রবীন্দ্রনাথের ভারতবোধঃ- শ্রদ্ধা ও স্মরণে
— পার্থ সারথি চক্রবর্তী
রবীন্দ্রনাথের প্রধান পরিচয় সৃজনে। তিনিই স্রষ্টা । সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করাই তার ধর্ম । তিনি তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন তার চিন্তন, মনন,ভাবনা সহ সব রকম অনুভূতি । রবীন্দ্রনাথের ভারতবোধের সাথে জড়িয়ে আছে দেশ ও কালের পটভূমি, ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস । পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মীতা ও সহানুভূতির আখ্যান । তিনি রাজা রামমোহন রায়ের উদার ও মৈত্রী বোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন । পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ঔপনিষদীয় চিন্তা ভাবনা অন্য ভাইদের মতো তাঁর মনেও প্রেরণার জন্ম দিয়েছিল । রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছিলেন, ভারত শুধু সকল সংস্কৃতির মিলনের চিন্তাই করেনি, সমগ্র বিশ্বের মানবজাতির ঐক্য ও মৈত্রীর কথাও চিন্তা করে।ভাবের দিক থেকে ভারতের সত্য হচ্ছে বিশ্ব মৈত্রী । সামগ্রিক কল্যাণের আদর্শ হল সবার লক্ষ্য ।দেশের ইতিহাস যে মানুষের জীবনের রোজকার গল্পকথা , যাপনকথা ছাড়া আর কিছুই না, তা রবীন্দ্রনাথ বিলক্ষণ বুঝেছিলেন ।
তিনি বলেছেন " ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি, প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্হাপন করা। নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখীন করিয়ে দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয় রূপে অন্তরতররূপে উপলব্ধি করা ।" তিনি বরাবর এই ঐক্য স্হাপন ও বিস্তারের পক্ষে সওয়াল করেছেন । প্রাক-রবীন্দ্রনাথ সময়ে দু'রকম স্বদেশবোধের উন্মেষ হয়েছিল- বঙ্গবোধ এবং ভারতবোধ। বাঙালির মনে প্রথম থেকেই এই দ্বিবিধ বোধের বিকাশ হয়েছিল । রবীন্দ্রনাথের বিশাল কাব্যসম্ভারের মধ্যে এই বোধের সম্মিলন দেখা যায় " চৈতালী ", " কথা"," কল্পনা " ," নৈবেদ্য " এবং " গীতাঞ্জলি "। রবীন্দ্রকাব্যে ভারতচেতনার আরো একটা দিক আছে ।ভারতের ইতিহাসে মনুষ্যত্বের যে রূপের প্রকাশ সেখানে ঠাকুর দেখতে পেয়েছেন, তা বর্ণনা করেছেন " গান্ধারীর আবেদন " এবং " কর্ণকুন্তিসংবাদ " এ। "নৈবেদ্য " ভারতাত্মার আত্মকথন ।এখানে বহু কবিতায় ফুটে উঠেছে ভারতবোধ।
যেমন-
# এ আমার শরীরের শিরায় শিরায়
# বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়
# চিত্ত যেথা ভয়শূন্য , উচ্চ সেথা শির
শৈশব থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাদের পারিবারিক আবহে এক স্বদেশিকতার গন্ধ পেয়েছেন।
" জীবনস্মৃতি " তে লিখেছেন " আমাদের পরিবারের হৃদয়ের মধ্যে একটা স্বদেশিকতা স্থির দীপ্তিতে জাগিতেছিল " । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারই প্রথম মনে করতেন, দেশপ্রেম দেশের ভাষার প্রতি ভালোবাসা ছাড়া উদ্ভূত হতে পারে না ।
" জীবনস্মৃতি "তে দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত জাতীয় সংগীত " মিলে সবে ভারতসন্তান " এর কথা জানা যায় । রবীন্দ্রনাথ 'হিন্দুমেলা 'র সাথে গভীর সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে ।
রবীন্দ্রনাথের ভারতবোধে সব জাতি ও শ্রেণীর মানুষের এক কদর। ভারতকে কবি বলেছেন ' পুণ্যতীর্থ ' । কারণ ভারতভূমি বহু জাতি ও বহু মানুষের মিলনস্থল। তাঁর চিন্তায় , দেশ বলতে কেবল মাটির দেশ নয় । সে মানবচরিত্রের দেশ। দেশের বাইরের প্রকৃতি আমাদের দেহ, কিন্তু মানবচরিত্রের থেকেই প্রেরণা পেয়ে আমাদের চরিত্র গড়ে ওঠে। কবি ভারতকে দেখেছেন মহাপথ রূপে। যে পথে আদিকাল থেকে মানবধারা চলমান । মানবমিলনের সত্যই মানুষের চরম সত্য ।এটাই সবচেয়ে বড় সত্য ।
রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্ব মৈত্রীর ধারণ ধাক্কা পায় বঙ্গভঙ্গের সময় ।আসমুদ্রহিমাচল তখন ব্রিটিশ বিরোধীতায় উত্তাল । কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ, বিক্ষোভ চলছে । রবীন্দ্রনাথের মনকে চঞ্চল করে তোলে গোটা পরিস্থিতি । অনুধাবন করেন ব্রিটিশ সরকারকে ক্রমশ কোনঠাসা করতে হবে । আর ভারতছাড়া করতে হবে । ১৯০৫ এ দেশব্যাপী ' রাখিবন্ধন' ও 'অরন্ধনব্রতের সূত্রপাত করেন তিনি ।
উচ্চারণ করেন-
" বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পুণ্য হউক পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান । "
তারপর জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বর্বরতার প্রতিবাদে 'নাইট ' উপাধি ত্যাগ করেন ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনার মাধ্যমে ভারতের এক অখণ্ড, অদ্বিতীয় ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন । যেখানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে এক ভারতভূমির স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছেন । ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের উপর ভর করে এক সুন্দর ও সবল ভারতবর্ষের কল্পনা করতেন ও স্বপ্ন দেখতেন ।
তাঁর কল্পনার তথা ভালোবাসার ভারতবর্ষ ছিল সর্বধর্ম সমন্বয়ের ও সবার প্রতি অসীম সহিষ্ণুতার এক সুন্দর ও জগৎশ্রেষ্ঠ অখণ্ড দেশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন