শনিবার, ১ আগস্ট, ২০২০

নির্বাচিত দীর্ঘ কবিতা।। শঙ্খ শুভ্র পাত্র





আলো

এসো আলো, এসো ৷
আর কতদিন বাতি জ্বেলে
            কাটাবো জীবন !
কৈশোরে কত লাফ-ঝাঁপ দিয়ে
          আজ যুবকে পদার্পণ ৷
            

বুকে বাজে ধুকপুক ধ্বনি
হাতের রেখাতে রাহু-শনি
বয়স গড়িয়ে যায় পঞ্চাশের দিকে ৷
          চুলে পাক ধরেছে সম্প্রতি
          কবে আসবে তুঙ্গে বৃহস্পতি
ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে
          জ্যোতিষীর বাক্যে সন্দেহ
দোলাচলে আছি বেশ
          পাকা চুলে ফের সন্ধে হোক ৷
বেকারত্ব, কেকা-তথ্য দোঁহে নাহি 
          যোগাযোগ সেতু
শেখা-তত্ত্বে কতদিন চলে—
একটু বাতাস হলেই দীপ নিভু-নিভু
          আলো চাই  যে-কোনও কৌশলে ৷

কাজে-কর্মে সদা ব্যস্ত
আমার ঘরনী অতি প্রিয়
তার মৃদু অনুযোগ : 'ঘন রাতে
         একটু জ্যোতি দিও ৷'
দিতে কি পেরেছি তাকে
         একখানি শাড়ি ও সিঁদুর ?
কেটে যায় দিন-রাত্রি
         মনে কষ্ট বিষাদ-বিধুর ৷
ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে
         অপত্য স্নেহ তো কম নয়
আমি কি এসব ভাবি
         লেখা নিয়ে আছি তন্ময় ৷
দীপ জ্বেলে সারারাত
        শব্দের ধারাপাতে ভাসি
চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে —
        যেন শ্বেত মুক্তো রাশি-রাশি ৷
শাদা কাগজের বুকে
        অক্ষমতা-অতৃপ্তির ঢেউ
এ-কবিতা আত্মকথা লিখে রাখি
        জানি, একদিন কেউ
বিবর্ণ-পাতার মাঝে খুঁজে পাবে
        হলুদ বর্ণ সেই জমি ৷
জমিতে ফসল কই ?
        সার-সার মৃতদেহ-মমি
সহস্র শব্দ হয়ে শুয়ে আছে
        আগাছার মতো,
হতভাগ্য কবি এক এঁকেছিল
        জীবনের ক্ষত ৷
অবারিত সংসারে, জোনাকিরা
        মিটিমিটি জ্বলে,
নক্ষত্রবীথিতে পিতা,
        জননীর স্নেহচ্ছায়াতলে
আমরা সবাই জুটে
        ভাগ করে খুঁটে খাই দানা,
তবুও অভাব এসে 
        অতর্কিতে দিয়ে যায় হানা ৷
কাজ নেই, আলস্য,
        ইতস্তত ব্যর্থ ছোটাছুটি
কবিজন্ম নাহি জানে —
        কাকে বলে সাংসারিক খুঁটি ৷
চিররুগ্ন ছেলেটির ভগ্নদশা দেখে
        পিতা হয়ে জর্জরিত হই ৷
মেয়েটি তৃতীয় শ্রেণি, বলে : 'বাবা,
        অঙ্ক খাতা কই ?'
আজকেই কিনে দেব
        একটু অপেক্ষা কর দিকি—
প্রতিশ্রুতি পেয়ে তবে, মেয়েটির
        ফাঁকা দাঁতে জ্যোৎস্না ঝিকিমিকি ৷
        
কী করি, চাকরি নেই
       টিউশনিও জোটে না তেমন
১২০ ছাত্র নেই বলে —
       বাদ দিল '...শিক্ষা নিকেতন' ৷
এখন মুক্ত আমি, সদাশিব,
       বোমভোলা মন
দেদার কবিতা লিখছি
       ক্যালেন্ডারে বাইশে শ্রাবণ
১৪১২ সাল - ইংরেজি ২০০৫
পকেট গড়ের মাঠ, বাছা,
        নাচ, তুই নাচ ৷
তবে কীরূপে সংসার চলে তোর ?
        - নৌকোটিকে ধরে রাখে কাছি ৷
আসলে এ-কলিযুগে, হাঁড়ি তো ভাঙেনি বাপু,
                               একযোগে আছি ৷
পাঁচভাই, আমি বড়—
         প্রত্যেকে কিছু না কিছু করে
ভাইয়েরা আলোর মতো
         কথা বলে অতি মৃদু স্বরে ৷
'দাদা তো কবিতা লেখে,
         তার জন্য ভাবব না কেউ !'
ছোটভাই দিলখোলা
         হাসলে তার মুখ জুড়ে ঢেউ ৷
মেজো, সেজো, ন-ভাই
         নবান্ন-উৎসবের মতো ৷
প্রাণশক্তি অফুরান
         বাড়ি এলে কথা হয় কত ৷
বিবাহিতা দুইবোন
          কেউ কাছে, কেউ অল্প দূরে,
সংসার ফুল্ল সদা
          বাচ্চাদের কিচিমিচি সুরে ৷ 
সংসার পাঁচালি ছেড়ে
          ফিরে আসি অন্য কথায়,
কবিতা মানেই মন
          ভাবে না সে 'অন্ন কোথায় ?'
মঞ্জির ফোন করে
           দূরভাষে সুরধুনী বয় ৷
বহুদূরে নন্দিতা
           সে-ও ভাবে আমি ঠিক 'জয়...' 
           
জয়কবি প্রণম্য
           আমি তার নখতুল্য নই ৷
ছন্দ পেয়েছি কানে
           যেরকম পাখি ডাকে ওই ৷
মঞ্জির কি নন্দিতা
           এরা সেই সুখাশ্রিতা নারী—
দুই-পদ্মে মন দিয়ে
           পদ্য আমি লিখতেও পারি ৷
প্রিয়কবি, সুধীজন—
           সকলেই উৎসাহ দেন :
'দেশ'-এ সুর বেরোলেই
           আগে একটা কেনো হারিকেন ৷

হে দীপ, বিজন দ্বীপ,
           কবিতা ও কবি নিত্য সার
এই স্বপ্ন জাগ্রত চোখে
           আর সব অনিত্য-অসার ৷
           
প্রাণ খুলে লিখছি — আহা !
           হে 'বৈঠা', কতদূরে তুমি ?
প্রণাম করেছি — এ তো
           সুনীলের প্রিয় জন্মভূমি ৷
কে সুনীল ? কে অনিল ?
           'বৈঠা' আর 'রুক্মিণীপুর',
কবি ও লেখক যথাক্রমে
            দুজনেই 'কিঙ্কিনি' সুর ৷
আমার মরমে পশে,
            পাশে বয় কৃশকায়া নদী,
এর সাথে মেলাব কি
            'কাল নিরবধি' ?
মিলিয়ে দিলাম বাপু
            এটা কিন্তু ইচ্ছাকৃত মিল ৷
ক্ষমা-ভিক্ষা চেয়ে নিই
             পশ্চাতে দীর্ঘ মিছিল...
অগ্রে নেই, ব্যগ্রে নেই —
              আমি কিন্তু ডাইনে কালা ঢের ৷
'প্রতিবন্ধী' ছাপ আছে,
               মিথ্যে বললে মারবো শালাদের ৷
একি অসৎ বাক্য !
               উচ্চারণে নিয়ে এল ক্ষোভ
প্রত্যুষে চা পাইনি, আর
               'শোঁ শোঁ' করে জ্বলছে না স্টোভ ৷
তাই অন্ধ-অভিমানে
                পুনর্বার চেয়ে নিচ্ছি ক্ষমা ৷
আমার জীবন জুড়ে
                তারাময় অন্ধকার-অমা
জমা হচ্ছে ৷ প্রাণে নেই একটু গরজ
এতই কৃপণ আমি —
                দুঃখকেও করি না খরচ ৷
আলস্যে এসেছে মোহ —
                দুদিকেই আছে জোড়া-সিঁড়ি,
কোথাও যাই না বটে
                সুখে টান দিই পোড়া বিড়ি ৷
কটু-গন্ধে বিভাসিত, বধূ ব্যস্ত
                গৃহস্থালী কাজে,
এইমাত্র জানালেন — ঘড়িতে
                 সাড়ে দশটা বাজে ৷
প্রাতঃকৃত্য সমাপন হয়নি তো
                 ছোট বউমা দিয়ে গেছে চা,
সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই —
                  এইভাবে লেখা বেঁচে যায় ৷
বাঁচে কি সত্যিকারে ?
                   নন্দিতা-মঞ্জির জানে,
এ-স্বভাব বেঁচে থাকে—
                   স্বপ্ন আর বেনজির টানে ৷
ইচ্ছে হয় তো খুব
                   এ-শরীর ধিকিধিকি জ্বলে,
তেষ্টা মেটাতে - আহা,
                    ঝাঁপ দিই গঙ্গার জলে ৷
হাতে ধরে তোলে কেউ
                 সংজ্ঞাহীন এই দেহটাকে,
না হলে কেমন করে পদ্য লিখি
                 ঘোর দুর্বিপাকে ?

তুমি জানো শাদাপাতা,
              বোঝে এই কালো ডটপেন ৷
কথা আছে অন্ত্যমিলে
              সকলের সাথে পটবে ৷
এইসব অকবিতা লিখে-লিখে
               একদিন ফিরে পাব হুঁশ,
শাদাপাতা জুড়ে থাকবে
                অসহায়, রিক্ত মানুষ ৷
চাঁদ-ফুল-নদী-নারী
                 প্রকৃতির অঙ্গভূষণ,
আছে বিষ, অমৃত —
                 কানে ঠেকে শব্দদূষণ ৷

এসো আলো, এসো কালো—
                 উদয়াস্ত রথচক্র ঘিরে
এ-জীবন চলমান-
                 গতিময়, কখনও-বা ধীরে ৷
হিরে-মোতি-পান্না নয়
                 'কান্না'-কেই ভালোবাসি ঢের ৷
দুঃখ থাক বুক জুড়ে—
                 পাশাপাশি আছি তোমাদের ৷
আমাকে গ্রহণ করো, ধরো—
                 দুই হাতে দীপাধার জ্বালো ৷

খুঁজে দেখি কবিতায়—
                 কাউকে কি বেসেছি ভালো ...




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন