বাঁধাপথ ছেড়ে মাঠভাঙা আলপথে
কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত
— অশোককুমার লাটুয়া
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন বলেই তাঁর কবিস্বভাব কিছুটা আলাদা। ইটকাঠ পাথর, লোহা, সিমেন্ট নিয়ে তাঁর কারবার। বস্তুজগতের সাথে এই চাক্ষুষ পরিচয় তাঁকে দিয়েছিল নির্মোহ নিজস্বতা। তিনি দেখেছেন দুঃখ দুর্দশা মৃত্যু মানুষের ভাগ্যের সারথি। ফলে তাঁর কবিতার ভাষা হয়ে উঠলো ধারালো। তাঁর জগৎ ও জীবন নীরস। তাঁর কবিতায় প্রকৃতির সরসতার বদলে আছে ঊষর মরুভূমির উষ্ণতা আর রুক্ষতা। প্রেমে আছে ক্ষণিকতা, রূপে নেই সৌন্দর্যের ছোঁয়া ও ছায়া। তাই তাঁর কাব্যনামেও আছে সেই অনুভবের স্পর্শ।
' মরীচিকা ', ' মরুশিখা ', ' মরুমায়া ', ' সায়ম ', ' ত্রিযামা ', ' নিশান্তিকা ' কাব্যগ্রন্থগুলি রবীন্দ্রযুগে এক বিরল স্বাতন্ত্র্যের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে। আর তখন থেকেই বাংলা কাব্যমহলে চালু হয়ে গেল ' দুঃখবাদী ' কথাটি। তবে কথাটি আপাত সত্য হলেও তা ছিল বাইরের খোলসমাত্র।
' কল্লোল ' যুগের আগেই রবীন্দ্রধারা থেকে সরে এসে অন্য পথ খোঁজা শুরু হয়ে গিয়েছিল যে ' রবীন্দ্রেতর ' কবিদের হাত ধ'রে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ( ১৮৮৭ — ১৯৫৪ )।
বাংলাসহিত্যে রোমান্টিকতা বিরোধী কবি হিসাবে তাঁর কাব্যবীণায় বেজে উঠেছে রূঢ়, কর্কশ, বিবর্ণ, বিচিত্র সুর। সমালোচকের কথায় —
" প্রথম জীবনে মানুষ ছোটে মরীচিকার পেছনে, পুড়ে মরুশিখার দহনে, তাহাকে জড়ায় মরুর মায়ায়। তাহার পর জীবনসন্ধ্যার অন্ধকার ঘনায়। "
" বঙ্গবাণীর সাথ
যেদিন অকস্মাৎ
কমল দ্বীপান্তরে হয়ে গেল সাক্ষাৎ
যেমনি ছুঁয়েছি পা,
চমকি উঠিল মা ; "
— ঠিক এভাবেই তিনি চমকে দিয়েছেন বাংলা কবিতাকে। এই কবির জগতে বেদনার চিতার জ্বলন্ত আগুন। বাঁধাপথ ছেড়ে তিনি হেঁটে বেড়ালেন মাঠভাঙা আলপথে। আর এই বিদ্রোহের মধ্যেই আমরা খুঁজে পেলাম নতুন কবির জন্মতিথি। কল্পনাবিলাসীদের তিনি জানিয়ে দিলেন কল্পনারও বিশ্রামের প্রয়োজন আছে।
" কল্পনা, তুমি শ্রান্ত হয়েছ, ঘন বহে দেখি শ্বাস
বারোমাস খেটে লক্ষ কবির একঘেয়ে ফরমাস। "
কবি বুঝেছেন পূর্ণতার মাঝখানে অপূর্ণতা ছাড়া আর কিছু নেই। জোনাকি যেমন দেখায় বনের অন্ধকার মুখ, পৃথিবীতে সুখও তেমন দুঃখের অন্ধকারকেই তুলে ধরে। আর এই সুখ মৃগতৃষ্ণিকা এবং আলেয়ার মতো মানুষকে দিকভ্রান্ত করে।
কবি যতীন্দ্রনাথ ছিলেন জড়বাদী ভাবনায় ভাবিত। তাঁর মতে আসল কথাকে ঢেকে রাখার জন্যই কবিরা কল্পনার জাল বোনেন। শুধু তাই নয়, তাঁর মনে হয়েছে এ জগৎ রহস্যে ভরা।
" জগৎ একটা হেঁয়ালি
যতবা নিয়ম তত অনিয়ম, গোঁজামিল খামখেয়ালী। "
কবি মনে করেন " প্রেম বলে কিছু নাই। " তাঁর মতে প্রেম আসলে সম্ভোগ — শারীরিক অবসাদ প্রেমকে ডুবিয়ে দেয় তাই সহজেই। কবির উচ্চারণ —
" প্রেম ও ধর্ম জাগিতে পারেনা
বারোটার বেশি রাতি। "
আবার এও বলেন —
" অভাবের লাখো ফুটো বাক্যের ফাঁসে বুনে
মামুলি প্রেমের নেট মশারিটা টাঙিয়ে নে। "
ঈশ্বরের কাজের সমালোচনা করেছেন তিনি, তাঁর ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন করেছেন —
" তুমি শালগ্রাম শিলা
শোয়া - বসা যার সকলি সমান তারে নিয়ে রাসলীলা। "
ঈশ্বর পক্ষপাতদুষ্ট — তাই এক জায়গা তিনি জলে ভাসিয়েছেন, অন্য জায়গায় মরুভূমি সৃষ্টি করেছেন। জীবনের সামঞ্জস্যহীনতাকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন —
" চেরাপুঞ্জির থেকে
একখানি মেঘ ধার দিতে পারো গোবি - সাহারার বুকে? "
যতীন্দ্রনাথ তাঁর দেবতাকে ব্যঙ্গের শায়কেই পূজারতি করেছেন। দুঃখের মামলায় তাঁর প্রধান আসামী ঈশ্বর আর ফরিয়াদি — কবি নিজে।
যে ঈশ্বর আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, তিনিই আবার ন্যায়াধীশ সেজে ন্যায়দন্ড ধরেছেন — এমন ' স্বর্গীয় প্রহসন ' কে ব্যঙ্গবিদ্ধ করেছেন। শুধু তাই নয়, ঈশ্বরকে তিনি স্রষ্টার মর্যাদা না দিয়ে দ্রষ্টার ভূমিকায় নিজের পাশে বসিয়ে জাগতিক ও সামাজিক জীবনের বৈষম্য ও বৈপরীত্য নিয়ে দায়ী করেছেন।
ঘৃণা অথবা করুণা নয়, মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাই কবির কাছে শ্রেষ্ঠ মানবতা। তা নাহলে অবিচার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ একদিন প্রলয় ডেকে আনবে। আর সেই বিদ্রোহে তন্দ্রা তবেই ভাঙবে।
" কাঁদিসনে খোকাধন, ভাবিসনে বৌ গো!
আজ তো কেটেছি মাটি পুরো এক চৌকো।
বুকে পিঠে মাটি চাপে! এ মাটি কে মাপেরে?
হক্ মাটি মাপ দিতে প্রাণ কেন কাঁপেরে। "
— মানুষের বুকে পিঠে যারা মাটি চাপিয়ে অত্যাচার করে তাদের মেপে নেবার দিন একদিন আসবে। সেদিন হক্ মাটি মেপে দিতে প্রাণ কাঁপলে চলবেনা।
কবি জীবন থেকে পালিয়ে যাননি। মানবিকতা বিনষ্টির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ ঝরে পড়েছে। স্বেচ্ছাচারী মানুষ নিজের স্বার্থে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে অহংকারী ও অত্যাচারী হয়ে উঠেছে। সেখানেও কবির বিদ্রোহ —
" ছলে বলে কলে দুর্বলে হেথা প্রবল অত্যাচার ;
এ যদি বন্ধু হয় তব ছায়া, কায়া তো চমৎকার। "
তবে রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়ে তিনি নতুন ধরণের রোমান্টিক হয়ে উঠেছেন। তাঁর কবিতা বিশ্লেষণে এমন উদাহরণ অনেক আছে। শ্রাবণের মেঘের গর্জনকে শাবকহারা বাঘিনীর গর্জন করে তুলেছেন । বিদ্যুতের ঝলককে তাঁর মনে হয় ' লয়া লয়া সাপের খেলা। '
বনবাংলার রাত্রির রূপকে তিনি বলেন ' বনবিভাগের বিপণি পণ্য। ' তাছাড়া দূর সুন্দর মরীচিকার প্রেম তাঁর রোমান্টিকতার এক তির্যক প্রকাশ। কেননা দূরত্বের সৌন্দর্য আর সৌন্দর্যের দূরত্বকে অনুভব করার নামই তো রোমান্টিকতা।
নিরাবরণ ও নির্ভেজাল সত্যের দুঃখবাদী নৌকোয় চড়ে বিদ্রোহের ঢেউয়ে কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত শেষ পর্যন্ত একজন সম্পূর্ণ জীবনবাদী রোমান্টিক মানুষ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন