শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২০

অঙ্কুরীশার শারদীয়া সংখ্যা ১৪২৭। গল্প- (পর্ব-২)

 




গল্প(পর্ব-২)

শঙ্কর ব্রম্ভ, দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়, মিতালী গায়েন,  কবির কাঞ্চন 



দুঃস্বপ্ন 

শংকর ব্রহ্ম


 " ভালবেসে যদি তুমি কষ্ট নাহি পাও

তবে সেটা ভালবাসা কিনা,

                      মনে আগে জেনে নাও।"                                                


রাত বারটার পর শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা, নিয়েই ফেলল অধ্যাপক বিনোদ মজুমদার। 

না আর নয়।  অনেক হয়েছে। অণিমা রায় তার মেয়ের মত। তবু তাকে ছাড়া বাঁচবে না সে।

বিচার বুদ্ধি হারিয়ে, এতটা ভালবেসে ফেলেছে সে তার ছাত্রীকে ।

          রাত এখন গভীর। কুকুরগুলো ডাকতে ডাকতে ঝিমিয়ে পড়েছে। হয়তো ঘুমিয়েও পড়ছে। জেগে নেই কেউ। 

                ফ্যান থেকে ফাঁসটা ঝুলিয়ে গলায় পরানোই আছে। শুধু টুলটা একটু পা দিয়ে ঠেলে দিলেই হল। এত ভালবেসেছে অণুকে,এখন মরণ ছাড়া আর কোন গতি নেই। 

          কৃষ্ণও তো রাধাকে ভালবেসে ছিল।রাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের মামী হতো। আর বয়সের ব্যবধানও তাদের মধ্যে খুব একটা কম ছিল না।  তাদের প্রেম নিয়ে কত অমর কাব্য লেখা হয়েছে যুগে যুগে। তাদেরটা ছিল লীলা।  আর আমি মেয়ের বয়সী কারও সাথে প্রেম করলে সেটা হয়ে যায় বিলা। মনে মনে ভাবল সে। কি বিচার এই পঙ্গু সমাজের।

টুলটা পায়ের ধাক্কায় ঠেলে দেবে এমন সময় আচমকা ঘরে ঢুকল কে যেন। চমকে উঠল সে। 

_  কে ?

_  আমি তোমার বিবেক 

_  কি চাই তোমার ?  কেন  এসেছো এখানে?

_  তোমাকে সাহায্য করতে

_  কি ভাবে ?

_   টুলটা আমি সরিয়ে নিচ্ছি, তোমার আর কষ্ট করে টুলটা সরাতে হবে না।

_  না   না   না  

     চেচিয়ে  উঠল বিনোদ। 

  অণু আমাকে এবারের মত বাঁচাও |  

  বাঁচাও প্লীজ...

_   কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। 

 অণিমা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কাল সকালে উঠে খবরটা শুনবে।  

কিম্বা খবরের কাগজের হেড লাইনে দেখবে

--একটি আত্মহত্যা আর অনেক জল্পনা--     

আঁতকে উঠল সে | হঠাৎ তার ঘুমটা ভেঙে

 গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। সারা শরীর ঘামে ভিজে,চপচপ করছে। বিছানা ছেড়ে উঠে এসে,এক বোতল জল ঢকঢক করে খেল সে।

জীবনে বাঁচার যে এত স্বাদ, এত আনন্দ বিনোদ আগে আর কখনো টের পায়নি। সারারাত সে আর ঘুমতে পারল না। দুঃস্বপ্নটা যদি পুনরায় ফিরে আসে?



 লাল কান্না
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়  

            আজ অভীকের মনটা বেশ ফুরফুরে।টেনশন ফ্রি। কদিন ধরে মাকে নিয়ে বেশ টানাপোড়েন চলছিল। কাল সকাল থেকে মা একটু সুস্থ, অনেকটা প্রাণবতী। বিকেলে অয়ন মাকে দেখতে এসেছিল। অনেক দিন পর সারা সন্ধ্যা ওর সাথে আড্ডা মেরে অনেকটা নিজের ছন্দে। কদিন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল ও। মায়ের ও কি তাহলে চলে যাবার সময় হল? যাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, সেই ওকে ফাঁকি দিয়ে পালায়। প্রথমে বাবা।তারপর সঞ্চিতা।আর এখন কি মা !
       কদিন ধরে অভীক মায়ের পাশেই ছিল। দীর্ঘ একসপ্তাহ প্রায় গৃহবন্দি। বেশ কয়েকটা কবিতা লিখেছিল। অয়নের বেশ ভালো লেগে গেল কবিতাগুলো।"পদধ্বনি" কবিতাটা ও ওদের পত্রিকার জন্য নিয়ে গেল।
     রেনীমাসি রান্না করে আজ সারাদিন মায়ের কাছে থাকবে বলেছে।তাই অভীক আজ বেড়িয়ে পড়ল। গন্তব্য বর্ধমান রাজ কলেজ। লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় রাজ কলেজের বাংলা বিভাগের কয়েকটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। ওদের পত্রিকা "শুভেচ্ছা" কিনেছিল ও। ছেলে গুলোর সাথে কথা বলে বেশ সতেজ ও সবুজ মনে হয়েছিল। চন্দন বলে ছেলেটিকে বেশ লেগেছিল অভীকের। কালো চশমার পিছনে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ওকে সকলের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। চন্দনের ডাকেই ও আজ বর্ধমান যাচ্ছে। ওদের শ্রাবণ সংখ্যার প্রকাশ আজ।অভীকেরও একটা ছোটগল্প আছে--"প্রাণ ঝর্ণা"। ডাকে পাঠিয়ে ছিল লেখাটা আগে।
      ট্রেনটা প্রায় ফাঁকা।এই গরমে কেউ আর দুপুরে বাইরে বেরতে চাইছে না বোধহয়।এসির প্রশান্তি ই শ্রেয় যেন ! জানালার ধারে বসেও ও ভেতরে সরে এল।'লু' বইছে যেন ! গরমে পাঞ্জাবি টা পুরো ভিজে গেছে।
        অয়ন কাল যাবার আগে গ্যাব্রিয়েলা গার্সিয়া মার্কসের  "ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউড" বইটা দিয়ে গেছিল পড়ার জন্য।বইটার কথা অনেক শুনেছে।কাল অনেক রাত পর্যন্ত বইটা পড়েছিল ও। অদ্ভুত লেখনী ! যেন জাদুকর।একদম ছাড়তে পারছিল না। বত্রিশ টা ভাষায় অনুদিত হয়েছে বইটা। বিক্রি হয়েছে এক কোটি কপিরও ওপর।সাধে কি আর চিলির কবি পাবলো নেরুদা মন্তব্য করেন---"সেরভানতেসের  ' ডন কিয়োটো'র পর স্প্যানিশ ভাষায় এত বিপুল উদঘাটন বোধহয় আর ঘটেনি ।" বইটার ইংরেজি অনুবাদ করেন মার্কিন সাহিত্যিক গ্রেগার বারসিসার।
      কাল পুরোটা শেষ হয়নি।ব্যাগ থেকে বইটা বের করে পড়তে শুরু করল। প্রাণবন্ত লেখনী ক্রমশঃ যেন টেনে হিঁচড়ে গল্পের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। একমনে পড়ে চলল ও।
       হঠাৎ কামরার গেটের কাছে চিৎকার কানে এল। তাকিয়ে দেখল গেটের একদিক প্রায় বন্ধ করে একটা বড়ো বস্তা রাখা আছে। বস্তা থেকে কাঠের ছোট ছোট টুকরো উঁকি মারছে। মনে হল ছোট ছোট গাছের ডালের সাথে কিছু বাঁশ গাছের গোড়াও আছে। জ্বালানির জন্যই বোধহয়। পাশে বসে আছে এক দেহাতী মহিলা।বয়স ত্রিশের নিচেই হবে। কালো পাথরে খোদাই করা রামকিঙ্কর বেইজের কোন আদিবাসী মহিলা যেন! স্বাস্থ্য বতী। পরনের শাড়ি অনেক জায়গায় ছেঁড়া। ব্লাউজটাও তথৈবচ। খুব কষ্ট করে লজ্জা নিবারণ করছে বোঝা গেল। পাশে বসে এক দেবশিশু। একমাথা কোঁকড়া কালো চুল।খালি গা। কোমরের প্যান্টটা অনেক জায়গায় ছেঁড়া।বয়স বড় জোর পাঁচ হবে। পাঁপড়ের একটা প্যাকেট   দুজনে মজা করে খাচ্ছে। বাচ্চাটার মুখে স্বর্গীয় হাসি। সামনের দাঁতটা নেই।ফোকলা দাঁতে আরও সুন্দর লাগছে ওকে।
      প্রবীরের" মা ও ছেলে" ছবিটার কথা মনে পড়ল। অ্যাকাডেমিতে ওর ছবির প্রদর্শনীতে ঠিক এরকমই একটা ছবি দেখেছিল অভীক। একটা থালায় কিছু ভাত ছড়ানো।আর এক আদিবাসী মা ও ছেলে ভাত খাচ্ছে থালা থেকে। মুখে ওদের অনাবিল হাসি। ছবিটা বেশ প্রশংসিত হয়েছিল সেই সময়। কয়েকটা কাগজে লেখা বেড়িয়েছিল ছবিটাকে নিয়ে।
       একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ও  ওদের দিকে। মেয়েটির মুখে চরম ঔদাসীন্য।কারও কোন কথা যেন ওর কানে যাচ্ছে না। একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নিয়েছে মা ও ছেলে।
       এভাবেই বেশ কয়েকটা ষ্টেশন গেল। চন্দননগরে কামরায় একটা চেকার ও লাঠি হাতে উর্দি পরা এক পুলিশ উঠল।উঠেই বস্তাটাকে কেন্দ্র করে হম্বিতম্বি শুরু। কিছু যাত্রী ওদের সাথে যোগ দিল। বস্তা টাকে পরের ষ্টেশনে ই নামিয়ে দেবে বলে পুলিশটা জোর করতে শুরু করল।মেয়েটি প্রথমে অনুনয় বিনয় কাকুতি করছিল। কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল--"ওর সোয়ামি খুব অসুস্থ। তিনদিন মুড়ি আটাগোলা খেয়ে আছে।আজ এই কাঠ নিয়ে গেলে দুটো রান্না করে খাবে।"
      চেকার ও পুলিশ দুজনেই নাছোড়।মেয়েটার কোমড়ে গোঁজা টাকার উঁকি ওদের আরো লোভী করে তুলেছে। জোরালো দাবির কাছে অসহায় মেয়েটা বার বার চিৎকার করে বলে চলেছে---" ডিম বেচে ট্যাকা কটা জুগার করেছি। যাবার পথে মরদটার জন্য ওষুধ কিনবো রে ! তোরা টাকা কটা লিস নাই বাপ ।"
     মেয়েটার কান্নার আর্তি সারা কামড়ায় সকাউকেই যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে না।সকলে যেন ষ্টেজের ওপর অভিনয় দেখছে।দেখে যাওয়া ছাড়া তাদের যেন আর কোন কাজ নেই।
       টাকা নিয়ে টানাটানি চূড়ান্ত পর্যায়ে। অভীক উঠে দাঁড়াল। এভাবে বসে বসে দেখা যাচ্ছে না। এগিয়ে গেল ওদের দিকে। কিছু বলতে যাবার আগেই পুলিশটা মেয়েটার কোমড়ের শাড়িতে হাত দিতেই চোখে আগুন নিয়ে পুলিশটার গালে এক থাপ্পর মারল মেয়েটা।পুলিশটা আরো মারমুখী প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠল।
         হঠাৎ পুলিশটা হেলে থাকা বস্তাটায় এক লাথি মেরে ট্রেনের বাইরে ফেলে দিল। বস্তাটাকে ধরতে মেয়েটাও দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে লাফ দিল কামরার বাইরে। হঠাৎ জোর একটা শব্দ। টাটকা রক্তের ফিনকি এসে আছড়ে পড়ল পুলিশের খাকি উর্দিতে।
        হতবাক কামড়ার সব। কাপুরুষ নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিল বাচ্চাটার   "মাগো" চিৎকার !
        ঠিকই বলেছেন মার্কোস! অত্যাচার ও অত্যাচারিত সমাজের বুকে আজও খাদ্য খাদকের সম্পর্কের মতো রয়ে গেছে।যে কোন সময় তা চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে !



     লাল নীল প্রজাপ্রতি
      কবির কাঞ্চন  


পড়ন্ত বিকেল। বেলকনিতে বসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি নেমেছিল।  এখন বৃষ্টি ভেজা মিষ্টি রোদ। আকাশে পাখি উড়ছে। একটা দুইটা নয়। ঝাঁকে ঝাঁকে। কাছে দূরে কিংবা বহুদূরে। কোন অজানা সুখের খোঁজে। পাখিদের চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ। দেখে মনে হচ্ছে অনেক অনেক দিনের পর ওরা সুনীল আকাশের বুকে প্রত্যাশিত ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। নির্মল বাতাসে প্রাণ ভরে ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। সমীরণে কিচিরমিচির সুর তুলে পৃথিবীকে তারা জানান দিচ্ছে তাদের খুশির বার্তা। এ এক অনিন্দ্য সুন্দর অনুভূতি!
একটুপর বেলকনি থেকে সামান্য দূরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা  কদমফুল গাছটির দিকে আমার দৃষ্টি পড়ে। অসংখ্য পাতার মাঝে লুকিয়ে থাকা পেয়ারার মতো ঝুলানো কদমফুল যেন আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি। দখিনা বাতাসে পাতার ফাঁক দিয়ে ফুলগুলো এদিকসেদিক নড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে  আমার মনের কষ্ট তাড়াতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি গাছটির একটি ডালে পাতার ফাঁকে মাথা বের করে কদমফুলে পরপর কয়েকবার ঠোকর মারে একটি কাক। আমি অপলক দৃষ্টিতে আরও উদগ্রীব হয়ে চেয়ে থাকি। খানিকক্ষণ পরে কাকটি এদিকওদিক তাকায়। আমার দিকে চোখ পড়তেই ডাল থেকে উড়তে শুরু করে।  আমি অবাক হলাম। তবে কী আমায় দেখে সে লজ্জায় উড়ে গেছে!
এরমধ্যে আমার স্নেহা মামণি আব্বু! আব্বু!  বলে ডাক শুরু করে দিয়েছে।
আমি পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি আমাদের বেলকনির দক্ষিণ কোণের ছোট্ট ফুলবাগানে খেলছে সে। আমার আসতে খানিক দেরি দেখে স্নেহা ব্যস্ত গলায় বলল,
- আব্বু,  জলদি এসো। ওরা চলে যাচ্ছে তো।
আমি ওর কাছে এসে হাঁটুগেড়ে বসে বললাম,
- কৈ মামণি, কারা চলে যাচ্ছে?
- ঐ যে দুইটা পাতা দেখছো, ওগুলো আমাদের গাছের পাতা। আমি একটু আগে গাছে দেখেছি। গাছের পাতায় হাত রাখতেই উড়াল দিলো। আচ্ছা, আব্বু, গাছের পাতা কেমন করে উড়তে পারে?
স্নেহার কথায় আমি না আর হেসে পারলাম না।  এরপর ওকে আদর করে বললাম,
- ওগুলো গাছের পাতা নয়, মামণি। ওগুলো হলো প্রজাপতি। লাল নীল প্রজাপতি।
স্নেহা চোখ কপালে তুলে বলল,
- তা কেমন করে হয়? আমি নিজের চোখে দেখলাম, ওরা গাছে ছিল। আমার হাতের ছোঁয়া পেতেই উড়াল দিলো। আর তুমি বলছো, গাছের পাতা না; প্রজাপতি।
আমার তিন বছর বয়সী কন্যা স্নেহার মিষ্টি গালে চুমু খেয়ে বললাম,
- শোন মামণি, ওগুলো আসলেই প্রজাপতি। গাছের পাতা হলে উড়তে উড়তে একসময় নিচে পড়ে যাবে। আর প্রজাপতি হলে মাটিতে পড়বে না। দ্যাখো, ওরা উড়ে উড়ে কোন দিকে যাচ্ছে?
এই কথা বলে আমি পাশের বেডরুমে চলে আসি।
আর স্নেহা একদৃষ্টে প্রজাপতি জোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা বেশ খানিকক্ষণ উড়ার পর আবার বেলকনির দিকে আসতে লাগলো। ওদের আসতে দেখে স্নেহার সে কী আনন্দ!  সে চিৎকার করে আমায় ডাকতে থাকে,
- আব্বু! আব্বু! তাড়াতাড়ি এদিকে এসো। ওরা আবার আসছে।
আমি তড়িঘড়ি করে বেলকনির দিকে ছুটে আসি। স্নেহা আমায় হাতের ইশারা করে আস্তে করে বলে,
- এখান থেকে দেখো। ওদিকে আর যেয়ো না। নইলে তোমার ছোঁয়া পেলে ওরা আবার উড়াল দেবে।
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,
- ওরা কী মাটিতে পড়েছিল?
- না, পড়েনি। কিছুক্ষণ উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে আবার ফিরে এসেছে।
- তাহলে এখন নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো, ওরা গাছের পাতা নয়; প্রজাপতি।
স্নেহা ঘাঁড় নেড়ে সায় দিয়ে বলল,
- হ্যাঁ, বাবা ওরা আসলে প্রজাপতি।
ওর প্রজাপতি চেনার বিষয় আমার খুব ভালো লেগেছে।
হঠাৎ স্নেহা আমায় প্রশ্ন করে বসে,
- আচ্ছা,  আব্বু  প্রজাপতি কোথায় বাস করে?
- প্রজাপতি ঠিক বাসা তৈরি করে বাস করে না। যেকোনো ধরনের গাছের ডালে, ঝোপঝাড়ে, ইটের খাঁজে, বিল্ডিংয়ের মাঝের ফাঁকা জায়গায় ওরা বাস করে।
- ওরা তো অনেক ছোট। তাহলে কী খেয়ে বাঁচে? 
- প্রজাপতির মূল খাবার হলো ফুলের মধু। তবে ফুলের রেণু, গাছের রস, পাকা ফলের রস, পঁচা মাংস এমন অনেক ধরনের খাবার গ্রহণ করে।
- ওদের ধরে একটু আদর করি, আব্বু।
- না, না, এ কাজ কখনো করো না। ওদের দেহ খুব নরম। ধরলে অল্পতেই ওদের ডানা ছিঁড়ে যেতে পারে।ওরা মারাও যেতে পারে।
ততক্ষণে স্নেহা আমার কোলে উঠে বলল,
- আব্বু, আমি কখনো ওদের ধরব না। ওদের কষ্ট দেব না।
এরপর ওকে নিয়ে আমি ড্রয়িংরুমের দিকে চলে আসি।

হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুললাম। আমার স্ত্রী ছাদ থেকে ফিরেছে। সাথে আমার ছেলে সায়ীদও। আমি তখন স্নেহার সাথে গল্প করছি।
সায়ীদের বয়স সাত বছর। এবছর সে প্রথম শ্রেণিতে ওঠেছে। পড়াশোনায় ভালো। কিন্তু পড়তে বসতে চায় না। সারাক্ষণ দুষ্টুমিতে পড়ে থাকে।

প্রায় মিনিট দশেকের মতো সায়ীদের কোন সাড়াশব্দ নেই। এরপর বেলকনি থেকে ছুটে এসে সে উৎফুল্ল হয়ে বলল,
- আব্বু, দ্যাখো এতক্ষণ আমি কী কাজ করেছি!
এই বলে সে প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা কৌটা বের করে দেখায়। আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকে কিছু বলতে যাব এমন সময় স্নেহা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।
স্নেহার কান্না দেখে সায়ীদ রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল।

প্লাস্টিকের কৌটার ভেতর দুইটি প্রজাপতি।
লালটির একটি ডানা ভাঙা। আর নীলটির দেহের কিছু অংশ ছিঁড়ে গেছে।
স্নেহা কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
- আব্বু, সায়ীদ ভাইয়া, আমার প্রজাপতির ডানা ভেঙে দিয়েছে। তুমি ওকে মারো।
আমি সায়ীদকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
- বাবা, তুমি একি করলে! প্রজাপতিগুলো তো আধমরা হয়ে গেছে। ওদের এভাবে ধরলে কেন? আবার রেখেছো প্লাস্টিকের কৌটার ভেতরে!
- কৌটায় রাখলে কী ওদের খারাপ লাগে, আব্বু?
সায়ীদের এমন প্রশ্নে আমি রাগান্বিত হয়ে বললাম,
- অবশ্যই খারাপ লাগে। সায়ীদ, তোমার  নাকটা একটু চেপে ধর। খারাপ লাগলে কিন্তু ছেড়ে দেবে।

আমার কথামতো সায়ীদ নিজের নাক চেপে ধরলো।  কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে কান্নার সুরে বলল,
- আব্বু, তুমি আমায় নাক চেপে ধরতে বললে কেন? আরেকটু হলে তো আমি মরেই যেতাম।
এই বলে সে কাঁদতে লাগলো।
আমি তার কান্না থামিয়ে বললাম,
- নাক চেপে ধরায় তুমি ঠিকমতো শ্বাস-নিঃশ্বাস নিতে পারছিলে না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এবার ভাব, তুমি যখন প্রজাপতি দুটিকে প্লাস্টিকের বদ্ধ কৌটায় রেখেছো তখন ওদেরও তো এমনটি লেগেছে। তোমার মতো ওরাও প্রাণী। ওদেরও তো আমাদের মতো শ্বাস-নিঃশ্বাসের প্রয়োজন হয়।
আমার কথা শুনে সায়ীদ লজ্জায় মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমি আবার বললাম,
- তোমার সামান্য আনন্দ যদি অন্য কারোর কষ্টের কারণ হয় তবে সেরকম আনন্দের কোন মানে হয় না। দাও, কৌটাটা আমার হাতে দাও।

সায়ীদের হাত থেকে নিয়ে আমি কৌটার মুখ খুলে দিলাম। মুক্তির পথ পেয়েও প্রজাপতিগুলো কৌটা ছেড়ে পালাচ্ছে না। আমি আলতোভাবে ওদের কৌটার বাইরে বের করলাম।
একটুপর নীল প্রজাপতিটি কাঁপা কাঁপা দেহে উড়াল দিল। লাল প্রজাপতিটি উড়বার জন্য অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু একবার উড়তে গিয়ে আবার মেঝেতে পড়ে গেল।
সায়ীদ দৌড়ে গিয়ে ওর পড়ার রুম থেকে একটা কাগজ এনে বলল,
- আব্বু, এই কাগজের টুকরোয় প্রজাপতিটি নিয়ে নিই। এরপর বেলকনিতে ফুল গাছের পাশে রেখে দিই। যখন ভালো হবে তখন উড়ে চলে যাবে। আমি একটু পরপর গিয়ে ওকে দেখব। এই তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন কারো মনে কষ্ট দেব না।


অমৃত খাওয়া
মিতালী গায়েন

জানি, আমার এই লেখা পড়ে আপনারা বলবেন :" *হাঙ্গার* *ইজ* *দ‍্যা* *বেষ্ট* *সস* "। আমিও তাই মনে করি। ক্ষিধের সময় কিছু খাবার আর তার সাথে যদি কিছু ভালোলাগার আবেগ জড়িয়ে যায় -- তবে সেই খাবার অমৃত খাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়।
এখনকার জমানায় উইক এন্ডে বাইরে খেতে যাওয়া অর্থাৎ হোটেল - রেষ্টুরেন্ট বা ফাস্টফুড আউটলেটে চাইনিজ,সাউথ কিংবা ফ্রেঞ্চ খাওয়ার যে ট্রেন্ড তরতর করে বেড়ে চলেছে বা সুইগি-জোমাটো --ফুড ডেলিভারি অ‍্যাপগুলোর প্রতি অসীম প্রেম দেখে আমার একদিন একজনের  বাড়িতে খাওয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
তখন আমি কলেজে পড়ি। একটা ক্লাস করেই বাড়ি গিয়ে শান্তি করে খাব বলে হোস্টেল থেকে না খেয়ে কলেজে চলে যাই। ক্লাস করে একটা অতি রুগ্ন কঙ্কালসার বাসে উঠে পড়ি।মাথার উপর তখন সূর্যের লেলিহান শিখা। অতি মন্থরগতির সমাপ্তি ঘটিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টা পর আমি আমার স্টপেজে নামলাম। মনে মনে ভাবলাম--বাঁচা গেল। পেটের মধ্যে গড়গড় আওয়াজটা বেশ জোরেই হচ্ছিল।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ আমার নাম ধরে জোরে ডেকে উঠলো। তাকিয়ে দেখি আমার এক নিকটতম আত্মীয়া। উনি আমাকে দেখেই খুব উচ্ছসিত হয়ে যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, " চল না রে আমার সঙ্গে একজায়গায়, বহুদিন একা একা  কোথাও যাইনি। খুব দরকার সেখানে যাওয়ার।"।
ক্ষিধেয় তখন আমি চোখে  অন্ধকার দেখছি। অবশ্য  তিনি আমাকে দোকানে কিছু খাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু লজ্জার খাতিরে আমি খেয়েছি বললাম। আবার একটা বাসে উঠে পড়লাম। একটাই সিট খালি ছিল - উনাকে বসিয়ে আমি দাঁড়ালাম। উনি বললেন --বাড়িতে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু ইম্পর্টেন্ট ডকুমেন্টসের একটা ফাইল না পেয়ে উনি যার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করতেন,তার বাড়িতে যদি ছেড়ে আসেন -- এই ভেবে ওখানে যাচ্ছিলেন প্রায় পনেরো বছর পরে। প্রায় এক ঘন্টার পর বাস থেকে নামলাম। ভাবলাম ধারে কাছে কোথাও বাড়ি হবে।
ওমা! পদব্রজে প্রায় আধা ঘন্টা গ্রামের সরু মেঠো পথে গিয়ে অবশেষে উনার গন্তব্য স্থানে পৌঁছালাম। আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপের দিকে------
একটা ছোট্ট মাটির ঘর। উঠোনে মাটির হরি মঞ্চে তুলসীগাছ। আর তার পাশেই পঞ্চ জবার ফুলে ভরা গাছ। তবে সৌন্দর্য দেখার মতো মানসিক স্থিতি তখন ছিল না। দাওয়াতে গিয়ে একটু বসবো বলে উঠতে যেতেই মাথায় নীচু খড়ের চাল লাগল খুব জোরে। মাথা ঘসতে ঘসতে ধপ করে বসে পড়ি ওখানে। 
"মাসিমা-- মাসিমা", আমার আত্মীয়া আওয়াজ দিলেন জোরে জোরে। আমার বুবুক্ষু পেটের জ্বালার সাথে সাথে নাকে তখন মুড়ি ভাজার গন্ধ স্পষ্ট। বেশ খানিকক্ষণ পরে আধ ময়লা শাড়ী পরিহিতা প্রায় আশির কাছাকাছি একজন মহিলা বাইরে এলেন। তাঁর মুখমন্ডলে অর্নিবচনীয় এক শু‍চিতা।যেন মনে হল এক করুণাময়ী মাতৃ মূর্তি। চিনতে পারলেন না কাউকেই। আমার আত্মীয়ার দেখাদেখি উনাকে প্রণাম করতেই কী সুন্দর একটা কপালে চুমু খেলেন! আমার আত্মীয়া মিষ্টির প‍্যাকেটটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে অনেক কথা বলে নিজেকে চেনানোর চেষ্টা করলেন  আর ওই ফাইলের কথা-----। আমার কনসেনট্রেশন কেবল ওই ভাজা মুড়ির গন্ধের দিকেই ছিল। উনি একটা মাদুর পেতে দিলেন মাটিতে। আর পাশেই এক মাটির কলসি থেকে পিতলের গ্লাসে দু গ্লাস জল দিলেন দুজনকে। ঢকঢক করে জল খেয়ে ভাবলাম --জীবনটা যেন এল। তখন সময় দুপুর আড়াইটে-তিনটে হবে।ফাইল যখন পাওয়া গেল না, আমারা উঠে পড়তেই উনি আমার ওই কাকিমার হাত চেপে ধরে বললেন,-- এত দুপুরে কেউ বাড়ি থেকে ভাত না খেয়ে যায় নাকি? শুনে আমার তো খুব -------
যদি দুটো মুড়িও জোটে, খুব ভালো হয়। কাকিমা তো একেবারেই খাবেন না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে কাকিমা আমার খাওয়ার ব‍্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। বাড়িতে উনি একার জন্যই খাবার বানিয়েছেন ভেবে আমারও প্রচন্ড সংকোচ হচ্ছিল। এ দুনিয়ায় উনার একমাত্র মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না। তাও আবার মেয়ের বহু বছর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে।
 সে যাই হোক, উনার আন্তরিক আহ্বানে আমি খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। পেছন দিকের পুকুর ঘাটে পা ধুতে গিয়ে মাটির ভাতের হাড়ির দিকে তাকালাম।উনি তখন ভাত বাড়ছেন। 
তাল পাতার আসনে বসে কাঁসার থালায় খাবার-- ক্ষিধের সঙ্গে অপূর্ব অনুভূতি। ভাতটাকে থালার মাঝে কী সুন্দর গোল করে রাখা ছিল।বাকী মুড়ি ভেজে উনি পরে খাবেন বললেন। যে তরকারি দিয়ে সেদিন খেয়েছিলাম--- এ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা তা জানেই না বা কল্পনাও করতে পারবে না। ওরকম রান্না আমার বাড়িতে আমার ঠাকুমাই বানাতো। কচি তেতুল পাতা আর তেতুল ফুল দিয়ে নটে শাকের কম্বিনেশনে বানানো তরকারি।তার সঙ্গে দুচারটে কুচো চিংড়ি ছিল। অদ্ভূত সেই তরকারির স্বাদ!  আর তিন- চার টুকরো কচুর ভাজা। মিথ‍্যে ভরা পেট বলে একটুখানি ভাত নিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওই একটু খেয়েই আমার পেট একেবারেই ভরে গিয়েছিল। উনি বিশেষ কিছু খাওয়াতে পারলেন না বলে দুঃখ করছিলেন। তাঁর আদর করে খেতে দেওয়া, স্নেহ মাখানো কথা আমার পেটের সঙ্গে সঙ্গে মনটাকে এতটাই ভরিয়ে দিয়েছিল যে আজ পৃথিবীর যেকোনো খাবারের চেয়ে ওই খাবারটাই শ্রেষ্ঠ ছিল মনে হয়। ধন্যবাদের অতো কিতাবী ভাষা সেদিন বলিনি। পাঁচ -ছয় মাস পরেই শুনেছিলাম উনি এই পৃথিবী ছেড়ে  চির শান্তির দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন।

আজ দেবী মায়ের আগমনের প্রাক্কালে চারিদিকে যখন শিশিরভেজা শিউলির গন্ধ,সারি সারি কাশফুল,স্নিগ্ধ আলোয় ঝলমলে শরতের সাদা-নীলচে আকাশ দেখি,আর পুজো পেন্ডেলে বিনা ক্ষিধেয় সকলের অনুরোধে বিরিয়ানি খাওয়ার তোষামোদ পাই,তখন আমার ওই পুণ্য হৃদয়ের মানুষটির ভালোবাসার কথা মনে পড়ে যায়। চোখে জল আসে। ওই অনুভূতিকে আজ একটুখানি  ভাষায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমরা এই ছোট ছোট অনুভূতি,ভালোলাগা, ভালোবাসা গুলোকে জীবন থেকে কখনোই যেন হারিয়ে না ফেলি। এই অনুভূতিগুলোই আমাদের ভালো রাখে- হতাশার মাঝে সবুজ করে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন