শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

রাধাকৃষ্ণণ ও শিক্ষক দিবস:- শ্রদ্ধা ও স্মরণে - মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

 




রাধাকৃষ্ণণ ও শিক্ষক দিবস:-

শ্রদ্ধা ও স্মরণে - মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি  



   ৫ই সেপ্টেম্বর ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, বিশ্বের অন্যতম সেরা দার্শনিক, ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক, চিন্তানায়ক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন। একই সঙ্গে আজকের এই দিনটি মহান শিক্ষক দিবস। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই দিনটির একটি আলাদা মর্যাদা আছে, আলাদা তাৎপর্য আছে। ১৯৬২ সাল। রাধাকৃষ্ণন তখন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেছেন। রধাকৃষ্ণনের অনুগামী, অনুরাগী ভক্তরা চাইলেন তার জন্মদিনটি ঘটা করে পালিত হোক। তখন রাধাকৃষ্ণন জানলেন তাঁর মনের কথা। তিনি চাইলেন তাঁর জন্মদিনটি নিছক জন্মদিন হিসাবে পালন নয়, পালিত হোক ‘শিক্ষক দিবস’ হিসাবে। তখন থেকেই তাঁর জন্মদিন ৫ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে। শিক্ষক সমাজের কাছে এ এক পরম গৌরবের দিন। শিক্ষকদের তিনি কতটা সম্মানের চোখে দেখতেন এই ঘটনাতেই তার পরিচয় মেলে। তাই আমাদের শিক্ষদের কাছে শিক্ষক দিবস হল আত্মসমীক্ষার দিন , শিক্ষার অঙ্গনে কতটুকু কি করতে পেরেছি তার পর্যালোচনার দিন। 

  ১৮৮৮ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর মাদ্রাজের এক ছোট্ট শহর তিরুত্তানি গ্রামে এক গোঁড়া তেলেগু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সর্বপল্লী বীরস্বামী, মাতা সীতাম্মা। সাংসারিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। কিন্তু রাধাকৃষ্ণনের ছিল তীব্র মেধা ও বুদ্ধির জোর। বই পড়ার প্রতি ছিল তীব্র নেশা ও আগ্রহ। বই পেলে তিনি আর কিছু চাইতেন না। যখন অন্যান্য সমবয়সী ছেলেরা খেলাধুলোয় মত্ত, বিনোদন খুঁজে বেড়াচ্ছে সেখানে রাধাকৃষ্ণন তখন বইয়ের মধ্যে মুক্তির স্বাদ খুঁজছেন। এক জ্ঞাতিতুতো ভাইয়ের কাছে তিনি প্রথম একটি দর্শনের বই পান। সেই দর্শন বইটি পড়ার পর দর্শন শাস্ত্রের প্রতি তীব্র অনুরাগ জন্মে। ইতিহাসের ছাত্র হলেও দর্শনকেই তিনি ভালোবেসে ফেলেন। তিনি যে ভবিষ্যতে একজন বিরাট জ্ঞানী মানুষ হতে চলেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই ছোট বেলা থেকেই। শিশুবেলার শিক্ষাটা তিনি পেয়েছেন তিরুত্তানিরই একটি খ্রিস্টান মিশনারী বিদ্যালয়ে। এইখানে পড়ার সময়েই তাঁর চরিত্র গড়ার ভিতটা মজবুত হয়। বাইবেল গ্রন্থের কিছু উপদেশ ও নীতি তাঁর জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মাত্র ২০ বছর বয়সে মাদ্রাজ কলেজে পড়ার সময়ে তিনি লিখে ফেলেন ‘The Ethics of the Vedanta and its metaphysical presupposition’-বেদান্তে নীতিধর্মের স্থান নামে একটি প্রবন্ধ। যা তাঁকে রাতারাতি পরিচিতির আলোয় নিয়ে চলে আসে। স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষাতেই প্রথম হন। তিনিই এমন একজন মানুষ কোনো পরীক্ষাতেই প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। যা বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ১৯০৯ সালে মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক রূপে শিক্ষকতা গ্রহণ করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি চলে তাঁর নিরন্তর গবেষণা ও গ্রন্থ রচনা। একে একে লিখে ফেলেন ‘Indian Phylosophy’ (প্রথম খণ্ড ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘The Hindu View of Life’, ‘Religion in Contemporary Phylosophy’, ‘phylosophy of RabindranathTagore’ ইত্যাদি সব কালজয়ী গ্রন্থ। এ ছাড়াও দেশে-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে, অনুষ্ঠানে প্রচুর বক্তব্য রাখেন সেগুলিও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। 

   অধ্যাপনার সুবাদে তিনি সারা বিশ্বের অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী মানুষ এবং প্রখ্যাত প্রখ্যাত সব দার্শনিকদের সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের লেখনী সম্পর্কে ধ্যান-ধারনা লাভ করেন। তিনি দর্শনকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চেয়েছেন। যেটা চেয়েছিলেন আমাদের যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ। কলেজে পড়ার সময় থেকেই রাধাকৃষ্ণণ স্বামী বিবেকান্দের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। তাই এই দুজন মানুষের মধ্যে অদ্ভুত এক মিল লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও সখ্যতা ও বন্ধুতাও ছিল দেখার মতো। প্রকৃত শিক্ষাদানের ব্যাপারে দুজনের মধ্যেই প্রচুর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। মহাত্মা গান্ধীকে তিনি ত্যাগ, সততা ও ন্যায়ের প্রতিমূর্তি বলে আখ্যা করেছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের মধ্যে তিনি চেয়েছেন একটা মেলবন্ধন ঘটাতে। রাধাকৃষ্ণণের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই। তিনি সগর্বে বলতে পেরেছেন দর্শন কোনো মৃত-জড়বত্‍ জিনিস নয়। পারমাত্মিক জীবনের অনুসন্ধান করে গিয়েছেন তিনি সারাটাজীবন ধরে। সবচেয়ে বড়ো কথা হিন্দু ধর্মকে তিনি ভেঙেচুরে, তন্ন তন্ন করে বিষয়টিকে দেখেছেন অথচ হিন্দু ধর্মের প্রচার কখনো তিনি করেননি। 


   শিক্ষা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে রাধাকৃষ্ণণ বলেছেন শিক্ষা হল চিন্তন ও মননের প্রকৃষ্ট হাতিয়ার। যে শিক্ষা চিন্তার সুসংহত প্রয়াস জাগিয়ে তুলতে পারে না তাকে শিক্ষা বলা চলে না। শিক্ষকদের প্রতি ছিল তাঁর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস। 

শিক্ষকদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন শিক্ষকরা হলেন এক দায়বদ্ধ মানুষ। তিনি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ, মানবতার প্রতি দায়বদ্ধ। শিক্ষকরা হলেন বিশ্ব নাগরিক। তাঁদের হাত দিয়েই তৈরি হবে ভবিষ্যতের সুনাগরিক। আমাদের দেশের শিক্ষার মান কেমন হবে সেটা নির্ভর করছে শিক্ষকদের মানের উপর। এরকমই সুউচ্চ ধারণা পোষণ করতেন তিনি শিক্ষকদের উপর। 

    ভারতত্ত্বের প্রবক্তা, বিশ্বের অন্যতম দার্শনিক, অন্যতম সেরা শিক্ষক, জ্ঞানতাপস, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণন ১৯৭৫ সালের ১৭ই এপ্রিল মহাপ্রয়াত হন। 

   আজ ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। অতলান্ত প্রজ্ঞার অধিকারী এই মনীষীর চরণে জানাই আমাদের বিনম্র প্রণাম। 





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন