কি ঢুকতে পারবেন শেষ পর্যন্ত? আশা নিরাশার টানাপোড়েন চলছিল বিজয়বাবুর মনের মধ্যে। একটা অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করছিলেন মনের মধ্যে। সেই ছেলেবেলার স্মৃতির একটু খানিক স্পর্শ কি পাবেন?

খুব ছোটোবেলা্র কথা মনে পড়ে। বেলেঘাটায় নিজেদের বাড়ি ছিল তাদের। বাবা, মা আর তারা তিন ভাই। তিনি বড়। মা ছিলেন কদমফুলির বিশ্বনাথ চৌধুরির একমাত্র সন্তান। নাম করা ব্যবসায়ী। তেলের ঘানি, মাছের ভেড়ি, তাছাড়া বিশাল ফলের বাগান। ফলবাগানের লাগোয়া মস্ত বাড়ি। স্কুলের ছুটিতে সবাই মিলে দাদু-দিদিমার কাছে আসা হত নিয়মিত ভাবে। বাবা অবশ্য দু একদিন থেকেই ফিরে যেতেন। তার ছিল ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা। আরো দুই পার্টনারের সঙ্গে। বেশি দিন বাইরে কাটাবার উপায় ছিলনা। তিনভাই মায়ের সঙ্গে ছুটির মাসখানেক কাটাত দাদুদের গ্রামে। সে বড় মায়াময় স্মৃতি। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে গাছে চড়া, ডাংগুলি খেলা, মাঠে জঙ্গলে টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। ছেলেবেলায় সাঁতার শেখাও বিদ্যেধরীর খালে। একদম বাড়ির পেছন দিক দিয়েই বয়ে যেত খালটা। নিজস্ব ঘাটও ছিল। সেসব ব্যাপারে দাদুর বিশেষ আপত্তিও ছিলনা। সন্ধ্যেবেলায় একটুখানি পড়তে বসা। তারপর দাদুর সঙ্গে আটকোনা বাইরের ঘরে বসে গল্প শোনা। রবিনসন ক্রুশো, জাঙ্গল বুক, চাঁদের পাহাড়। ছোটোভাই অজয় অবশ্য তখন মা’র কোলে। কাঠের ফ্রেমে ক্যানভাস লাগানো মস্ত ইজিচেয়ারে বসতেন দাদু। ঘাড়ের কাছে তারা বসে অধীর আগ্রহে শুনত দেশ বিদেশের কত গল্প। রাতে মা আর দিদিমার সঙ্গে বিশাল তক্তপোশের ওওর ঢালা বিছানায় শোওয়া। দিদিমাও ঘুমোনোর আগে শোনাতেন রূপকথার গল্প। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি, রাক্ষোস- খোক্কোস, পরী আর রাজকুমারদের গল্প। কিন্তু সলতে কমানো হ্যারিকেনের আবছা আলোয় সেগুলোও কেমন যেন সত্যি মনে হত। এতই ভাল লাগত ওদের মনে হত এখানেই তো থেকে গেলে হয়। মাকে সেকথা বললে মা হাসত। -পড়াশুনো করে বড় হবার ইচ্ছে নেই নাকি? আর দিদিমা নিঃশ্বাস ফেলে বলতেন –আমাদেরও তো ইচ্ছে করে দাদুভাই তোমাদের এখানেই রেখে দিই। কিন্তু উপায় যে নেই।

সে উপায়ও একদিন একদিন সত্যি সত্যি হয়ে গেল। এমন ভাবে হল, সে রকম কেউ ভাবেনি,   কেউ চায়ওনি।

বিজয়বাবুর বয়স যখন আট সেই সময়ে পার্টনারদের চক্রান্তে তাদের ব্যবসাতে নামল বিপর্য্যয়। তখন না বুঝলেও পরে বড়দের মুখে সেসব কথা শুনেছিলেন বিজয়বাবু। ব্যাঙ্কের দেনা শোধ করতে তাদের বেলেঘাটার বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল। ছোট্টো একটা ভাড়াবাড়িতে চলে যেতে হল তাদের। সে ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই মাত্র তিনদিন জ্বরে ভুগে মারা গেলেন তাদের মা। দাদু দিদিমা খবর শুনে ছুটে এলেন। দিদিমা থেকেও গেলেন কিছুদিন। মা মরা ছেলেগুলোকে কে দেখবে। তারপর ঠিক হল ওরা তিন ভাই দাদুর বাড়িতে গিয়ে থাকবে। গ্রামের স্কুলে পড়বে। একদিন দাদু গিয়ে ওদের নিয়ে এল গ্রামে। ফুলবেড়িয়ার ইস্কুলে ভর্তি হল বিজয় আর সুজয়, যথাক্রমে ক্লাস থ্রি আর ওয়ানে। অজয়ের তখন বছর তিনেক।তবে সেও পরে ঐ স্কুলেই ভর্তি  হয়।

সেই থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা অবধি কদমফুলিতেই কেটেছে বিজয়বাবুর। মা’র শোক ভুলতে সময় লেগেছিল। বাবা আসতেন প্রতি সপ্তাহের শেষে। ভেঙে পড়া মানুষটা তখন একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। শ্বশুরের সহযোগিতাও ছিল হয়ত। শেষ পর্যন্ত আবার আগের ব্যবসা দাঁড় করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। সেই ব্যবসাই এখনও চালিয়ে যাচ্ছে তার দুই ভাই সুজয় আর অজয়।

মাধ্যমিক পরিক্ষায় নজর কাড়া নম্বর নিয়ে পাশ করার পর বিজয়বাবু চলে আসেন কলকাতায়। ভাল স্কুলে ভর্তি করা হয় তাকে। তাদের নতুন বাড়ি তখন তৈরি হচ্ছে সল্ট লেকে। কথা ছিল সুজয় আর অজয়ও মাধ্যমিক পর্যন্ত গ্রামে থেকেই পড়বে। কিন্তু বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে বছর দুয়েকের ভেতর তাদের বাবা ছোটো দুই ছেলেকেও কলকাতায় নিয়ে আসেন। আসলে তাদের দাদুরও বয়স বাড়ছিল। সব দিকে আর আগের মত খেয়াল রাখতে পারেন না সেই সুযোগে সুজয় একটু বিগড়ে যাচ্ছিল।বাড়ির পুরোনো কাজের লোক সুবলদা’র ছোটোছেলে বিমল তার সমবয়সি। দুজনে আরো কিছু সঙ্গীসাথী জুটিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। নেশাভাংও করত সম্ভবত। স্কুলের পরিক্ষায় একবার ফেল করে বছর নষ্টও করেছিল। ব্যাপার দেখে দুই ছেলেকেই কলকাতায় নিয়ে এসে স্কুলে ভর্তি করে দেন তাদের বাবা। সুজয় অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়েছিল। তবে পড়াশুনা বেশিদুর এগোয়নি। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে একটা কলেজে নাম লিখিয়ে বাবার ব্যবসাতে ঢুকে পড়ে। ছোটোভাই অজয়ও তাই, তবে গ্রাজুয়েশনের পর।

সাইকেল রিকশা চলেছে গ্রামের সরু সরু রাস্তা দিয়ে বাঁক ঘুরতে ঘুরতে। বিজয়বাবু অবাক চোখে দেখছেন সবকিছু কেমন বদলে গেছে।  আগে দাদুর বাড়িটা ছাড়া আর তিনটে মাত্র পাকাবাড়ি ছিল। এখন মাটির বাড়িই দেখা যাচ্ছেনা, থাকলেও আছে হয়ত ভেতরের দিকে। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছেনা। এই ক’বছরে অন্তত দশগুণ বেড়ে গেছে গ্রামটা। রাস্তাগুলো কিছুই চিনতে পারছেন না। ছেলেটাকে বলেছিলেন পুরোনো কাঠের পুলের রাস্তাটা এলে দেখাতে। সে জানিয়েছে সেটা একেবারে অন্যদিকে, দেখাতে গেলে অনেক ঘুরতে হবে। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়েছেন বিজয়বাবু। এদিকে অন্ধকারও নেমে এসেছে বেশ। তিনি বেশ চিন্তায় পড়লেন। যাবেন, না ফিরে যাবেন?

ছেলেটা একবার রিকশা থামিয়ে পাশের একটা চায়ের দোকানে ঢুকল। সম্ভবত চৌধুরি বাড়ির খোঁজ করতেই। ফিরে এসে শ’ খানেক মিটার এগিয়েই ডান দিক ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে দিল রিকশা।

একদম ফাঁকা জায়গাটা। দূরে চায়ের দোকান আর কয়েকটা ছোটোখাটো দোকানের আলো অবশ্য দেখা 

যাচ্ছে। ডানদিকে একটা মাটির রাস্তা ঢুকে গেছে। অন্ধকারের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে দুটো পিলারে লাগানো ভারি লোহার গ্রীলের গেট। ভেতরে গাছপালার জন্যেই বোধহয় অন্ধকারটা বেশ গাঢ়। ছেলেটা রিকশা ঘোরাচ্ছিল। বিজয়বাবু তাকে বললেন - একটু দাঁড়িয়ে যাও ভাই। আমি এক্ষুনিই ফিরব।

ছেলেটা জানাল সে ঐ চায়ের দোকানেই থাকবে । তবে দেরি হলেও অসুবিধে হবেনা। সওয়ারি পেয়ে সে চলে গেলেও রাত আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত ওখানে দু একটা রিকশা থাকেই। বিজয়বাবু মোবাইলের টর্চের আলো জ্বেলে গলির ভেতর পা বাড়ালেন। অন্ধকারে বেশিদুর আলো পৌঁছোচ্ছে না । তারই মধ্যে পুরোনো স্মৃতির সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি।

গলি পথটা মোটামুটি পরিষ্কারই। গেটটাও তো ঠিকই আছে। পিলারগুলোও দিব্যি আস্ত। বিজয়বাবু বেশ অবাক হয়ে গেলেন। সুজয় তো বলেছিল একদম ভাঙাচোরা দশা হয়েছে বাড়িটার। গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে বাড়ির গায়ে টর্চের আলো ফেলে মনে হল সেটাতেও ভেঙে পড়ার কোনো চিহ্ণ নেই। আশ্চর্য। ভুল জায়গায় এসে গেছেন নাকি? নাঃ, তা কি করে হবে ঐতো সামনেই অষ্টভুজ বাইরের ঘরটা। বাগান আর ঝোপঝাড়গুলো যদিও অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছেনা। কিন্তু নুড়ি বিছোনো রাস্তাটা তো একই রকম আছে। 

গেটটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই হঠাৎ যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। গা-টা শিরশির করে উঠল তার। একটু এগিয়েই দেখলেন সামনের ঘরের দেওয়ালটাও ভাঙাচোরা প্লাস্টার খসা নয়। জানলাগুলো বন্ধ বটে কিন্তু দেখে মনে হচ্ছেনা সেগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। বিজয়বাবু মন্ত্রমুগ্ধের মত পায়েপায়ে এগিয়ে গেলেন ঘরের সামনের সিঁড়ির দিকে। ধীর পায়ে চারটে ধাপ উঠে দাঁড়ালেন রোয়াকের ওপর। আর তক্ষুনি তাকে ভীষণ চমকে দিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে ঝুলে গেল সামনের ঘরের দরজার পাল্লাদুটো।

সামনে ওকে লন্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে। মূহুর্তের জন্যে বিজয়বাবুর মনে হল যেন সুবলদা। উত্তেজনায় বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল তার। সুবলদা অপঘাতে মারা গেছে কত দিন হল।

-বড় দাদাবাবু এলেন? সসম্ভ্রমে বলল লোকটা। - আসুন আসুন, ভেতরে আসুন –

আচ্ছন্নের মত ঘরে ঢুকলেন বিজয়বাবু। গলাটা জোর করে স্বাভাবিক করে বললেন – আলো নেই নাকি? বাইরের দোকানগুলোতে তো বেশ আলো জ্বলছে দেখলাম।

-ভেতরের কোনো গোলমাল হবে। লোকটা মাথা নাড়ল। -কাল মিস্ত্রী ডাকতে হবে।

টর্চের আলোটা একবার চারদিকে ঘুরিয়ে নিভিয়ে দিলেন বিজয়বাবু। ব্যাটারির চার্জ চলে গেলে বিপদ হবে। কিন্তু এরই মধ্যে যেটুকু দেখলেন তাতেই তিনি হতবাক। কোত্থাও ভাঙ্গা-চোরা, ঝুল ময়লা নেই। আসবাবপত্রও রয়েছে বেশ কিছু একটা সোফা সেট, পুরোনো ইজিচেয়ারগুলোর ভেতর দুটো রয়েছে। চারটে ছিল ওরকম। তিনটেতে তিন ভাই আর অন্যটায় দাদু বসে দুপুর বেলায় গল্প করতেন।দেওয়ালে ঝুলছে কয়েকটা বাঁধানো ছবি। একটা তিনি খুব চেনেন, যামিনী রায়ের আঁকা গণেশ জননীর প্রিন্ট। ঘরের বাঁ দিকের অংশে একটা সাদা চাদর ঢাকা তক্তপোশ। ঠিক যেন জীবনদাদুর সেরেস্তা। কি আশ্চর্য, সবই তো আগের মতই রয়েছে। তবে কি তিনি ভুল দেখছেন? নাকি কোনো মন্ত্রবলে পৌঁছে গেছেন পঁচিশ বছর আগের চৌধুরি বাড়ির অষ্টভুজ বাইরের ঘরে? এক্ষুনি বুঝি ভেতরের দরজা খুলে ধবধবে সাদা ধুতি আর ফতুয়া পরা বিশ্বনাথ চৌধুরি এসে ঢুকে বলবেন – আরে, কাল্টু যে? কখন এলি? একটা খবর দিস নি কেন?



ক্রমশ...



--------------------------------------------------------------------------------

প্রতি বৃহস্পতিবার এই ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস টি অঙ্কুরীশা-র পাতায় ক্লিক করে পড়ুন ও পড়ান।



https://wwwankurisha.blogspot.com/2020/11/blog-post_10.html



---------------------------------------------------------------------------------


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন