রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২০

ধারাবাহিক বিশেষ নিবন্ধ ।। উৎসব- উৎস, প্রভাব, বৈচিত্র্য ও কার্যকারিতা (পর্ব- ৮) ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

 


ধারাবাহিক বিশেষ নিবন্ধ    

উৎসব- উৎস,  প্রভাব,  বৈচিত্র্য ও কার্যকারিতা (পর্ব- ৮)

পার্থ সারথি চক্রবর্তী 


 Life is not a bed of roses' এই ইংরেজী আপ্তবাক্যটির বাংলা ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায় ' জীবন ফুলে ভরা নয়, বরং কণ্টকাকীর্ণ। আর জীবন একটাই ও সেটা ক্ষুদ্র। তাই  জীবনকে উপভোগ করাটাও একান্ত জরুরী। জীবনের সংগ্রাম ও কসরতের কষ্ট লাঘব করতে আনন্দ উপকরণের দরকার।  আর তা সম্ভব হয় উৎসবের হাত ধরে। একেকটা উৎসব একেক রকমের, কোনটা একদিনের, কোনটা বা চারদিনের বা এক সপ্তাহের। জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে উৎসবের প্রয়োজনীয়তা কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত। তাই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে উৎসবের আয়োজন হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মানুষের জীবনে।
এ ব্যাপারে অনেক বিতর্কের অবকাশ থাকলেও উৎসবের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক অবদান অনস্বীকার্য। যারা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে পুজোর মন্ডপ বানান, তারা হয়তো সারাবছর ওই কাজটির অপেক্ষায় থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, মেদিনীপুরের অনেক মন্ডপশিল্পী, পটশিল্পী বন্যাকবলিত হন, ঘরছাড়া হন। তারা দুর্গাপূজায় মণ্ডপসজ্জার কাজ করেন। তেমনি বাঁকুড়া, বর্ধমানের ডোকরা শিল্পী, হাওড়ার জারি শিল্পী, কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা কিছুটা সুখের মুখ দেখেন। চন্দননগরের আলোকশিল্পীদের কাজ তো আজ এক প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড। তারপর রাজ্যের বহু জায়গায় ফুলের চাষ হয়। তারাও উৎসবের মরশুমে উপকৃত হয়। বাঁশচাষীরাও রোজগারের মুখ দেখে।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে দেখা যায় কোটি কোটি টাকার অর্থনীতি জড়িয়ে আছে একেকটা উৎসবের সঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ প্রথমে এপার বাংলার দুর্গাপূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক প্রভাব আলোচনা করা যেতে পারে।



পুজোতে সব মানুষ যার যার সাধ্যমত নতুন বস্ত্র কেনে। যারা একান্ত পারেনা,  তাদেরও  বিভিন্ন পুজো কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে কিছু না কিছু অবশ্যই জুটে যায়। ২০১৮ সালের দুর্গাপূজায় পশ্চিমবঙ্গে শুধু কাপড়ের দোকান বা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আনুমানিক ৫০০০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল বলে জানা যায়। তার ফল বড় দোকানদার, বিতরক, নামী দামী সংস্থার পাশাপাশি তাঁতি, সুতোশিল্পী ও ছোট বস্ত্রব্যবসায়ীরা এমনকি যারা হাটে হাটে কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে ফেরি করেন, তারাও প্রাপ্ত হন। যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে স্টাইল বা ফ্যাশন বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। ফলে সেলুনে বা পার্লারগুলোতে ভীড় জমে। এতে নরসুন্দর, বিউটিশিয়ান, চুলের স্টাইলিস্টরা লাভের মুখ দেখেন। শুধু কি মানুষ নিজেকে সাজায়, পুজোর সময় মানুষ নিজের বাড়ি সাজায়, চুনকাম ,নতুন রং করে, আলো লাগায়। যার ফলে রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রী, রং মিস্ত্রী, ইলেকট্রিশিয়ানের কাজের সুযোগ হয়। গহনা শিল্পের মতো বিভিন্ন হস্তশিল্প ও কুটিরশিল্প সংশ্লিষ্ট সকলকে এক বাড়তি উপার্জনের দরজা খুলে দেয় এই উৎসবগুলো। মিষ্টির দোকান, ফার্স্টফুডের দোকান, রেস্টুরেন্টগুলো জমিয়ে ব্যবসা করে। হোটেলগুলিতে প্রচুর পর্যটক আসেন। পর্যটনশিল্পে এক নতুন জোয়ার আসে। কয়েক বছর আগেও পুজো উপলক্ষ্যে বিভিন্ন গানের ক্যাসেট, সিডি বেরোত, নতুন সিনেমা হয় আজো। কিছুটা কমলেও, এখনো উৎসবের মরশুমে মিউজিক ও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে। হোর্ডিং,  ব্যানার ইত্যাদি তৈরিতে ও বিভিন্ন স্মরণিকার কাজে প্রেসগুলো ব্যস্ত থাকে। গান, পল্লীগান, লোকগান, কীর্তন, বাউল, নাটক, যাত্রাগান, ছৌ নাচ, গানের অনুষ্ঠান চলতে থাকে সর্বত্র। এগুলোকে অবলম্বন করে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। হাসি, আনন্দ আর উৎযাপনের মধ্য দিয়ে মেতে ওঠে অসংখ্য মানুষ। ফলে অনেক মানুষ তথা দোকানী, ব্যবসায়ীরা উপকৃত হয়। আসলে উৎসবের এক বহুমাত্রিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আর সেই সঙ্গে জোটে মনের খোরাক। মানসিকভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠে সবাই। মানুষ পুজো উপলক্ষ্যে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রী যথা টিভি, মোবাইল ইত্যাদি কেনেন। ক্রেতাদের উৎসাহিত করতে উৎসবের মরশুমে কোম্পানি ও বিতরকেরাও প্রচুর ছাড় দিয়ে থাকেন বিক্রি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য। অর্থনৈতিক প্রভাবের এক সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব আলাদা এক অবসরে আলোচনা করা যেতে পারে।
একইভাবে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঈদের অর্থনৈতিক প্রভাবও চারিত্রিকদিক থেকে সদৃশ।
উৎসব এভাবেই মানুষকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে একসূত্রে আবদ্ধ করে।


চলবে... 



--------------------------------------------------------------------------------------------

এই ধারাবাহিক বিশেষ নিবন্ধটি     প্রতি সোমবার অঙ্কুরীশা-র পাতায় ক্লিক করে পড়ুন ও পড়ান। মতামত জানান। 
ankurishapatrika@gmail. com
..------------------------------------------------------------------------------------------                         

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন