বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২০

ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-২ ) ।। নেপথ্য সংগীতের অন্তরালে — অনন্যা দাশ

 



ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-২ ) 

নেপথ্য সংগীতের অন্তরালে

 অনন্যা দাশ    

(২)

ফোনটা বাজতেই চমকে উঠল ছেলেটা । আশপাশের সব কিছু গৌণ হয়ে গেল। ওর শরীর মন টানটান হয়ে উঠল। একবার মনে করল ধরবে না ফোনটা, পরক্ষণেই আবার মনে হল যদি দরকারি কিছু হয়। ফোনটা বেজেই চলল। কয়েক সেকেণ্ডের দ্বিধার পর সে তুলেই ফেলল রিসিভারটা। কানে দিতেই ওপাশ থেকে হিমশীতল কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “কাজটা তুমি ঠিক করোনি হে ছোকরা, তোমার পাপের শাস্তি তোমাকে পেতে হবে!”

«কে তুমি? কি চাও? কেন বারবার আমাকে এভাবে ফোন করছ? আমি পুলিশে যেতে পারি জানো?”

ওপাশের লোক খ্যাকখ্যাক করে হাসল, “আমি বোকা নয় হে! সব খবর রাখি। তুমি পুলিশের কাছে গিয়েছিলে। ওরা তোমার কথা বিশ্বাস করেনি। কোন এক পাগলা ছেলের প্রলাপ শোনার মতন সময় ওদের নেই। ওদের বিশ্বাস হবে না আমি জানতাম। কোন প্রমাণ তো তুমি ওদের দিতে পারো নি, পারবেও না।”

«কেন তুমি আমার পিছু নিচ্ছ?” ছেলেটা মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠল।

“তুমি ভুল করেছো, পাপ কাজ করেছো, সেই কাজের প্রতিকার না করা পর্যন্ত তোমার নিস্তার নেই!”

“আমি পালিয়ে যাবো তোমারা আমাকে খুঁজে পাবে না!”


“অত সোজা নয় মানিক! আমরা নজর রাখছি তোমার উপর!”

ছেলেটা উঠে গিয়ে জানালার পর্দাটা অল্প সরিয়ে দেখল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। ওদের ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনের ল্যাম্প পোস্টটায় ঠেস দিয়ে রেনকোট পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাধারণ দৃশ্য কিন্তু সাধারণ তো নয়, বৃষ্টির মধ্যে কারো তো এই রকম বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। তাহলে কেন... একটা অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলে ছেলেটা।

“আমি কি ভুল করেছি না বললে আমি তার প্রতিকার করব কিভাবে?”

“তোমাকে তোমার ভুল বুঝতে হবে সেটাই তোমার শাস্তি।” বলে ফোনটা কেটে দিল লোকটা।

কাঁপতে কাঁপতে ফোনটা রাখল ছেলেটা। ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে কী ভুল করে থাকতে পারে সেটা ভাবতে চেষ্টা করতে লাগল সে।


(৩)

চিকেনের ঠ্যাংটায় সবে একটা কামড় দিয়েছে জিকো এমন সময় মামা ঘোষণা করলেন, “দিদি এবার জামাইবাবু যখন আসবেন তখন শীতের ছুটিটায় রাজস্থানটা ঘুরে আসব ভাবছি!” 

জিকো আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে ফেলল, “রাজস্থান মানে সোনার কেল্লা?”

আর ওমনি ধমক খেল মার কাছে, “জিকো তোমাকে কতবার বলেছি মুখভর্তি খাবার নিয়ে কথা বলবে না!”

মামা হেসে বললেন, “না, জয়সালমেঢের দিকটা যাচ্ছি না। মরুভূমি দেখতে হলে অনেক বেশি সময় লাগবে আর বাড়তি ছুটি নিতে হবে। মোটামুটি জয়পুর, উদয়পুর, মাউন্ট আবু রেঞ্জে থাকার কথা ভাবছিলাম।”

মা বললেন, “জয়পুরে আমার এক কলেজের বন্ধু থাকে, অনেকবার আমাকে যেতে বলেছে। কলেজের সময় খুব ভাল বন্ধ ছিলাম আমরা তারপর ওর বিয়ে হয়ে ও অন্যত্র চলে গেল। আগে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত, এখন আবার ফেসবুকে বন্ধু হয়েছে।”

“আমি অবশ্য হোটেলে থাকার কথাই ভাবছিলাম। আমাদের অফিসের একজন, মানে সুগতদা ঘুরে এলেন পুজোর সময়।আমাকে সব হোটেলের নামধাম ইত্যাদি দিয়েছেন, এমনকি ট্যুর প্ল্যানটাও দিয়েছেন। খাসা ঘোরা হবে।” 

“না, না, আমি ওদের বাড়িতে থাকব না, বড়জোর দেখা করতে যাবো এক দিন।”

জিকো-কেকার বাবা নিউ ইয়র্কে কাজ করেন। বছরের শেষে ছুটি নিয়ে তাঁর কলকাতা আসার কথা।

“তবে শীতের সময় রাজস্থান বেশ ঠাণ্ডা হবে মনে হয়,” মা বললেন।

কেকা বলল, “আমরা নিউ ইয়র্কের শীত সহ্য করে আসলাম, তার সামনে অয়পুরের ঠাণ্ডা তো আমাদের কাছে নস্যি।”

খাবার পর মার বন্ধু স্নিগ্ধামাসির ফোন আসতে মা বেডরুমে চলে গেলেন কথা বলতে। মা যেতেই মামা ফিসফিস করে বললেন, “আসলে আরো একটা ব্যাপার আছে!”

“কি? কি?”

“আমাদের অফিসের এক ক্লায়েন্ট ওখানে বিপদে পড়েছেন। দিদিকে সেটা বললে তো খেপে যাবে আর যেতে চাইবে না। তাই ওই কথাটা ওকে আর বললাম না। আমাকে এমনিতেও অফিস থেকে যেতেই হত।”

জিকো-কেকার মামা সাগর দত্ত একটা ল ফার্মে কাজ করেন। মামার কথা শুনে জিকো-কেকা “কি হয়েছে কি হয়েছে?" করে মামাকে চেপে ধরল।

মামা বলতে শুরু করলেন, “ধূর্জটিচরণ কর্মকার বলে আমাদের একজন ক্লায়েন্ট আছেন। ভদ্রলোক লেখক। উনি যেটা করেন, ভারতের প্রাচীন এবং দামি দামি মণিমাণিক্য যা সব আছে সেগুলোকে নিয়ে রিসার্চ করে সেইসব গল্প লেখেন। ওঁর লেখা “প্রাইসলেস জেম্‌স অফ ইন্‌ডিয়া অ্যান্ড দেয়ার অ্যামেজিং স্টোরিজ” বইটা বেশ ভাল বিক্রি হচ্ছে। ওঁর প্রকাশক ওঁকে দ্বিতীয় পর্ব লিখতে বলেছে। যাই হোক, বিভিন্ন জায়গা থেকে বিখ্যাত সব মণিমাণিক্য সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করে উনি বই লেখেন। 

অনেক সময় সেই মণিমাণিক্যগুলো মিউজিয়ামে থাকে, আবার অনেক সময় রাজাদের বাড়িতে বা প্রাইভেট কালেকটারদের বাড়িতে থাকে। সেই রকমই একটা পাথর দেখতে গিয়েছিলেন উনি। পাথরটা একটা অ্যামেথিস্ট। আ্যামেথিস্ট এক ধরনের কোয়ার্টজ। 

সাধারণত বেগুনি রঙের হয়। ওর নামটা এসেছে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা থেকে। “আ” মানে না আর “মেথুসটোস' মানে নেশা। প্রাচীন কালে গ্রিকরা আ্যামেথিস্ট পরত আর অ্যামেথিস্ট. দিয়ে পাত্র তৈরি করত কারণ ওদের ধারণা ছিল যে তাহলে ওদের নেশা হবে না! তেমন আবার ইউরোপের সৈনিকরা আ্যামেথিস্টের মাদুলি পরে যুদ্ধে যেত রক্ষাকবচ হিসাবে। এমনিতে এখন তো গয়নাগাটিতে ব্যবহার হয়।” 

কেকা বলল, “আমার বন্ধু দিব্যার জন্মদিন ফেব্রুয়ারিতে। ও বলে যাদের ফেব্রুয়ারিতে জন্ম তাদের বার্থস্টোন নাকি অ্যামেথিস্ট।”

হযা। তা যা বলছিলাম, জয়পুরের শেঠ কুন্দনলাল ঝভরের কাছে একটা খুব দামি আ্যামেথিস্ট আছে। সেটা ওনার পরিবারে বহু দিন থেকে আছে। আ্যামেথিস্ট নাকি যত বড় আর স্বচ্ছ হয় তার তত দাম বেশি। এটা বেশ বড় এবং খুবই স্বচ্ছ। ওনাদের পরিবারে কিংবদন্তী আছে যে যত দিন ওই পাথরটা ঝভর গরিবারে থাকবে ততদিন তাদের টাকা পয়সার কোন অভাব হবে না। একবার নাকি তাঁর কোন এক পূর্বপুরুষ সেটা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং ভয়ানক দারিদ্রের কবলে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর কিভবে জানি পাথরটা আবার উদ্ধার করতে অবস্থা ভাল হয়ে যায়। ওইরকম অনেক গল্প আছে। সেইসব গল্প বিস্তারিতভাবে জানতেই শেঠ কুন্দনলালের বাড়ি গিয়েছিলেন ধূর্জটবাবু। সেখানে আরো কিছু লোকজন ছিল। মোদ্দা কথা হল পাথরটা চুরি যায়। দুজন সাক্ষী দিয়েছে যে তারা ধূর্জটবাবুর কাছে গাথরটা শেষ বার দেখেছে। উনি বলেছেন উনি পাথরটার ছবি তুলছিলেন বটে নিজের বইটার জন্যে কিন্তু তারপর উনি সেটাকে যথাস্থানে ফিরিয়ে দেন। সেখান থেকে অন্য কেউ ওটাকে নেয় হাতে, কে সেটা ওনার মনে নেই। এদিকে কুন্দনলাল বলেন তিনি ফোন ধরতে ঘরের বাইরে গিয়ে ছিলেন, ফিরে এসে দেখেন পাথরটা নেই। উনি কাউকে ওই ঘর থেকে বেরোতে না দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে ফোন করেন। পুলিশ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আর সবাইকে এবং সবার বাড়ি সার্চ করে। পাথরটা ওরাই পায় ধূর্জটিবাবুর ঝোলায় ওঁর জিনিসপত্রের সাথে এবং ওঁকে ধরা হয়েছে। যেটা সবচেয়ে বাজে সেটা হল বেশ কিছুদিন ধরে একজন চোর এই ধরনের দামি পাথর চুরি করে বেড়াচ্ছিল। পুলিশের ফাইলে তার নাম দেওয়া হয়েছিল কালনাগ। সেই কালনাগের চুরির একটা পাথরও ওনার বাড়িতে পাওয়া যায়। এখন পুলিশ বলছে উনিই আসলে কালনাগ! ওই কালনাগ তার চুরি করার সময় কিছু লোককে খুনও করেছে তাই তার অপরাধ আরো অনেক বেশি সঙ্গীন।  

ধূর্জটিবাবু বলছেন ওঁকে ফাঁসানো হয়েছে আর আমাদের কাছে কেঁদে পড়েছেন। তাই কম্পানি থেকে আমাকে যেতে বলা হয়েছে। আমি প্রথমে ব্যাপারটা ঠিক কি হয়েছিল একটু যাচাই করে দেখব তারপর আমাদের অফিসের বড় সাহেবরা যাবেন কোর্টে কেসটা লড়তে। এবং সেই জন্যেই রাজস্থান যাওয়া!”

“অত ফিস্‌ফিস্‌ করে কি কথা হচ্ছে?” মার ফোন করা শেষ হয়ে গেছে বলে মা ঘরে এসে ঢুকেছেন!

জিকো তাড়াতাড়ি বলল, “মামা আমাদের গল্প বলছিল!”

“ও, তা তো বুঝলাম কিন্তু অত ফিস্‌ফিস্‌ করে গল্প বলার কি আছে?”

মার কথা বিপদজনক মোড় নিতে পারে দেখে মামা কথা ঘুরিয়ে বললেন, “ভাবছি অখিলবাবুকে আমাদের সাথে যেতে বলব কিনা। উনি তো বেড়াতে ভালবাসেন অথচ একা কোথাও যেতে সাহস করেন না!”

“হ্যাঁ, তা বলতে পারিস, দলে ভারি হলে খারাপ তো কিছু হবে না!” বলে মা আবার ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। 

কেকা বলল, “কিন্ত মামা ধূর্জটিবাবু যদি সত্যি সত্যি কালনাগ হন তা হলে?”

“সেটা বের করাই তো আমার কাজ হবে। উনি যদি সত্যি কালনাগ হন তাহলে তো ওনাকে শাস্তির হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না, আর তখন আমাদের কম্পানিও ওনার কেস লড়বে না। 


(৪)

দুপুরবেলা একটা দোকানে বসে পুরি তরকারি খাচ্ছিল কালনাগ। দিনেরবেল৷ সে আর পাঁচটা সাধারণ লোকের মতনই বিশেষত্বহীন। তাকে দেখে কেউ বুঝাবে না যে রাতেরবেলায় সেই ওই রকম ভয়াবহ ভয়ানক হয়ে ওঠে। খেতে খেতে সামনের বাড়িটার উপর নজর রাখছিল সে। সাধারণ একটা বাড়ি। জয়পুর শহরের প্রসিদ্ধ গোলাপি রঙে রঙ করাও নয়। ভাবতে অবাক লাগে যে ওই ঝরঝরে বাঁড়িটার তিনতলায় নীলজ্যোতি রয়েছে। রাজা মহারাজার মুকুটে যার স্থান পাওয়ার কথা সেই মণি কিনা এক আস্তাকুড়ে!   

তিনতলার ঘরটায় ডিসেম্বর মাসেও ফুল স্পীড পাখার তলায় বসে দরদর করে ঘামছিল অঙ্গদ। ভারি রাগ হচ্ছিল ওর দিদির উপর। কেন যে দিদি ওই রকম করল! নীলজ্যোতিটা কেন যে ওকে রাখতে দিল এক সপ্তাহের জন্যে! ওর জামাইবাবু সুধীর বাড়ির বড়ছেলে। ওদের পূর্বপুরুষরা কোন রাজাদের কাছে জানি কাজ করতেন। সেই রাজা খুশি হয়ে নীলজ্যোতিটা ওই পূর্বপুরুষকে উপহার দিয়েছিলেন। নীলজ্যোতি একটা বিশাল নীলা। তারপর সেটাকে হারে গাঁথা হয় আর পরিবারের বড় ছেলে সেটা উত্তারাধিকার সুত্রে পায়। ওর জামাইবাবু বড়ছেলে বলে সেটা পেয়েছে আর দিদি মাঝেমধ্যে ওই হারটা পরে। তাই নিয়ে জামাইবাবুর ভাইবোনদের মধ্যে যথেষ্ট রাগ, ক্ষোভ। মণিটা লকারেই থাকে বেশিরভাগ সময়। দুদিন আগে দিদি কোন একটা হাইফাই বিয়েতে পরবে বলে ওটাকে বার করেছিল। সেদিনই হঠাৎ খবর আসে যে ইন্দোরে ওর শাশুড়ি খুব অসুস্থ আর তখনই ওরা তড়িঘড়ি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ইন্দোর রওনা হয়ে যায়। লকারে নীলজ্যোতিকে রেখে যাওয়ার আর সময় হয়নি! যাওয়ার আগে দিদি অঙ্গদকে হারটা দিয়ে বলে, “আমরা না আসা পর্যন্ত তুই এটাকে নিজের কাছে রাখ। একসপ্তা দশদিনের মধ্যেই ফিরে আসব। খালি বাড়িতে ওটাকে রেখে যেতে চাই না। কেউ কিছু জানবে না। তুই ওটাকে চালের ড্রামে বা অন্য কোথাও টুক করে লুকিয়ে রেখে দিস। কিছু হবে না।”  

দিদি তো কিছু হবে না বলেই খালাস আর এদিকে অঙ্গদের তো ভয়ে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। গতকাল থেকেই সবসময় মনে হচ্ছে কে যেন ওর পিছু নিয়েছে। দিদিকে ফোন করে কথাটা বলতে দিদি হেসেই উড়িয়ে দিল। বলল, “দুর, ওসব তোর মনের ভুল! কেউ জানেই না ব্যাপারটা তাহলে কেন তোর পিছু নেবে?” 

এদিকে অঙ্গদের তো নাওয়াখাওয়া মাথায় উঠেছে। খাটের উপর বসে সে ভাবল, 'সত্যি কি কেউ জানে না? কেউ যদি জেনে ফেলে থাকে কোন ভাবে? অত দামি জিনিস খোওয়া গেলে কি করবে অঙ্গদ? ওকে বেচে দিলেও তো অত টাকা জোগাড় হবে না! তিনতলার ঘরে বসে ভয়ে ঘামতে থাকে অঙ্গদ।


চলবে...


----------------------------------------------------------------

প্রতি শুক্রবার এই ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাসটি অঙ্কুরীশা-র পাতায় ক্লিক করে পড়ে নিন। মতামত জানান। 

                

ankurishapatrika@gmail.com

-----------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন