ধ্রপদী বাংলা সিনেমার সোনালী অধ্যায়ের নায়ক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
স্মরণে — বিমল মণ্ডল
ধ্রুপদী বাংলা সিনেমার সোনালি অধ্যায়ের নায়ক কবি ও পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। যিনি কবিতা এবং সিনেমায় হাত ধরাধরি করে হেঁটেছেন। একাধারে কবি, অন্যদিকে পরিচালকের ভূমিকায়। সিনেমায় কবিতা আঁকতেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাঁর সিনেমাও কবিতা হয়ে উঠত। করোনাদ্বগ্ধ এই সময়ে থেমে গেল সেই আশ্চর্য স্রষ্টার পথচলা।
পরাধীন ভারতে ১৯৪৪ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারিতে পুরুলিয়ার আনাড়া গ্রামে জন্ম বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর।বাবা তারাকান্ত দাশগুপ্ত ছিলেন রেলের চিকিৎসক।মাত্র ১২ বছর বয়সে, ১৯৫৬ সালে বুদ্ধদেব চলে আসেন কলকাতায়। আমৃত্যু পুরুলিয়ার অনুষঙ্গ ফিরে এসেছে তাঁর প্রতিটি কাজে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পেশাগত জীবন শুরু করেন অধ্যাপক হিসেবে। অর্থনীতির তত্ত্ব আর বাস্তব জীবনের দূরত্বই তাঁকে সিনেমায় টেনে আনে। বুদ্ধদেব কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হন। প্রথমেই বানান একটি ১০ মিনিটের তথ্যচিত্র।তাঁর সিনেমার একের পর দৃশ্যে উপচে পড়ে পুরুলিয়া। লালমাটির গন্ধ তাঁর ক্যামেরায় লগ্ন হয়ে থাকে। অজস্র আর্ন্তজাতিক পুরস্কারের ঝলমলানি পেরিয়েও তিনি রয়ে গিয়েছিলেন আনাড়া গ্রামের সেই কিশোর।তাঁর তিন বছরের মধ্যেই খাদ্য আন্দোলন। তাঁরও তিন বছর পর চিন-ভারত যুদ্ধ। এই ক্রান্তিলগ্নেই তাঁর হয়ে ওঠা। অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা। প্রথমে স্কটিশচার্চ কলেজে, তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই সঙ্গে একদিকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে নিবিড় সখ্য, অন্যদিকে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া। আস্তে আস্তে বুদ্ধদেবের চেতনায় ঢুকে পড়লেন ইঙ্গমার বার্গম্যান, আকিরা কুরোসাওয়া-সহ আরও অনেক কিছু।
বাংলা সিনেমা এবং বাংলা কবিতা দুই জগতেই অবাধ বিচরণ ছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর। তৈরি করেছেন 'বাঘ বাহাদুর', 'লাল দরজা', 'চরাচর', 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান', 'কালপুরুষ', 'উত্তরা', 'স্বপ্নের দিন', 'তাহাদের কথার মত ছবি'। একদা তাহাদের কথায় যেমন এক অন্য মিঠুন চক্রবর্তীকে উপহার দিয়েছিলেন তিনি, তেমনই শেষ বয়সেও আনোয়ার কা আজিব কিসসা ছবিতে নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকিকে ব্যবহার করে চমকে দিয়েছিলেন।
মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়-এই ত্রয়ী বাংলা ছবিতে যে সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ এনেছিলেন তার যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ১৯৭৮-এ প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি 'দূরত্ব' পরিচালনা করে জাতীয় পুরস্কারের শিরোপা পেয়েছিলেন তিনি। এরপর 'নিম অন্নপূর্ণা', 'গৃহযুদ্ধ', বাঘ বাহাদুর', 'তাহাদের কথা', 'চরাচর', 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান'-সহ একের পর এক উল্লেখযোগ্য ছবি।পুরস্কারের ঝুলিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার। এছাড়াও চলচ্চিত্র পরিচালনায় বিদেশি পুরস্কারও পেয়েছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মামা সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত কাছে। অন্তর্জলী নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনাও একসময় শুরু করেছিলেন তিনি। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে সখ্য ছিল তাঁর। কবি ভাস্কর চক্রবর্তী, সামশের আনোয়াররা ছিলেন তাঁর আত্মার আত্মীয়। কবি বুদ্ধদেবের কলমে উঠে এসেছে একাধিক কবিতা, যা নিয়ে আজও চর্চা হয়। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রোবটের গান’, ‘ছাতা কাহিনি’, ‘গভীর আড়ালে’ ইত্যাদি। বন্ধু ফাল্গুনী রায়ের একটা লাইন কোনও এক ভেতর থেকে উঠে আসে—
‘মানুষ বেঁচে থাকে মানুষ মরে যায়
কাহার তাতে ক্ষতি? কিই বা ক্ষতি হয়?
আমার শুধু বুকে গোপনে জ্বর বাড়ে
মানুষ বেঁচে থাকে মানুষ মরে যায়।’
প্রয়াত চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১০ই জুন২০২১ সকালে দক্ষিণ কলকাতার তাঁর নিজের বাসভবনে মৃত্যু হয় । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত -এর মৃত্যুতে শেষ হল বাঙালি- অহঙ্কারের অধ্যায়, সাথে সাথে একটা যুগের অবসান ঘটল ৷ শুধুমাত্র আমাদের দেশের নয়, আন্তর্জাতিক সিনেমার ক্ষেত্রেও এই মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি ৷ তাঁর এই মৃত্যুতে বিনম্র প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন