।।প্রতিদিন বিভাগ।।
।। জুন সংখ্যা।।
।। বিষয় - মুক্ত (গুচ্ছ কবিতা) -২।।
সুতো জড়ানো সেতু
সুজিত রেজ
১
সুতো জড়ানো সেতু রাহু এবং কেতু
এলায়িত শঙ্কা বেহুলা- ধৈর্যের ;
সুতো জড়ানো সেতু একটা জাল, খাঁচা
যা পেতে রেখে নিদডুব নিষাদের ।
২
যত সুতো ছাড়ি জড়িয়ে ফেলো আষ্টেপৃষ্ঠে
টানাপোড়েন চলে অনির্বাণ মোহে
উপোসের দিনলিপি থেকে
পোড়া মদনের নাভির গন্ধ বেরোয়
বুক পকেটে ঢুকে পড়ে মেঘ
বারিধারা অশ্রুত
জীর্ণ মাদুরের আত্মা, ছেদন গ্রন্থির চিৎকার
শুনতে-শুনতে বেতারদুপুর কাটে
মোহনাই যদি লক্ষ্য তবে সিধে চলনই তো ছিল শ্রেয় ;
বঙ্কুবিহারীর মতো কটাক্ষ নিক্ষেপের কী কারণ?
চড়াই-উতরাইয়ে পদস্খলন অস্বাভাবিক নয়,
সমতল করতলে কেন এই বিষমীভবন !
৩
গান গাইলেই গলা থেকে সুর নয় দুচারটে সুতো বেরিয়ে আসে।আহ্লাদী সুচ নৃত্য করতে থাকে। ভয় করে। হয়তো আমার গলাটাকেই সেলাই করে দেবে। গান গাওয়া দূর ছাড় হয়ত আর কথা বলতেই পারব না।তারপর থেকে যতবার গান গাই গাছের কোটরে বসে কিংবা আম্রপল্লবে দোল খেতে-খেতে, সুতোগুলো গিলেনি একের পর এক।তাতে আমার হজমশক্তি কিছুটা বেড়েছে। প্রকৃতঅর্থে তো পৌষ্টিক নালির জালিকা তো সুতোরই নকশা।
৪
সেই কবে থেকে সুতো নিয়েই তো খেলা করছি ?এ খেলার অর্থ কী সত্যি জানি না। সুচগুলো পড়ে আছে শীতলপাটি মাদুরের উপর। শান্ত, নিরুদ্বেগ। তার পাশে শুয়ে-শুয়ে যা ভাবছি, কাজে করতে পারছি কই? সুচ তুলে নিতে এত দ্বিধা করছি কেন? অহেতুক ফুটোর দিকে তাকিয়ে আছি। তাতে কী গলবে, কতটা গলবে, কী সেলাই করব----এইসব সাতপাঁচ ভাবনাচিন্তা সময়ের নিধন।
সুতো টেনে কী দেখছি? ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়? সুতো তো ছিঁড়বেই, ছেঁড়ার জন্যই সুতো। ছিঁড়ে গেলেও সুচসুতো থাকলে আবার তো জোড়া লাগানো যাবে। কতখানি টেকসই হবে জানারই বা কী প্রয়োজন?
কোনকিছুই তো চির নয় এ জগতে।
৫
সেতু শুয়ে থাকে কোলবালিশ কোমরে নিয়ে। আমার মতোই তারও ঘুম নেই দু'চোখে। প্রহরের ঘণ্টা বেজে যায়। নদীর জলে সাহসী কয়েকটি মাছ কানামাছি খেলায় উন্মত্ত। জেলেদের পাড়ায় খবর রটে যায়।
পাখিবেলা থেকেই আমি একটা সেতু বানিয়ে চলেছি। কবে শেষ হবে জানি না। আদৌ কি শেষ হবে?
সেতুটা সুতোর।সেই খেজুরবেলা থেকেই আমি সুতো জড়ো করে চলেছি। লাল নীল সবুজ হলুদ শাদা।সুতো হাতে পেলেই ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে জড়িয়ে-জড়িয়ে নানান নকশা বুনে চলেছি। নিজের হাত বন্ধক রেখেছি নিজের কাছেই।
শর্তাধীন জামিনে থাকা দিনগুলি এইসব করেই বেশ উপভোগ করছি। ভাবের ঘরে সিঁদ কাটছি। আর মাঝেমাঝে বাতায়নে মুখ রেখে এলোকেশী কাঁধে ট্যাটুর চলন দেখছি। তন্তুবায়ের মতো সূক্ষ্ম টানাপোড়েনে বাণী ও বীণার জট খুলছি।
৬
লাভা ফরেস্ট গেস্ট হাউস থেকে মনাস্ট্রি দেখতে যাব বলে বিকেলে বেরিয়েছি।
দেড় কিলোমিটারের মতো হাঁটা পথ। চড়াই। আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। বয়স টের পাচ্ছি। মাঝে বাসস্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ বসলাম। চা পানের বিরতি। সঙ্গে ক্যাপসির পকোড়া। গরম গরম। মেয়ে বলল, চলো যাওয়া যাক। উঠতে গিয়ে পায়ে টান। শিরায়। তোরা যা বলে মনাস্ট্রি দর্শনে ইতি টানলাম।
এক সন্ন্যাসী আমাকে লক্ষ করছিলেন। কাছে এলেন। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। জিজ্ঞাসা করলেন---
গেলেন না কেন?
বুদ্ধ দর্শন আমার ভাগ্যে নেই।
ওই তো বুদ্ধ---দেখে নিন।
সত্যি! সূর্য ডুবছে। লালিমায় ঢেকেছে সোনার শৃঙ্গ। তিনি শুয়ে আছেন।
কিন্তু সন্ন্যাসী কোথায় গেলেন--- এই তো ছিলেন!
একটু দূরে দেখি আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে। সন্ন্যাসী সেখানেই।
গায়ের শালটি খুলে ওঁকে বললাম: নিন, আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।
এটা কী?
শীতবস্ত্র?
বস্ত্র কী?
জানি না।
সুতো জড়ানো সেতু।।
৭
আজও সেই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা।
জিজ্ঞাসা করলাম: আপনি কি বৌদ্ধ ভিক্ষু ?
উত্তর দিলেন না।
তবে, হিন্দু সন্ন্যাসী?
নীরব রইলেন।
জৈন নির্গ্রন্থ?
হাসলেন।
ফকির?
এবার তিনি মুখ খুললেন : এত প্রশ্ন কেন? কেন আমায় তোর সুতোয় বাঁধতে চাইছিস?
সুতোয় বাঁধলে গিঁট লেগে যায়। সে এমন গিঁট খোলা যায় না। তার চেয়ে এই যে আমি, এই যে তুই --- এটাই সত্য, আর কী চাই?
চা খাবেন?
অনেকেই খায় না।
মুড়ি খাবেন?
অনেকেই পায় না।
তবে চলুন, ওইখানটায় গিয়ে বসি। গল্প করি।
গল্পের কোনো শেষ নেই। তুই কবিতা লিখিস?
হ্যাঁ।
কাল থেকে আর লিখিস না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন