ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৫)
মুখোশের আড়ালে
আবীর গুপ্ত
লেক গার্ডেন্সের মোড়ে ধাকা স্কুলটির সামনে থেকে কেনা লজেন্সগুলো নিয়ে পার্কসার্কাসের নার্কোটিক্স ডিপার্টমেন্টে টেস্টের জন্য দিয়ে এসেছে সকালবেলায়। সন্ধ্যার সময় নার্কোটিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে অনামিকার কাছে ফোন এল। দশটি লজেন্সের মধ্যে চারটিতে অল্প মাত্রায় কোকেন পাওয়া গেছে। কোকেনের মাত্রা এমন যাতে অল্প অল্প নেশা হবে এবং বেশ কয়েকদিন ধরে নিয়মিত খেলে নেশা জন্মাবে
যা যে খাচ্ছে তাকে রীতিমত
কোকেনে আসক্ত করে তুলবে। লজেন্সগুলো কোথা থেকে কিনেছে ওঁরা জানতে চাইলেও অনামিকা না বলে বিষয়টা এড়িয়ে গেল। কারণ, এ মুহূর্তে, এটা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে গেলে আসল অপরাধীরা সাবধান হয়ে যাবে। টেস্টের রিপোর্ট ওর ইমেইলে পাঠিয়ে দিতে বলল।
ইমেইল থেকে টেস্ট রিপোর্টের প্রিন্ট নিয়ে পরদিন সকালে চলে গেল লালবাজারে। পুলিশ কমিশনারের চেম্বারের সামনে থাকা সোফায় বসে পড়ল কারণ চেম্বারের দরজার উপর লাল বাতি জ্বলছে। অর্থাৎ, ওঁর ঘরে কোন জরুরী মিটিং চলছে অথবা উচ্চপদস্থ কারো সঙ্গে দরকারি কথা বলছেন। দরজার সামনে পাহারায় থাকা পুলিশ কর্মীটি ওর থেকে নাম জেনে স্লিপে লিখে ভিতরে বড়ো সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিল।
স্লিপ পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢোকার পারমিশন পাওয়া যাবে এটা ওর কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। কমিশনার সাহেবের চেম্বারে ঢুকে অনামিকা থমকে গেল, ভিতরে নয় দশজন উচ্চপদস্থ পুলিসকর্মীর সঙ্গে কমিশনার সাহেব কোন জরুরী মিটিং করছেন। ওকে কমিশনার সাহেব বসতে বলে ভেতরে বসে থাকা সবাইকে বললেন
–
-
ও অনামিকা চৌধুরি, আপনারা আশা করি সবাই ওর নাম শুনেছেন। বেশ কয়েকটি কেসে আমাদের সাহায্য করেছে।
ড্রাগ চক্রটা নিয়ে অনামিকারও কিছু অবজারভেশন
রয়েছে। দুতিন দিন আগেই এসে আমাকে জানিয়েছিল। এরপর আপনাদের রিপোর্টও হাতে এল। তার
মানে বিষয়টা সত্যি এবং এই কারণেই আজকে এই মিটিংটা ডাকা হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে অনামিকা
এসে গেছে সম্ভবত ড্রাগ চক্রটা নিয়ে ওর কাছে কোন নতুন তথ্য এসেছে যা আমাদের কাজে আসতে
পারে।
অনামিকার দিকে ফিরে বললেন
–
- হঠাৎ
এসেছ, মনে হচ্ছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। এম আই রাইট?
অনামিকা মৃদু হেসে বলল –আমার কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বাকি আপনারা বলবেন। এই মাদক ব্যবসায়ীরা ওদের টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছে স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের। এই সমস্ত বাচ্চা ছেলে মেয়েদেরকে ওরা নেশায় আসক্ত করে তুলতে চাইছে। আমার সন্দেহ হওয়ায় গত কয়েকদিন বেশ কয়েকটা স্কুলের সামনে যাই, টিফিন পিরিওডে যে সমস্ত ভেন্ডার নানারকম খাবার-দাবার বিক্রি করছে তাদের নজরে রাখি। আমার সন্দেহ হওয়ায় দুটি স্কুলের সামনে থাকা দোকান থেকে লজেন্স কিনে নার্কোটিক্স ডিপার্টমেন্টে টেস্টের জন্য পাঠাই। একটির ক্ষেত্রে রেজাল্ট নেগেটিভ হলেও লেক গার্ডেন্সের মোরে থাকা স্কুলের সামনে দোকান থেকে কেনা লজেন্সগুলোর টেস্ট রিপোর্ট কিন্তু ভয়ানক এবং যথেষ্টই এলার্মিং। দশটা লজেন্সের মধ্যে চারটিতে কোকেন পাওয়া গেছে। কোকেনের মাত্রা এমনই যে কয়েকদিন ধরে খেয়ে চললে সেই ছাত্র কোকেনের নেশায় আসক্ত হতে বাধ্য। আমি অরিজিনাল টেস্ট রিপোর্ট হাতে পাওয়া মাত্রই নিয়ে চলে এসেছি। ড্রাগ চক্রটির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে কলকাতা পুলিশের সাহায্য না পেলে লড়া সম্ভব নয়। তাই আসা।
কমিশনার সাহেব অনামিকার হাত থেকে রিপোর্টটা নিয়ে নিজে পড়ে সবাইকে রিপোর্টটা শুনিয়ে বললেন –
- এতদিন যেটা অনুমানের জায়গায় ছিল সেটা আর অনুমানের জায়গায় নেই। আমাদের হাতে প্রমাণ এসে গেছে। মাদক ব্যবসায়ীরা এবারে এক ভয়ঙ্কর স্টেপ নিয়েছে, ছোট্ট বাচ্চাদেরকেও নেশায় আসক্ত করে তুলতে চাইছে। আমাদের ওদেরকে আটকাতেই হবে। আমি অনামিকাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের হাতে প্রমাণ তুলে দেওয়ার জন্য। আপনাদের প্রত্যেককেই কী কী করণীয় তা বলা হয়ে গেছে। ঠিক দু'দিন বাদে আবার আমরা মিট করবো। তখন আপনাদের কাছ থেকে পূর্ণ রিপোর্ট চাই।
মিটিং শেষ হয়ে গেছে, সবাই চলে গেছেন। কমিশনার সাহেব অনামিকাকে জিজ্ঞাসা করলেন –
-তোমার প্ল্যানটা কী? কীভাবে এগোতে চাইছ?
- আমি তিনদিন বাদে দিল্লী যাচ্ছি।
আমার মনে হচ্ছে দিল্লিতে গেলে হয়তো কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে। ব্যবসায়ী সুবিনয়
ঘোষালের ফোন কল ডিটেলসটা থানায় ফোন করে জানলাম ওঁদের কাছে এখনো আসে নি। ওটা কি পেতে
দেরী হবে?
- না-না, আজই পাঠিয়ে দিয়েছে।
মিটিংটার জন্য পাঠাতে পারি নি। আসলে যাকে-তাকে তো বিষয়টা বলা যায় না। তুমি দিল্লি
যাচ্ছ খুব ভালো কথা। ওখানকার কমিশনার আমার পরিচিত। আমি তোমার কথা জানিয়ে দেব যাতে
সব রকমের সহযোগিতা পাও।
-স্যার, ওটা প্লিজ করবেন না।
আমি চাই না আমার পরিচয় কেউ জানুক। তাতে সুবিধার থেকে অসুবিধা হয়তো বেশি হবে। আপনি
তো বুঝতেই পারছেন, এত বড়ো একটা মাদক ব্যবসা, কোটি কোটি টাকার ব্যাপার, সেখানে পুলিশে
ওদের লোক থাকাই স্বাভাবিক। আপনি আমাকে বরঞ্চ কমিশনার সাহেবকে দেওয়ার জন্য একটা অফিসিয়াল
চিঠি লিখে দিন, যদি একান্তই প্রয়োজন হয় তাহলেই সেটা ব্যবহার করব। আমার ইচ্ছা গোপনে
তথ্য সংগ্রহ করা। যে তথ্যই পাই আপনাদেরকে অবশ্যই জানাবো।
সুবিনয় ঘোষালের ফোন কল ডিটেলসটা
নিয়ে অনামিকা লালবাজার পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এল নিজের বাড়িতে। হরিকাকা
দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল –
- দিদিমণি
কী খাবে?
-এক
কাপ কফি আর চিকেন পকোড়া।
- কুরিয়ার
থেকে একটা প্যাকেট দিয়ে গেছে, টেবিলের উপর রেখে দিয়েছি। তোমার সময় হলে খুলে দেখ।
অনামিকা তাকিয়ে টেবিলের ওপর
রাখা প্যাকেটটা দেখল, সাইজ দেখে মনে হলো ছোট আকৃতির মোটা কোন বইয়ের প্যাকেট অথবা কোন
বাক্স জাতীয় কিছুর প্যাকেট। ও বেডরুমে ঢুকে পড়ল। প্যাকেটটা পরে সময় সুযোগ বুঝে খুলে
দেখবে।
অনামিকা সুবিনয় ঘোষালের ফোন
কল ডিটেইলসটা দেখছিল। যেদিন উনি দিল্লি গিয়েছিলেন তার দুদিন আগে দিল্লি থেকে দুপুর
দুটো নাগাদ একটা ফোন কল গিয়েছিল। প্রায় মিনিট দশেক কথা হয়েছিল। এরপর, ওই ফোন নম্বরে
সুবিনয় ঘোষাল বিকাল পাঁচটা বেজে দশ মিনিটে ফোন করেছিলেন। এক্ষেত্রে মিনিট তিনেক কথা
হয়েছিল। দিল্লির ফোন নম্বরের মালিকের নাম ভিষ্ণু মেহতা। দিল্লির ফোন নম্বরটির পাশে
ভিষ্ণু মেহতা নামটি লেখা আছে পাশে ঠিকানাও দেওয়া আছে। এছাড়া, ফোন কল ডিটেইলস থেকে
আর উল্লেখযোগ্য কিছু পেল না। অনামিকার মনে হল এটা একটা দরকারি সূত্র হতে পারে। দিল্লি
গিয়ে ভিষ্ণু মেহতার সঙ্গে কায়দা করে কথা বলতে হবে। একটা ইনসিওরেন্স কোম্পানির আই
কার্ড বানাতে হবে। সবার সঙ্গে কথা বলতে গেলে হয়তো ওই ফলস্ আই কার্ডের দরকার হতে পারে।
ঘণ্টা দুয়েক বাদে বেডরুম
থেকে ড্রয়িংরুমে এসে টিভিটা চালিয়ে সোফায় বসে পড়ল। চোখ পড়ল সেন্টার টেবিলের উপর
রাখা কুরিয়ার থেকে ডেলিভারি দেওয়া প্যাকেটটা উপর। স্ট্রেঞ্জ! প্রেরকের নাম এমনকী কুরিয়ার কোম্পানির নামও কোথাও নেই! একটু সাবধান হল। কেউ কোন বিস্ফোরক জাতীয় কিছু পাঠায়
নি তো? কারণ, এ মুহূর্তে ও যে কেসের তদন্তে নেমেছে তাতে ওকে সরিয়ে দিতে পারলে ক্রিমিনালদের
লাভ তো হবেই। হরিকাকাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল কুরিয়ারের ছেলেটি প্যাকেটটা দিয়ে
হরিকাকাকে কোথাও কোন সই করতে বলেনি যেটা অস্বাভাবিক। প্যাকেটটা সাবধানে নিয়ে সোজা
চলে গেল নিচে। গাড়িতে সাবধানে প্যাকেটটা রেখে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল লালবাজার পুলিশ
স্টেশনে কমিশনার সাহেবের ঘরে। উনি ছিলেন, স্লিপ পাঠানো মাত্রই ডেকে নিলেন।
অনামিকা ঘরে ঢোকা মাত্রই উনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন
–
- কী হয়েছে! এনি প্রবলেম?
অনামিকা হাতে গ্লাভস পরে অত্যন্ত সাবধানে প্যাকেটট ঘরের
এক কোণে রেখে সব খুলে বলতেই উনি উত্তেজিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ বিশেষজ্ঞদের
ডেকে পাঠালেন। এক্সপ্লোসিভ বিশেষজ্ঞরা নানারকম যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করে যখন নিশ্চিতভাবে
জানালেন ভিতরে কোনরকম এক্সপ্লোসিভ নেই তখনই উনি প্যাকেটটা খুলবার অনুমতি দিলেন।
অনামিকা কমিশনার সাহেবের সামনে প্যাকেটটা সাবধানে খুলল।
প্রথমেই থাক থাক করে দুহাজার টাকার নোটের পাঁচটা বান্ডিল অর্থাৎ মোট দশ লক্ষ টাকা রয়েছে।
নোটের বান্ডিলের নিচে আরও কিছু আছে। ও নোটগুলো তুলে টেবিলের উপর রেখে নিচের প্যাকেটটা
বার করল। একটা পলিথিন-এর প্যাকেটের মধ্যে চারটে লজেন্স, ঠিক যেই লজেন্সগুলো কিনে ও
নারকোটিক্স ডিপার্টমেন্টে টেস্টের জন্য পাঠিয়েছিল। লজেন্সগুলোর গায়ে আর পলিথিন প্যাকেটের
ভেতর কালচে লাল রঙের কোন তরল পদার্থ লেগে আছে। বাক্সের ভেতর পলিথিন প্যাকেটের নিচে
একটা ভাজ করা সাদা কাগজ রাখা। অনামিকা কাগজটা খুলে পড়ে হেসে কমিশনার সাহেবকে পড়ার
জন্য এগিয়ে দিল। উনি দেখলেন লেখা আছে –
“ম্যাডাম,
এই দশ লক্ষ টাকা আপনার, আপনাকে দেওয়া হল। এটা অ্যাডভান্স।
পরে আরও চল্লিশ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। বেড়াতে প্রচুর টাকা-পয়সা লাগে। দু-তিন দিনের
মধ্যে মাসখানেকের জন্য কোথাও ঘুরতে চলে যান। লজেন্সগুলোতে মুরগির রক্ত লাগানো আছে।
কথা না শুনলে পরের বারে কিন্তু ওটা মুরগির রক্ত থাকবে না। রক্তটা মানুষের রক্ত হবে।
কে বলতে পারে সেটা আপনারই রক্ত হবে কিনা।“
কমিশনার সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে অনামিকা বলল
–
- এরকম হুমকি চিঠিতে আমি ভয়
পাই না। এগুলো বরং ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দিলে যদি কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়
তাহলে হয়ত সুবিধা হবে। ইমপর্টেন্ট ডিস্কাশন আছে, একদম আলাদা করে কথা বলতে চাই। এখানে
কি সম্ভব? নাকি বাইরে কোথাও?
- আমার সঙ্গে চল, উপরে একটা
মিটিং রুম আছে যেটা সাউন্ড প্রুফ। ওখানেই কথা বলা যাবে।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন