বৃহস্পতিবার, ৬ আগস্ট, ২০২০

দীর্ঘ কবিতা।। রাখহরি পাল





মরচে ধরা ডাকবাক্স
রা খ হ রি পা ল

গ্রাম চলে সদলবলে মনের মতো শহর খুঁজে
বললে বলে, সব পাওয়া যায়, --তাইতো যাওয়া।
ঘরবাড়ী সব রইল পড়ে শহর নাকি দিচ্ছে ঢেলে
বিদ‍্যা বুদ্ধি অর্থ-টর্থ বেকার ছেলের চাকরী পাওয়া।
এমনটি আর গ্রামের থেকে হয়না বলে তাইতো যাওয়া।

কেমন করে থাকবে তোমার গরু-বাছুর হাঁস-মুরগী
বাঁশের খুঁটি পুই-এর মাচা গাদায় ভরা খড়ের আঁটি?
রইবে তারা একলাটি?এই কথাটি যখন বলি 
চুপ কথারা পাতার কোণে অশ্রু ফেলে শিশির ফোঁটা।
তবু যাওয়া প্রাণের মায়া এমনি করে বাজী ধরে
স্রোত বয়ে যায় কালের নিয়ম সাগর জলে মিশবে বলে।
চলছে খোকা চলছে খুকি সঙ্গে যে যার বই পত্তর
কাঁধে-কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো। বললে পরে,-- চলছি শহর।


চিত্ত খুড়ো লাঙল কাঁধে, আর কদ্দিন আর কদ্দিন?
ধান ষোল মণ বিঘা-প্রতি বারো আনাই খায় মহাজন।
মাত্র ছেলে ডিগ্রী করে বেকার বনে, না করে চাষ ঘর
  কন্যার খুঁটিনাটি। বললে পরে কঁকিয়ে ওঠে।
এখন আবার বন্ধু ক’জন আড্ডা মারে পাড়ার মোড়ে।
কানাঘুষো, পাড়ার ঠেকে গেলাস ঢালে সুযোগ মতো।
জাহান্নামের আর কি বাকি?গ্রামটা গেল রসাতলে।
--তাইতো ধাওয়া গ্রামকে ফেলে সব পেয়েছির শহর যাওয়া।


দিন-মজুরের সকাল ছ’টা ঘাম ঝরানোর সময় শুরু
সারা দিনটা খাটলে পরে খোরাকি ধান মাসকাবারি।
পেট চলে না অসুখ-বিসুখ তখন ছোটা সুদব্যাপারি
একশ টাকায় দশটাকা সুদ মেটাতে হয়  মাসের শেষে।
এমনি করে দিন কি চলে? সবাই বলে,--- শহর কলে
আটটা-পাঁচটা তিনশ টাকা দিনের দিন নগত মেলে
ঘর-ফেরতা হরেক বাজার চাল ডাল শাকসব্জি
ঘরকন্না টুকিটাকি তবু বাঁচে গাঁটের কড়ি,
তুমিই বলো, থাকবো কেন পেট মাঙনা চাষীর দোরে?
সাহস করে বলল গিয়ে পাড়ার ছেলে নিমু পালই
দাঁড়িয়ে দূরে বিঘা দশেক জমির মালিক খগেন সামুই।
---ঠিক আছে, ঠিক আছে,সুযোগ যেথায় যাবি যা
আমার না হয় চাষ হবে না শহর-বাবু দর দিয়েছে
আধা- মূলে চুকিয়ে দিয়ে চিরতরে গ্রামকে ছাড়ি।


হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে আসেন নবতিপর ঘোষাল বাবু
এক সময়ের মস্ত প্রতাপ আট তহ্সিল জোত জমিদার
চুন সুরকির মস্ত দালান চৌহদ্দি তার প্রাচীর ঘেরা
এখন তবে শ্যাওলা জমে হারিয়ে যাওয়ার প্রহর গোনে।
কোনো ক্রমে একটি দুটি ঘর বাঁচিয়ে জীবন ধারণ।
আত্মীয়রা এখন সবাই কলকাতা বা দূর বিদেশে
মাঝে মধ্যে শুভেচ্ছা ফোন বিজয়া বা নববর্ষে 
কেউ ডাকেনা কে আর চায় বাড়তি কিছু ঝুট ঝামেলা।
বলতে শুনি শ্লেষ্মাজড়া ভরাট গলায় আগের মেজাজ
কে আর মানে? ভোট রাজ্যে তুমি আমি সবাই সমান।


সবার যখন এক বাক‍্যি,প্রদীপ হাতে রায়-ঠাকুমা
একলা হাতে ফুটিয়ে দুটো সকাল সাঁঝে ভাতে-ভাতে
ভিটের পিদিম জ্বালিয়ে রাখে তুলসী মঞ্চ উঠোন দ্বারে।
আর কেন বা ঠাঁই বদলে সুখের খোঁজে শহর ধাওয়া?
এই মাটিতে তেনার পায়ের ছাপ এখনো স্পষ্ট আঁকা
জীবন শিকড় উপড়ে ফেলা মুখের কথা হয় কি সহজ?
অনেক স্মৃতি আঁচল ধরে হাঁটতে থাকে মনের ভিতর।
এসব ছেড়ে আর যাওয়া কি? আর কটা দিন গ্রামেই থাকি।

গ্রাম কি তবে মরচে ধরা ডাক বাক্স অচল পয়সা ?
অতীত দিনের ফ্যারাও মমি? যাদুঘরের নীল নকশা?
ডাক পিওনের হারানো সুর,ফ্রেম বন্দী তৈল চিত্র?
গরুর গাড়ী, চাষের  লাঙল, তুলসী প্রদীপ ঝাড়-গেরস্ত?
রাখাল বালক রাখবে কোথায় রাধা নামের তরল বাঁশি
গরু এখন গোয়াল ছাড়া চাষ আবাদে বিরাগ চাষী
মাঠতো এখন শিল্প তালুক তার নদীটি বর্জ্য ভরা
ঘরের পাশে খাঁ-খাঁ দুপুর হারিয়ে গেল দিগন্তেরা
বাতাস ভারি ওজন ছ্যাঁদা বৃক্ষেরা পড়ছে নুয়ে
আমরা কেবল পথের নুড়ি ছিলাম খানিক চিহ্ন ছুঁয়ে।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন