লেবেল

মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২০

ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস (সপ্তম পর্ব) একটি মার্ডার:এবং তারপর... । সৈয়দ রেজাউল করিম

 



ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস  (সপ্তম পর্ব) 

একটি মার্ডার:এবং তারপর... 

 সৈয়দ রেজাউল করিম

 

 

          রাত্রে হাওড়া জি.আর.পি. থানাতে ফিরে একদফা ভালো করে রত্নেশ্বরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন মেজ বাবু। দু' চার ঘা বাড়িও মারলেন তার পিঠে । কিন্তু সে কিছুতেই স্বীকার করল না, মানস মিত্রের হত্যার ব্যাপারে সে কিছু জানে। সকালে থানায় এসে আরেক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করতে বসলেন মেজবাবু । ঠিক সেইসময়ে একটা সোর্স এসে হাজির হল সেখানে। বাইরে দাঁড়িয়ে ইশারায় মেজবাবুকে ডাকল। জ্যোতিষ বাবুর সাথে চোখাচোখি হলো তার। সিগারেট খাবার নাম করে জ্যোতিষ বার হলেন থানা ছেড়ে। নিভৃতে একপাশে দাঁড়িয়েছিল সে। মেজবাবু কাছে যেতেই সে নিচু গলায় বলল-- ওই আসামীকে আমি চিনতে পারছি। ওর নাম ধাম আমি কিছু জানিনা। তবে জানি, ও হকারি করে। ওর সাথে চোরেদের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। তাদের কথামতো যাত্রীদের চায়ের পেয়ালায় ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। ওকে একটু চাপ দিলে, সব কথা স্বীকার করবে বলে আমার বিশ্বাস।

          ‎এ কথা বলে সোর্স চলে গেল তার কাজে। থানায় ফিরে রত্নেশ্বরকে ধরে বসলেন মেজবাবু। ভয় দেখালেন পিঠে লাঠি ভাঙ্গার। অবশেষে রত্নেশ্বর স্বীকার করে নিল সে ব্যাপারে জড়িত। এক এক করে বাকি চোরেদের নামধাম সে বলে দিল। মানস মিত্রের হত্যা কেস তখন মাথায় উঠল। যতীন দারোগার নির্দেশে আসামীকে সাথে নিয়ে সিভিল পোশাকে দলবলসহ বেরিয়ে পড়লেন মেজবাবু। পাঁচ জন আসামী এবং যাত্রীদের মালামাল উদ্ধার করে যখন থানায় ফিরলেন তখন রাত সাড়ে বারোটা।

          ‎চোর ধরা, মালামাল উদ্ধার করা, নিঃসন্দেহে পুলিশ প্রশাসনের একটা গর্বের কাজ। জনগণের একটা আস্থা, একটা বিশ্বাসের জায়গা। অপরাধীরা অপরাধ করার আগে যেন দশবার ভাবে, অপরাধ করবে কি না ? এগুলো তার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে সরকারের মান মর্যাদা যেমন বাড়ে, তেমন মানুষের মনে অপরাধ করার প্রবণতা কমে। এই কাজের জন্য পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পদাধিকারীরা জুনিয়ারদের বিভিন্ন পুরস্কারে পুরস্কৃত করেন। তাতে একটা আনন্দের হয়ে যায় জুনিয়রদের মনে। কিন্তু মেজবাবুর মনে সেই আনন্দটুকু যেন উধাও। মন তার পড়ে আছে মানস মিত্রের হত্যারহস্য কেসে। বড়সাহেব কত আশা করে ফোন করেছিলেন তাকে, এ কেসটা উদ্ধার করে দাও জ্যোতিষ! তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন-- কিচ্ছু ভাববেন না স্যার ! পাঁচ-ছ'টা দিন আমাকে সময় দিন, এর মধ্যে আমি ডিটেকশন করে দেব। কিন্তু ছ'দিন গড়িয়ে গেল, এখনো সামান্য কিছু সূত্র মিলল না।

          ‎জ্যোতিষ বাবু মনে মনে ভাবতে থাকেন, দুটো বছর হাওড়া থানাতে কাটতে চলেছে তার। কিন্তু দিনদুপুরে এরকম কান্ড ঘটতে দেখেনি কখনো। হাঁ, আত্মহত্যার জন্য অনেকেই ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়েছে, ট্রেনের তলায় জীবন দিয়েছে। অসাবধান বশতঃ ট্রেন থেকে পড়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু মেরে ফেলবে বলে এভাবে ট্রেন থেকে কাউকে ফেলে দিতে দেখেননি তিনি। কিন্তু কী কারণে তাকে এভাবে হত্যা করা হল ? সে প্রশ্নের কোন যুতসই উত্তর ছিল না তার কাছে। আর এই সাদামাটা প্রশ্নের সঠিক জবাব না মিললে কেসটা ডিটেকশন হবে না। আর কেসটা ডিটেকশন না হলে, সাহেবদের কাছে অনেক কথা শুনতে হবে। অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে। অপরাধী অপরাধ করেও বেঁচে যাবে দন্ডের হাত থেকে। ভাবতে ভাবতে মনটা খুব বিষন্ন হয়ে উঠল মেজবাবুর । তার মনে হল, ঈশ্বর যদি সহায় না হন, তাহলে হয়তো অধরাই থেকে যাবে কেস ডিটেকশন।

          ‎বড় সাহেবের কাছ থেকে ফিরে এসে অফিসে ঢুকে যতীন দারোগা দেখতে পেলেন, মেজবাবু গালে হাত দিয়ে বিষন্ন মনে কি সব ভাবছেন। যতীন দারোগাকে দেখে, তার প্রতি সম্মান জানাতে জুনিয়ররা সব উঠে দাঁড়াল। মেজবাবু তখনো চুপচাপ মাথা নিচু করে কি সব ভাবছিলেন। যতীন দারোগা নিজের চেম্বারে ঢুকে মেজবাবুকে ডেকে নিলেন। অর্ডারলি দু'কাপ চা-বিস্কুট দিয়ে গেল তাদের সামনে। গরম চায়ের পেয়ালায় আমেজে চুমুক দিয়ে জ্যোতিষ বাবুকে উদ্দেশ্য করে যতীন দারোগা জিজ্ঞাসা করলেন-- বসে বসে কি এত ভাবছেন ? চোখে মুখে কিসের এত বিষন্নতা ?

          ‎জ্যোতিষ বাবু বললেন-- কি বলবো স্যার ! বড় চিন্তায় আছি। মানস হত্যার কেসটা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছে। কেসটা বোধহয় আর ডিটেকশন হবে না। অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন সূত্র খুঁজে পাচ্ছিনা।

          ‎-- ওহ ! তাই বলো। আমি ভাবছিলাম বাড়ির কোন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। হাল্কা রসিকতার সুরে যতীন দারোগা বললেন-- কিন্তু মেজোবাবু! আঁধারে হাতড়ে ফিরলে তদন্তে কিছুই মিলবে না। ভালো ডাক্তারের মতো উপসর্গ দেখে রোগ নির্ণয় করতে হবে। সেই মতো ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে রোগ সারবে। উপশম হবে।

          ‎জ্যোতিষ বাবু বললেন-- হেঁয়ালি রাখুন স্যার ! খোলসা করে বলে দিন, আমাকে কি করতে হবে ? আমি আপ্রান চেষ্টা করব কেসটা ডিটেকশন করতে। শুধু পথটা বাতলে দিন স্যার !

          ‎-- পথ আপনার সব জানা মেজোবাবু ! যতীন দারোগা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললেন-- এতদিন ধরে তদন্ত করছেন, এত আসামি ধরে আনছেন, তা কি এমনি এমনি ? মন্ত্রবলে ? তবুও যখন শুনতে চাইছেন তখন বলছি। মন দিয়ে শুনুন। আমরা যদি মৃতের কাছ জানতে চাই কে তোমাকে হত্যা করেছে ? সে বলে দেবে হত্যাকারী কে ? একটা অপরিচিত, আনআইডেন্টিফায়েড ডেডবডি যখন বলে দিয়েছে তার নাম মানস মিত্র, সে বাগনানের সুমতি কোচিং সেন্টার থেকে ফিরছিল, সে একজন কলেজের ছাত্র তার কাছে বেশি টাকা পয়সা না ছিল না, তার বাবা মারা গেছেন, তখন সে আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে। এর মধ্যে আপনি জেনে গেছেন, মানসরা প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক নয়। সেদিন ট্রেনে চুরি ডাকাতি হয়েছে বলে আমাদের কাছে কোন খবর নেই। কেউ আমাদের কাছে কোন অভিযোগ করেনি । তাই আমরা ধরে নিতে পারি, মানসের পরিচিত কেউ এই দুষ্কর্মটি করেছে। কেন করেছে, তার কারণ খোঁজার আগে আমরা যদি সেই দুষ্কৃতকারী খোঁজখবর করি, তাহলে আমাদের কাজটা অনেক সহজ হবে। কেসটা ডিটেকশানের অনেক সম্ভাবনা থাকবে।

          ‎একথা বলে একটু থামলেন যতীন দারোগা। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন এখন প্রশ্ন হলো সেটাকে তাকে চিনব কি করে আমি আগেই বলেছি দুষ্কৃতকারীদের পরিচিত সে মানুষের বন্ধু হতে পারে গ্রামের ছেলে হতে পারে কলেজের কোন ছাত্র হতে পারে বাগনানের সম্মতি কোচিং সেন্টারে কোন বলতে বলতে থেমে গেলে যে দিন ধরে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কিছু একটা ভাবলেন তারপর জ্যোতিষ বাবুর মুখের দিকে চেয়ে যতীন্দ্র কে বললেন মেজ বাবু আপনি কি খোঁজ নিয়েছেন মানুষের সঙ্গে এদিক থেকে কোন ছাত্র-ছাত্রী বাগনানের সমুতি কোচিং সেন্টার যেত কিনা ?

          ‎-- হাঁ স্যার ! এ ব্যাপারে ওর মায়ের সাথে কথা বলেছিলাম। ওর মা, কিংবা প্রতিবেশীরা, কিছুই জানেনা। সুমতি কোচিং সেন্টারের মালিক শুভাশিস কেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। সেদিন কিছু বলতে পারেনি। বলেছিল খাতাপত্র দেখে খুঁজে বলব। এর পরে তাকে আর ফোন করে জিজ্ঞাসা করা হয়নি।

          ‎-- ঠিক আছে, ওই শুভাশিসের ফোন নাম্বারটা আমাকে দিন, আমি কথা বলে নিচ্ছি। সেই সাথে আরও একটা কাজ করুন। মানস মিত্র যে কলেজে পড়ত, গ্রামের যে ক্লাবে ওঠাবসা করত, যাদের সাথে মেলামেশা করত, তাদের সাথে বন্ধু হিসেবে গল্পচ্ছলে জিজ্ঞাসাবাদ করলে একটা সূত্র অবশ্যই মিলবে।

          ‎জ্যোতিষ বাবু একনিষ্ঠ ছাত্রের মতো মনোযোগ সহকারে হেডমাস্টারের কথা শুনে প্যাডে নোট করে রাখলেন। ওগুলো এক এক করে সব কিছু দেখে নেবেন তিনি। তার আগে ডাইরিটা খুলে সুমতি কোচিং সেন্টারের মালিকের ফোন নাম্বারটা বার করে যতীন দারোগার হাতে দিলেন। তারপর লাঠি হাতে দলবল নিয়ে প্ল্যাটফর্ম চক্কর দিতে বেরিয়ে পড়লেন মেজোবাবু। এই চক্করটা প্রতিদিন না দিলে কুলি, মজুর, ভিক্ষুক, ধান্দাবাজরা প্লাটফর্মের উপর অস্থায়ি ঘর বাড়ি বানিয়ে ফেলবে। তাতে প্যাসেঞ্জার ও সাধারণ মানুষের যাতায়াতে অসুবিধা হবে। তার সমস্ত দায় এসে পড়বে পুলিশ প্রশাসনের উপর।

          ‎যতীন দারোগা ফোন নাম্বারটা পেয়ে ফোনে ধরলেন সুমতি কোচিং সেন্টারের মালিক শুভাশিস কে। হাওড়া জি.আর.পি. থানা থেকে বলছি শুনে শুভাশীষ বলল-- হাঁ স্যার ! এ ক'দিন ফোনে যোগাযোগ করতে পারিনি আপনাদের সাথে। আমি রেজিস্টার ঘেঁটে দেখেছি। অন্যান্য ছাত্রদের সাথে কথা বলে জেনেছি, মানস মিত্রের সঙ্গে আর একটা ছেলে আসত ওদিক থেকে। তার নাম দেবব্রত দাস। বাবার নাম করালি মোহন দাস। বাড়ি রাজারামতলা । ঘটনার দিন দুজনে কোচিং সেন্টার এসেছিল। খড়্গপুর লোকাল ধরবে বলে একই সাথে বার হয়েছিল। ঘটনার পরে আর কোচিং সেন্টারে আসছে না দেবব্রত দাস। আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম ওর সাথে, কিন্তু ওর ফোন বন্ধ।

          ‎শুভাশিসের কথা শুনে একটা গভীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন যতীন দারোগা। ছেলেটা নিঃসন্দেহে সন্দেহজনক। মানস মিত্রের মৃত্যুর পর থেকে কোচিং সেন্টারে না যাওয়ার মানে, মৃত্যুর ব্যাপারে সে কিছু না কিছু জানে। কোচিং সেন্টারে না গিয়ে পরিস্থিতিটা বুঝতে চাইছে। রামরাজাতলাতে দুজনেই নামত। ওখান থেকে মানস যেত জগাছাতে। সেদিন স্টেশনে নামার আগেই শেষ করে দিল তার বন্ধু মানসকে। তা যদি না হবে, তাহলে সেদিনের সেই ঘটনার কথা মানসের মাকে জানালো না কেন ? কেন নিকটবর্তী থানায় জানালো না? তবুও মনে একটা সন্দেহ জাগল। সন্দেহ মেটাতে যতীন দারোগা শুভাশিসকে শুধালেন-- আচ্ছা শুভাশিস! ওদের সঙ্গে আর কোন ছাত্রছাত্রী কোচিং নিতে যেত কিনা ?

          ‎শুভাশিস বলল-- না স্যার ! ওরা দুজনেই আসত।

          ‎-- ঠিক আছে শুভাশিস ! রাখছি তাহলে ।

          ‎এ কথা বলে যতীন দারোগা ফোনটা রেখে দিলেন। ব্যাপারটা আরেকটু খতিয়ে দেখার জন্য ফোনে ধরলেন ও.সি. জগাছাকে। জিজ্ঞাস করলেন- মানস মিত্রের ব্যাপারে তাকে কেউ কিছু জানিয়েছে কিনা ?

          ‎ও.সি. জগাছা বললেন-- আমাকে কেউ কিছু জানায়নি স্যার ! থানাতেও কিছু জানায়নি। কোন কিছু জানালে তো আপনাকে ফোন করে জানাতাম।

          ‎যতীন দারোগা বললেন-- ঠিক আছে। ‌ ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। এখন একটা কাজে আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে ভাই!

          ‎-- কি করতে হবে বলুন না স্যার ! আমাকে এরকম করে বলছেন কেন ? কি করতে হবে আদেশ করুন স্যার !

          ‎যতীন দারোগা বললেন-- কাল সকালে আমার থানার মেজোবাবু জ্যোতিষ রায়কে আপনার থানায় পাঠাবো। ওর সাথে পাঁচ-ছ'জন সাদা পোশাকের পুলিশ দিতে হবে। আর তার আগে সোর্স পাঠিয়ে দেবব্রত দাসের বাড়ির লোকেশনটা ঠিক করে রাখতে হবে।

          ‎-- দেবব্রত দাসের বাড়িটা কোনখানে স্যার ? অবাক হয়ে ও.সি. জগাছা জিজ্ঞাসা করলেন।

          ‎-- দেবব্রত দাসের বাড়ি রামরাজাতলায়। ওর বাবার নাম করালি মোহন দাস।

          ‎এ কথা বলে ফোনটা রেখে দিলেন যতীন দারোগা। পরক্ষণে তার মনে হলো দেবব্রত নামটা বলে দেওয়া কি ঠিক হল ? জগাছা থানার বড়বাবু তো ভালো ছেলে। তার স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে যতীন দারোগা ওয়াকিবহাল। কিন্তু যাকে দিয়ে ও.সি. জগাছা কাজটা করাবে, সে যদি পয়সাকড়ি খেয়ে আসামীকে পালিয়ে যেতে বলে। তাহলে আর এক কেলোর কীর্তি হবে। কিন্তু সে সাহস বোধহয় সোর্স কিংবা হোমগার্ডের হবে না।



ক্রমশ... 


-----------------------------------------------------এই ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাসটি প্রতি বুধবারে অঙ্কুরীশা-র পাতায় প্রকাশিত হচ্ছে। আপনারা এই পাতাটি ক্লিক করে পড়ুন ও পড়ান  এবং মতামত জানান। 


ankurishapatrika@gmail.com


-------------------------------------------------                        

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন